আবেদন-আবদুস শহীদের বাড়িটি রক্ষা করুন by অদিতি ফাল্গুনী

‘...চকিত দৃষ্টিতে দেখলাম, খাপড়ার প্রায় পঞ্চাশটি জানালায় বন্দুকের নল লাগিয়ে সিপাহীরা দাঁড়িয়ে আছে। আমি তৎক্ষণাৎ উপুড় হয়ে বালিশের নীচে মাথা গোঁজার সঙ্গে সঙ্গে রাইফেলের গর্জনে খাপড়ার ভিত যেন ফেটে চৌচির হতে চাইল। গেটের দিকে একটু চোখ পড়তেই দেখলাম ফিনকি দিয়ে রক্ত একেবারে ছাদ পর্যন্ত উঠছে।


আমার মাথা একটা সাপোর্টিং ওয়ালের আড়ালে বালিশের নীচে গোঁজা ছিল, পা-কনুই বাইরে ছিল। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম হাঁটু দু’ফাঁক করে স্পিলিন্টার ঢুকে গেল। বালিশের নীচে থেকেই দেখলাম পাশেই কমরেড হানিফের বাহুর উপরিভাগ ছিঁড়ে গেছে এবং সেখান থেকে অঝোরে রক্ত ঝরছে। একটু পরেই কমরেড হানিফকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখি। যেন দেখলাম আমার অদূরেই কুষ্টিয়ার কমরেড নন্দ সান্যাল রক্তাক্ত শরীরে মেঝের উপর লুটিয়ে পড়ছে। আমার হুঁশ হারাবার পূর্বে যতটুকু মনে আছে দেখলাম খাপড়া ওয়ার্ডে রক্তের স্রোত বইছে। আমার শরীর বুক পর্যন্ত রক্তে ডুবন্ত।’ (কারাস্মৃতি, আবদুস শহীদ, প্রথম প্রকাশ, মে ১৯৭৭, মুক্তধারা)
এই প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের কাছে কমরেড আবদুস শহীদ প্রায় অপরিচিত একটি নাম। ‘খাপড়া ওয়ার্ড’ শব্দবন্ধটি আরও বেশি অপরিচিত হওয়ারই সম্ভাবনা। পাকিস্তান আমলের শুরুর দিকে রাজশাহী জেলে বন্দী কমিউনিস্ট নেতা-কর্মীদের ওপর তদানীন্তন মুসলিম লীগ সরকারের কারা প্রশাসন গুলিবর্ষণ করলে এক দিনেই নিহত হয়েছিলেন বিজন সেন (রাজশাহী), হানিফ শেখ (কুষ্টিয়া), দেলওয়ার (কুষ্টিয়া), কম্পরাম সিং (দিনাজপুর), আনোয়ার (খুলনা), সুখেন ভট্টাচার্য্য (ময়মনসিংহ) ও সুধীন ধর (রংপুর)। এ ছাড়া গুলিবিদ্ধ ও আহত হয়ে যে ২৯ জন বেঁচে যান, তাঁদের ভেতর কয়েকজন চিরতরে পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ হয়ে যান। কমরেড আবদুস শহীদ চোখের সামনে সহযোদ্ধাদের এই মর্মান্তিক মৃত্যু ও আহত হওয়ার স্মৃতি লিখেছেন তাঁর ‘কারা সাহিত্য’মূলক গ্রন্থ কারাস্মৃতিতে।
বরিশালের চাখার উপজেলায় রুশ বিপ্লবের বছর ১৯১৭ সালে জন্ম কমরেড শহীদের। একটি সম্ভ্রান্ত ও রক্ষণশীল পীর বংশে জন্ম নিয়েও তিনি তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছেন প্রগতি ও মানবমুক্তির লড়াইয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা নিয়েও সরকারি-বেসরকারি নানা দামি চাকরির মোহ ত্যাগ করে প্রথম যৌবনের সুদীপ্ত নয়টি বছর (১৯৪৮—৫৭) তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন জেলখানার গরাদের ভেতরে। জীবিকা ছিল শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতা। জেলখানা থেকে মুক্তির পরও ১৯৫৮ থেকে ১৯৭০ সাল অবধি গ্রামের কৃষকদের ভেতর কাজ করেছেন আবদুস শহীদ, অংশ নিয়েছেন ১৯৭১-এর গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে।
জীবনের শেষ বছরগুলো স্কুলে শিক্ষকতা ও বিভিন্ন সংবাদপত্রে সাংবাদিকতা করে, বই লিখে পার করেছেন আবদুস শহীদ। অবশ্য উপার্জনের অধিকাংশই তিনি ব্যয় করেছেন সামাজিক নানা কাজে ও রাজনৈতিক লেখালেখি, প্রকাশনায়। ১৯৯৬ সালে মৃত্যু হয় তাঁর। এই প্রয়াত সাংবাদিক, লেখক ও মুক্তিযোদ্ধা বরিশালে পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে এবং ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ১৫ লাখ টাকায় স্ত্রী ও সন্তানসন্ততির জন্য একটি বাড়ি এই ঢাকা শহরে রেখে যেতে সমর্থ হন। ৫৮/১ উলন, রামপুরায় অবস্থিত ও হাতিরঝিলের পাশে বাড়িটি যেকোনো মুহূর্তে বুলডোজারের আঘাতে ধসে পড়ার আশঙ্কায় আশঙ্কিত। আবদুস শহীদের বিধবা স্ত্রী, দুই মেয়ে ও একমাত্র অসুস্থ ছেলের মাথা গোঁজার এই আশ্রয়টুকুতে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়েও ২০০৮ সালে হাতিরঝিল উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় উচ্ছেদ নোটিশ পাঠানো হয়। ভবিষ্যতে এই বাড়িটি অধিগ্রহণের জন্য কর্তৃপক্ষ লাল নিশানও টাঙিয়ে দেয়। আবদুস শহীদের স্ত্রী রাজিয়া শহীদ এই উচ্ছেদ নোটিশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন। হাইকোর্ট প্রথম দফায় ২০০৯-এর ৩১ আগস্ট ও দ্বিতীয় দফায় ২০০৯-এর ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত রিট পিটিশনের মেয়াদ মঞ্জুর করলেও আর বুঝি এই ত্যাগী ও আদর্শবাদী পরিবারের শেষ আশ্রয়টুকু থাকছে না। এ পর্যন্ত এ দেশের ২১৬ জন খ্যাতনামা সম্পাদক, কলাম লেখক ও সাংবাদিক এই বাড়িটির উচ্ছেদ-প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সরকারের কাছে স্বাক্ষরসংবলিত আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মানববন্ধনের আয়োজন করেছেন। তবুু শেষ রক্ষা বুঝি আর হয় না!
এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ৭ তারিখ পূর্ত প্রতিমন্ত্রী, রাজউকের চেয়ারম্যান, এসি ল্যান্ড ও হাতিরঝিল প্রকল্পের প্রকল্পপ্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাঈদ এসে বাড়িটি রক্ষা পাবে বলে আশ্বাস দিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও আমলাতান্ত্রিক নানা নিয়মকানুনের সঙ্গে তাঁরাও পেরে উঠছেন না। পার্শ্ববর্তী যেসব পরিবার সরকারের কাছে জায়গাজমি বা বসতবাড়ি ছেড়ে দিয়েছে, তারা প্রতি কাঠা জমিতে দুই লাখ ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে, যদিও এই এলাকায় প্রতি কাঠা জমির দাম চার লাখ টাকা বলে আবদুস শহীদের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়।
সরকার থেকে এরই মধ্যে প্রস্তাবিত হাতিরঝিল রাস্তায় শহীদ পরিবারের যেটুকু জমি এবং যতগুলো ভাড়া দেওয়া টিনের ঘর আছে, তার পরিমাণ দুই কাঠা। সেই দুই কাঠা জমি শহীদ পরিবার সরকারি ক্ষতিপূরণের সমমূল্যেই ছেড়ে দিতে রাজি। শুধু বাকি দুই কাঠার ওপর নির্মিত দোতলা বাড়িটি নিয়েই তাদের যত উদ্বেগ।
‘আমার ছেলে পাভেল কয়েক বছর ধরে বিষণ্নতার রোগী। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করতে পারল না বলে কাজও পাচ্ছে না। বড় মেয়ে তানিয়া ব্যাংকে একটি চাকরি করছে। ব্যাংক থেকে লোন করে যে বাড়ি বানিয়েছি, তার মাসিক কিস্তি শোধ করতেই তানিয়ার বেতন ফুরিয়ে যায়। ছোট মেয়ে জয়া গৃহবধূ, ঘরসংসার ও দুই মেয়ের বাচ্চাদের সামলায়। জয়ার স্বামী একটি ব্যবসা সবে শুরু করেছে। কিন্তু এটা লাভজনক হতে এখনো দেরি আছে।’ রাজিয়া শহীদ বললেন।
‘সরকার যদি এখন আমাদের উচ্ছেদ করে, আমরা কোথায় দাঁড়াব? বড় বোনের বেতনে লোন শোধ করি। আর বাড়ির কিছু অংশ ভাড়া দিয়ে মাসের অন্যান্য খরচ চালাই। এই যে দ্যাখেন, আমাদের বাসায় আসতে এই যে নড়বড়ে বাঁশের সাঁকোটা পার হলেন, আর চারপাশে কচুরিপানার দঙ্গল...কেউ এ বাসায় আসতেও চায় না! তবু এটাই আমাদের শেষ আশ্রয়! দেশে যেহেতু একটি নির্বাচিত সরকার এসেছে, আমরা সরকারের কাছে, বিশেষত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দেশের এক ত্যাগী সন্তানের শেষ আশ্রয় ও স্মৃতিটুকু রক্ষা করার জন্য আকুল আবেদন জানাই।’ বললেন আবদুস শহীদের কনিষ্ঠা তনয়া জয়া শহীদ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদেরও আকুল আবেদন, কোনোভাবেই কি রক্ষা করা যায় না এই ত্যাগী পরিবারের শেষ আশ্রয়টুকু? যে অসম্ভব মাতৃস্নেহে প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রতিক সময়ে নিমতলীর অগ্নিদগ্ধ পরিবারগুলোর বিয়ের জন্য বাগ্দত্তা তিন তরুণীকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গণভবনে ডেকে বিয়ে দিয়েছেন, তেমনি ব্যক্তিগত মমতা দিয়ে এই অসহায় পরিবারটির পক্ষেও তিনি নিশ্চয়ই দাঁড়াতে পারেন।
অদিতি ফাল্গুনী: কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক।

No comments

Powered by Blogger.