অভিবাসী-ইউরোপে বর্ণবাদ ও অর্থনৈতিক মন্দা by জয়তি ঘোষ
ইউরোপের চলতি অর্থনৈতিক মন্দার নানা অনাকাঙ্ক্ষিত অভিঘাতের ভেতর বর্ণবাদী ও বিদেশি-বিদ্বেষী মনোভাবের প্রত্যাবর্তন অপেক্ষাকৃত কম মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। এই বিষয়টি ইতিমধ্যে সমস্যা হয়ে আবির্ভূত হয়েছে। বিশেষত পশ্চিম ইউরোপে গত দশকে যখন ডানপন্থী রাজনৈতিক শক্তিগুলো অভিবাসনের ওপর বড় ধরনের বিধিনিষেধ
আরোপের দাবি জানায় এবং অভিবাসী ও দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত রোমা জনগোষ্ঠীর মানুষদের বিরুদ্ধে বিক্ষিপ্তভাবে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে, তখন একে সমস্যা হিসেবে না দেখে উপায় নেই।
অর্থনৈতিক সংকট যত গভীরে আঘাত হানছে আর সরকারের কৃচ্ছ্র পদক্ষেপের ফলে আরও বেকারত্ব বেড়ে চলেছে, ক্ষুদ্র পরিবারচালিত ব্যবসা ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে, অনিবার্যভাবে ততই জনমনে তিক্ততা ও রোষ বাড়ছে এবং ভবিষ্যতেও বাড়বে। বিপদ হলো এই রোষ ক্ষমতাধর আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দিকে চালিত হবে না। এমনকি যেসব সরকার বাজারের হুকুম অত্যন্ত নমনীয় হয়ে তালিম করে গেছে, তাদের বিরুদ্ধেও যাবে না। বরং সহজে আক্রমণ করা যায় এমন নাজুক লক্ষ্যবস্তুর ওপরই আঘাত আসবে। এ ক্ষেত্রে স্পষ্টতই অভিবাসীরা হবে হামলার লক্ষ্যবস্তু। তাদের তো খুব সহজেই জাতিগত পার্থক্যের বোধ থেকে আলাদা করা যায়।
সাধারণত এই সমস্যাটিকে যতটা ছোট সমস্যা হিসেবে দেখা হয়, আসলে তার চেয়ে অনেক বড় সমস্যা। ইউরোপের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি দিন দিন অভিবাসীদের শ্রমের ওপর অধিক হারে নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। অবশ্য বহু আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে এই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, এখন ইউরোপেও ক্রমবর্ধমান হারে এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ১৯৯০-এর দশক এবং ২০০২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধময়তার পাশাপাশি বয়সী জনসংখ্যার জনসংখ্যাতাত্ত্বিক চাপ যোগ হওয়ায় কৃষি খামার, প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, নির্মাণশিল্প এবং নানা খাতে চাকরির জন্য শ্রমিকের চাহিদা তৈরি হয়েছিল। ফলে এশিয়া ও আফ্রিকার স্বল্পোন্নত দেশ থেকে শুরু করে পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের সাবেক সমাজতন্ত্রী দেশগুলো থেকেও নারী ও পুরুষ শ্রমিকেরা এসেছেন। বৈধ ও অবৈধ দুই পথেই। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা অত্যন্ত কম মজুরি, নিম্নমানের আবাস ও কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ এবং অবিরত নিরাপত্তাহীনতাকে সহ্য করে নিচ্ছেন শুধু নিজেদের জীবনযাত্রার মান কোনোরকমে উন্নত করা এবং স্বদেশে বসবাসরত স্বজনদের অর্থ প্রেরণের আশায়।
ইউরোপের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে ইন্ধন ও সহায়তা জুগিয়েছে সস্তা শ্রম। এই সস্তা শ্রমের ফলে কেবল নিয়োগদাতার লাভই বাড়েনি, কম দামে পাওয়ার কারণে স্থানীয় মানুষের পণ্য ও সেবা ভোগের পরিমাণও বেড়েছে। আর এসব অভিবাসীর উৎপাদনশীল ভূমিকা দৃশ্যমান আর আড়ালের নানা কর্মকাণ্ডে ব্যাপকভাবে ছড়ানো।
ইতালির কথাই ভেবে দেখুন। মাত্র এক প্রজন্মের ভেতর দেশটি শ্রমের নিট রপ্তানিকারক দেশ থেকে অন্যতম অভিবাসীগ্রহীতায় পরিণত হয়েছে। ইতালির কৃষি মূলত অভিবাসী শ্রমিকদের ওপর নির্ভরশীল। উত্তর ইতালির কৃষিক্ষেত্র থেকে শুরু করে কালাব্রিয়ার ফলবাগান পর্যন্ত সবখানে আফ্রিকা থেকে আসা অভিবাসী শ্রমিকদেরই প্রাধান্য দেখা যায়। ফ্লোরেন্স আর বোলোগনার কারখানাগুলোতে তালিকাভুক্ত এক লাখ ২০ হাজার চীনা শ্রমিক কাজ করছেন, হয়তো তালিকাবহির্ভূত আরও অনেকে আছেন। তাঁরা পাশাপাশি কাজ করেন আলবেনিয়া, ইউক্রেন, রোমানিয়া ও সাবেক যুগোশ্লাভিয়াসহ পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের দেশ থেকে আসা আরও অধিকসংখ্যক শ্রমিকের সঙ্গে। পশুসম্পদ ব্যবস্থাপনা, মালামাল পরিবহন, পয়োনিষ্কাশন ও বর্জ্য অপসারণ, আরও নানা ধরনের নোংরা, কঠিন বা বিপজ্জনক (3D-dirty, difficult, dangerous) কাজ বহুলাংশে অভিবাসীরাই করেন।
এগুলো অভিবাসীদের কর্মসংস্থানের অনেক দৃশ্যমান রূপ। নারী অভিবাসী শ্রমিকের প্রধান নিয়োগের ক্ষেত্র তত্ত্বাবধানের অর্থনীতি, বিশেষত ঘরের এবং গৃহস্থালি কাজে। ইতালির বহু শহর ও নগরে অভিবাসী নারী শ্রমিকেরা (বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফিলিপাইন থেকে আসা) শিশু পালন, বৃদ্ধ ও অসুস্থদের দেখাশোনা করা এবং গৃহ পরিচর্যার মতো কাজ করেন (যদিও অভিবাসী নারী শ্রমিককে হয়তো নিজের সন্তান পালনের ভার বাড়িতে অন্য কারও ওপর দিয়ে যেতে হয়)।
তবে ইউরোপের অর্থনীতির এই সমৃদ্ধিতে ধস নামার সঙ্গে সঙ্গে অভিবাসীদের সম্পর্কে স্থানীয়দের ধারণা দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। এমনকি যাঁরা বর্ণবাদী মতাদর্শ দ্বারা সরাসরি চালিত হচ্ছেন না, তাঁদের ধারণাতেও এমন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এমন কিছু কাজ আছে যেগুলো অভিবাসী শ্রমিক ছাড়া এখন আর চলবে না। কেননা, স্থানীয়রা এসব কাজ আর করতে চায় না অথবা পারে না। কিন্তু অভিবাসীদের হুমকি হিসেবে দেখার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। কেবল স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতিই নয়, স্থানীয়দের কাজের সুযোগের ক্ষেত্রেই অভিবাসীদের হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। মজুরি কমে যাওয়া, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ সৃষ্টি, জনপরিসরকে অনিরাপদ বানিয়ে ফেলার মতো নানা কারণ সৃষ্টির জন্য অভিযোগের তীরটিও তাদের দিকে। কালাব্রিয়ায় দাঙ্গার পর স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া ছিল আপত্তিকর। এই দাঙ্গার ফলে অধিকাংশ অভিবাসী শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: ‘অনেক ইতালীয় নাগরিক বহুল ব্যবহূত একটি কথা বারবার উচ্চারণ করছিল, “আমরা বর্ণবাদী নই, কিন্তু...”।’ শেষ পর্যন্ত তারা যেটি বলতে চেয়েছে তা হলো, ইতালীয়দের জীবনধারণই যেখানে খুব কষ্টকর, সেখানে অভিবাসীরা না থাকলেই ভালো হতো।
এই কয়েক ধরনের শক্তির সম্মিলন থেকে সাম্প্রতিক বর্ণবাদী সহিংসতা বৃদ্ধি আর পাশাপাশি প্রত্যক্ষ বর্ণবাদী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির ব্যাপারে অন্তত অংশত হলেও ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে। ইউরোপের নানা প্রান্তে রোমা বসতিগুলোর ওপর হামলার ঘটনা এখন অনেক ঘন ঘন দেখা যায়। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে দক্ষিণ ইতালির কালাব্রিয়া এবং মে মাসে স্পেনের বার্সেলোনায় জাতিগত দাঙ্গা ঘটেছে। তা ছাড়া গ্রিসেও এ ধরনের ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে (অভিবাসীদের প্রতি আচরণের দিক থেকে ইউরোপে গ্রিস সবচেয়ে বাজে রেকর্ডের অধিকারী)। ইউরোপের সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে ইতালির নর্দার্ন লিগ, বেলজিয়ামের ভ্লামস ব্লক, ডেনমার্কের ড্যানিশ পিপলস পার্টি, ফ্রান্সের ন্যাশনাল ফ্রন্ট, যুক্তরাজ্যের ব্রিটিশ ন্যাশনাল পার্টি, স্পেনের মোভিমেন্তো সোশাল এস্পানল এবং পর্তুগালের ন্যাশনাল রিনিউয়াল পার্টির মতো ডানপন্থী ও অভিবাসনবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ভোটের হার বেড়েছে। হাঙ্গেরিতে কট্টর ডানপন্থী দল জোবিক চলতি বছরের এপ্রিলে দেশটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সংসদে ঢুকতে সক্ষম হয়েছে। ১৭ শতাংশ ভোট পেয়ে তারা আছে সাবেক ক্ষমতাসীন দল সোশালিস্ট পার্টির পরই। সোশালিস্ট পার্টি পেয়েছে ১৯ শতাংশ ভোট। মার্চ মাসে ফ্রান্সের আঞ্চলিক নির্বাচনে ন্যাশনাল ফ্রন্টের নির্বাচনী পুনর্জাগরণ দেখা গেছে। নেদারল্যান্ডের গত জুন মাসের সাধারণ নির্বাচনে অভিবাসনবিরোধী দল ফ্রিডম পার্টি জয়লাভ করেছে।
ইউরোপিয়ান এজেন্সি ফর ফান্ডামেন্টাল রাইটসের এক অনুসন্ধানে দেখা যায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত যে ২২টি দেশে জরিপ চালানো হয়েছে সেখানে কোনো গড়পড়তা রোমা অধিবাসী প্রতিবছর গড়ে ৪.৬ বার নানাভাবে বৈষম্যের সম্মুখীন হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। কর্মসংস্থান, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে এই বৈষম্য ঘটে। আর তাদের ওপর প্রত্যক্ষ সহিংসতার ব্যাপার তো রয়েই গেছে। রোমা অধিবাসীদের পর আফ্রিকানরাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। আফ্রিকান অভিবাসীদের প্রায় অর্ধেকই জীবনে কোনো না কোনো ধরনের বৈষম্যের শিকার হয়েছে, আর রোমাদের তুলনায় তাদের শারীরিকভাবে আক্রান্ত হওয়া এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তাহীনতা আরও বেশি।
অভিবাসী শ্রমিকের জন্য অব্যাহত অর্থনৈতিক চাহিদা এবং তাদের উপস্থিতির ব্যাপারে স্থানীয়দের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ—এই দুইয়ের মধ্যে অস্বস্তিকর ও অমীমাংসিত এক সম্পর্ক ইউরোপে বিদ্যমান। বর্তমানে সম্পর্কের অধোগতি এই দ্বন্দ্বকে আরও তীব্রতর করবে। এসব সমস্যার বিষয়ে ইউরোপের সরকারগুলো সরাসরি কোনো সাড়া না দিয়ে সব ভুল পদক্ষেপ নিচ্ছে: একদিকে তারা অভিবাসনবিরোধী আবেগকে উৎসাহিত করছে, অন্যদিকে স্থানীয় অধিবাসী এবং অভিবাসীদের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাও আরও কমিয়ে আনছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার অর্থনৈতিক নীতি এবং সহিষ্ণুতা ও বিভিন্ন জাতিসত্তার মিশ্রণে সমতা সাধনের সামাজিক নীতি এ ক্ষেত্রে অনেক বেশি অর্থপূর্ণ হতো।
ফরেন পলিসি ইন ফোকাস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
জয়তি ঘোষ: ভারতের জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক; ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্স অ্যাসোসিয়েটসের (আইডিয়াস) নির্বাহী সম্পাদক।
অর্থনৈতিক সংকট যত গভীরে আঘাত হানছে আর সরকারের কৃচ্ছ্র পদক্ষেপের ফলে আরও বেকারত্ব বেড়ে চলেছে, ক্ষুদ্র পরিবারচালিত ব্যবসা ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে, অনিবার্যভাবে ততই জনমনে তিক্ততা ও রোষ বাড়ছে এবং ভবিষ্যতেও বাড়বে। বিপদ হলো এই রোষ ক্ষমতাধর আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দিকে চালিত হবে না। এমনকি যেসব সরকার বাজারের হুকুম অত্যন্ত নমনীয় হয়ে তালিম করে গেছে, তাদের বিরুদ্ধেও যাবে না। বরং সহজে আক্রমণ করা যায় এমন নাজুক লক্ষ্যবস্তুর ওপরই আঘাত আসবে। এ ক্ষেত্রে স্পষ্টতই অভিবাসীরা হবে হামলার লক্ষ্যবস্তু। তাদের তো খুব সহজেই জাতিগত পার্থক্যের বোধ থেকে আলাদা করা যায়।
সাধারণত এই সমস্যাটিকে যতটা ছোট সমস্যা হিসেবে দেখা হয়, আসলে তার চেয়ে অনেক বড় সমস্যা। ইউরোপের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি দিন দিন অভিবাসীদের শ্রমের ওপর অধিক হারে নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। অবশ্য বহু আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে এই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, এখন ইউরোপেও ক্রমবর্ধমান হারে এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ১৯৯০-এর দশক এবং ২০০২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধময়তার পাশাপাশি বয়সী জনসংখ্যার জনসংখ্যাতাত্ত্বিক চাপ যোগ হওয়ায় কৃষি খামার, প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, নির্মাণশিল্প এবং নানা খাতে চাকরির জন্য শ্রমিকের চাহিদা তৈরি হয়েছিল। ফলে এশিয়া ও আফ্রিকার স্বল্পোন্নত দেশ থেকে শুরু করে পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের সাবেক সমাজতন্ত্রী দেশগুলো থেকেও নারী ও পুরুষ শ্রমিকেরা এসেছেন। বৈধ ও অবৈধ দুই পথেই। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা অত্যন্ত কম মজুরি, নিম্নমানের আবাস ও কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ এবং অবিরত নিরাপত্তাহীনতাকে সহ্য করে নিচ্ছেন শুধু নিজেদের জীবনযাত্রার মান কোনোরকমে উন্নত করা এবং স্বদেশে বসবাসরত স্বজনদের অর্থ প্রেরণের আশায়।
ইউরোপের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে ইন্ধন ও সহায়তা জুগিয়েছে সস্তা শ্রম। এই সস্তা শ্রমের ফলে কেবল নিয়োগদাতার লাভই বাড়েনি, কম দামে পাওয়ার কারণে স্থানীয় মানুষের পণ্য ও সেবা ভোগের পরিমাণও বেড়েছে। আর এসব অভিবাসীর উৎপাদনশীল ভূমিকা দৃশ্যমান আর আড়ালের নানা কর্মকাণ্ডে ব্যাপকভাবে ছড়ানো।
ইতালির কথাই ভেবে দেখুন। মাত্র এক প্রজন্মের ভেতর দেশটি শ্রমের নিট রপ্তানিকারক দেশ থেকে অন্যতম অভিবাসীগ্রহীতায় পরিণত হয়েছে। ইতালির কৃষি মূলত অভিবাসী শ্রমিকদের ওপর নির্ভরশীল। উত্তর ইতালির কৃষিক্ষেত্র থেকে শুরু করে কালাব্রিয়ার ফলবাগান পর্যন্ত সবখানে আফ্রিকা থেকে আসা অভিবাসী শ্রমিকদেরই প্রাধান্য দেখা যায়। ফ্লোরেন্স আর বোলোগনার কারখানাগুলোতে তালিকাভুক্ত এক লাখ ২০ হাজার চীনা শ্রমিক কাজ করছেন, হয়তো তালিকাবহির্ভূত আরও অনেকে আছেন। তাঁরা পাশাপাশি কাজ করেন আলবেনিয়া, ইউক্রেন, রোমানিয়া ও সাবেক যুগোশ্লাভিয়াসহ পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের দেশ থেকে আসা আরও অধিকসংখ্যক শ্রমিকের সঙ্গে। পশুসম্পদ ব্যবস্থাপনা, মালামাল পরিবহন, পয়োনিষ্কাশন ও বর্জ্য অপসারণ, আরও নানা ধরনের নোংরা, কঠিন বা বিপজ্জনক (3D-dirty, difficult, dangerous) কাজ বহুলাংশে অভিবাসীরাই করেন।
এগুলো অভিবাসীদের কর্মসংস্থানের অনেক দৃশ্যমান রূপ। নারী অভিবাসী শ্রমিকের প্রধান নিয়োগের ক্ষেত্র তত্ত্বাবধানের অর্থনীতি, বিশেষত ঘরের এবং গৃহস্থালি কাজে। ইতালির বহু শহর ও নগরে অভিবাসী নারী শ্রমিকেরা (বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফিলিপাইন থেকে আসা) শিশু পালন, বৃদ্ধ ও অসুস্থদের দেখাশোনা করা এবং গৃহ পরিচর্যার মতো কাজ করেন (যদিও অভিবাসী নারী শ্রমিককে হয়তো নিজের সন্তান পালনের ভার বাড়িতে অন্য কারও ওপর দিয়ে যেতে হয়)।
তবে ইউরোপের অর্থনীতির এই সমৃদ্ধিতে ধস নামার সঙ্গে সঙ্গে অভিবাসীদের সম্পর্কে স্থানীয়দের ধারণা দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। এমনকি যাঁরা বর্ণবাদী মতাদর্শ দ্বারা সরাসরি চালিত হচ্ছেন না, তাঁদের ধারণাতেও এমন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এমন কিছু কাজ আছে যেগুলো অভিবাসী শ্রমিক ছাড়া এখন আর চলবে না। কেননা, স্থানীয়রা এসব কাজ আর করতে চায় না অথবা পারে না। কিন্তু অভিবাসীদের হুমকি হিসেবে দেখার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। কেবল স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতিই নয়, স্থানীয়দের কাজের সুযোগের ক্ষেত্রেই অভিবাসীদের হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। মজুরি কমে যাওয়া, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ সৃষ্টি, জনপরিসরকে অনিরাপদ বানিয়ে ফেলার মতো নানা কারণ সৃষ্টির জন্য অভিযোগের তীরটিও তাদের দিকে। কালাব্রিয়ায় দাঙ্গার পর স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া ছিল আপত্তিকর। এই দাঙ্গার ফলে অধিকাংশ অভিবাসী শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: ‘অনেক ইতালীয় নাগরিক বহুল ব্যবহূত একটি কথা বারবার উচ্চারণ করছিল, “আমরা বর্ণবাদী নই, কিন্তু...”।’ শেষ পর্যন্ত তারা যেটি বলতে চেয়েছে তা হলো, ইতালীয়দের জীবনধারণই যেখানে খুব কষ্টকর, সেখানে অভিবাসীরা না থাকলেই ভালো হতো।
এই কয়েক ধরনের শক্তির সম্মিলন থেকে সাম্প্রতিক বর্ণবাদী সহিংসতা বৃদ্ধি আর পাশাপাশি প্রত্যক্ষ বর্ণবাদী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির ব্যাপারে অন্তত অংশত হলেও ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে। ইউরোপের নানা প্রান্তে রোমা বসতিগুলোর ওপর হামলার ঘটনা এখন অনেক ঘন ঘন দেখা যায়। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে দক্ষিণ ইতালির কালাব্রিয়া এবং মে মাসে স্পেনের বার্সেলোনায় জাতিগত দাঙ্গা ঘটেছে। তা ছাড়া গ্রিসেও এ ধরনের ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে (অভিবাসীদের প্রতি আচরণের দিক থেকে ইউরোপে গ্রিস সবচেয়ে বাজে রেকর্ডের অধিকারী)। ইউরোপের সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে ইতালির নর্দার্ন লিগ, বেলজিয়ামের ভ্লামস ব্লক, ডেনমার্কের ড্যানিশ পিপলস পার্টি, ফ্রান্সের ন্যাশনাল ফ্রন্ট, যুক্তরাজ্যের ব্রিটিশ ন্যাশনাল পার্টি, স্পেনের মোভিমেন্তো সোশাল এস্পানল এবং পর্তুগালের ন্যাশনাল রিনিউয়াল পার্টির মতো ডানপন্থী ও অভিবাসনবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ভোটের হার বেড়েছে। হাঙ্গেরিতে কট্টর ডানপন্থী দল জোবিক চলতি বছরের এপ্রিলে দেশটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সংসদে ঢুকতে সক্ষম হয়েছে। ১৭ শতাংশ ভোট পেয়ে তারা আছে সাবেক ক্ষমতাসীন দল সোশালিস্ট পার্টির পরই। সোশালিস্ট পার্টি পেয়েছে ১৯ শতাংশ ভোট। মার্চ মাসে ফ্রান্সের আঞ্চলিক নির্বাচনে ন্যাশনাল ফ্রন্টের নির্বাচনী পুনর্জাগরণ দেখা গেছে। নেদারল্যান্ডের গত জুন মাসের সাধারণ নির্বাচনে অভিবাসনবিরোধী দল ফ্রিডম পার্টি জয়লাভ করেছে।
ইউরোপিয়ান এজেন্সি ফর ফান্ডামেন্টাল রাইটসের এক অনুসন্ধানে দেখা যায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত যে ২২টি দেশে জরিপ চালানো হয়েছে সেখানে কোনো গড়পড়তা রোমা অধিবাসী প্রতিবছর গড়ে ৪.৬ বার নানাভাবে বৈষম্যের সম্মুখীন হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। কর্মসংস্থান, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে এই বৈষম্য ঘটে। আর তাদের ওপর প্রত্যক্ষ সহিংসতার ব্যাপার তো রয়েই গেছে। রোমা অধিবাসীদের পর আফ্রিকানরাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। আফ্রিকান অভিবাসীদের প্রায় অর্ধেকই জীবনে কোনো না কোনো ধরনের বৈষম্যের শিকার হয়েছে, আর রোমাদের তুলনায় তাদের শারীরিকভাবে আক্রান্ত হওয়া এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তাহীনতা আরও বেশি।
অভিবাসী শ্রমিকের জন্য অব্যাহত অর্থনৈতিক চাহিদা এবং তাদের উপস্থিতির ব্যাপারে স্থানীয়দের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ—এই দুইয়ের মধ্যে অস্বস্তিকর ও অমীমাংসিত এক সম্পর্ক ইউরোপে বিদ্যমান। বর্তমানে সম্পর্কের অধোগতি এই দ্বন্দ্বকে আরও তীব্রতর করবে। এসব সমস্যার বিষয়ে ইউরোপের সরকারগুলো সরাসরি কোনো সাড়া না দিয়ে সব ভুল পদক্ষেপ নিচ্ছে: একদিকে তারা অভিবাসনবিরোধী আবেগকে উৎসাহিত করছে, অন্যদিকে স্থানীয় অধিবাসী এবং অভিবাসীদের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাও আরও কমিয়ে আনছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার অর্থনৈতিক নীতি এবং সহিষ্ণুতা ও বিভিন্ন জাতিসত্তার মিশ্রণে সমতা সাধনের সামাজিক নীতি এ ক্ষেত্রে অনেক বেশি অর্থপূর্ণ হতো।
ফরেন পলিসি ইন ফোকাস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
জয়তি ঘোষ: ভারতের জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক; ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্স অ্যাসোসিয়েটসের (আইডিয়াস) নির্বাহী সম্পাদক।
No comments