চারদিক-সোনাঝরায় আসে সোনাঝরা দিন by লায়লা নূর

...তারপর একদিন নেমে এল সোনার বৃষ্টি। ঝরঝর করে সোনারঙা জলের কুচি ঝরল আকাশ থেকে। সেই জলে স্নান করল সবাই। আর এ গ্রামের নাম হয়ে গেল ‘সোনাঝরা’। শিশুরা এ গল্প শোনে কি শোনে না। তবে ওরা প্রতিদিনই জলের ঝরঝর শব্দ তোলে। পাতাল থেকে তোলা বিশুদ্ধ রুপালি জল ট্যাপের ঝরনায় বইয়ে ওরা স্নান করে।


পরিচ্ছন্নতা আর সুস্থতার আনন্দে উজ্জ্বল থাকে।
গ্রামটির নাম সোনাঝরা। বগুড়ার শেরপুর পৌরসভার গ্রাম এটি। ভৌগোলিক অবস্থান ও জীবনযাত্রার বৈশিষ্ট্যে সোনাঝরা গ্রাম ও শহরের মিশেল। একদিকে তার পুকুর-জমি, ফুল-ফল, গাছগাছালিভরা শান্ত-সবুজ গ্রামীণ প্রকৃতি। অন্যদিকে তার অধিবাসীরা পাচ্ছে শহরবাসীদের মতো ট্যাপের জলে স্নান, ধোয়া-মোছা-পরিচ্ছন্ন থাকার স্বাচ্ছন্দ্য। দুই বছর হলো এখানে সারা সময় সব কাজে বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করা হয়। তাই তো এখানে বোশেখের খইফোটা গরমেও ঘরের চালের ওপর ডাল-পাতা মেলে শান্তি ছড়ায় ফল-সবজির গাছ। পানিতে ভেজা থাকে তুলসীবেদি। গৃহস্থালি কাজের শব্দ ছাপিয়ে ট্যাপের জলের কলকল ধ্বনি শোনা যায় অহরহ।
‘তিন-চার বছর আগেও জল জোটাতে সারা দিন লেগে যেত। চাপকল চেপে সব কাজের জল তুলতাম। চৈত্র-বৈশাখ মাসে জলের কষ্ট ছিল খুব বেশি। এখন আর সেই সমস্যা নেই। আমাদের এখন ট্যাপের জল আসে। এই জল আমাদের জন্য সুদিন এনেছে।’ বলছিলেন সোনাঝরার গৃহবধূ কাজলী সরকার (৩৫)।
সোনাঝরায় বিশুদ্ধ জলের এই সুদিন এনেছে বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (আরডিএ) সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রের (সিআইডব্লিউএম) ‘সোনাঝরা পিএপি উপপ্রকল্প’। গভীর নলকূপের পানির এ প্রকল্পটি সরকারের অর্থ সহায়তায় ব্যক্তি উদ্যোগে পরিচালিত। এ প্রকল্পের পানি দিয়ে শেরপুর পৌরসভার প্রায় শতভাগ পরিবার দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি বাগান-নার্সারি, জমি চাষসহ হাঁস-মুরগি, গরুর খামার ও মাছ চাষ করছেন বলে জানান প্রকল্প পরিচালক হাজি মো. ইছহাক আলী।
‘বিশুদ্ধ পানি পেয়ে মানুষের কাজের আগ্রহও বেড়ে গেছে। সবাই আয়মূলক কাজ করছে। আর পানির দামও কম। পৌর এলাকায় প্রতি পরিবারে গৃহস্থালি পানির মূল্য প্রতিমাসে ১০০ টাকা আর সেচের পানি বিঘাপ্রতি ১৫০০ টাকা, জানালেন তিনি।
সোনাঝরা প্রকল্পের একপাশে বাড়িঘর, তিনদিকে ধানি জমি। মাঝখানে ঘাসভরা উঠোনের অনেক উঁচুতে পানির ট্যাঙ্ক। বৈশাখ মাসেও পুকুরভরা পানিতে মাছের চাষ হচ্ছে। হাঁস চড়ে বেড়াচ্ছে। আশপাশে গরুর খামার, নার্সারি, ভুট্টা খেত। বাড়িতে কলপাড়ে ঝরনা। প্রতিটি বাড়ি পরিচ্ছন্ন। দেয়ালে ফুলগাছ। গাছে অগুনতি ফুল ফুটে আছে।
কথা হয় প্রকল্পের পানি ব্যবহারকারী কয়েকজন নারীর সঙ্গে। বেশ ভালো আছেন বলে জানান তাঁরা। এখন তাঁদের নলকূপ চাপার খাটুনি নেই। সংসারের কাজ সেরে হাতে অনেক সময় পান। সে সময়টা তাঁরা আয়ের কাজ করেন। প্রকল্পের সুফলভোগীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং স্বল্প সুদে ঋণ-সহযোগিতা দেয় আরডিএ।
‘ঋণের টাকা আমরা ক্ষুদ্র ব্যবসায় খাটাই। কেউ কেউ কৃষিকাজ করে। আমি ভুট্টা চাষ করছি’, বললেন সোনাঝরা পিএপি উপপ্রকল্প সমিতির সদস্য গোলাপী রানী দাস (৩৭)।
‘ট্যাপ খুললে অনায়াসে পানি আসে। টলটলে পানিতে গোসল করে বাচ্চারা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে। এ পানিতে আর্সেনিক নেই। এখন আমাদের খুজলি-পাঁচড়া, পেটের অসুখ, আমাশয় হয় না বললেই চলে। আমি গাভি পালন করি। খামারের ধোয়া-মোছা বিশুদ্ধ পানিতে হয়। আমাদের চাষ করা ধান, সবজি, ফল, দুধে আর্সেনিকের ভয় নেই।’ বললেন মাঝবয়সী আনোয়ারা বেগম।
‘এখন গোসলের জন্য নদীতে যেতে হয় না। ট্যাপের ঝরনায় গোসল করি। খুব আনন্দ লাগে।’ বলল কিশোরী আনিকা আক্তার আঁখি।
আরডিএর বগুড়ার উপপরিচালক প্রকৌশলী মো. নজরুল ইসলাম খান জানালেন, ‘২০০৬ সাল থেকে মার্চ ২০১০ পর্যন্ত আরডিএ বগুড়ার আরও ১৬টি গ্রামে এ রকম বিশুদ্ধ পানির প্লান্ট স্থাপন করেছে। সারা দেশে এমন আরও ১৫০টি প্লান্টের কাজ চলছে। গ্রামে স্বল্পমূল্যে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হয়। পরিবারপ্রতি মাসে পানির দাম দিতে হয় মাত্র ৩০ টাকা।’
আরডিএর সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রের (সিআইডব্লিউএম) পরিচালক এম এ মতিন বললেন, ‘আমরা গবেষণা করে দেখেছি, বিশুদ্ধ পানির বহুমুখী ব্যবহার মানুষের সময় ও শ্রম সাশ্রয় করে। বেঁচে যাওয়া সময় ও শ্রম আয়মূলক কাজে খাটিয়ে মানুষ দারিদ্র্য দূর করে জীবনমান উন্নত করতে পারে। এ ব্যাপারে আরডিএ উপকারভোগীদের ব্যবস্থাপনা, পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ সহায়তা দেয়।’
বিশুদ্ধ পানি সোনাঝরা গ্রামের কাজলীদের পানির দুর্ভোগ ও রোগবালাই কমাচ্ছে, তাঁদের জীবনে স্বস্তি আনছে, আয়ের পথও দেখাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের হাজারো গ্রামের লাখো কাজলী জীবনের ‘মৌলিক প্রয়োজন’ পানি নিয়ে প্রতিনিয়ত লড়াই করছেন।
বাংলাদেশে পানির উৎস প্রচুর আছে। কিন্তু তার পরও এখানে বিশুদ্ধ পানির সমস্যা বেশ তীব্র। আমাদের নদী-পুকুরের পানি দূষিত ও জীবাণুযুক্ত। প্রতিবছর এ দেশের অনেক মানুষ পানিবাহিত রোগে মারা যায়। গ্রামাঞ্চলে পানির প্রধান উৎস নলকূপ। এ পানি জীবাণুমুক্ত হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আর্সেনিক বিষযুক্ত। বাংলাদেশের ৬১টি জেলার অধিকাংশ নলকূপই আর্সেনিকদুষ্ট।
গভীর নলকূপের পানি হতে পারে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বিশুদ্ধ পানির বিকল্প উৎস। কিন্তু সারা দেশে এ জল পৌঁছাবে কি? এ প্রসঙ্গে কাজলীর একটি দুর্ভাবনার কথা মনে পড়ে, ‘জল পেয়ে ভালো আছি। তবে মাঝেমাঝে ভাবনাও হয়। মেয়ে বড় হলে যে গ্রামে বা শহরে ওর বিয়ে হবে, সেখানে এমন বিশুদ্ধ জল মিলবে তো!’

No comments

Powered by Blogger.