শিক্ষিকাকে উত্ত্যক্ত-বিদ্যালয় চার দিন বন্ধ! by শিপন খান

এক যুবকের উত্ত্যক্ত ও হুমকির কারণে বিদ্যালয়ে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন সিলেটের বালাগঞ্জের আদমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষিকা। এতে সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চার দিন ধরে বিদ্যালয়টির পাঠদান বন্ধ রয়েছে।


উত্ত্যক্ত করায় একজন শিক্ষিকা এ ব্যাপারে থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, বখাটের হুমকির মুখে তিনি চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
এদিকে অভিযুক্ত ব্যক্তি তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি উল্টো শিক্ষিকাদের বিরুদ্ধে ইউএনওর কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন।
বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির উপজেলা শাখার নেতারা বৃহস্পতিবার বিকেলে এক সভা ডেকে শুক্রবারের (গতকাল) মধ্যে সমাধান না করলে শনিবার (আজ) ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে মানববন্ধন করার হুমকি দেন।
শিক্ষিকার লিখিত অভিযোগ ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উপজেলার পশ্চিম পৈলনপুর ইউনিয়নে বিদ্যালয়টি অবস্থিত। ২২২ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে এখানে তিনজন শিক্ষিকা রয়েছেন। এর মধ্যে দুজন স্থায়ী ও একজন স্বেচ্ছাসেবী। স্থায়ী শিক্ষক ইসরাত জাহান ২০০৭ সালে এখানে যোগ দেন। এর পর থেকে বিদ্যালয়ের পাশের চানপুর গ্রামের আনোয়ার হোসেন (৩০) তাঁকে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করে আসছেন।
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছয়ফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক দিন ধরে নানাভাবে শিক্ষিকাকে হয়রানি করছে আনোয়ার। মীমাংসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। এর আগেও একজন শিক্ষিকা তার কারণে বিদ্যালয় ছেড়ে গেছেন।’
এদিকে অশ্লীল আচরণ, হুমকি প্রদান ও জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে গত বুধবার ওসমানীনগর থানায় লিখিত অভিযোগ দেন শিক্ষিকা ইসরাত। এতে তিনি আনোয়ার, তাঁর সহযোগী একই গ্রামের আবু জায়েদ ও বকশিপুর গ্রামের সেলিম মিয়ার নাম উল্লেখ করেন।
শিক্ষিকা ইসরাত জাহান বলেন, ‘বিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার পর থেকে আনোয়ার আমাকে বিভিন্নভাবে উত্ত্যক্ত করে আসছে। বিদ্যালয়ে আসার পথে প্রায়ই মোটরসাইকেল নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাকে কটূক্তিপূর্ণ মন্তব্য করে। সে আমাকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় ঝুঁকি নিয়ে কী করে বিদ্যালয়ে যাই!’
গত বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে সরেজমিনে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষগুলোতে তালা ঝুলছে। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে প্রধান শিক্ষক নূরজাহান বেগম তাঁর কক্ষে আসেন। তিনি বলেন, ‘ইসরাতকে উত্ত্যক্ত করার বিষয়টি আনোয়ারের বাবাকে একাধিকবার জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। এমনকি তিনি ছেলের পক্ষ নিয়ে আমাদের হুমকি দিচ্ছেন। তাঁদের ভয়ে আমরা বিদ্যালয়ে আসছি না। নিরাপত্তা না থাকায় বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছি।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ভোটার তালিকার কাজের জন্য বিদ্যালয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি। ইসরাতের মানসিক অবস্থা খারাপ থাকায় তাকে তিন দিনের ছুটি দেওয়া হয়েছে।’
স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষিকা সায়রা বেগম বলেন, নিরাপত্তা না থাকায় দুই শিক্ষিকা বিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না। এ কারণে তিনিও যাওয়া বন্ধ করেছেন।
জানা যায়, গত ১৫ এপ্রিল প্রধান শিক্ষিকার অনুপস্থিতিতে আনোয়ার বিদ্যালয়ে যান। কাজ না থাকলে আনোয়ারকে চলে যেতে বলেন শিক্ষিকা ইসরাত। একপর্যায়ে শিক্ষিকার সঙ্গে তাঁর বাগিবতণ্ডা হয়। তিনি শিক্ষিকাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। এ নিয়ে গত ২৬ এপ্রিল বিদ্যালয়ের এক সভায় আলোচনা হয়। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির পক্ষ থেকে বিষয়টি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে জানানো হয়।
গত ২৭ মে আশপাশের তিন গ্রামের শতাধিক মানুষ নিয়ে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি বৈঠকে বসে। এতে আনোয়ারের বাবা এখলাছুর রহমানকে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হয়। তিনি রাগ করে সভাস্থল ত্যাগ করেন। পরে এলাকাবাসী নিরাপত্তার স্বার্থে শিক্ষিকাদের বিদ্যালয়ে না যাওয়ার পরামর্শ দেন।
এখলাছুর রহমান ওই বিদ্যালয়েরই পরিচালনা কমিটির সদস্য। তিনি পশ্চিম পৈলনপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে শান্তশিষ্ট। সে বিদ্যালয়ের অনিয়মের কথা তুলে ধরায় আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে।’
অভিযুক্ত আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এক দিন শুধু ওই শিক্ষিকার (ইসরাত) সঙ্গে আমার কথা-কাটাকাটি হয়েছে। আমাকে হয়রানি করার জন্য শিক্ষিকাদের ব্যবহার করছে একটি মহল।’ তিনি বলেন, ‘শিক্ষিকারা নিয়মিত স্কুলে আসেন না।’ এ ব্যাপারে গত ২৪ মে তিনি ইউএনওকে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এতে এলাকার কয়েকজনের স্বাক্ষর রয়েছে।
অভিযোগে যাঁদের স্বাক্ষর রয়েছে তাঁদের অনেকেই বিষয়টি জানেন না। অভিভাবক গীতা রানী বিশ্বাস বলেন, ‘স্কুলের একটি তালিকা তৈরির কথা বলে আনোয়ার কাগজ নিয়ে আমার কাছে আসে। পরে আমার মেয়ে আমার নাম লিখে দেয়। স্কুলের এই বিষয়টি জানলে আমি বাধা দিতাম। শিক্ষিকাদের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই।’
ওসমানীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আল আমিন বলেন, ‘অভিযোগটি ডায়রিভুক্ত করা হয়েছে। আনোয়ারকে ধরার চেষ্টা চলছে।’ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা গকুল চন্দ্র দেবনাথ বলেন, ‘বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি বিষয়টি দেখছে। তাই আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে যাইনি। পুরো ঘটনা তদন্ত করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ বালাগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জহিরুল ইসলাম খান বলেন, ‘উত্ত্যক্তের অভিযোগ সঠিক হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

1 comment:

Powered by Blogger.