প্রাথমিক শিক্ষা-শিক্ষকদের পদোন্নতিতে বাধা কোথায়? by মোঃ সিদ্দিকুর রহমান

আজ শিক্ষকদের অবমাননার নির্মম পরিহাস পুরো জাতি ও সংশ্লিষ্টদের সর্বাঙ্গে মাখতে পেরেছি কি-না জানি না। এ বাস্তবতা উপলব্ধি করে কালক্ষেপণ না করে সমাধানের পদক্ষেপ নিলেই কেবল বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা ও বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে সময়ের কাজ এগিয়ে চলা।


সময় পথচলার বাঁকে বাঁকে সৃষ্টি করে নতুন নতুন দৃষ্টান্ত। সময়ের প্রধান দাবি পরিবর্তন। প্রাথমিক শিক্ষক সমাজের ভবিষ্যৎ নিয়ে লিখতে গেলে এখানেই থমকে যেতে হয়। প্রাথমিক শিক্ষকদের কর্মজীবন যেখানে শুরু সেখানেই শেষ করতে হয়। সময়ের পেছন দিকে তাকালে ইতিহাসের বর্বরতম অধ্যায় ক্রীতদাস প্রথার কথা স্মরণে আসে। ক্রীতদাসদের একমাত্র স্বপ্ন ছিল প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জন। ব্যক্তিগত জীবনে তাদের সাধ-আহ্লাদ বলে কিছুই ছিল না। তারা জ্বালানি তেলের মতোই জন্ম থেকে জ্বলেছে। অন্যকে আলোকিত করাই ছিল তাদের জীবনের লক্ষ্য। ক্রীতদাসদের জন্মই যেন আজন্ম পাপ। তাদের জন্ম ক্রীতদাস হয়ে, মৃত্যুও হয় ক্রীতদাসরূপেই। সারাটা জীবন যন্ত্রণার আগুন নিয়ে বাঁচতে হয়। মানুষের আরাম-আয়েশের সেবক ক্রীতদাসদের জীবনে আরাম-আয়েশ ছিল কেবলই স্বপ্ন। দারিদ্র্যের কশাঘাতে যাদের জীবন জর্জরিত, সেই গৃহকর্মী ভাইবোনদের ওপর আদি যুগের যন্ত্রণার এখন অনেকটা অবসান ঘটেছে। কিন্তু সেই যন্ত্রণার রূপ ও পাত্র কেবল বদল হয়েছে। সময়ের বিবর্তনে প্রাথমিক শিক্ষকরা সে স্থানে প্রতিস্থাপিত হয়েছেন।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নে উপলব্ধি করেছেন_ দেশের মানুষের কাঙ্ক্ষিত উন্নতির জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন জাতিকে শিক্ষিত করে তোলা। এ লক্ষ্যে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে সর্বপ্রথম প্রাথমিক শিক্ষাকে সরকারিকরণ করেন। তিনি অর্থের কথা চিন্তা করেননি। অথচ আজকে আমরা নির্মম চিত্র দেখতে পাচ্ছি। একের পর এক সরকারের আমলে শিক্ষকদের পুলিশের কাঁদানে গ্যাস, লাঠিপেটা খেতে হয়। চাকরি জাতীয়করণের দাবি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। অথচ বর্তমান সরকার তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের নামে স্ববিরোধী কাজ করে চলেছে, যা পুরো জাতির সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষক সমাজকে হতবাক করছে। সংশ্লিষ্টদের কেন ভাবতে কষ্ট হয়_ শিক্ষকরা শুধু জাতি গড়ার কারিগরই নন, তারা পথপ্রদর্শকও। এ বাস্তবতা স্বীকার করার মানসিকতা সমাজে দুর্লভ। অথচ আজ মনে হচ্ছে, শিক্ষকতা হলো দরিদ্রতার কশাঘাতে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকার এক বিষাদময় পেশা। যেখানে শিক্ষকদের তার পেশা নিয়ে গর্বের সঙ্গে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার কথা, সেখানে ২০০৫ সালে আমি দেখেছি, ন্যায্য পাওনা আদায়ের দাবিতে তাদের রাজপথে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। পথের ধুলায় বঞ্চনার কষ্টে আত্মহননের সিদ্ধান্ত আর কান্নায় ভেঙে পড়া শিক্ষকদের মধ্যে অবস্থান করার সুযোগ পেয়েছি। আরও পেয়েছি হাজতবাসের নিদারুণ অভিজ্ঞতা। সত্যিকারের মানুষ তৈরি করতে হলে দক্ষ, যোগ্যতাসম্পন্ন, আন্তরিক শিক্ষকের কোনো বিকল্প নেই। উচ্চশিক্ষিত ও মেধাবী ছেলেমেয়েদের শিক্ষকতা পেশায় আকর্ষণ করার মতো কোনো প্রয়াসই লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বরং এ পেশাকে অনাকর্ষণীয় করার জন্য পদোন্নতির সুযোগ রুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। বর্তমান নিয়োগবিধি অনুসারে নিজে শিক্ষক না হলেও শিক্ষকের শিক্ষক হওয়ার সুযোগ রয়েছে। একজন অনভিজ্ঞ ব্যক্তি কর্মকর্তা ও প্রশিক্ষক হিসেবে অভিজ্ঞ শিক্ষকদের কাজ তত্ত্বাবধান, পরীক্ষণ ও মনিটরিং করেন। এ ক্ষেত্রেও প্রাথমিক শিক্ষকদের অবস্থা অতীতের ক্রীতদাসদের মতো। শিক্ষকদেরও জন্ম হয় শিক্ষক হিসেবে, মৃত্যুও হয় শিক্ষক হিসেবে। স্বাধীনতার পরপর শিক্ষকদের পদোন্নতির সুযোগ ছিল। পরবর্তী সময়ে তা বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমান অবস্থায়_
সহকারী শিক্ষক ম প্রধান শিক্ষক
এটুকুতেই পদোন্নতির দুয়ার চিরতরে রুদ্ধ। সত্যিকার অর্থে হওয়া উচিত_
সহকারী শিক্ষক ম প্রধান শিক্ষক ম সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার ম উপজেলা শিক্ষা অফিসার ম সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার ম জেলা শিক্ষা অফিসার ম সহকারী পরিচালক ম উপ-পরিচালক ম পরিচালক ম মহাপরিচালক
প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের উপরোক্ত নয়টি স্তর অতিক্রম করে যিনি সর্বশেষ ধাপটিতে পেঁৗছবেন, প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়নের অঙ্গীকার তার চেয়ে বেশি আর কার মধ্যে প্রতিফলিত হতে পারে? তার দক্ষতা, বিষয়সংশ্লিষ্ট প্রাজ্ঞতা, অভিজ্ঞতা অবশ্যই বড় সম্পদ। সম্পদের এ অপচয় ও অবহেলা বন্ধ হওয়া জরুরি। যথাযথ সুযোগ সৃষ্টি করা গেলে মেধাবী-উচ্চশিক্ষিতরা শিক্ষকতা পেশা ত্যাগ করবেন না। বরং উচ্চ দায়িত্ব পালনের হাতেখড়ি গ্রহণ করতে মেধাবী, উদ্যমীরা শিক্ষকতা পেশাকেই তাদের প্রথম পছন্দ হিসেবে গ্রহণ করবেন। বর্তমান অবস্থায় অনভিজ্ঞ কর্মকর্তারা কর্মজীবনে কখনোই বিদ্যালয়ের সঙ্গে কোনোভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন না। প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে বারবার শুধু নিয়মনীতির পরিবর্তন হয়। শিক্ষার মানের কাঙ্ক্ষিত কোনো পরিবর্তন হয় না। ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে যারা সংশ্লিষ্ট, তারা সেদিকে ব্যবস্থা গ্রহণে কতটুকু পরিপকস্ফ? প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে ৬০ ভাগ মহিলা কোটা রয়েছে। শিক্ষকদের পদোন্নতি দেওয়া হলে নারীর ক্ষমতায়ন ও মর্যাদাও প্রতিষ্ঠিত হবে। দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে নারীর ক্ষমতায়ন অত্যন্ত জরুরি। প্রধান শিক্ষক থেকে পরিচালক পর্যন্ত সব পদে সরাসরি নিয়োগ বন্ধ ও শতভাগ পদোন্নতির বিধান রেখে শিক্ষাবান্ধব নিয়োগবিধি প্রণয়ন অত্যন্ত জরুরি। মানুষ গড়ার কারিগররা শুধু ক্রীতদাসের মতো সমাজে আলো জ্বালাবেন। যোগ্যতা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও তাদের একই অবস্থানে পদোন্নতিবিহীন বন্দি করে রাখা আদি যুগের ক্রীতদাস প্রথার মতোই পদোন্নতিবিহীন স্বল্প বেতনের কষ্টে সমগ্র শিক্ষক সমাজ আজ নিস্তব্ধ। আজ শিক্ষকদের অবমাননার নির্মম পরিহাস পুরো জাতি ও সংশ্লিষ্টদের সর্বাঙ্গে মাখতে পেরেছি কি-না জানি না। এ বাস্তবতা উপলব্ধি করে কালক্ষেপণ না করে সমাধানের পদক্ষেপ নিলেই কেবল বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা ও বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। অধীর আগ্রহে প্রাথমিক শিক্ষকদের সঙ্গে আমিও প্রতীক্ষায় রইলাম।

মোঃ সিদ্দিকুর রহমান :প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ক গবেষক ও শিক্ষক নেতা
 

No comments

Powered by Blogger.