‘পুলিশ আইন সংস্কার না হলে পরিস্থিতি পাল্টাবে না’-বেপরোয়া পুলিশ, প্রশ্ন জবাবদিহি নিয়ে by কামরুল হাসান
‘১৫-১৬ ঘণ্টা কাজ করে ব্যারাকে ফিরে দেখি, আমার জায়গায় আরেকজন ঘুমিয়ে আছে। তাকে কোনোভাবে ঠেলেঠুলে একটু জায়গা করে ঘুমাতে যেতে না-যেতেই বিদ্যুৎ চলে গেল। তারপর আবার ভোরে ডিউটি করতে নেমে এলাম রাস্তায়। এবার বলুন, কী করে ভালো ব্যবহার করব?’
কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনের সময় ভালো ব্যবহার করা নিয়ে প্রশ্ন করতেই এমন মন্তব্য ছুড়ে দিলেন মতিঝিলে দায়িত্বরত এক পুলিশ কনস্টেবল।
তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন উপপরিদর্শক (এসআই)। পরিচয় শুনে বললেন, ‘এসআইদের দ্বিতীয় শ্রেণী করার মুলা ঝুলছে তিন বছর ধরে। দুবার প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, কার্যকর হলো না। এটা কোনো দেশ হলো! আবার বলেন ভালো ব্যবহার করতে হবে।’ কণ্ঠে ঝরে পড়ল তীব্র ক্ষোভ।
মাঠপর্যায়ের এই পুলিশ সদস্যদের হাতে সাধারণ মানুষের নিগৃহীত হওয়ার ঘটনা সম্প্রতি উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গেছে। হঠাৎ করেই পুলিশের এমন আচরণ বেড়ে গেল কেন, সে ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেছে এমন ক্ষোভের কথা।
এর পাশাপাশি আরও কয়েকজন পুলিশ সদস্য অভিযোগ করলেন, পুলিশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ এখন একটি বিশেষ রাজনৈতিক সমর্থক গোষ্ঠীর হাতে। বদলি, পদোন্নতি, মিশনে যাওয়া (বিদেশে শান্তিরক্ষী বাহিনীর কাজে) থেকে শুরু করে সবকিছুই তারা নিয়ন্ত্রণ করছে। এ নিয়ে পুলিশের মাঠপর্যায়ে কর্মরত অনেক কর্মকর্তা ক্ষুব্ধ। আর এসবের একটা প্রভাব তাঁদের কর্মক্ষেত্রে পড়ছে বলে কেউ কেউ মনে করছেন। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক উত্তাপ বেড়ে যাওয়ায় পুলিশ সদস্যদের অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হয়। এ কারণে তাঁদের ছুটি ও বিশ্রামের সময় কমে গেছে।
সর্বোপরি খুব বড় ধরনের অন্যায় না করলে পুলিশ বাহিনীতে শাস্তির তেমন কোনো নজির নেই। কোনো ঘটনা আলোচনায় এলেই সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। প্রত্যাহার অবশ্য কোনো শাস্তি নয়। আর কোনো ঘটনা খুব বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করলে শাস্তি হয় বড়জোর সাময়িক বরখাস্ত, যা কিছুদিন পরে আবার তুলে নেওয়া হয়। ফলে পুলিশের জবাবদিহির জায়গাটি প্রশ্নবিদ্ধ থেকে গেছে। এ রকম পরিস্থিতি পুলিশ সদস্যদের বেপরোয়া হয়ে উঠতে ভূমিকা রাখছে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এএসএম শাহজাহান এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, প্রচলিত আইনে পুলিশের জবাবদিহির সুযোগ কম। তা ছাড়া রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও আছে। এটা দিনে দিনে বাড়ছে। এখন যেসব ঘটনা ঘটছে, এটা তারই ফল। কিন্তু পুলিশ সংস্কারের জন্য যে আইনের প্রস্তাব করা হয়েছিল, তাতে পুলিশের জবাবদিহি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা ছিল। পুলিশ আইন সংস্কার না হলে এ পরিস্থিতি কোনো দিনই পাল্টাবে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পুলিশ প্রশাসনকে যুগোপযোগী করতে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও ব্রিটিশ সাহায্য সংস্থার (ডিএফআইডি) অর্থায়নে ২০০৫ সাল থেকে পুলিশ সংস্কার প্রকল্প নামে একটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রথম তিন বছরে ব্যয় হয় ১১৫ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের একটি অংশ ‘বাংলাদেশ পুলিশ অধ্যাদেশ-২০০৭’ তৈরি করে। দফায় দফায় পরিবর্তনের পর খসড়াটি এখন পর্যন্ত মন্ত্রণালয়েই পড়ে আছে। সরকারের ভেতরের অংশই চায় না, আইনটি আলোর মুখ দেখুক। ইতিমধ্যে প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের মেয়াদ শুরু হয়েছে। অথচ এ আইনে পুলিশের জবাবদিহি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা ছিল। রাজনৈতিক খবরদারির তেমন সুযোগ ছিল না।
‘পুলিশ আগের চেয়ে ভালো হয়েছে’—সাম্প্রতিক সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের এ মন্তব্য যেমন মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের খুশি করতে পারেনি, তেমনি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর ‘পুলিশ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থেকে সংবাদ সংগ্রহ করুন’ বক্তব্য পুলিশকে করেছে ক্ষুব্ধ। ফলে নানাভাবে ক্ষোভ জমা হচ্ছে পুলিশের বিভিন্ন স্তরের সদস্যদের মধ্যে।
পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তারা ক্ষোভের কথা প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে গত বৃহস্পতিবার রাতে বৈঠক হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরে। এর আগে একই ধরনের বৈঠক করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ ও চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কর্মকর্তারা। চট্টগ্রামে পুলিশ সদস্যদের জন্য পরামর্শ সভার কাজও শুরু হয়েছে।
ঢাকায় বৈঠকের পর মহানগর পুলিশের কমিশনার বেনজীর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। কেন এসব ঘটনা ঘটছে, কী কারণ এবং কোন পরিস্থিতিতে এসব ঘটেছে, তা জানতে এ বৈঠক ডাকা হয়। তিনি বলেন, সবাইকে বলা হয়েছে এমন কাজ করতে হবে, যাতে সংবাদপত্রে পুলিশের কোনো নেতিবাচক ছবি না ছাপা হয়।
গত ২৯ মে ঢাকার মুখ্য মহানগর আদালতের চত্বরে এক নারীর শ্লীলতাহানি এবং কয়েকজন সাংবাদিক ও আইনজীবীকে মারধর করে পুলিশ। এ ঘটনায় হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত রুল জারি করে আট পুলিশ কর্মকর্তাকে আদালতে হাজির হতে বলেছেন। এর আগে ২৬ মে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে প্রথম আলোর তিন আলোকচিত্র সাংবাদিককে মারধর করে পুলিশ। এ ঘটনায়ও পুলিশের তিন কর্মকর্তাকে তলব করেছেন হাইকোর্ট। তাই এসব বিষয় নিয়ে পুলিশ বিভাগ বিব্রত, চিন্তিত পুলিশ কর্মকর্তারা।
এর আগে গত ২২ এপ্রিল খুলনা সদর থানায় ছাত্রদলের এক কর্মীকে ঝুলিয়ে ও আরেকজনকে চোখ বেঁধে নির্যাতন করা হয়। এ ঘটনায় ওসিসহ চার পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়। ৩ মে ফেনী সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) নজরুল ইসলামকে লাঞ্ছিত করেন সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজিম উদ্দিন। এ নিয়ে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিবকে চিঠি দিয়ে অভিযুক্ত ওসিসহ জড়িত অন্য পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। এরপর পুলিশ সদর দপ্তর ওসিকে সাময়িক বরখাস্ত করে। কিন্তু পরদিন উচ্চ আদালত সাময়িক বরখাস্তের আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ দেন।
পুলিশের মহাপরিদর্শকের দায়িত্বে থাকা পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, কী করে এসব অবস্থা থেকে উত্তরণ পাওয়া যায়, সে ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সব ইউনিটকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সাম্প্রতিক এসব ঘটনা নিয়ে কথা হয় পুলিশ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তার সঙ্গে। এসব ঘটনায় শুধু সাধারণ মানুষ নয়, পদস্থ কর্মকর্তারাও ক্ষুব্ধ। তাঁরা মনে করেন, অতীতে দায়ী পুলিশের বিরুদ্ধে যথাযথ ও কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণেই বারবার এসব ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া অনেকেই মনে করছেন, পুলিশ বাহিনীর শৃঙ্খলা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। কর্মকর্তারা এমন কথাও বলেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী কিংবা পুলিশের মহাপরিদর্শকের কথাও অনেক সময় শুনছেন না থানার ওসি কিংবা কর্মকর্তারা। তাঁরা যোগাযোগ রাখছেন সরকারদলীয় বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক নেতা ও সাংসদদের সঙ্গে। ফলে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে এখন বিশেষ অঞ্চলের লোকেরাই প্রাধান্য পাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
তবে এ ব্যাপারে পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোখলেসুর রহমান ভিন্ন কথা বলেছেন। তাঁর অভিমত, কয়েকটি ঘটনা পরপর ঘটছে বলেই এ রকম মনে হচ্ছে। এসব ঘটনা কাকতালীয় হতে পারে। এসব ঘটনার মধ্যে সময়ের ব্যবধান থাকলে এ রকম মনে হতো না।
সভাপতির এই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, পরিদর্শকদের দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে প্রথম শ্রেণী আর উপপরিদর্শকদের তৃতীয় শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত করা হবে। তিন বছর ধরে এ প্রতিশ্রুতি ঝুলে আছে। এটা একটা বড় সমস্যা। তাঁদের কেউ কেউ বলছেন, সরকার নতুন করে ২০ হাজার পুলিশ নিয়োগ করেছে। কিন্তু তাঁদের থাকার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই।
কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার অভিযোগ, পুলিশের বদলি ও পদোন্নতিতে এখন পুলিশ প্রশাসনের কোনো হাতে নেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের নেতারা চাপ দিয়ে বদলি করতে বাধ্য করছেন। যে কারণে রাজনৈতিক তদবিরে বদলি হওয়া পুলিশ কর্মকর্তারা ঊর্ধ্বতনদের মানতে চান না। তাঁরা নিজেদের সবকিছুর ঊর্ধ্বে মনে করছেন। পেশাগত পরিচয়ের বদলে দলীয় পরিচয়ই এখন তাঁদের কাছে মুখ্য হয়ে উঠেছে। দলীয় পরিচয় দিতে তাঁরা গর্ববোধও করেন। একইভাবে মধ্যম শ্রেণীর কর্মকর্তারা নানা ধরনের সংকট তৈরি করছেন। পদোন্নতির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ৪৩ জনকে ডিঙিয়ে ৩৬ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে দলীয় বিবেচনাই প্রাধান্য পায় বলে অভিযোগ আছে। এসব কর্মকর্তার মধ্যে একজন হারুন অর রশীদ। ৪২ জনকে ডিঙিয়ে তাঁকে মানিকগঞ্জের এসপি করা হয়েছিল। এর এক সপ্তাহের মাথায় তাঁকে ঢাকার লালবাগে উপকমিশনার করা হয়েছে। গত বছরের ৬ জুলাই সংসদ ভবনের সামনে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে মারধর করে তিনি সমালোচিত হন।
তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন উপপরিদর্শক (এসআই)। পরিচয় শুনে বললেন, ‘এসআইদের দ্বিতীয় শ্রেণী করার মুলা ঝুলছে তিন বছর ধরে। দুবার প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, কার্যকর হলো না। এটা কোনো দেশ হলো! আবার বলেন ভালো ব্যবহার করতে হবে।’ কণ্ঠে ঝরে পড়ল তীব্র ক্ষোভ।
মাঠপর্যায়ের এই পুলিশ সদস্যদের হাতে সাধারণ মানুষের নিগৃহীত হওয়ার ঘটনা সম্প্রতি উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গেছে। হঠাৎ করেই পুলিশের এমন আচরণ বেড়ে গেল কেন, সে ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেছে এমন ক্ষোভের কথা।
এর পাশাপাশি আরও কয়েকজন পুলিশ সদস্য অভিযোগ করলেন, পুলিশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ এখন একটি বিশেষ রাজনৈতিক সমর্থক গোষ্ঠীর হাতে। বদলি, পদোন্নতি, মিশনে যাওয়া (বিদেশে শান্তিরক্ষী বাহিনীর কাজে) থেকে শুরু করে সবকিছুই তারা নিয়ন্ত্রণ করছে। এ নিয়ে পুলিশের মাঠপর্যায়ে কর্মরত অনেক কর্মকর্তা ক্ষুব্ধ। আর এসবের একটা প্রভাব তাঁদের কর্মক্ষেত্রে পড়ছে বলে কেউ কেউ মনে করছেন। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক উত্তাপ বেড়ে যাওয়ায় পুলিশ সদস্যদের অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হয়। এ কারণে তাঁদের ছুটি ও বিশ্রামের সময় কমে গেছে।
সর্বোপরি খুব বড় ধরনের অন্যায় না করলে পুলিশ বাহিনীতে শাস্তির তেমন কোনো নজির নেই। কোনো ঘটনা আলোচনায় এলেই সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। প্রত্যাহার অবশ্য কোনো শাস্তি নয়। আর কোনো ঘটনা খুব বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করলে শাস্তি হয় বড়জোর সাময়িক বরখাস্ত, যা কিছুদিন পরে আবার তুলে নেওয়া হয়। ফলে পুলিশের জবাবদিহির জায়গাটি প্রশ্নবিদ্ধ থেকে গেছে। এ রকম পরিস্থিতি পুলিশ সদস্যদের বেপরোয়া হয়ে উঠতে ভূমিকা রাখছে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এএসএম শাহজাহান এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, প্রচলিত আইনে পুলিশের জবাবদিহির সুযোগ কম। তা ছাড়া রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও আছে। এটা দিনে দিনে বাড়ছে। এখন যেসব ঘটনা ঘটছে, এটা তারই ফল। কিন্তু পুলিশ সংস্কারের জন্য যে আইনের প্রস্তাব করা হয়েছিল, তাতে পুলিশের জবাবদিহি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা ছিল। পুলিশ আইন সংস্কার না হলে এ পরিস্থিতি কোনো দিনই পাল্টাবে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পুলিশ প্রশাসনকে যুগোপযোগী করতে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও ব্রিটিশ সাহায্য সংস্থার (ডিএফআইডি) অর্থায়নে ২০০৫ সাল থেকে পুলিশ সংস্কার প্রকল্প নামে একটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রথম তিন বছরে ব্যয় হয় ১১৫ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের একটি অংশ ‘বাংলাদেশ পুলিশ অধ্যাদেশ-২০০৭’ তৈরি করে। দফায় দফায় পরিবর্তনের পর খসড়াটি এখন পর্যন্ত মন্ত্রণালয়েই পড়ে আছে। সরকারের ভেতরের অংশই চায় না, আইনটি আলোর মুখ দেখুক। ইতিমধ্যে প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের মেয়াদ শুরু হয়েছে। অথচ এ আইনে পুলিশের জবাবদিহি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা ছিল। রাজনৈতিক খবরদারির তেমন সুযোগ ছিল না।
‘পুলিশ আগের চেয়ে ভালো হয়েছে’—সাম্প্রতিক সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের এ মন্তব্য যেমন মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের খুশি করতে পারেনি, তেমনি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর ‘পুলিশ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থেকে সংবাদ সংগ্রহ করুন’ বক্তব্য পুলিশকে করেছে ক্ষুব্ধ। ফলে নানাভাবে ক্ষোভ জমা হচ্ছে পুলিশের বিভিন্ন স্তরের সদস্যদের মধ্যে।
পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তারা ক্ষোভের কথা প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে গত বৃহস্পতিবার রাতে বৈঠক হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরে। এর আগে একই ধরনের বৈঠক করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ ও চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কর্মকর্তারা। চট্টগ্রামে পুলিশ সদস্যদের জন্য পরামর্শ সভার কাজও শুরু হয়েছে।
ঢাকায় বৈঠকের পর মহানগর পুলিশের কমিশনার বেনজীর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। কেন এসব ঘটনা ঘটছে, কী কারণ এবং কোন পরিস্থিতিতে এসব ঘটেছে, তা জানতে এ বৈঠক ডাকা হয়। তিনি বলেন, সবাইকে বলা হয়েছে এমন কাজ করতে হবে, যাতে সংবাদপত্রে পুলিশের কোনো নেতিবাচক ছবি না ছাপা হয়।
গত ২৯ মে ঢাকার মুখ্য মহানগর আদালতের চত্বরে এক নারীর শ্লীলতাহানি এবং কয়েকজন সাংবাদিক ও আইনজীবীকে মারধর করে পুলিশ। এ ঘটনায় হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত রুল জারি করে আট পুলিশ কর্মকর্তাকে আদালতে হাজির হতে বলেছেন। এর আগে ২৬ মে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে প্রথম আলোর তিন আলোকচিত্র সাংবাদিককে মারধর করে পুলিশ। এ ঘটনায়ও পুলিশের তিন কর্মকর্তাকে তলব করেছেন হাইকোর্ট। তাই এসব বিষয় নিয়ে পুলিশ বিভাগ বিব্রত, চিন্তিত পুলিশ কর্মকর্তারা।
এর আগে গত ২২ এপ্রিল খুলনা সদর থানায় ছাত্রদলের এক কর্মীকে ঝুলিয়ে ও আরেকজনকে চোখ বেঁধে নির্যাতন করা হয়। এ ঘটনায় ওসিসহ চার পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়। ৩ মে ফেনী সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) নজরুল ইসলামকে লাঞ্ছিত করেন সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজিম উদ্দিন। এ নিয়ে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিবকে চিঠি দিয়ে অভিযুক্ত ওসিসহ জড়িত অন্য পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। এরপর পুলিশ সদর দপ্তর ওসিকে সাময়িক বরখাস্ত করে। কিন্তু পরদিন উচ্চ আদালত সাময়িক বরখাস্তের আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ দেন।
পুলিশের মহাপরিদর্শকের দায়িত্বে থাকা পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, কী করে এসব অবস্থা থেকে উত্তরণ পাওয়া যায়, সে ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সব ইউনিটকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সাম্প্রতিক এসব ঘটনা নিয়ে কথা হয় পুলিশ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তার সঙ্গে। এসব ঘটনায় শুধু সাধারণ মানুষ নয়, পদস্থ কর্মকর্তারাও ক্ষুব্ধ। তাঁরা মনে করেন, অতীতে দায়ী পুলিশের বিরুদ্ধে যথাযথ ও কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণেই বারবার এসব ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া অনেকেই মনে করছেন, পুলিশ বাহিনীর শৃঙ্খলা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। কর্মকর্তারা এমন কথাও বলেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী কিংবা পুলিশের মহাপরিদর্শকের কথাও অনেক সময় শুনছেন না থানার ওসি কিংবা কর্মকর্তারা। তাঁরা যোগাযোগ রাখছেন সরকারদলীয় বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক নেতা ও সাংসদদের সঙ্গে। ফলে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে এখন বিশেষ অঞ্চলের লোকেরাই প্রাধান্য পাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
তবে এ ব্যাপারে পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোখলেসুর রহমান ভিন্ন কথা বলেছেন। তাঁর অভিমত, কয়েকটি ঘটনা পরপর ঘটছে বলেই এ রকম মনে হচ্ছে। এসব ঘটনা কাকতালীয় হতে পারে। এসব ঘটনার মধ্যে সময়ের ব্যবধান থাকলে এ রকম মনে হতো না।
সভাপতির এই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, পরিদর্শকদের দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে প্রথম শ্রেণী আর উপপরিদর্শকদের তৃতীয় শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত করা হবে। তিন বছর ধরে এ প্রতিশ্রুতি ঝুলে আছে। এটা একটা বড় সমস্যা। তাঁদের কেউ কেউ বলছেন, সরকার নতুন করে ২০ হাজার পুলিশ নিয়োগ করেছে। কিন্তু তাঁদের থাকার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই।
কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার অভিযোগ, পুলিশের বদলি ও পদোন্নতিতে এখন পুলিশ প্রশাসনের কোনো হাতে নেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের নেতারা চাপ দিয়ে বদলি করতে বাধ্য করছেন। যে কারণে রাজনৈতিক তদবিরে বদলি হওয়া পুলিশ কর্মকর্তারা ঊর্ধ্বতনদের মানতে চান না। তাঁরা নিজেদের সবকিছুর ঊর্ধ্বে মনে করছেন। পেশাগত পরিচয়ের বদলে দলীয় পরিচয়ই এখন তাঁদের কাছে মুখ্য হয়ে উঠেছে। দলীয় পরিচয় দিতে তাঁরা গর্ববোধও করেন। একইভাবে মধ্যম শ্রেণীর কর্মকর্তারা নানা ধরনের সংকট তৈরি করছেন। পদোন্নতির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ৪৩ জনকে ডিঙিয়ে ৩৬ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে দলীয় বিবেচনাই প্রাধান্য পায় বলে অভিযোগ আছে। এসব কর্মকর্তার মধ্যে একজন হারুন অর রশীদ। ৪২ জনকে ডিঙিয়ে তাঁকে মানিকগঞ্জের এসপি করা হয়েছিল। এর এক সপ্তাহের মাথায় তাঁকে ঢাকার লালবাগে উপকমিশনার করা হয়েছে। গত বছরের ৬ জুলাই সংসদ ভবনের সামনে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে মারধর করে তিনি সমালোচিত হন।
No comments