গন্তব্য ঢাকা-আদর-আবদারের দিনগুলো by শর্মিলা সিনড্রেলা

‘নানা চকোলে (চকলেট) খাব। নানা বিস্কু (বিস্কুট) দাও।’ নানা গ্রামে গেলেই এমন আবদার করে ছোট্ট তুষি। নাতনির আবদারে ভরা মুখখানা দেখতে ১৫-২০ দিন পরপর বাড়ির পানে ছুটে যান আবদুল আওয়াল। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর থানার ইরতা গ্রামে তাঁর বাড়ি। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ধলেশ্বরী নদী।


একেক ঋতুতে ধলেশ্বরীর একেক রূপ-সৌন্দর্য। চির বহমান সেই ধলেশ্বরী তাঁর ঘরে ফেরার ব্যাকুলতা বাড়িয়ে দেয় বহু গুণে। মা নেই, বাবাও নেই গ্রামে। কিন্তু আছে মেয়ে, ভাই-ভাবি আর বোন। তাঁদের ছেড়ে বেশি দিন আবদুল আওয়াল থাকতে পারেন না এই ঢাকা শহরে, ছুটে যান ইরতায়।
মোহাম্মদপুরের কাজী নজরুল ইসলাম রোডের পশ্চিম দিকের দ্বিতীয় গলির মোড়েই চোখে পড়বে ছোট্ট একটা চায়ের দোকান। এখানেই ভোর সাড়ে ছয়টা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত বসে থাকেন আবদুল আওয়াল। তারপর খাওয়া ও নামাজ পড়ার জন্য দোকান বন্ধ রাখেন কিছুক্ষণ। বিকেলে আবার শুরু হয় তাঁর চা বেচা-কেনা। চারটা থেকে আবার চলে রাত ১০টা পর্যন্ত।
পড়ন্ত বিকেলে যখন আবদুল আওয়ালের সঙ্গে দেখা, তখন তাঁর ব্যস্ততা অনেক বেশি। চায়ের জলটা শেষ হয়ে গেছে এরই মধ্যে। চা-বিস্কুটের চাহিদা তারপরও কমেনি। চা খেতে খেতে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। বাবার নাম আবদুর রাশিদ খান, মা জোহরা বেগম। বাবা কাজ করতেন বার্মার (বর্তমানে মিয়ানমার) রেঙ্গুনে। ফলে স্বভাবতই দুই বা তিন বছর পরপর বাবার সঙ্গে দেখা হতো। বাবা আয় করতেন বেশ ভালোই, কিন্তু রেঙ্গুন থেকে সরকার টাকা পাঠাতে দিত না। তাই মায়ের কষ্ট হতো খুব বেশি। বাবা চিঠিতে মাকে বলতেন, ‘কষ্ট করে চালিয়ে নিয়ো।’ মা জোহরা বেগম দুই ছেলে, দুই মেয়েকে নিয়ে কষ্টেই পার করতেন তাঁর দিনগুলো। বাবা টাকা পাঠাতে পারতেন না বলে পড়াশোনাটাও শেষ পর্যন্ত চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি আওয়াল ও তাঁর ভাই-বোনদের পক্ষে।
এসএসসি পরীক্ষায় পাসের পর টাকার অভাবে আর কলেজে ভর্তি হওয়া হয়ে ওঠেনি আবদুল আওয়ালের। তারপর একসময় চলে আসেন ঢাকায় চাচাতো ভাই ইদ্রিস খানের কাছে। তাঁর বুক বাইন্ডিংয়ের দোকান ছিল। সেই শুরু তাঁর ঢাকায় থাকা। ‘তখন তো এই সব এলাকা জঙ্গল ছিল। আরে সে কি, একেবারে আফ্রিকার জঙ্গল। সেই অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে পরিবর্তন হয়ে আজকের এই ঢাকা। তখন আমার মুদির দোকান ছিল। সেই দোকান চালাতে গিয়ে একসময় লস খাইলাম। পরে বাড়ি চলে গেছি। আবার এসে শুরু করেছি এই চায়ের দোকান।’
প্রায় ৩৫ বছর হলো আবদুল আওয়াল ঢাকায় আছেন। কিন্তু গ্রামের আকাশ-বাতাস, নদী-নালা তাঁকে এখনো ঠিক আগের মতোই টানে। গ্রীষ্মে নদীটি শুকিয়ে যেতো। বর্ষা এলেই থই থই জলের কলরব বাড়ত। ফেলে আসা দিনগুলো মনে করার চেষ্টা করেন আবদুল আওয়াল, ‘ধলেশ্বরী নিয়ে কত স্মৃতি আমাদের আছে। এই নদীতে আমি, আমার বন্ধু লিয়াকত, নজরুল অনেক আনন্দ করতাম। আমরা যখন তখন নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। সাঁতার কাটতাম। জাল ফেলে মাছ ধরতাম।’ শুধু নদী নয়, বন্ধুদের সঙ্গে তরুণ আওয়ালের দুরন্তপনা ছিল সবখানেই। তিনি বলছিলেন, ‘গাছে গাছে দৌড়ে বেড়াতাম। কতবার যে অন্যের গাছের আম চুরি করে পেড়ে এনে ভর্তা করে খেয়েছি। অনেক সময় তো গাছের মালিকের দৌড়ানিও খেয়েছি।’
আবদুল আওয়াল ১৯৭৮ সালে বিয়ে করেন। স্ত্রী সখিনা বেগম। দুই মেয়ে, এক ছেলে তাঁদের সংসারে। বড় মেয়ে সুমির বিয়ে হয়েছে মানিকগঞ্জে, আর ছোট মেয়ে টুম্পার বিয়ে হয়েছে বরিশালের ভোলায়। একমাত্র ছেলে শাহীন। ছেলেটা এখানে একটা হুন্ডা গ্যারেজের দেখাশোনা করে। সে-ই সংসারটা চালায়। আর এই চায়ের দোকান থেকে দিন শেষে আয় হয় ১০০ থেকে ১২০ টাকা।
১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ, তখন আবদুল আওয়াল ছিলেন করাচিতে। তিনি বলেন, ‘বড় ভাই আবদুল হক খান সেখানে প্রেসে কাজ করতেন। তখন খুব ভয়ে থাকতাম। খুব সাবধানে রাস্তায় বের হতাম। পরে রেডক্রসের মাধ্যমে বিমানে করে চলে আসি দেশে।’
সকাল-সন্ধ্যা তাঁর ঢাকাতেই কাটে। তবু মন তাঁর পড়ে থাকে সেই সোঁদা মাটির গ্রাম ইরতাতেই। ঢাকা আর গ্রামের পার্থক্য প্রতিনিয়তই প্রকট হয় তাঁর মনে। ‘গ্রামের পরিবেশ আর এই শহরের পরিবেশে আকাশ-পাতাল ফারাক।’ গ্রামে একটা বসতবাড়ি ছাড়া আর কিছু নেই তাঁর। তবু গ্রামেই ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। ‘যদি গ্রামে কখনো একটা মুদির দোকান দিতে পারি, তবে আর থাকব না এখানে।’ সবুজ গ্রামে ফেরার এই বাসনা পূর্ণ করতে তিনি আবার মন দেন কাজে। যদি কিছু টাকা হয়, যদি গ্রামে একটা মুদির দোকান দেওয়া যায়। তাহলে হয়তো কংক্রিটের এই ঢাকায় আর থাকতে হবে না আবদুল আওয়ালকে।

No comments

Powered by Blogger.