সরল গরল-নীরব ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত দুদক by মিজানুর রহমান খান

সেগুনবাগিচায় একটা ভূমিকম্প ঘটে গেছে। নীরবে। রিখটার স্কেলের সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলে নাকি ঢাকার দালানকোঠা ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রাকৃতিক ভূমিকম্প হলে ধ্বংসযজ্ঞ খালি চোখে দেখা যায়। কিন্তু এই ভূমিকম্প খালি চোখে দেখা যাবে না।


সেগুনবাগিচায় দুদক ভবন। ভূমিকম্পটা সেখানে আঘাত হেনেছে। ধ্বংসযজ্ঞটা কল্পনা করতে হবে।
রিখটার স্কেলটার নাম ডিসমিস। ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর দুর্নীতির মামলায় হাইকোর্টে খালাস পান। এর বিরুদ্ধে দুদক লিভ টু আপিল করে। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগে ৪ জুলাই সেটা খারিজ হলো। এর ফলে হাইকোর্ট বিভাগের রায় পুরোপুরি বহাল থাকল। আর এই বহাল থাকার ঘোষণার মুহূর্তেই ভূকম্পনটা অনুভূত হলো। দুদকের এক হাজারের বেশি দুর্নীতির মামলা এখন বিচারাধীন। দুদকের লিভ পিটিশন খারিজ হওয়ায় এসব মামলা পাইকারিভাবে অবৈধ হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ, দুদক তার সব মামলা একটি অনুমোদনপত্র দিয়ে দায়ের করেছে। কিন্তু হাইকোর্ট কার্যত বলেছেন, একটি নয়; অন্তত দুটি লাগবে।
লিভ মঞ্জুরি একটি প্রাথমিক বিষয়। দুদকের আবেদন মঞ্জুর হলে বিষয়টির পূর্ণাঙ্গ শুনানির সুযোগ সৃষ্টি হতো। এখন আর শুনানি হবে না। অথচ দরকারি ছিল এই শুনানি। এই মামলায় শুধু ব্যক্তির স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় জড়িত ছিল না। একজন ড. আলমগীর দোষী কি নির্দোষ, সেটা ছিল গৌণ বিষয়। মুখ্য বিষয় ছিল, কতিপয় আইনি ব্যাখ্যা। দুদক আইনসংক্রান্ত কতিপয় প্রশ্ন। তাও এমন প্রশ্ন, যা নতুন করে অযথা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল।
আওয়ামী লীগের সাংসদ হাবিবুর রহমান মোল্লার মামলায় আপিল বিভাগ মাইলফলক সিদ্ধান্ত দেন। তারা হাইকোর্টের রায় সমুন্নত রাখেন। আমরা আশাবাদী হই। বাংলার মাটিতে তাহলে দুর্নীতির মামলার বিচার হবে। শাসকশ্রেণী ও তাদের মিত্রজীবীরা কোনো প্রকারের বিচারই চান না। তাই মোল্লায় যা অর্জন হয়, আলমগীরে তার বিসর্জন ঘটে। শুধু বিসর্জন নয়, একটা মহাবিপর্যয়। সে জন্যই ভূমিকম্পের সঙ্গে তুলনা করেছি।
প্রতিটি মামলা আলাদা। আলাদা তার ঘটনাবলি ও তথ্য। কিন্তু কতিপয় সাধারণ বিষয় থাকে আইনসংক্রান্ত। আমরা এখন এ রকম একটি আইনি বিষয়ে আলোচনা করব।
ইয়াসমিনকে আপনাদের মনে পড়ে? পুলিশি হেফাজতে তাঁকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছিল। সারা দেশ আন্দোলনে ফুঁসে উঠেছিল। যথারীতি মামলা হয়েছিল। কিন্তু তার বিচার শুরুই হতে পারছিল না। কারণ হলো, সরকারের অনুমোদন লাগবে। কিন্তু বিএনপি সরকার তা দিচ্ছিল না। তারা পুলিশকে রক্ষা করতে চাইছিল। ইতিমধ্যে বিএনপি বিদায় নেয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হন বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। নারীনেত্রীরা তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। স্যাংশন বা অনুমোদন দিতে তাঁরা তদবির করেন। তিনি তাঁর দপ্তরে ফেরেন। দেখেন টেবিলে ফাইল। তিনি তাতে ঝটিকা সই করেন। তাঁর সেই নব্বই দিনের মেয়াদেই অভিযুক্তদের দণ্ড ঘোষিত হয়। তো আমরা দেখি, অনুমোদনেই জাদু। সরকার বিচার করে না। কিন্তু তারা না চাইলে বিচার শুরুই হতে পারে না।
প্রতিটি সরকার, তা আইয়ুব হোক, আর জেনারেল এরশাদ হোক কিংবা নির্বাচিত সরকার হোক, সব শেয়ালের এক রা। তারা কখনো অনুমোদনের ক্ষমতা ব্যুরোকে দিয়েছে। ব্যুরোর আঞ্চলিক দপ্তরকেও দিয়েছে। আবার তা কেড়ে নিয়েছে। সেই যুগেও একটি মামলার জন্য একটি অনুমোদন লাগত। সরকারি লোকলস্কর ছাড়া অন্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দায়েরে অনুমোদন লাগত না।
দুদক আইনের বিদ্যমান ৩২ ধারা দেখুন। ২০০৪ সালে তাতে প্রথম লেখা হলো, ‘দুর্নীতির মামলা দায়েরে দুদকের আগাম অনুমোদন লাগবে। অনুমোদনের অনুলিপি মামলা দায়েরের সময় আদালতে দিতে হবে। অনুমোদনের প্রক্রিয়াটা বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে।’ এটা ইতিহাসে প্রথম। প্রথমবারের মতো অনুমোদন প্রদানের এখতিয়ার কমিশন পেল। সরকারের ভূত চলে গেল। কিন্তু সেই ভূতটা ভিন্নরূপে ফিরে এল।
নতুন ব্যবস্থায় প্রথমবারের মতো পাবলিক সার্ভেন্ট আর বেসরকারি নাগরিকের ব্যবধান ঘুচে গেল। এখন দুদকের মামলা মানেই অনুমোদন থাকতে হবে। কেন অনুমোদন লাগে? যুক্তি হলো, গণকর্মচারীরা সেবা দেন। দিতে দিতে বেভুল মনে কত কি ভুলচুক করে ফেলতে পারেন। যাতে তাঁরা অহেতুক মামলায় না জড়ান, সে জন্য অনুমোদনের রক্ষাকবচ দেওয়া হয়। ড. আলমগীর সরকারে ছিলেন না। আগের আইন থাকলে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হতো। অনুমোদনের প্রশ্ন উঠত না।
অনুমোদন কোনো মৌলিক অধিকার নয়। সংসদ এ বিধান বিলোপ করতে পারে। মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া কী হবে, তা দুনিয়ার কোথাও মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত নয়। যুদ্ধাপরাধীদের ট্রাইব্যুনালে নিতে ফৌজদারি কার্যবিধিটাই বাতিল করা হয়েছে। কথা হলো, বিচার হতে হবে সুষ্ঠু। সেটা পাওয়া অভিযুক্তের মৌলিক অধিকার।
প্রায় তিন বছরের বেশি সময় ধরে আমরা অনুমোদন-নাচ দেখছি। অভিযুক্তদের অনেকেই রাঘববোয়াল। তাঁরা ইনিয়ে-বিনিয়ে বিচিত্র সব গল্প ফেঁদেছে। এতে অনুমোদন-যন্ত্রটা সরকারের কাছে না থাকার ঘাটতি পূরণ হচ্ছে। দুদক-স্বাধীনতা দাঁড়াল, যাহা বায়ান্ন তাহা তেপ্পান্ন।
১৮ এপ্রিল ২০০৭ অধ্যাদেশ জারি হলো। অনুমোদনসংক্রান্ত ৩২ ধারা সংশোধন করা হলো। অথচ এর কোনো দরকার ছিল না। সংসদ অধ্যাদেশ পাস করেনি। তাতে অনুমোদনের শর্ত পাল্টায়নি। কারণ ওই সংশোধনে শুধু বাক্য বদলায়। লক্ষ্য একই থাকে। ৩২(১) দফায় বলা হলো, কমিশনের অনুমোদন ছাড়া কোনো আদালত মামলা আমলে নেবেন না। ৩২(২) দফাটা অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার বিষয়। কারণ, এতে দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তার প্রতি নির্দেশনা দেওয়া হয়। বলা হয়, ‘তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দাখিলের আগে কমিশনের অনুমোদন সংগ্রহ করবেন এবং সেটা তিনি তাঁর রিপোর্টের (অভিযোগপত্র) সঙ্গে একত্রে আদালতে দাখিল করবেন।’
এবার আসুন আমরা দেখে নিই গত তিন বছরে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে এই অনুমোদনের প্রশ্নটি কীভাবে আন্দোলিত হয়েছে।
২০০৮ সাল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্তরীণ। তাঁর বিরুদ্ধে সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্র মামলা হলো। কোয়াশ করতে রিট হলো। এতে অনুমোদনের প্রশ্নটি এল। সেটা অবশ্য দুদক আইনে নয়। কিন্তু সুর, তাল ও লয়টা একই। সেই অনুমোদন দিয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ বললেন, ‘হাইকোর্ট বিভাগ (অথর জজ বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান) বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদমর্যাদা দেখে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। জনগুরুত্ব বা অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় দেওয়া হয়নি। তাই এই অনুমোদন অবৈধ। অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল (সালাহ উদ্দিন আহমেদ) বলেছেন, অনুমোদন একটি প্রশাসনিক বিষয়। কর্তৃপক্ষের সন্তুষ্টিকে আদালতের সন্তুষ্টি দ্বারা প্রতিস্থাপন করা যায় না।’
আপিল বিভাগ (অথর জজ বিচারপতি মো. আবদুল মতিন) বলেন, ‘আমরা অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য সমর্থন করি। কারণ, সেটাই যৌক্তিক। অনুমোদন দেওয়া ঠিক আছে।’
অনুমোদন বিরুদ্ধ যুক্তি প্রধানত দুটি আমরা দেখতে পাই। মামলা দায়েরে দুদকের অনুমোদন ছিল যান্ত্রিক। দুদকের অনুমোদন দেওয়ার কথা একাধিক, দিয়েছে একটি। এ বিষয়ে আমরা প্রথম রায় পাই ২০ নভেম্বর ২০০৮। হাবিবুর রহমান মোল্লা বনাম রাষ্ট্র মামলা। বিচারপতি মোহাম্মদ আনোয়ারুল হক ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুবের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ। তাঁরা রায় দেন, দুদক আইন ও বিধি একেবারেই স্পষ্ট। অনুমোদনের জন্য ফরম পর্যন্ত নির্দিষ্ট করা আছে। এর বাইরে গিয়ে কারণ দেখানোর সুযোগ নেই।’
এর ১৫ মাস ১৪ দিন পর আপিল বিভাগ ওই অভিমত সমর্থন করেন। ৪ এপ্রিল, ২০১০ প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম, বিচারপতি মো. আবদুল মতিন, বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও বিচারপতি এস কে সিনহার সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ হাইকোর্ট বিভাগের ওই সিদ্ধান্তকে অনুমোদন করেন। অনুমোদনে যান্ত্রিকতার যুক্তি আপিল বিভাগ অগ্রাহ্য করেন। সেখানে কিন্তু দুদকের দেওয়া একটি অনুমোদনই টিকে যায়।
ইকবাল হোসেন মাহমুদ টুকুর আয়কর ফাঁকির মামলাও উল্লেখযোগ্য। এটা জরুরি অবস্থার একেবারে গোড়ার দিকের মামলা। টুকুর মামলার অনুমোদন দিয়েছিল এনবিআর। বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রশীদ ড. কামাল হোসেন, রফিক-উল হক, মাহমুদুল ইসলাম প্রমুখের বক্তব্য শুনলেন। তারপর হাইকোর্ট বললেন, রাজস্ব বোর্ড গঠনটাই অবৈধ। তাই তাদের দেওয়া অনুমোদনও অবৈধ। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সর্বসম্মতিক্রমে সেই যুক্তি অগ্রাহ্য করেন।
আপিল বিভাগ অব্যাহতভাবে এভাবে দুর্নীতির মামলার অনুমোদনের প্রশ্নে স্থির ছিলেন। শেখ হাসিনা, টুকু, সাংসদ মোল্লার মামলায় আমরা দেখি আপিল বিভাগ অনুমোদন বিষয়ে অভিযুক্তদের যুক্তি নাকচ করেছেন। আরও একটি মামলার নজির আছে। যেটি নিরঙ্কুশভাবে অনুমোদন প্রশ্নেই রায়।
নাজিম উদ্দিন বনাম বাংলাদেশ মামলা। বিচারপতি মো. ইমান আলী ও বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ। রায় হয় ৪ ডিসেম্বর, ২০০৮। মোল্লার রায়ের ১৩ দিন পর। এতে অনুমোদনসংক্রান্ত সব আইন ও বিধিবিধানের চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়। হাইকোর্ট বেঞ্চ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় অভিমত দেন, অনুমোদন লাগবে মাত্র একটি। ভিন্ন ধরনের কোনো অনুমোদনের জায়গা নেই। হাইকোর্ট যথার্থই দুদকের ১৫(৪) বিধির বরাত দেন। এতে বলা আছে, ‘অভিযোগনামা দায়েরের ক্ষেত্রেই কেবল কমিশনের পূর্বানুমোদন লাগবে।’ এরপর আদালতের ভিন্ন ব্যাখ্যা কি করে চলে?
শুনেছি, এই যথার্থ রায়টির বিরুদ্ধে অভিযুক্তের আইনজীবী (সাবেক মন্ত্রী মাহবুবুর রহমান) আপিলের উদ্যোগ নেন। কিন্তু চেম্বার জজ স্টে দেননি। পরে আর নিয়মিত আপিল হয়েছে বলেও জানা যায় না। আইনের চোখে এই রায় টিকে আছে।
এ রকম প্রেক্ষাপটে ড. আলমগীরের মামলার রায় এল। বিচারপতি এস এম দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মোহাম্মদ রইচ উদ্দিনের সমন্বয় গঠিত বেঞ্চ ২০০৯ সালের ১৩ জুলাই রায় দেন। অনুমোদনের প্রশ্নটি এই রায়ে কীভাবে আলোচিত হয়েছে, সে ব্যাপারে আমরা বড়ই আগ্রহী ছিলাম। কিন্তু হতাশ হয়েছি। আমাদের সুপ্রিম কোর্টের পূর্বাপর একটি রায়েরও সেখানে উল্লেখ নেই। মোল্লা নেই। নাজিমউদ্দিন নেই। বরং উল্লেখ আছে দুটো অপ্রাসঙ্গিক রায়। ১৯৪৫ সালে ফেডারেল কোর্ট ও ১৯৪৮ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট অনুমোদন না থাকার কারণে দণ্ড বাতিল করেছিলেন। বিচারপতি এস এম দস্তগীর হোসেন তাঁর রায়ে ‘ল্যাক অব স্যাংশন’ কথাটি উল্লেখ করেন। কিন্তু সেটা এখানে খাটে না। হাইকোর্ট যা উল্লেখ করেননি তা হলো, ১৯৪৫ সালের মামলায় অনুমোদন ছিল। ওষুধ নিয়ন্ত্রণ আইনে অভিযুক্তকে আদালতে চালান করা হয় ২২ মে ১৯৪৫। আর অনুমোদনপত্রের তারিখ ছিল ২৩ মে। সুতরাং অনুমোদনপত্রের ঘাটতি ছিল না। এটা তথ্যগত বিচ্যুতি। শোধরানোর দাবি রাখে।
ড. আলমগীরের মামলার রায় পড়ে বিস্মিত হতে হয়। এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলের ভূমিকা কী? দুদুকের বিরুদ্ধে এবং আসামির পক্ষে তিনি এক অভাবনীয় অবস্থান নেন। এমনকি বিতর্কিত ব্যাখ্যা দেন। এর পেছনে কে বা কারা, সেটা একটা বিরাট প্রশ্ন। প্রসিকিউশনের খেয়ে-পরে প্রসিকিউশনের বিরোধিতার এমন নজির বিরল। তাঁর যুক্তিগুলো হাইকোর্টের রায়ে লেখা আছে। অনেক আগেই এই রায়ের বিবরণ পেয়েও কিছু লিখিনি। ভেবেছি, এটা কী করে সম্ভব? তাঁর বয়ান ইতিমধ্যে ছাপার অক্ষরে বেরিয়েছে। কিছুদিন আগেই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের মামলায় স্বয়ং অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতে শুনানি করেন। অ্যাটর্নি জেনারেল দুদকের একাধিক অনুমোদন লাগার যুক্তি নাকচ করেন। আসামিপক্ষে বলা হয় তিনটি অনুমোদনপত্র লাগবে। আমরা তাই উদগ্রীব ছিলাম, আপিল বিভাগের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের এই ‘স্ববিরোধিতা’ কীভাবে আসে।
একজন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমানের ব্যাখ্যা যদি সঠিক হয়, তাহলে সেগুনবাগিচায় দুদকের দালানটা থাকবে। কিন্তু ওটা হবে গোডাউন। আর কিছু থাকবে না। তারেক রহমান ও মামুনের বিরুদ্ধে ৬ জুলাই যে মামলাটা দুদক করল, সেখানেও যথারীতি একটিই অনুমোদন আছে। তাই এই মামলাটিও টেকার নয়।
শুধু তারেক কেন, বেগম খালেদা জিয়াসহ সব অভিযুক্তের আইনজীবীরা পড়িমরি ছুটবেন বেঞ্চগুলোতে। তাঁরা বলবেন এই দেখুন, আপিল বিভাগ অনুমোদন দিয়েছেন যে দুদকের মামলায় একটি নয়, একাধিক অনুমোদন লাগবে। তাই বলছি, ড. আলমগীরের রায় পুরোপুরি টেকা মানে দুদকের বিচারাধীন মামলাগুলো ধূলিসাৎ হওয়ার নামান্তর। ইতিমধ্যে তেমন বাস্তব লক্ষণও ফুটে উঠছে।
অনুমোদন প্রশ্নে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান কী বলেছেন, তা জানা জরুরি। তিনি তত্ত্ব দিয়েছেন, মামলা দায়েরে একটি অনুমোদন লাগবে। মামলা আমলে নিতে আরেকটি লাগবে। এই ব্যাখ্যা আজগুবি। আমরা এটা প্রত্যাখ্যান করি।
বিচারপতি মো. দস্তগীর এ সম্পর্কে তাঁর রায়ে লিখেছেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এফআইআর দায়েরের ক্ষেত্রেও দুদুকের অনুমোদন বাধ্যতামূলক। ৩২(২) ধারায় যে অনুমোদনের কথা বলেছে তা থেকে ৩২(১) ধারার অনুমোদন ভিন্নতর। ড. আলমগীরের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়েরে যেহেতু অনুমোদন ছিল না, তাই মামলাটির পুরো কার্যক্রম বেআইনি হয়ে পড়েছে। যে দণ্ড তাঁকে দেওয়া হয়েছে, তাও বেআইনি হয়ে পড়েছে।’
হাইকোর্ট বিভাগ তাঁর রায়ে ওই অভিমত উল্লেখ করেন। সমর্থন করেন। বিচারপতি দস্তগীর লিখেছেন, ‘আমরা দুদকের আইনজীবীর কাছে জানতে চাইলাম, দুদুকের অনুমোদন কোথায়। জবাব যা পেলাম তাতে দেখি, সেই অনুমোদন ৩২(২) ধারায় অভিযোগপত্র দাখিলের জন্য দেওয়া হয়েছে। ৩২(১) ধারার আওতায় দেওয়া হয়নি। আদালত বলেন, এখানে একটা ভিন্ন ধরনের অনুমোদন লাগবে।’
আমাদের কথা হলো, ভিন্ন ধরনের অনুমোদন আমরা আইনে দেখি না। বিধিতে পাই না। তদুপরি যদি একটির পরিবর্তে দুটি লাগেই, তাহলেও লিভ মঞ্জুর সমীচীন। কারণ, আপিল বিভাগ সর্বোচ্চ আদালত। তাঁদের পক্ষে আইনের ব্যাখ্যা শুধু নয়, শূন্যতা বা দ্ব্যর্থকতা থাকলে তাও পূরণ করা সম্ভব। দুদকের মামলা দায়েরই যদি অবৈধ হয়, তাহলে দুদক আর কেন মামলা দায়ের করবে। কেন মামলা চালাবে। তাদের কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রাখা উচিত কি না, তা বিবেচনার দাবি রাখে।
আইন শোধরানোর দরকার পড়লে সে কথা বলারও এখতিয়ার আপিল বিভাগ রাখেন। রায়ের সঙ্গে রায়ের একটা সাংঘর্ষিক অবস্থা আমরা দেখি। আমরা দেখি নখদন্তহীন দুদকের প্রাণ ওষ্ঠাগত। তাদের অস্তিত্ব-সংকট। একটা নৈরাজ্য।
দুদক এখন রিভিউ পিটিশন দাখিল করতে পারে। আপিল বিভাগ অন্তত অনুমোদন প্রশ্নে আইনি ব্যাখ্যা চূড়ান্তভাবে ফয়সালা দিতে পারেন। এর তো কোনো বিকল্প দেখি না। না হলে প্রধান বিচারপতিরই সম্ভবত উচিত হবে দুদকের মামলা শোনার বেঞ্চগুলো ভেঙে দেওয়া। ২০০৭ সালের পর দায়ের করা দুদকের মামলা যেখানে যেটি যে অবস্থায় আছে, সেগুলো তো এখন বেআইনি হয়ে পড়েছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.