তরুণসমাজ-চিন্তা ও কর্মে ফারাক কতটুকু? by সালমা খান
আমরা সব সময়ই বলে থাকি, তরুণরাই আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ এবং বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা বিকাশের চাবিকাঠি। দেশ তাদের শক্তি ও মেধা বিকাশের যথাযথ সুযোগ সৃষ্টি করলে তারাই আমাদের জন্য গড়তে পারে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত আলোকিত এক বাংলাদেশ।
কিন্তু আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা, নীতি ও কৌশলে প্রায়ই উপেক্ষিত রয়ে যায় তরুণদের সমস্যা ও সম্ভাবনা, তাদের আশা আকাঙ্ক্ষা ও চাওয়া-পাওয়ার হিসাব। সার্বিকভাবে তরুণ সম্প্রদায় ন্যায্য সুবিধাবঞ্চিত ও হতাশাগ্রস্ত—এ ধরনের মোটা দাগে কিছু তথ্য ব্যতীত তাদের সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি জানার সুযোগ তেমনি হয়নি।
সম্প্রতি ব্রিটিশ কাউন্সিলের উদ্যোগে দেশব্যাপী এক জরিপে প্রথমবারের মতো দেশের তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গিগত গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য উঠে এসেছে, যা এতটাই ইতিবাচক ও আশাব্যঞ্জক যে মনে হয় এ যেন আমাদের নিত্যদিনের খবরের কাগজের পাতায় প্রকাশিত বা গ্রাম-গঞ্জে আনাচ-কানাচে ঘটে যাওয়া নারী, শিশু ও দরিদ্রের অধিকার লঙ্ঘন ও দলীয় হানাহানিতে লিপ্ত পরিচিত বাংলাদেশ নয়, এটি সত্যিই এক সোনার বাংলার চিত্র।
এই জরিপকে কেন্দ্র করে প্রথম আলো এবং অন্য কয়েকটি পত্রিকায় ইতিমধ্যেই লেখা হয়েছে। সেসব লেখকের সঙ্গে আমিও কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই যে জরিপের তথ্যগুলো আমাকে আনন্দিত করেছে, দেশের তরুণদের জন্য গর্বিত বোধ করেছি। কিন্তু একজন গবেষক ও মানবাধিকারকর্মী হিসেবে বিভিন্ন সূত্রে যে তথ্যসমূহ আমাদের কাছে আসে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এ ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন সমীচীন মনে করছি। জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সের সাড় পাঁচ কোটি জনগোষ্ঠী রয়েছে, যার মধ্যে দুই হাজার ১৬৭ জন উত্তরদাতার মধ্যে এ জরিপ চালানো হয়েছে। উত্তরদাতাদের দেশের সাতটি বিভাগের প্রতিটির দুটি জেলা থেকে নির্দিষ্ট শ্রেণীভুক্তি হিসেবে বাছাই করা হয়েছে, যার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ ছিল শিক্ষার্থী। বিরাট এক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে মাত্র দুই হাজার ১৬৭ জন বাছাইকৃত উত্তরদাতার সংখ্যা যদিও পরিসংখ্যান তত্ত্বগতভাবে বেঠিক নয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জরিপের উদ্দেশ্য যেখানে দৃষ্টিভঙ্গি যাচাই (attitude), বাস্তব ক্ষেত্রে কী করা হয় (practice) তা নয়, এখন এই সংখ্যা প্রতিনিধিত্বকারী বলে মনে করা সংগত নয়। মানুষ নীতিগতভাবে যেকোনো ভালো ধারণাকে সমর্থন করে, কিন্তু প্রায়ই নিজের জীবনে তা চর্চা করে না। উইমেন ফর উইমেনের একটি গবেষণায় দেখা যায় যে বিধবা বিবাহকে নীতিগতভাবে সমর্থনকারী অনেকেই বলেছে কিন্তু তার মায়ের দ্বিতীয় বিবাহ সে সমর্থন করে না। মূল প্রশ্নের সঙ্গে সম্পূরক প্রশ্নগুলো উত্তরদাতার কাছে তুলে না ধরলে কোনো গোষ্ঠী বা শ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গি সম্বন্ধে সিদ্ধান্তে যাওয়া তাই প্রশ্নবিদ্ধ রয়ে যায়।
এই জরিপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্যে দেখা যায়, শতকরা ৮৮ ভাগ তরুণ মনে করে, তারা সুখী অথবা ভীষণ সুখী। এ ক্ষেত্রে সুখের সংজ্ঞা কী ছিল তা বলা হয়নি। যে দেশের সুবৃহৎ জনগোষ্ঠীর জীবনে দারিদ্র্য নিত্যসঙ্গী, যেখানে নিয়ন্ত্রণহীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি (যুগান্তর, ৯ জুলাই), যেখানে তরুণদের চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজিতে সাধারণ জনজীবন বিপর্যস্ত (নয়াদিগন্ত), সেখানে এত গভীর সুখের উৎস কী হতে পারে? প্রশ্নকর্তার আশানুরূপ প্রশ্নের উত্তর দেওয়াই সংগত হবে এ ধারণা বা সক্ষম তরুণ হিসেবে পারিবারিক দায়িত্বকে এড়িয়ে চলার মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ? এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও দুটি উত্তর এসেছে যুবগোষ্ঠীর কাছ থেকে, যা তাদের সুখের বোধগম্যতাকে আরও ধোঁয়াটে করে তুলেছে। ৭৯ শতাংশ তরুণ বলছে, তারা দেশের উন্নয়ন ইস্যুতে আগ্রহী কিন্তু একই সঙ্গে ৭০ শতাংশ বলছে, তারা কোনো প্রকার স্থানীয় বা সামাজিক ক্রিয়াকর্মে সম্পৃক্ত নয়, যদিও ৯৮ শতাংশ তরুণ মনে করে, তাদের সমাজসেবামূলক কাজে অংশ নেওয়া উচিত। আবার দেখা যাচ্ছে, ৯৫ শতাংশ তরুণ যদিও স্থানীয় এবং নিজের পাড়া পর্যায়ে সেবামূলক কাজ করতে আগ্রহী, কিন্তু ৯৪ শতাংশ এ ধরনের কাজ করার জন্য কোনো তরুণদের সংগঠন বা আন্দোলনের খোঁজ পায়নি। এখানে প্রায় সব উত্তরই পরস্পরবিরোধী। তরুণদের সংগঠন তো তরুণরাই করবে—যেখানে ৯৮ শতাংশ তরুণ মনে করে, তাদের সমাজসেবামূলক কাজে অংশ নেওয়া উচিত। তাহলে তরুণ সংগঠন, তরুণ আন্দোলন কি ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া কিছু হতে পারে? তারুণ্যের ব্যাখ্যাই তো সক্রিয় হওয়া, উদ্যমী হওয়া এবং সর্বোপরি ইচ্ছা আর স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে পরিণত করা। এসব তথ্যের মাধ্যমে সামাজিক দায়বদ্ধতা সম্বন্ধে তরুণসমাজের ধারণাগত অস্বচ্ছতার দিকটি ফুটে উঠেছে, তা কতটা গ্রহণযোগ্য সেটা ভাবার বিষয়।
দেশের চলমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে তরুণদের মনোভাবের মধ্যেও পরস্পর বিরোধিতার আভাস পাওয়া যায়। ৭০ শতাংশ বলেছে, দেশ সঠিক পথে এগিয়ে চলেছে আবার ৬০ শতাংশ শঙ্কিত যে দেশে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দুর্নীতি আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি ধারণ করবে। দেশ যদি ঠিক পথেই চলে, তাহলে দুর্নীতি অবশ্যই ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ রূপ গ্রহণ করবে, এ ধরনের দুটো ধারণাই সঠিক হতে পারে না।
এই জরিপে নারী-পুরুষের সংখ্যা সমান সমান ছিল কি না তা বলা না হলেও নারীর অংশগ্রহণ ছিল এবং তরুণদের ৭৬ দশমিক ৫ শতাংশ বলেছে, তারা বিশ্বাস করে যে সমাজকে প্রভাবান্বিত করে এ ধরনের সব সিদ্ধান্তে নারীর অধিক অংশগ্রহণে তারা বিশ্বাসী। এটা আমাদের সমাজ সম্বন্ধে আমাদের ধারণা পাল্টে দিতে বাধ্য করে। এই মনোভাব উন্নত ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। কিন্তু উত্তরদাতাদের কি প্রশ্ন করা হয়েছিল যে তাদের বোন, স্ত্রী বা মাকে কি তারা একইভাবে পরিবারে ও সমাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমঅংশীদারিত্ব দিয়ে থাকে? আমরা জানি, পরিবার ও সমাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর কোনো ভূমিকা না থাকাই নারী নির্যাতনের মূল কারণ। বাস্তবতায় দেখা যায়, দিন দিনই বাড়ছে নারী নির্যাতন এবং অধিকাংশ নির্যাতক ও নির্যাতিত উভয়েই এই তরুণ সম্প্রদায়ভুক্ত। নারী নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন আজকাল আর কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মে মাসের প্রথম ১৫ দিনেই বিভিন্ন প্রকার নির্যাতনের কারণে ২০ জন আত্মহত্যা করেছে (মহিলা আইনজীবী সমিতি)। পরিবার নির্যাতন ও সমাজে নারীকে উত্ত্যক্ত হেয় প্রতিপন্ন করার কারণে ইদানীং নারীর আত্মহত্যার প্রবণতা সংকটজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, শহরের প্রজননক্ষম বিবাহিত নারী, যাঁরা মূলত তরুণ সম্প্রদায়ভুক্ত, তাঁদের মধ্যে অসহনীয় পারিবারিক নির্যাতনের কারণে ১৪ শতাংশ আত্মহত্যার কথা ভাবেন (প্রথম আলো, ৯ জুলাই)। ৭৬ দশমিক ৫ শতাংশ, তরুণ যাদের মধ্যে অর্ধেকই পুরুষ—যদি নারীকে সমমর্যাদা দিতে আগ্রহী, তাহলে নারীর এই করুণ পরিণতি কেন?
এই জরিপের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ উদ্ঘাটন তরুণসমাজের রাজনীতিতে অনীহা। ৭৪ শতাংশ তরুণ রাজনীতিতে আগ্রহী নয়, এটা জাতির জন্য একটা নেতিবাচক সংকেত। এতে একদিকে যেমন বর্তমানের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধবিবর্জিত সংঘাতময় রাজনীতির পরিবর্তে সমাজসচেতন ও দেশপ্রেমে উদ্ভাসিত তরুণ প্রজন্ম ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে সে সম্ভবনা ক্ষীণ বলে মনে হচ্ছে, অন্যদিকে দেশজুড়ে যেসব তরুণ দলীয় লেজুড়বৃত্তির মাধ্যমে সন্ত্রাসী তাণ্ডব ও বিভিন্ন প্রকার নেতিবাচক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে এবং জাতীয় পর্যায়ে যারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতির মূল কারণ, তাদের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলবহির্ভূত বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। তারা তরুণসমাজের শক্তিশালী অংশ হওয়া সত্ত্বেও তাদের রাজনৈতিক চিন্তাধারার কোনো ইঙ্গিত এই জরিপে প্রতিফলিত হয়নি।
জরিপটির উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে—তরুণসমাজের চিন্তাভাবনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও উদ্বেগ উপলব্ধির মাধ্যমে আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদের সুপ্ত সম্ভাবনা বিকাশের পদক্ষেপ নেওয়া। সেই পরিপ্রেক্ষিতে জরিপের কেন্দ্রবিন্দু ইতিবাচক হওয়াটা স্বাভাবিক এবং উত্তরদাতাদের উক্তিতেও সেই সুর প্রতিফলিত হয়েছে। কিন্তু তরুণসমাজের এক বৃহদাংশের মধ্যে রয়েছে বঞ্চনা ও না-পাওয়ার বেদনা থেকে উৎসারিত হতাশা ও সমাজবিচ্ছিন্নতা, যার নেতিবাচক প্রভাবসমূহ ক্রমেই ভয়াবহ সামাজিক সমস্যায় রূপান্তরিত হচ্ছে। এ ইস্যুটি তরুণসমাজের জন্য অবশ্যই একটি বিশেষ উদ্বেগ, যা এই জরিপের অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত ছিল। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় শিক্ষাঙ্গনে অরাজকতা, তরুণদের মধ্যে মাদকাসক্তি ও নারীর চলাফেরার নিরাপত্তার বিষয়টি। মাদকাসক্তির ব্যাপকতা ও ভয়াবহ পরিণতির কথা প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে গুরুত্ব পাচ্ছে। মাদকাসক্তি নিরাময়ে নিবেদিত সংগঠন ‘মানস’-এর তথ্যে জানা যায়, দেশে ৭০ লাখের অধিক মাদকাসক্ত রয়েছে, যার মধ্যে ৯০ শতাংশ ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সের এবং ৩৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সের মাদকাসক্তদের শতকরা পাঁচজনই নারী। নারীর চলাফেরার নিরাপত্তার ইস্যুটিও সম্ভবত সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। প্রায় শিশু থেকে কিশোরী ও তরুণ মেয়েদের চলাফেরা, বিদ্যালয় বা কাজে যাওয়ার পথে নিপীড়ন, নির্যাতন থেকে আরম্ভ করে হত্যা বা প্ররোচিত আত্মহত্যা এক ভয়াবহ রূপ গ্রহণ করেছে, যার সংঘটক ও শিকার উভয়ই তরুণ।
সালমা খান: সিডও কমিটির সাবেক চেয়ারপারসন ও উইমেন ফর উইমেন-এর প্রেসিডেন্ট।
সম্প্রতি ব্রিটিশ কাউন্সিলের উদ্যোগে দেশব্যাপী এক জরিপে প্রথমবারের মতো দেশের তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গিগত গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য উঠে এসেছে, যা এতটাই ইতিবাচক ও আশাব্যঞ্জক যে মনে হয় এ যেন আমাদের নিত্যদিনের খবরের কাগজের পাতায় প্রকাশিত বা গ্রাম-গঞ্জে আনাচ-কানাচে ঘটে যাওয়া নারী, শিশু ও দরিদ্রের অধিকার লঙ্ঘন ও দলীয় হানাহানিতে লিপ্ত পরিচিত বাংলাদেশ নয়, এটি সত্যিই এক সোনার বাংলার চিত্র।
এই জরিপকে কেন্দ্র করে প্রথম আলো এবং অন্য কয়েকটি পত্রিকায় ইতিমধ্যেই লেখা হয়েছে। সেসব লেখকের সঙ্গে আমিও কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই যে জরিপের তথ্যগুলো আমাকে আনন্দিত করেছে, দেশের তরুণদের জন্য গর্বিত বোধ করেছি। কিন্তু একজন গবেষক ও মানবাধিকারকর্মী হিসেবে বিভিন্ন সূত্রে যে তথ্যসমূহ আমাদের কাছে আসে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এ ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন সমীচীন মনে করছি। জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সের সাড় পাঁচ কোটি জনগোষ্ঠী রয়েছে, যার মধ্যে দুই হাজার ১৬৭ জন উত্তরদাতার মধ্যে এ জরিপ চালানো হয়েছে। উত্তরদাতাদের দেশের সাতটি বিভাগের প্রতিটির দুটি জেলা থেকে নির্দিষ্ট শ্রেণীভুক্তি হিসেবে বাছাই করা হয়েছে, যার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ ছিল শিক্ষার্থী। বিরাট এক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে মাত্র দুই হাজার ১৬৭ জন বাছাইকৃত উত্তরদাতার সংখ্যা যদিও পরিসংখ্যান তত্ত্বগতভাবে বেঠিক নয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জরিপের উদ্দেশ্য যেখানে দৃষ্টিভঙ্গি যাচাই (attitude), বাস্তব ক্ষেত্রে কী করা হয় (practice) তা নয়, এখন এই সংখ্যা প্রতিনিধিত্বকারী বলে মনে করা সংগত নয়। মানুষ নীতিগতভাবে যেকোনো ভালো ধারণাকে সমর্থন করে, কিন্তু প্রায়ই নিজের জীবনে তা চর্চা করে না। উইমেন ফর উইমেনের একটি গবেষণায় দেখা যায় যে বিধবা বিবাহকে নীতিগতভাবে সমর্থনকারী অনেকেই বলেছে কিন্তু তার মায়ের দ্বিতীয় বিবাহ সে সমর্থন করে না। মূল প্রশ্নের সঙ্গে সম্পূরক প্রশ্নগুলো উত্তরদাতার কাছে তুলে না ধরলে কোনো গোষ্ঠী বা শ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গি সম্বন্ধে সিদ্ধান্তে যাওয়া তাই প্রশ্নবিদ্ধ রয়ে যায়।
এই জরিপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্যে দেখা যায়, শতকরা ৮৮ ভাগ তরুণ মনে করে, তারা সুখী অথবা ভীষণ সুখী। এ ক্ষেত্রে সুখের সংজ্ঞা কী ছিল তা বলা হয়নি। যে দেশের সুবৃহৎ জনগোষ্ঠীর জীবনে দারিদ্র্য নিত্যসঙ্গী, যেখানে নিয়ন্ত্রণহীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি (যুগান্তর, ৯ জুলাই), যেখানে তরুণদের চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজিতে সাধারণ জনজীবন বিপর্যস্ত (নয়াদিগন্ত), সেখানে এত গভীর সুখের উৎস কী হতে পারে? প্রশ্নকর্তার আশানুরূপ প্রশ্নের উত্তর দেওয়াই সংগত হবে এ ধারণা বা সক্ষম তরুণ হিসেবে পারিবারিক দায়িত্বকে এড়িয়ে চলার মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ? এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও দুটি উত্তর এসেছে যুবগোষ্ঠীর কাছ থেকে, যা তাদের সুখের বোধগম্যতাকে আরও ধোঁয়াটে করে তুলেছে। ৭৯ শতাংশ তরুণ বলছে, তারা দেশের উন্নয়ন ইস্যুতে আগ্রহী কিন্তু একই সঙ্গে ৭০ শতাংশ বলছে, তারা কোনো প্রকার স্থানীয় বা সামাজিক ক্রিয়াকর্মে সম্পৃক্ত নয়, যদিও ৯৮ শতাংশ তরুণ মনে করে, তাদের সমাজসেবামূলক কাজে অংশ নেওয়া উচিত। আবার দেখা যাচ্ছে, ৯৫ শতাংশ তরুণ যদিও স্থানীয় এবং নিজের পাড়া পর্যায়ে সেবামূলক কাজ করতে আগ্রহী, কিন্তু ৯৪ শতাংশ এ ধরনের কাজ করার জন্য কোনো তরুণদের সংগঠন বা আন্দোলনের খোঁজ পায়নি। এখানে প্রায় সব উত্তরই পরস্পরবিরোধী। তরুণদের সংগঠন তো তরুণরাই করবে—যেখানে ৯৮ শতাংশ তরুণ মনে করে, তাদের সমাজসেবামূলক কাজে অংশ নেওয়া উচিত। তাহলে তরুণ সংগঠন, তরুণ আন্দোলন কি ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া কিছু হতে পারে? তারুণ্যের ব্যাখ্যাই তো সক্রিয় হওয়া, উদ্যমী হওয়া এবং সর্বোপরি ইচ্ছা আর স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে পরিণত করা। এসব তথ্যের মাধ্যমে সামাজিক দায়বদ্ধতা সম্বন্ধে তরুণসমাজের ধারণাগত অস্বচ্ছতার দিকটি ফুটে উঠেছে, তা কতটা গ্রহণযোগ্য সেটা ভাবার বিষয়।
দেশের চলমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে তরুণদের মনোভাবের মধ্যেও পরস্পর বিরোধিতার আভাস পাওয়া যায়। ৭০ শতাংশ বলেছে, দেশ সঠিক পথে এগিয়ে চলেছে আবার ৬০ শতাংশ শঙ্কিত যে দেশে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দুর্নীতি আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি ধারণ করবে। দেশ যদি ঠিক পথেই চলে, তাহলে দুর্নীতি অবশ্যই ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ রূপ গ্রহণ করবে, এ ধরনের দুটো ধারণাই সঠিক হতে পারে না।
এই জরিপে নারী-পুরুষের সংখ্যা সমান সমান ছিল কি না তা বলা না হলেও নারীর অংশগ্রহণ ছিল এবং তরুণদের ৭৬ দশমিক ৫ শতাংশ বলেছে, তারা বিশ্বাস করে যে সমাজকে প্রভাবান্বিত করে এ ধরনের সব সিদ্ধান্তে নারীর অধিক অংশগ্রহণে তারা বিশ্বাসী। এটা আমাদের সমাজ সম্বন্ধে আমাদের ধারণা পাল্টে দিতে বাধ্য করে। এই মনোভাব উন্নত ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। কিন্তু উত্তরদাতাদের কি প্রশ্ন করা হয়েছিল যে তাদের বোন, স্ত্রী বা মাকে কি তারা একইভাবে পরিবারে ও সমাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমঅংশীদারিত্ব দিয়ে থাকে? আমরা জানি, পরিবার ও সমাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর কোনো ভূমিকা না থাকাই নারী নির্যাতনের মূল কারণ। বাস্তবতায় দেখা যায়, দিন দিনই বাড়ছে নারী নির্যাতন এবং অধিকাংশ নির্যাতক ও নির্যাতিত উভয়েই এই তরুণ সম্প্রদায়ভুক্ত। নারী নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন আজকাল আর কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মে মাসের প্রথম ১৫ দিনেই বিভিন্ন প্রকার নির্যাতনের কারণে ২০ জন আত্মহত্যা করেছে (মহিলা আইনজীবী সমিতি)। পরিবার নির্যাতন ও সমাজে নারীকে উত্ত্যক্ত হেয় প্রতিপন্ন করার কারণে ইদানীং নারীর আত্মহত্যার প্রবণতা সংকটজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, শহরের প্রজননক্ষম বিবাহিত নারী, যাঁরা মূলত তরুণ সম্প্রদায়ভুক্ত, তাঁদের মধ্যে অসহনীয় পারিবারিক নির্যাতনের কারণে ১৪ শতাংশ আত্মহত্যার কথা ভাবেন (প্রথম আলো, ৯ জুলাই)। ৭৬ দশমিক ৫ শতাংশ, তরুণ যাদের মধ্যে অর্ধেকই পুরুষ—যদি নারীকে সমমর্যাদা দিতে আগ্রহী, তাহলে নারীর এই করুণ পরিণতি কেন?
এই জরিপের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ উদ্ঘাটন তরুণসমাজের রাজনীতিতে অনীহা। ৭৪ শতাংশ তরুণ রাজনীতিতে আগ্রহী নয়, এটা জাতির জন্য একটা নেতিবাচক সংকেত। এতে একদিকে যেমন বর্তমানের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধবিবর্জিত সংঘাতময় রাজনীতির পরিবর্তে সমাজসচেতন ও দেশপ্রেমে উদ্ভাসিত তরুণ প্রজন্ম ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে সে সম্ভবনা ক্ষীণ বলে মনে হচ্ছে, অন্যদিকে দেশজুড়ে যেসব তরুণ দলীয় লেজুড়বৃত্তির মাধ্যমে সন্ত্রাসী তাণ্ডব ও বিভিন্ন প্রকার নেতিবাচক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে এবং জাতীয় পর্যায়ে যারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতির মূল কারণ, তাদের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলবহির্ভূত বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। তারা তরুণসমাজের শক্তিশালী অংশ হওয়া সত্ত্বেও তাদের রাজনৈতিক চিন্তাধারার কোনো ইঙ্গিত এই জরিপে প্রতিফলিত হয়নি।
জরিপটির উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে—তরুণসমাজের চিন্তাভাবনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও উদ্বেগ উপলব্ধির মাধ্যমে আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদের সুপ্ত সম্ভাবনা বিকাশের পদক্ষেপ নেওয়া। সেই পরিপ্রেক্ষিতে জরিপের কেন্দ্রবিন্দু ইতিবাচক হওয়াটা স্বাভাবিক এবং উত্তরদাতাদের উক্তিতেও সেই সুর প্রতিফলিত হয়েছে। কিন্তু তরুণসমাজের এক বৃহদাংশের মধ্যে রয়েছে বঞ্চনা ও না-পাওয়ার বেদনা থেকে উৎসারিত হতাশা ও সমাজবিচ্ছিন্নতা, যার নেতিবাচক প্রভাবসমূহ ক্রমেই ভয়াবহ সামাজিক সমস্যায় রূপান্তরিত হচ্ছে। এ ইস্যুটি তরুণসমাজের জন্য অবশ্যই একটি বিশেষ উদ্বেগ, যা এই জরিপের অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত ছিল। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় শিক্ষাঙ্গনে অরাজকতা, তরুণদের মধ্যে মাদকাসক্তি ও নারীর চলাফেরার নিরাপত্তার বিষয়টি। মাদকাসক্তির ব্যাপকতা ও ভয়াবহ পরিণতির কথা প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে গুরুত্ব পাচ্ছে। মাদকাসক্তি নিরাময়ে নিবেদিত সংগঠন ‘মানস’-এর তথ্যে জানা যায়, দেশে ৭০ লাখের অধিক মাদকাসক্ত রয়েছে, যার মধ্যে ৯০ শতাংশ ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সের এবং ৩৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সের মাদকাসক্তদের শতকরা পাঁচজনই নারী। নারীর চলাফেরার নিরাপত্তার ইস্যুটিও সম্ভবত সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। প্রায় শিশু থেকে কিশোরী ও তরুণ মেয়েদের চলাফেরা, বিদ্যালয় বা কাজে যাওয়ার পথে নিপীড়ন, নির্যাতন থেকে আরম্ভ করে হত্যা বা প্ররোচিত আত্মহত্যা এক ভয়াবহ রূপ গ্রহণ করেছে, যার সংঘটক ও শিকার উভয়ই তরুণ।
সালমা খান: সিডও কমিটির সাবেক চেয়ারপারসন ও উইমেন ফর উইমেন-এর প্রেসিডেন্ট।
No comments