ঢাকার ত্রি-মহাদেশীয় সম্মেলন-যুদ্ধাপরাধের বিচার-প্রক্রিয়া কেন বিলম্বিত হচ্ছে by শাহরিয়ার কবির
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার জাতীয় সংসদে তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি আসনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় গিয়ে নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী যখন থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলছে—যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান দল জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। প্রথমে জামায়াতপ্রধান নিজামী নরম গলায় বলেছিলেন
বটে—সরকার যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে, জামায়াত মহাজোট সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করবে। কিন্তু প্রবল জনমতের কারণে সরকারকে এই বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয়েছে। দেরিতে হলেও ২০১০-এর ২৫ মার্চ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার কর্তৃক প্রণীত ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩’ অনুযায়ী ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ গঠিত হয়েছে। এর পাশাপাশি বিচার বিঘ্নিত করার জন্য জামায়াত দেশে ও বিদেশে বহুমাত্রিক তৎপরতা আরম্ভ করেছে।
১৯৭৩-এর আইনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের জন্য বহির্বিশ্বে জামায়াত যে অপতৎপরতা চালাচ্ছে তার প্রতি পাকিস্তান ও সৌদি আরবের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন রয়েছে। বিদেশে তারা কিছু প্রতিষ্ঠান গঠন করেছে (যেমন ‘জাস্টিস কনসার্ন’) এবং কিছু আন্তর্জাতিক সংগঠন ভাড়া করেছে (যেমন ‘ইন্টারন্যাশনাল বার অ্যাসোসিয়েশন’ বা আইবিএ) ’৭৩-এর আইনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া ব্যাহত করার জন্য। সমপ্রতি তারা লন্ডনে ‘হাউস অব লর্ডস’-এ একটি সেমিনার করে আইবিএর ‘১৭ দফা সুপারিশ’ অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে। লন্ডনের পত্রিকায় বেরিয়েছে, দুই মাস আগে জামায়াত লন্ডনে ‘জাস্টিস কনসার্ন’ গঠন করেছে। ‘আইবিএ’র সঙ্গে যুক্ত রয়েছে দুই শীর্ষ জামায়াতনেতার পুত্র ও জামাতা।
দেশের ভেতরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য জামায়াত ২৭ জুন বিএনপির হরতালকে কেন্দ্র করে যে সুদূরপ্রসারী নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের চক্রান্ত করেছিল—দলের তিন শীর্ষনেতা গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদ থেকে থলের বুনো বেড়ালগুলো এক এক করে বেরোচ্ছে। জামায়াত আরও অনেক কিছু করবে এবং এটাই স্বাভাবিক। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতিপক্ষের পূর্বাপর প্রতিক্রিয়া বিবেচনা না করেই কি সরকার ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মতো বিশাল একটি কর্মযজ্ঞ আরম্ভ করেছে? আমরা দেড় বছর ধরে দেশে ও বিদেশে জামায়াতের এসব তৎপরতা সম্পর্কে লিখছি। আইবিএর কথিত ১৭ দফা সুপারিশ নিয়ে পাঁচ মাস ধরে লিখছি, বিভিন্ন সেমিনারে বলছি, সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এসব বিবেচনায় আনার প্রয়োজন বোধ করেননি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সাড়ে তিন মাস আগে যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে, এখনো তা লোকবল ও অন্যান্য রসদের অভাবে ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না। বারবার বলা সত্ত্বেও কেন পর্যাপ্তসংখ্যক আইনজীবী ও তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না, কেন বরাদ্দকৃত অর্থ ট্রাইব্যুনালকে দেওয়া হচ্ছে না, কেন ট্রাইব্যুনালের জন্য বরাদ্দকৃত ভবন থেকে আইন কমিশনের দপ্তর অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে আইনজীবী ও তদন্ত কর্মকর্তাদের বসার জায়গার ব্যবস্থা হচ্ছে না, কেন বিচারিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত মন্ত্রণালয়গুলোর কাজের কোনো সমন্বয় হচ্ছে না—এসবের উত্তর আমাদের জানা নেই। আমরা শুধু জানি, এ কাজগুলো সরকার করবে, বিরোধী দল নয়। ট্রাইব্যুনালের কাজ নির্বিঘ্ন না করে বিচার বানচালের জন্য ক্রমাগত বিরোধী দলকে দায়ী করার সরকারি মনোভাব আমজনতাকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না।
গত ২০ জুন ঢাকায় ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’, ‘মৌলবাদ ও সামপ্রদায়িকতাবিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলন’ এবং ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্র’-এর উদ্যোগে যে ‘ত্রি-মহাদেশীয় সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হলো, সেখানে অন্যতম আলোচ্য বিষয় ছিল একাত্তরের গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার ১১টি দেশ থেকে ৪০ জন প্রতিনিধি ও পর্যবেক্ষক এসেছিলেন এই সম্মেলনে অংশ নেওয়ার জন্য। সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজকেরা ১৫০ পৃষ্ঠার স্মরণিকা এবং প্রায় ৩০০ পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন, যেখানে বাংলাদেশসহ সম্মেলনে অংশ নেওয়া দেশসমূহের ৩৫ জন বিশেষজ্ঞ এ বিষয়গুলো নিয়ে লিখেছেন এবং সম্মেলনের কর্ম অধিবেশনে আলোচনাও করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিঘ্নিত করার জন্য জামায়াতের শিখণ্ডীরা যেসব প্রশ্ন তুলে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, তার জবাব দেওয়া হয়েছে সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশিত ‘জেনোসাইড, ওয়ার ক্রাইমস অ্যান্ড ক্রাইমস এগেইনস্ট হিউম্যানিটি ইন বাংলাদেশ: ট্রায়াল আন্ডার ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট নাইনটিন সেভেনটি থ্রি’ গ্রন্থে। এই গ্রন্থে বাংলাদেশের আটজন প্রবীণ ও নবীন আইনজ্ঞ ১৯৭৩-এর আইনে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যৌক্তিকতা উত্থাপন করে আইবিএর কথিত ১৭ দফা সুপারিশের জবাব দিয়েছেন। গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন নির্মূল কমিটির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার তুরীন আফরোজ।
‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’সহ ‘আইবিএ’র কিছু সুপারিশ সম্মেলনে আলোচিত হয়েছে। এর একটি হচ্ছে অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড-সংক্রান্ত। ইউরোপ মৃত্যুদণ্ড রহিত করেছে বটে তবে ইউরোপের বাইরে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া ছাড়া পৃথিবীর তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রেও এখন পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ড রহিত হয়নি। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় মৃত্যুদণ্ড থাকবে অথচ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড দিতে পারবে না, এ প্রস্তাব কখনো মেনে নেওয়া যায় না। ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে যখন বিচারের প্রহসন করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ বা ‘আইবিএ’ তা বন্ধ করতে পারেনি। ’৭১-এ বাংলাদেশের গণহত্যার কোনো নিন্দা এসব সংগঠন করেছিল কি না আমাদের জানা নেই।
বাংলাদেশে গণহত্যাকারী, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করে কানাডার বিশিষ্ট মানবাধিকার নেতা, উত্তর আমেরিকার জুরিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রধান অ্যাটর্নি উইলিয়াম স্লোন সম্মেলনে বলেছেন, তিনি বা তাঁর দেশ মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে নয়, কিন্তু বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল যদি কাউকে গণহত্যার জন্য মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেই অপরাধীও কারাগার থেকে বেরিয়ে আসবে, অতীতে এমনটি ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয়ও আলোচিত হয়েছে। সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের সার্বভৌম সত্তা এবং নিজস্ব আইনের ধারাবাহিকতা। যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার বিরোধিতা করার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশের সার্বভৌম সত্তাকে অশ্রদ্ধা করা। একইভাবে ’৭৩-এর আইনের অন্যান্য সমালোচনারও কঠিন জবাব দেওয়া হয়েছে, যা সম্মেলনে উপস্থিত পাকিস্তানের আইনজীবী ও মানবাধিকার নেতারা শুধু সমর্থন করেননি, বলেছেন, দেশে ফিরে গিয়ে এই বিচারের পক্ষে জনমত সংগঠনে তাঁরা সাহায্য করবেন। ২০ জুনের সম্মেলনের সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে এটি। ৭১ সদস্যবিশিষ্ট ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ঢাকা সহায়ক মঞ্চ’-এর দুজন সদস্য হচ্ছেন পাকিস্তানের মানবাধিকার নেতা কবি ও সাংবাদিক আহমদ সালিম ও ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর সিভিল লিবার্টিজ’-এর মহাসচিব অ্যাডভোকেট জাফর মালিক।
বিদেশে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে এবং এই বিচারকে উপলক্ষ করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার চলছে, তা কূটনৈতিকভাবে মোকাবিলা করা হচ্ছে না। গত দেড় বছরে ইউরোপ ও আমেরিকায় দেড় ডজনেরও বেশি আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও সেমিনারে অংশ নিতে গিয়ে লক্ষ করেছি, এসব বিষয়ে আমাদের দূতাবাসগুলোর স্পষ্ট কোনো ধারণা বা প্রস্তুতি নেই। গত ২৩ জুন ‘হাউস অব লর্ডস’-এ ‘জাস্টিস কনসার্ন’-এর নামে আয়োজিত সেমিনারে জামায়াত-বিএনপির আইনজীবীরা বাংলাদেশকে তুলোধুনো করেছেন, আমাদের রাষ্ট্রদূত সেখানে না গিয়ে সরকারের একটি নোট পাঠিয়েছেন। লন্ডনে আওয়ামী লীগের আইনজীবীরা এই সেমিনার বয়কট করেছেন। অথচ লর্ড এভবরিকে সামনে রেখে বিএনপি-জামায়াত এবং আইবিএর কর্মকর্তারা যেসব প্রশ্ন তুলেছেন, ’৭৩-এর আইনের যে সমালোচনা করেছেন, তার দাঁতভাঙা জবাব নির্মূল কমিটির একাধিক প্রকাশনায় রয়েছে, যেগুলো বিভিন্ন সময়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের দেওয়াও হয়েছে।
২০ জুন ঢাকায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল সরকারের এসব অপূর্ণতা দূর করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে এবং জঙ্গি মৌলবাদের বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদীদের একটি আন্তর্জাতিক মঞ্চ গঠনের বিষয়ে আলোচনা এবং প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা, যা সম্মেলনে গৃহীত ১০টি প্রস্তাব এবং নয় দফা ঢাকা ঘোষণায় মূর্ত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৬ জুন গঠিত হয়েছে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ঢাকা সহায়ক মঞ্চ।’ ২০ জুনের সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী ১১টি দেশের এবং যাঁরা আমন্ত্রিত হয়েও বিভিন্ন কারণে অংশ নিতে পারেননি সেই সব দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী, আইনপ্রণেতা ও মানবাধিকার আন্দোলনের নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত এই মঞ্চ আমাদের ট্রাইব্যুনালকে প্রয়োজনে আইনি সহযোগিতার পাশাপাশি ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনমত সৃষ্টি করতে সহায়তা করবেন।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের জন্য দেশের ভেতরে যেসব চক্রান্ত হচ্ছে তা সরকারকে মোকাবিলা করতে হবে রাজনৈতিকভাবে এবং বিদেশে যেসব অপতৎপরতা চলছে তা প্রতিহত করতে হবে কূটনৈতিকভাবে। এ কথা আমি বহুবার বলেছি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সরকারের আন্তরিকতার অভাব না থাকলেও বিচারের গুরুত্ব ও ধরন সম্পর্কে নীতিনির্ধারকদের স্বচ্ছ কোনো ধারণাও নেই। সরকারকে মনে রাখতে হবে, এ বিচার আওয়ামী লীগ করছে না, রাষ্ট্র করছে। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে সমগ্র জাতির প্রত্যাশা এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। বিচার বানচালের জন্য যা কিছু করা সম্ভব, জামায়াত তা করছে এবং করবে। যথাসময়ে সুষ্ঠুভাবে বিচার সম্পন্ন করার যাবতীয় কাজ সরকারকে এখনই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে করতে হবে
গোটা জাতিকে সঙ্গে নিয়ে; বিচ্ছিন্ন, অদক্ষ বা বিভ্রান্তভাবে নয়।
শাহরিয়ার কবির: সাংবাদিক। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কার্যনির্বাহী সভাপতি।
১৯৭৩-এর আইনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের জন্য বহির্বিশ্বে জামায়াত যে অপতৎপরতা চালাচ্ছে তার প্রতি পাকিস্তান ও সৌদি আরবের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন রয়েছে। বিদেশে তারা কিছু প্রতিষ্ঠান গঠন করেছে (যেমন ‘জাস্টিস কনসার্ন’) এবং কিছু আন্তর্জাতিক সংগঠন ভাড়া করেছে (যেমন ‘ইন্টারন্যাশনাল বার অ্যাসোসিয়েশন’ বা আইবিএ) ’৭৩-এর আইনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া ব্যাহত করার জন্য। সমপ্রতি তারা লন্ডনে ‘হাউস অব লর্ডস’-এ একটি সেমিনার করে আইবিএর ‘১৭ দফা সুপারিশ’ অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে। লন্ডনের পত্রিকায় বেরিয়েছে, দুই মাস আগে জামায়াত লন্ডনে ‘জাস্টিস কনসার্ন’ গঠন করেছে। ‘আইবিএ’র সঙ্গে যুক্ত রয়েছে দুই শীর্ষ জামায়াতনেতার পুত্র ও জামাতা।
দেশের ভেতরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য জামায়াত ২৭ জুন বিএনপির হরতালকে কেন্দ্র করে যে সুদূরপ্রসারী নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের চক্রান্ত করেছিল—দলের তিন শীর্ষনেতা গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদ থেকে থলের বুনো বেড়ালগুলো এক এক করে বেরোচ্ছে। জামায়াত আরও অনেক কিছু করবে এবং এটাই স্বাভাবিক। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতিপক্ষের পূর্বাপর প্রতিক্রিয়া বিবেচনা না করেই কি সরকার ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মতো বিশাল একটি কর্মযজ্ঞ আরম্ভ করেছে? আমরা দেড় বছর ধরে দেশে ও বিদেশে জামায়াতের এসব তৎপরতা সম্পর্কে লিখছি। আইবিএর কথিত ১৭ দফা সুপারিশ নিয়ে পাঁচ মাস ধরে লিখছি, বিভিন্ন সেমিনারে বলছি, সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এসব বিবেচনায় আনার প্রয়োজন বোধ করেননি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সাড়ে তিন মাস আগে যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে, এখনো তা লোকবল ও অন্যান্য রসদের অভাবে ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না। বারবার বলা সত্ত্বেও কেন পর্যাপ্তসংখ্যক আইনজীবী ও তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না, কেন বরাদ্দকৃত অর্থ ট্রাইব্যুনালকে দেওয়া হচ্ছে না, কেন ট্রাইব্যুনালের জন্য বরাদ্দকৃত ভবন থেকে আইন কমিশনের দপ্তর অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে আইনজীবী ও তদন্ত কর্মকর্তাদের বসার জায়গার ব্যবস্থা হচ্ছে না, কেন বিচারিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত মন্ত্রণালয়গুলোর কাজের কোনো সমন্বয় হচ্ছে না—এসবের উত্তর আমাদের জানা নেই। আমরা শুধু জানি, এ কাজগুলো সরকার করবে, বিরোধী দল নয়। ট্রাইব্যুনালের কাজ নির্বিঘ্ন না করে বিচার বানচালের জন্য ক্রমাগত বিরোধী দলকে দায়ী করার সরকারি মনোভাব আমজনতাকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না।
গত ২০ জুন ঢাকায় ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’, ‘মৌলবাদ ও সামপ্রদায়িকতাবিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলন’ এবং ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্র’-এর উদ্যোগে যে ‘ত্রি-মহাদেশীয় সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হলো, সেখানে অন্যতম আলোচ্য বিষয় ছিল একাত্তরের গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার ১১টি দেশ থেকে ৪০ জন প্রতিনিধি ও পর্যবেক্ষক এসেছিলেন এই সম্মেলনে অংশ নেওয়ার জন্য। সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজকেরা ১৫০ পৃষ্ঠার স্মরণিকা এবং প্রায় ৩০০ পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন, যেখানে বাংলাদেশসহ সম্মেলনে অংশ নেওয়া দেশসমূহের ৩৫ জন বিশেষজ্ঞ এ বিষয়গুলো নিয়ে লিখেছেন এবং সম্মেলনের কর্ম অধিবেশনে আলোচনাও করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিঘ্নিত করার জন্য জামায়াতের শিখণ্ডীরা যেসব প্রশ্ন তুলে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, তার জবাব দেওয়া হয়েছে সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশিত ‘জেনোসাইড, ওয়ার ক্রাইমস অ্যান্ড ক্রাইমস এগেইনস্ট হিউম্যানিটি ইন বাংলাদেশ: ট্রায়াল আন্ডার ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট নাইনটিন সেভেনটি থ্রি’ গ্রন্থে। এই গ্রন্থে বাংলাদেশের আটজন প্রবীণ ও নবীন আইনজ্ঞ ১৯৭৩-এর আইনে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যৌক্তিকতা উত্থাপন করে আইবিএর কথিত ১৭ দফা সুপারিশের জবাব দিয়েছেন। গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন নির্মূল কমিটির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার তুরীন আফরোজ।
‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’সহ ‘আইবিএ’র কিছু সুপারিশ সম্মেলনে আলোচিত হয়েছে। এর একটি হচ্ছে অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড-সংক্রান্ত। ইউরোপ মৃত্যুদণ্ড রহিত করেছে বটে তবে ইউরোপের বাইরে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া ছাড়া পৃথিবীর তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রেও এখন পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ড রহিত হয়নি। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় মৃত্যুদণ্ড থাকবে অথচ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড দিতে পারবে না, এ প্রস্তাব কখনো মেনে নেওয়া যায় না। ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে যখন বিচারের প্রহসন করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ বা ‘আইবিএ’ তা বন্ধ করতে পারেনি। ’৭১-এ বাংলাদেশের গণহত্যার কোনো নিন্দা এসব সংগঠন করেছিল কি না আমাদের জানা নেই।
বাংলাদেশে গণহত্যাকারী, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করে কানাডার বিশিষ্ট মানবাধিকার নেতা, উত্তর আমেরিকার জুরিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রধান অ্যাটর্নি উইলিয়াম স্লোন সম্মেলনে বলেছেন, তিনি বা তাঁর দেশ মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে নয়, কিন্তু বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল যদি কাউকে গণহত্যার জন্য মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেই অপরাধীও কারাগার থেকে বেরিয়ে আসবে, অতীতে এমনটি ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয়ও আলোচিত হয়েছে। সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের সার্বভৌম সত্তা এবং নিজস্ব আইনের ধারাবাহিকতা। যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার বিরোধিতা করার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশের সার্বভৌম সত্তাকে অশ্রদ্ধা করা। একইভাবে ’৭৩-এর আইনের অন্যান্য সমালোচনারও কঠিন জবাব দেওয়া হয়েছে, যা সম্মেলনে উপস্থিত পাকিস্তানের আইনজীবী ও মানবাধিকার নেতারা শুধু সমর্থন করেননি, বলেছেন, দেশে ফিরে গিয়ে এই বিচারের পক্ষে জনমত সংগঠনে তাঁরা সাহায্য করবেন। ২০ জুনের সম্মেলনের সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে এটি। ৭১ সদস্যবিশিষ্ট ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ঢাকা সহায়ক মঞ্চ’-এর দুজন সদস্য হচ্ছেন পাকিস্তানের মানবাধিকার নেতা কবি ও সাংবাদিক আহমদ সালিম ও ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর সিভিল লিবার্টিজ’-এর মহাসচিব অ্যাডভোকেট জাফর মালিক।
বিদেশে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে এবং এই বিচারকে উপলক্ষ করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার চলছে, তা কূটনৈতিকভাবে মোকাবিলা করা হচ্ছে না। গত দেড় বছরে ইউরোপ ও আমেরিকায় দেড় ডজনেরও বেশি আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও সেমিনারে অংশ নিতে গিয়ে লক্ষ করেছি, এসব বিষয়ে আমাদের দূতাবাসগুলোর স্পষ্ট কোনো ধারণা বা প্রস্তুতি নেই। গত ২৩ জুন ‘হাউস অব লর্ডস’-এ ‘জাস্টিস কনসার্ন’-এর নামে আয়োজিত সেমিনারে জামায়াত-বিএনপির আইনজীবীরা বাংলাদেশকে তুলোধুনো করেছেন, আমাদের রাষ্ট্রদূত সেখানে না গিয়ে সরকারের একটি নোট পাঠিয়েছেন। লন্ডনে আওয়ামী লীগের আইনজীবীরা এই সেমিনার বয়কট করেছেন। অথচ লর্ড এভবরিকে সামনে রেখে বিএনপি-জামায়াত এবং আইবিএর কর্মকর্তারা যেসব প্রশ্ন তুলেছেন, ’৭৩-এর আইনের যে সমালোচনা করেছেন, তার দাঁতভাঙা জবাব নির্মূল কমিটির একাধিক প্রকাশনায় রয়েছে, যেগুলো বিভিন্ন সময়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের দেওয়াও হয়েছে।
২০ জুন ঢাকায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল সরকারের এসব অপূর্ণতা দূর করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে এবং জঙ্গি মৌলবাদের বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদীদের একটি আন্তর্জাতিক মঞ্চ গঠনের বিষয়ে আলোচনা এবং প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা, যা সম্মেলনে গৃহীত ১০টি প্রস্তাব এবং নয় দফা ঢাকা ঘোষণায় মূর্ত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৬ জুন গঠিত হয়েছে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ঢাকা সহায়ক মঞ্চ।’ ২০ জুনের সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী ১১টি দেশের এবং যাঁরা আমন্ত্রিত হয়েও বিভিন্ন কারণে অংশ নিতে পারেননি সেই সব দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী, আইনপ্রণেতা ও মানবাধিকার আন্দোলনের নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত এই মঞ্চ আমাদের ট্রাইব্যুনালকে প্রয়োজনে আইনি সহযোগিতার পাশাপাশি ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনমত সৃষ্টি করতে সহায়তা করবেন।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের জন্য দেশের ভেতরে যেসব চক্রান্ত হচ্ছে তা সরকারকে মোকাবিলা করতে হবে রাজনৈতিকভাবে এবং বিদেশে যেসব অপতৎপরতা চলছে তা প্রতিহত করতে হবে কূটনৈতিকভাবে। এ কথা আমি বহুবার বলেছি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সরকারের আন্তরিকতার অভাব না থাকলেও বিচারের গুরুত্ব ও ধরন সম্পর্কে নীতিনির্ধারকদের স্বচ্ছ কোনো ধারণাও নেই। সরকারকে মনে রাখতে হবে, এ বিচার আওয়ামী লীগ করছে না, রাষ্ট্র করছে। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে সমগ্র জাতির প্রত্যাশা এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। বিচার বানচালের জন্য যা কিছু করা সম্ভব, জামায়াত তা করছে এবং করবে। যথাসময়ে সুষ্ঠুভাবে বিচার সম্পন্ন করার যাবতীয় কাজ সরকারকে এখনই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে করতে হবে
গোটা জাতিকে সঙ্গে নিয়ে; বিচ্ছিন্ন, অদক্ষ বা বিভ্রান্তভাবে নয়।
শাহরিয়ার কবির: সাংবাদিক। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কার্যনির্বাহী সভাপতি।
No comments