কূটনৈতিক নিয়োগ-পররাষ্ট্র দপ্তর নিয়ে কিছু কথা by সৈয়দ বদরুল আহ্সান

ইসমত জাহান এই গেল কিছুদিন আগে সিডো (CEDAW)-এ নির্বাচিত হয়েছেন এবং সেও ব্যাপক সমর্থনের মধ্য দিয়ে। জাহান বর্তমানে বেলজিয়ামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত পদে নিযুক্ত রয়েছেন। এর আগে তিনি জাতিসংঘে আমাদের স্থায়ী প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেছেন।


বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিদেশির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, যার ফলে সেই সরকার বাংলাদেশের কূটনীতিকদের বিদেশি নাগরিকদের সঙ্গে বিয়ের বিষয়ে যে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিল তা তুলে নেয়। খুবই ভালো কথা। প্রেম-ভালোবাসা-বিয়ের বিষয়ে রাষ্ট্র কোনো বাধা সৃষ্টি করুক, সেটা আমরা কেউই চাইব না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অন্য জায়গায়। ইসমত জাহানের বর্তমান, ভবিষ্যৎ ও বাকি জীবন বোধকরি বিদেশেই অতিবাহিত হবে; যেহেতু তিনি এখন একজন বিদেশির স্ত্রী। তাতে আমাদের কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তার পরও আমরা বলতে বাধ্য হই যে, ওই যে সিডো-এ একটি স্থান পাওয়ার জন্য ইসমত জাহানকে বাংলাদেশ সরকার, বিশেষ করে আমাদের পররাষ্ট্র দপ্তর ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছে, সহযোগিতা করেছে, এই কাজটি কি এমন একজন নারীর জন্য করা যেত না, যিনি সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের নারীসমাজের কথা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরতে পারেন? আয়েশা খানম বা সুলতানা কামালের মতো সক্রিয় নারী ও মানবাধিকারকর্মী তো অনেক রয়েছেন বাংলাদেশে, যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমাদের হয়ে কথা বলতে পারেন। তাঁরা সবাই দেশে থাকেন এবং বিদেশে গেলেও স্বদেশেই ফিরে আসেন। নারী আন্দোলন এবং নারীর অধিকার সম্পর্কে তাঁরা সর্বদা সচেতন। এর আগে সালমা খান সিডোর চেয়ারপারসন হয়েছিলেন। তিনি যথেষ্ট সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন এবং এখনও নারী ও বিভিন্ন ইস্যুতে সক্রিয় রয়েছেন।
আজ আমাদের কূটনীতি অথবা পররাষ্ট্রনীতি—কোনোটিই আদৌ রয়েছে বা আছে বলে মনে হয় না। এখন আবার শোনা যাচ্ছে ভিন্ন ধরনের কথা। এখন থেকে নাকি বিদেশে আমাদের রাষ্ট্রদূতের নিয়োগপত্র আসবে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নয়। এর ফলে যে ভয়াবহ এক পরিস্থিতির উদ্ভব হবে, তা সহজেই অনুমেয়। প্রথমত, পররাষ্ট্র দপ্তর তার ক্ষমতা হারাবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রসচিবের বিদেশে উচ্চপর্যায়ের নিয়োগের ব্যাপারে কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। দ্বিতীয়ত, যেসব নিয়োগ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সম্পন্ন করা হবে, তার সবগুলো না হলেও একটি বড় অংশ রাজনৈতিক বিবেচনায় করা হবে। এসব নিয়োগ সরাসরি প্রধানমন্ত্রী দেখবেন অথবা দেখেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আদৌ কোনো ভূমিকা এ ক্ষেত্রে থাকবে কি না, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে আমাদের। কিন্তু তাতে কি আমাদের অবাক হওয়ার কোনো কারণ আছে? বিগত বছরগুলো থেকেই তো পররাষ্ট্র দপ্তরের অধিকার ও ক্ষমতা খর্ব হয়ে আসছে। একদিকে এমন সব ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যাঁদের বাইরের জগৎ সম্পর্কে ধারণা খুবই সীমিত। তাঁদের নিয়োগ রাজনৈতিকভাবে হয়েছে, যার ফলে তাঁরা বিদেশে গিয়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের হয়েই কাজ করেছেন, দেশের প্রতিনিধি হয়ে নয়। অন্যদিকে দশকের পর দশক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে উঠেছে এমন একটি জায়গা, যার মাধ্যমে যেকোনো সরকার অনায়াসে তার পছন্দের বা অপছন্দের যেকোনো উচ্চপদস্থ সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাকে বিদেশে রাষ্ট্রদূত করে পাঠিয়ে দিতে পারে। এসবের ফলে দেখা যায় যে সাবেক সচিব ও কর্মকর্তা বা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা—সবাই বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হয়ে বিদেশের বিভিন্ন দেশে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। একইভাবে কেবল রাজনৈতিক বিবেচনায় এমন সব ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যার ফলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। প্রথা অনুযায়ী রাজনৈতিক বা অন্য বিবেচনায় সর্বোচ্চ ৩০ ভাগ অপেশাদার কূটনীতিক নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। বর্তমানে তা পূরণ হয়ে গেছে। নতুন এ ধরনের কোনো নিয়োগ দেওয়া হলে তা ছাড়িয়ে যাবে।
এই বাস্তবতাগুলো পররাষ্ট্র দপ্তরকে ধাপে ধাপে দুর্বল করে তুলেছে এবং ওই দুর্বলতার একটি দিক হলো, যেসব বাঙালি কূটনীতিকের বিদেশে দেশের হয়ে কথা বলার সুযোগটি ছিল, সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করা গেল না। যেসব কূটনীতিক সত্যিকার অর্থে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ এবং শক্তিশালী দেশে বাংলাদেশের ইতিহাস-সংস্কৃতি ও রাজনীতির কথা তুলে ধরতে পারতেন, সেসব কূটনীতিক বা সেই ধরনের কূটনীতিক আজ বিলুপ্তপ্রায়। উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন নিজের ও দেশের প্রতিনিধি হয়ে কথা বলার।
এর মধ্যে আরও একটি ব্যাপার লক্ষণীয় এবং তা এই যে অবসরে যাওয়া সাবেক রাষ্ট্রদূতদের আবারও রাষ্ট্রদূত করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠানোকে কেন্দ্র করে। নীতিগতভাবে এ বিষয়ে আমাদের কোনো আপত্তি থাকার কথা নয় যদি ওই সাবেক রাষ্ট্রদূত এমন উচ্চমানের হন, যাঁদের দ্বারা বাংলাদেশের আত্মসম্মানবোধ তার কথা পৃথিবীর দরবারে আরও ভালোভাবে তুলে ধরা যেতে পারে। কিন্তু সেটাই বা হচ্ছে কোথায়? এ ধরনের নিয়োগের কারণে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি এক রকম থেমে আছে। যাঁরা এভাবে নতুন করে রাষ্ট্রদূত হয়েছেন, তাঁদের বিশেষ কোনো নতুন অবদান আমরা খুব একটা লক্ষ করিনি। এর চেয়েও বড় সত্য হলো, রাজনৈতিক বা অন্য কোনো বিবেচনায় পুরোনো কূটনীতিককে ফিরিয়ে আনার অর্থই হলো নতুনদের পথ রোধ করে ফেলা। আর সেটা যখন হয়, তখন অসন্তোষ এবং চাপা ক্ষোভ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে পররাষ্ট্র দপ্তরে। রাষ্ট্রের কর্মকর্তা বা কর্মচারীর মনে যদি এই মনোভাব জেগে ওঠে যে রাষ্ট্রই তার উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন আমাদের সবারই অমঙ্গল হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই মুহূর্তে যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে দেশের স্বার্থ, দেশের ভাবমূর্তি বিদেশে যথাযথভাবে তুলে ধরা যাবে কি না, সে বিষয়ে আমাদের প্রচুর প্রশ্ন রয়েছে। পাকিস্তানের বিষয়টিই ধরা যাক। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক যে কত জটিল বিষয়, সেটা বোধকরি আমাদের কোনো সরকারই কোনো দিন অনুধাবন করতে পারেনি। ১৯৭১ সালের ইতিহাস রয়েছে এবং রয়েছে বলেই পাকিস্তানে সব সময় আমাদের এমন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা দরকার, যিনি জোরালো ও বুদ্ধিদীপ্তভাবে আমাদের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য তুলে ধরবেন। সেই কাজটি কি আমরা কখনো করতে পেরেছি? এই কিছুদিন আগে যে অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিককে পাকিস্তানে বাংলাদেশের হাইকমিশনার করে পাঠানো হলো, তিনি কি আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে পাকিস্তানিদের সামনে তুলে ধরতে পারবেন? ইসলামাবাদের জন্য কি অন্য কাউকে নিয়োগ দেওয়া যেত না? সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে হয়তো আমাদের ভাবতে হবে আজকাল এ ধরনের উচ্চপর্যায়ের কূটনীতিক নিয়োগে প্রধান ভূমিকাটি কে বা কারা পালন করছেন। দিল্লি, লন্ডন ও ওয়াশিংটনে নিযুক্ত তিন রাষ্ট্রদূতকে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এসব নিয়োগের ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রসচিবের ক্ষমতা কতটুকু, ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। লন্ডন, ওয়াশিংটন, দিল্লি ও নিউইয়র্কের মতো জায়গায় যাঁদের পাঠানো হয়েছে, তাঁদের বেলায় কাদের প্রভাব বেশি কাজ করেছে? জাতিসংঘের মতো একটি স্পর্শকাতর জায়গায় যে একজন ঝানু কূটনীতিককে পাঠানো প্রয়োজন, সেই সত্য কেন অনুধাবন করা হলো না? রাজনৈতিক নিয়োগ অবশ্যই হবে, তাই বলে এমন নিয়োগ কেন হবে, যেখানে রাষ্ট্রদূত অথবা স্থায়ী প্রতিনিধির পররাষ্ট্র বিষয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা বা অভিজ্ঞতা থাকবে না?
এই মুহূর্তে প্রয়োজন পররাষ্ট্র দপ্তরকে একটি শক্তিশালী অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে আসা এবং সে কাজটি করতে গেলে কতগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করা খুবই প্রয়োজন। প্রথমত, পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে মন্ত্রণালয়ের সব কাজের ক্ষেত্রে তাঁর প্রভাব নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, এই ক্ষমতা প্রয়োগ করার মধ্য দিয়ে সরকারের অন্য কর্তাব্যক্তিদের পরিষ্কার জানিয়ে দিতে হবে যে কূটনীতির বিষয়ে কেবল পররাষ্ট্রসচিব ও পররাষ্ট্র দপ্তরের ভূমিকাই মুখ্য। তৃতীয়ত, যেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রয়েছেন, সেখানে আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা বা ‘প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত’ থাকার কোনো দরকার নেই এবং সবশেষে যা করা দরকার তা হলো, আমাদের গুরুত্বপূর্ণ দূতাবাস এবং হাইকমিশনে কিছু রদবদল করা। খোদ পররাষ্ট্র দপ্তরে একজন ইতিহাস এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ে পারদর্শী প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ জরুরি হয়ে পড়েছে।
আর একটি ছোট প্রশ্ন—পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কি ঘন ঘন বিদেশ সফর করার এতই প্রয়োজন? আমাদের রাষ্ট্রদূত তো আছেনই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এবং তাঁদেরই তো দায়িত্ব দেশের পক্ষে ওই বিদেশের মাটিতে কথা বলা। সব জায়গায় যে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকেই উপস্থিত হতে হবে, তেমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এরপর রয়েছে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশের মন্ত্রী ঘন ঘন দেশের বাইরে গেলে সেটা আমাদের সবাইকে ভাবিয়ে তোলে। আমরা সবাই কিছুটা লজ্জিত হই।
সৈয়দ বদরুল আহ্সান: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.