সরল গরল-স্পিকারের একটি অসম্পূর্ণ রুলিং by মিজানুর রহমান খান
রাজনীতিতে নতুন একটা উপসর্গ জুটেছে। সেটা হলো, সংসদীয় বিশেষ অধিকারের অপব্যবহার। সাংসদেরা বিশেষ অধিকারের নামে আইনের ঊর্ধ্বে থাকার প্রবণতা দেখাচ্ছেন। ক্ষমতাসীন দলের এক সাংসদের আবদার পূরণ করেছেন সাহারা খাতুন। নির্দেশ গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া সাংসদদের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না।
বিএনপির সাংসদ শহীদ উদ্দীন চৌধুরীর পরে এবার আলোচনায় মো. ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহর নাম। মোল্লাহ আওয়ামী লীগদলীয় সাংসদ। প্রথম আলোয় খবর (১৪ জুলাই ২০১০) বেরিয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ১৩ জুলাই সমন্বয় কমিটির সভা হয়েছে। সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেন, ‘ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ একজন সাংসদ। তাঁর বিরুদ্ধে মামলার আগে যেমন চিন্তা করা উচিত ছিল, তেমনি মামলা নেওয়ার সময় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা উচিত ছিল।’ জানালে কী হতো? তার জবাবও আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বচনে পাই। তাঁর কথায়, ‘জানালে ওই সাংসদের সঙ্গে কথা বলা যেত।’ কথা বললে কী হতো? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায়, ‘তিনি অন্যায় করলে অবশ্যই তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতো।’ এর মানে হলো ন্যায়-অন্যায় ঠিক করে দেবে অভিযুক্ত। আর এর মাধ্যম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বিএনপির সাংসদ শহীদ উদ্দীন চৌধুরীর গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে ২৯ জুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আইন অনুযায়ী, কোনো সাংসদকে গ্রেপ্তার করতে হলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দরকার স্পিকারের অনুমতি। সে অনুমতি না নিয়ে অবশ্যই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। ওই দিন সংসদ চলছিল। স্পিকার আবদুল হামিদ পাঁচটা ৩৫ মিনিটে হাউসে বললেন, তিনি টিভি খবর শুনেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে অনুমতির কথা বলেছেন তা তিনি দেননি। স্পিকারের কথায়, ‘এই খবর সত্য নয়। সংসদ চত্বর থেকে কোনো সাংসদকে গ্রেপ্তারের দরকার পড়লে স্পিকারের অনুমতি লাগে। কিন্তু বিএনপির সাংসদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সংসদ থেকে বহু দূরে।’
কেউ বিধি অনুযায়ী স্পিকারের কাছে হয়তো আনুষ্ঠানিক রুলিং চাননি। কিন্তু স্পিকার ওই দিন শুধু সাহারা নন, বিএনপির দাবিও নাকচ করেন। ‘সংসদ অধিবেশনের ১৫ দিন আগে ও ১৫ দিন পরে সাংসদকে গ্রেপ্তার করা যায় না’ বলে বিএনপি যে দাবি করছে, তা ঠিক নয়। এ ধরনের কোনো আইন নেই।’ স্পিকারের এই বক্তব্যের যথার্থতা চ্যালেঞ্জ করার অবকাশ ছিল। কিন্তু তা হয়নি। এখন তাঁর বক্তব্য অসম্পূর্ণ থাকল। এমনকি তথ্যগতভাবেও থাকল প্রশ্নবিদ্ধ।
সাংসদদের গ্রেপ্তারসংক্রান্ত বিধিবিধানের মূলে আছে, ১৯৬৩ ও ১৯৬৫ সালের দুটি আইন। স্পিকার এর উল্লেখ করেননি। এর একটি দি মেম্বার্স অব দি ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি (এক্সেম্পশন ফ্রম প্রিভেনটিভ ডিটেনশন অ্যান্ড পার্সোনেল অ্যাপিয়ারেন্স) অর্ডিন্যান্স। অন্যটি হলো দি ইস্ট পাকিস্তান অ্যাসেম্বলি মেম্বার্স প্রিভিলিজেস অ্যাক্ট। ১৯৮০ সালের ১৪ মে এই আইন দুটি বিলোপ করে একটি স্বতন্ত্র অধ্যাদেশ জারি হয়। কিন্তু সেটি সংসদে অনুমোদিত হয়নি। ১৯৮১ সালে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বনাম নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল মামলায় হাইকোর্ট মত দেন যে ‘ওই দুটি আইনই বহাল আছে।’ এর ফলে একটা সাংঘর্ষিক অবস্থাও চলছে। ’৬৩-র আইনমতে, সংসদের অধিবেশন চলমান (শুরুর আগে ১৪ দিন ও অধিবেশন শেষের পরে ১৪ দিনসহ) থাকলে কোনো সাংসদকে নিবর্তনমূলক আইনে আটক করা যাবে না। এ সময় তাঁরা ওই আইনে আদালতেও হাজির হবেন না। এর মানে এখানে স্পিকারের অনুমতির প্রশ্ন নেই।
’৬৩ ও ’৬৫-র আইন দুটির মধ্যে একটা বিরোধ লক্ষ্যনীয়। কারণ, ’৬৩-র অধ্যাদেশে নির্দিষ্টভাবে নিবর্তনমূলক আইনে আটক করা যাবে না বলা হয়েছে। আবার ’৬৫-র আইনের আট দফায় বলা হয়েছে, ‘কোনো সদস্য ফৌজদারি অভিযোগে বা অপরাধে গ্রেপ্তার হলে বা কোনো নির্বাহী আদেশক্রমে আটক হলে বিচারক বা নির্বাহী কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট ফরমে স্পিকারকে তা জানাবেন।’
নিবর্তনমূলক আটকাদেশ একটি নিরঙ্কুশ নির্বাহী আদেশ। অনধিক ছয় মাস পর্যন্ত আটকানো যায়। জনস্বার্থের ছুতো দিয়ে এমনকি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছেও তার কারণ লুকানোর ফন্দি সংবিধানই বাতলে দিয়েছে।
আমাদের সংসদীয় কার্যপ্রণালি বিধির ১৭২ বিধিটি কিন্তু ’৬৫-র আইনের ওই আট দফারই অনুবাদমাত্র। এখানে আমরা দেখি, সংসদ অধিবেশনের আগে বা পরে বা চলমান থাকা ইত্যাদির মধ্যে কোনো পার্থক্য টানা হয়নি। এখানে শুধু দুটো বাধা। কোনো সাংসদকে সংসদের সীমার মধ্যে গ্রেপ্তার বা সংসদ সীমার মধ্যে পরোয়ানা জারি করতে হলে স্পিকারের আগাম অনুমতি নিতে হবে। এ ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে লাগবে না।
ভারতীয় সংসদ বিশেষজ্ঞ কাউল অ্যান্ড শাকধারের বই বলছে নিবর্তনমূলক আটকাদেশে ভারতে বাধা নেই। একটু বাড়তি সতর্কতা আছে। ১৯৭৩ সালে ভারতীয় সংসদের কমিটি অব প্রিভিলেজ সুপারিশ করে যে এ ক্ষেত্রে স্পিকারকে শুধু অবহিত করলেই চলবে না, কেন গ্রেপ্তার করা হলো তার কারণ ও প্রেক্ষাপট স্পিকারের কাছে বিস্তারিত প্রকাশ করতে হবে। এ রকম একটি বিধান আমাদের এখানে চালু করতে হলে সংবিধানের ৩৩(৫) অনুচ্ছেদটা সংশোধন করতে হবে।
আমরা মনে রাখব, ’৭২-এর মূল সংবিধানে কিন্তু নিবর্তনমূলক আটকাদেশের বিধান ছিল না। ১৯৭৩ সালে দ্বিতীয় সংশোধনীতে এটা আনা হয়। ড. কামাল হোসেন আমাকে বলেন, ‘পাকিস্তানি তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই ওটা আমরা ভেবেচিন্তে বাদ দিয়েছিলাম।’ ’৭২-এর সংবিধানে ফিরতে অনেকে অজ্ঞান। তাদের বলি, ‘যাবে ভাই, যাবে মোর সাথে? নিবর্তনমূলক আইন, জরুরি অবস্থা বুড়িগঙ্গায় বিসর্জন দিতে?’ এ অপ্রিয় প্রসঙ্গ থাক।
আমরা শুনেছি, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মামলাসংক্রান্ত হাইকোর্টের ওই রায় সম্প্রতি স্পিকারের দপ্তরের নজরে নেওয়া হয়েছে। আমরা আশা করব, স্পিকার এ বিষয়ে ভবিষ্যতে একটি পূর্ণাঙ্গ রুলিং দেবেন। সংবিধানের ৭৮(৫) অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘সংসদের আইনের দ্বারা সংসদের, সংসদের কমিটিসমূহের এবং সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকার (প্রিভিলেজ) নির্ধারণ করতে পারবে।’ বাংলাদেশ সত্যি একটি অদ্ভুত দেশ। অদ্ভুত এর গণতন্ত্র-পাগল রাজনীতিকেরা। গত ৪০ বছরেও তাঁরা এই আইনটি পাস করেননি। এ নিয়ে তাঁদের যে বড় মাথাব্যথা আছে, তারও তেমন লক্ষণ দেখি না। তবে কতিপয় সাংসদের গ্রেপ্তার এড়ানোর আকাঙ্ক্ষা ক্রমেই উদগ্র হতে পারে। কারণ, বেশ কিছু আসনে মনোনয়ন লাভে যে বিনিয়োগ বা টাকা ঢালা হয়, তার সঙ্গে আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে পারার একটা বিবেচনা কাজ করে। তাই সংসদকে এ নিয়ে এখনই ভাবতে হবে।
সাংসদ শহীদ উদ্দীন চৌধুরী শাহবাগে গ্রেপ্তার হলেন। বিএনপি বিশেষ অধিকারের একটা অপব্যাখ্যা দিল। তিনি নিবর্তনমূলক আইনে আটক হননি। তারা স্মরণও করল না যে ১৯৮০ সালে তাদের আমলেই দি মেম্বার্স অব পার্লামেন্ট (এক্সেম্পশন ফ্রম প্রিভেনটিভ ডিটেনশন) বিল সংসদে তোলা হয়। পরে তা পাস হয়নি। এর এক দশকের ব্যবধানে তারা দুই দফায় পুরো এক দশক রাজত্ব করলেও ওই রকম বিল পাসের দরকার তারাও মনে করেনি।
সংসদ বয়কটরত বিরোধী দল বিশেষ সংসদীয় সুবিধা চাইছে। দায়িত্ব না পালন করে বেতন-ভাতা ভোগে তাদের যেমন লজ্জা নেই। তেমনি সাংসদ হিসেবে সুবিধা ভোগ করতেও তাদের কুণ্ঠা নেই। এরাই বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী। ভারতীয় কার্যপ্রণালি বিধিতেও সংসদের সীমানা থেকে গ্রেপ্তারে বাধা-নিষেধ দেখি। পাকিস্তানেও তাই। তবে এই বিধান আর থাকা উচিত নয়। সংসদের সীমা, সংসদের অধিবেশন ও সংসদের বৈঠকরত থাকা ভিন্ন বিষয়। শুধু বৈঠকরত (মূলতবি না করে সংসদ যতক্ষণ ধারাবাহিকভাবে বৈঠকরত থাকেন সেইরূপ মেয়াদ) অবস্থায় কোনো সাংসদকে গ্রেপ্তারে স্পিকারের অনুমতি নিতে হবে। এটা না করা হবে সংসদের অবমাননা। ব্রিটেনে ১৮১৫ সালে সরকারি বেঞ্চে বসে থাকা সাংসদ লর্ড কোচরেন গ্রেপ্তার হন। পুলিশ সেটা পেরেছিল কারণ হাউস অব কমন্সের বৈঠক তখনো শুরু হয়নি। বাংলাদেশ নতুন আইন করুক। কিন্তু সাংসদদের আইনের ঊর্ধ্বে রাখার দরকার নেই। সাংসদ শহীদ উদ্দীন চৌধুরী ও সাংসদ ইলিয়াছ উদ্দিন মোল্লাহকে নিয়ে সরকারি ও বিরোধীদলীয় সাম্প্রতিক প্রবণতা বিপজ্জনক।
সাংসদ ইলিয়াছ উদ্দিন মোল্লাহর বিরুদ্ধে ট্রাফিক সার্জেন্টের মামলার সুষ্ঠু বিচার আমরা দেখতে চাই। একজন আইনপ্রণেতা হয়ে তিনি আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। ট্রাফিক সার্জেন্টকে প্রহার করার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। এই অবস্থায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ১৩ জুলাইয়ের বৈঠকের সিদ্ধান্ত দুর্ভাগ্যজনক। এমনকি নিন্দনীয়। এটা গণতন্ত্রের জন্য লজ্জা। কোনো সাংসদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগবে। এ ধরনের কোনো সার্কুলার জারি করা হলে তা হবে অবৈধ। সংবিধানের পরিপন্থী।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইজিপি নূর মোহাম্মদকে তদন্ত কমিটি গঠনে নির্দেশ দিয়েছেন। এটা অনেকটা জুতা মেরে গরু দানের মতো ব্যাপার হলো না? তদন্ত কমিটির সিদ্ধান্তের জন্য অনিষ্টকর সিদ্ধান্ত তো আগেই নেওয়া হলো। এখন কী করে নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত হবে?
ব্রিটেনে ২০০৮ সালে টোরি সাংসদ দামিয়ান গ্রিন অ্যাশফোর্ড গ্রেপ্তার হন। নয় ঘণ্টা তাঁকে আটকে রাখা হয়। খোদ কমন্সে তাঁর কক্ষে পুলিশ তল্লাশি চালায়। ওই সাংসদ প্রিভিলেজের ধুয়া তোলেন। দারুণ ঝড় ওঠে। লেবার দলীয় তৎকালীন স্পিকার রুলিং দেন। তিনি বলেন, আইনের কোথাও তল্লাশি চালাতে বাধা নেই। আইন পুলিশকে স্পিকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে বলেনি। স্পিকারের দপ্তর থেকে একটি বাক্যের বিবৃতি বেরোয়। ‘যে প্রক্রিয়া অনুসরণের নিয়ম রয়েছে তা অনুসরণ করা হয়েছে।’ হাউস অব কমন্সের যৌথ কমিটি ১৯৯৯ সালে সর্বশেষ প্রিভিলেজ বিষয়ে বড় প্রতিবেদন দেয়। এতে বলা হয়, সংসদের সীমা ‘নট বি এ হেভেন ফ্রম দ্য ল’ বা ‘আইনের ঊর্ধ্বের কোনো স্বর্গ নয়’। আমাদের সাংসদ ইলিয়াছ উদ্দিন মোল্লাহ-সমর্থক সাহারা খাতুন কিংবা বিরোধীদলীয় চিফ হুইফ জয়নাল আবেদীনের মতো সাংসদ শহীদ উদ্দীন চৌধুরীর মুরব্বিবর্গ স্বর্গবাসে অভ্যস্ত হতে পারেন। সে কারণেই তাঁদের বোলচালে কোনো ফারাক নেই।
সংসদীয় প্রিভিলেজের বাইবেল হলো অ্যারিস্কন মে-র গ্রন্থ। এতে লেখা আছে, ‘সংসদীয় প্রিভিলেজ কখনো ফৌজদারি আইনের কোনো প্রয়োগকে প্রতিরোধ করেনি।’ বড় কৌতূহলী ছিলাম এটা জানতে যে সংসদীয় সীমানায় সাংসদ গ্রেপ্তারে স্পিকারের অনুমতি লাগবে কেন। উপমহাদেশে এটা এল কোথা থেকে। আমার ধারণা ছিল, এর উৎস নিশ্চয় মধ্য যুগীয় ইংল্যান্ড হবে। ১৭৭০ সালে ইংল্যান্ড প্রথম প্রিভিলেজ অ্যাক্ট পাস করেছিল। কিন্তু না, তাদের আইনে কোথাও এমন কিছু দেখলাম না। সেখানে ১৯৮৭ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত পুলিশ যে ১৫ সাংসদকে গ্রেপ্তার করেছে তার তথ্য স্পিকারকে অবহিত করেছে। মোট কথা ফৌজদারি অভিযোগে সাধারণ নাগরিক ও সাংসদের মধ্যে পার্থক্য থাকবে একটি। সাংসদ হলে স্পিকারকে জানাতে হবে। এর বেশি নয়। আমরা অবিলম্বে ’৬৩ ও ’৬৫-র আইন এবং ১৭৪ ও ১৭৫ বিধির বিলোপ দাবি করি।
কিন্তু হায়, এসব করবে কে? আমাদের এখানে এসব কী হচ্ছে? এসব আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে?
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
বিএনপির সাংসদ শহীদ উদ্দীন চৌধুরীর গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে ২৯ জুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আইন অনুযায়ী, কোনো সাংসদকে গ্রেপ্তার করতে হলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দরকার স্পিকারের অনুমতি। সে অনুমতি না নিয়ে অবশ্যই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। ওই দিন সংসদ চলছিল। স্পিকার আবদুল হামিদ পাঁচটা ৩৫ মিনিটে হাউসে বললেন, তিনি টিভি খবর শুনেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে অনুমতির কথা বলেছেন তা তিনি দেননি। স্পিকারের কথায়, ‘এই খবর সত্য নয়। সংসদ চত্বর থেকে কোনো সাংসদকে গ্রেপ্তারের দরকার পড়লে স্পিকারের অনুমতি লাগে। কিন্তু বিএনপির সাংসদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সংসদ থেকে বহু দূরে।’
কেউ বিধি অনুযায়ী স্পিকারের কাছে হয়তো আনুষ্ঠানিক রুলিং চাননি। কিন্তু স্পিকার ওই দিন শুধু সাহারা নন, বিএনপির দাবিও নাকচ করেন। ‘সংসদ অধিবেশনের ১৫ দিন আগে ও ১৫ দিন পরে সাংসদকে গ্রেপ্তার করা যায় না’ বলে বিএনপি যে দাবি করছে, তা ঠিক নয়। এ ধরনের কোনো আইন নেই।’ স্পিকারের এই বক্তব্যের যথার্থতা চ্যালেঞ্জ করার অবকাশ ছিল। কিন্তু তা হয়নি। এখন তাঁর বক্তব্য অসম্পূর্ণ থাকল। এমনকি তথ্যগতভাবেও থাকল প্রশ্নবিদ্ধ।
সাংসদদের গ্রেপ্তারসংক্রান্ত বিধিবিধানের মূলে আছে, ১৯৬৩ ও ১৯৬৫ সালের দুটি আইন। স্পিকার এর উল্লেখ করেননি। এর একটি দি মেম্বার্স অব দি ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি (এক্সেম্পশন ফ্রম প্রিভেনটিভ ডিটেনশন অ্যান্ড পার্সোনেল অ্যাপিয়ারেন্স) অর্ডিন্যান্স। অন্যটি হলো দি ইস্ট পাকিস্তান অ্যাসেম্বলি মেম্বার্স প্রিভিলিজেস অ্যাক্ট। ১৯৮০ সালের ১৪ মে এই আইন দুটি বিলোপ করে একটি স্বতন্ত্র অধ্যাদেশ জারি হয়। কিন্তু সেটি সংসদে অনুমোদিত হয়নি। ১৯৮১ সালে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বনাম নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল মামলায় হাইকোর্ট মত দেন যে ‘ওই দুটি আইনই বহাল আছে।’ এর ফলে একটা সাংঘর্ষিক অবস্থাও চলছে। ’৬৩-র আইনমতে, সংসদের অধিবেশন চলমান (শুরুর আগে ১৪ দিন ও অধিবেশন শেষের পরে ১৪ দিনসহ) থাকলে কোনো সাংসদকে নিবর্তনমূলক আইনে আটক করা যাবে না। এ সময় তাঁরা ওই আইনে আদালতেও হাজির হবেন না। এর মানে এখানে স্পিকারের অনুমতির প্রশ্ন নেই।
’৬৩ ও ’৬৫-র আইন দুটির মধ্যে একটা বিরোধ লক্ষ্যনীয়। কারণ, ’৬৩-র অধ্যাদেশে নির্দিষ্টভাবে নিবর্তনমূলক আইনে আটক করা যাবে না বলা হয়েছে। আবার ’৬৫-র আইনের আট দফায় বলা হয়েছে, ‘কোনো সদস্য ফৌজদারি অভিযোগে বা অপরাধে গ্রেপ্তার হলে বা কোনো নির্বাহী আদেশক্রমে আটক হলে বিচারক বা নির্বাহী কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট ফরমে স্পিকারকে তা জানাবেন।’
নিবর্তনমূলক আটকাদেশ একটি নিরঙ্কুশ নির্বাহী আদেশ। অনধিক ছয় মাস পর্যন্ত আটকানো যায়। জনস্বার্থের ছুতো দিয়ে এমনকি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছেও তার কারণ লুকানোর ফন্দি সংবিধানই বাতলে দিয়েছে।
আমাদের সংসদীয় কার্যপ্রণালি বিধির ১৭২ বিধিটি কিন্তু ’৬৫-র আইনের ওই আট দফারই অনুবাদমাত্র। এখানে আমরা দেখি, সংসদ অধিবেশনের আগে বা পরে বা চলমান থাকা ইত্যাদির মধ্যে কোনো পার্থক্য টানা হয়নি। এখানে শুধু দুটো বাধা। কোনো সাংসদকে সংসদের সীমার মধ্যে গ্রেপ্তার বা সংসদ সীমার মধ্যে পরোয়ানা জারি করতে হলে স্পিকারের আগাম অনুমতি নিতে হবে। এ ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে লাগবে না।
ভারতীয় সংসদ বিশেষজ্ঞ কাউল অ্যান্ড শাকধারের বই বলছে নিবর্তনমূলক আটকাদেশে ভারতে বাধা নেই। একটু বাড়তি সতর্কতা আছে। ১৯৭৩ সালে ভারতীয় সংসদের কমিটি অব প্রিভিলেজ সুপারিশ করে যে এ ক্ষেত্রে স্পিকারকে শুধু অবহিত করলেই চলবে না, কেন গ্রেপ্তার করা হলো তার কারণ ও প্রেক্ষাপট স্পিকারের কাছে বিস্তারিত প্রকাশ করতে হবে। এ রকম একটি বিধান আমাদের এখানে চালু করতে হলে সংবিধানের ৩৩(৫) অনুচ্ছেদটা সংশোধন করতে হবে।
আমরা মনে রাখব, ’৭২-এর মূল সংবিধানে কিন্তু নিবর্তনমূলক আটকাদেশের বিধান ছিল না। ১৯৭৩ সালে দ্বিতীয় সংশোধনীতে এটা আনা হয়। ড. কামাল হোসেন আমাকে বলেন, ‘পাকিস্তানি তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই ওটা আমরা ভেবেচিন্তে বাদ দিয়েছিলাম।’ ’৭২-এর সংবিধানে ফিরতে অনেকে অজ্ঞান। তাদের বলি, ‘যাবে ভাই, যাবে মোর সাথে? নিবর্তনমূলক আইন, জরুরি অবস্থা বুড়িগঙ্গায় বিসর্জন দিতে?’ এ অপ্রিয় প্রসঙ্গ থাক।
আমরা শুনেছি, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মামলাসংক্রান্ত হাইকোর্টের ওই রায় সম্প্রতি স্পিকারের দপ্তরের নজরে নেওয়া হয়েছে। আমরা আশা করব, স্পিকার এ বিষয়ে ভবিষ্যতে একটি পূর্ণাঙ্গ রুলিং দেবেন। সংবিধানের ৭৮(৫) অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘সংসদের আইনের দ্বারা সংসদের, সংসদের কমিটিসমূহের এবং সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকার (প্রিভিলেজ) নির্ধারণ করতে পারবে।’ বাংলাদেশ সত্যি একটি অদ্ভুত দেশ। অদ্ভুত এর গণতন্ত্র-পাগল রাজনীতিকেরা। গত ৪০ বছরেও তাঁরা এই আইনটি পাস করেননি। এ নিয়ে তাঁদের যে বড় মাথাব্যথা আছে, তারও তেমন লক্ষণ দেখি না। তবে কতিপয় সাংসদের গ্রেপ্তার এড়ানোর আকাঙ্ক্ষা ক্রমেই উদগ্র হতে পারে। কারণ, বেশ কিছু আসনে মনোনয়ন লাভে যে বিনিয়োগ বা টাকা ঢালা হয়, তার সঙ্গে আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে পারার একটা বিবেচনা কাজ করে। তাই সংসদকে এ নিয়ে এখনই ভাবতে হবে।
সাংসদ শহীদ উদ্দীন চৌধুরী শাহবাগে গ্রেপ্তার হলেন। বিএনপি বিশেষ অধিকারের একটা অপব্যাখ্যা দিল। তিনি নিবর্তনমূলক আইনে আটক হননি। তারা স্মরণও করল না যে ১৯৮০ সালে তাদের আমলেই দি মেম্বার্স অব পার্লামেন্ট (এক্সেম্পশন ফ্রম প্রিভেনটিভ ডিটেনশন) বিল সংসদে তোলা হয়। পরে তা পাস হয়নি। এর এক দশকের ব্যবধানে তারা দুই দফায় পুরো এক দশক রাজত্ব করলেও ওই রকম বিল পাসের দরকার তারাও মনে করেনি।
সংসদ বয়কটরত বিরোধী দল বিশেষ সংসদীয় সুবিধা চাইছে। দায়িত্ব না পালন করে বেতন-ভাতা ভোগে তাদের যেমন লজ্জা নেই। তেমনি সাংসদ হিসেবে সুবিধা ভোগ করতেও তাদের কুণ্ঠা নেই। এরাই বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী। ভারতীয় কার্যপ্রণালি বিধিতেও সংসদের সীমানা থেকে গ্রেপ্তারে বাধা-নিষেধ দেখি। পাকিস্তানেও তাই। তবে এই বিধান আর থাকা উচিত নয়। সংসদের সীমা, সংসদের অধিবেশন ও সংসদের বৈঠকরত থাকা ভিন্ন বিষয়। শুধু বৈঠকরত (মূলতবি না করে সংসদ যতক্ষণ ধারাবাহিকভাবে বৈঠকরত থাকেন সেইরূপ মেয়াদ) অবস্থায় কোনো সাংসদকে গ্রেপ্তারে স্পিকারের অনুমতি নিতে হবে। এটা না করা হবে সংসদের অবমাননা। ব্রিটেনে ১৮১৫ সালে সরকারি বেঞ্চে বসে থাকা সাংসদ লর্ড কোচরেন গ্রেপ্তার হন। পুলিশ সেটা পেরেছিল কারণ হাউস অব কমন্সের বৈঠক তখনো শুরু হয়নি। বাংলাদেশ নতুন আইন করুক। কিন্তু সাংসদদের আইনের ঊর্ধ্বে রাখার দরকার নেই। সাংসদ শহীদ উদ্দীন চৌধুরী ও সাংসদ ইলিয়াছ উদ্দিন মোল্লাহকে নিয়ে সরকারি ও বিরোধীদলীয় সাম্প্রতিক প্রবণতা বিপজ্জনক।
সাংসদ ইলিয়াছ উদ্দিন মোল্লাহর বিরুদ্ধে ট্রাফিক সার্জেন্টের মামলার সুষ্ঠু বিচার আমরা দেখতে চাই। একজন আইনপ্রণেতা হয়ে তিনি আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। ট্রাফিক সার্জেন্টকে প্রহার করার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। এই অবস্থায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ১৩ জুলাইয়ের বৈঠকের সিদ্ধান্ত দুর্ভাগ্যজনক। এমনকি নিন্দনীয়। এটা গণতন্ত্রের জন্য লজ্জা। কোনো সাংসদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগবে। এ ধরনের কোনো সার্কুলার জারি করা হলে তা হবে অবৈধ। সংবিধানের পরিপন্থী।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইজিপি নূর মোহাম্মদকে তদন্ত কমিটি গঠনে নির্দেশ দিয়েছেন। এটা অনেকটা জুতা মেরে গরু দানের মতো ব্যাপার হলো না? তদন্ত কমিটির সিদ্ধান্তের জন্য অনিষ্টকর সিদ্ধান্ত তো আগেই নেওয়া হলো। এখন কী করে নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত হবে?
ব্রিটেনে ২০০৮ সালে টোরি সাংসদ দামিয়ান গ্রিন অ্যাশফোর্ড গ্রেপ্তার হন। নয় ঘণ্টা তাঁকে আটকে রাখা হয়। খোদ কমন্সে তাঁর কক্ষে পুলিশ তল্লাশি চালায়। ওই সাংসদ প্রিভিলেজের ধুয়া তোলেন। দারুণ ঝড় ওঠে। লেবার দলীয় তৎকালীন স্পিকার রুলিং দেন। তিনি বলেন, আইনের কোথাও তল্লাশি চালাতে বাধা নেই। আইন পুলিশকে স্পিকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে বলেনি। স্পিকারের দপ্তর থেকে একটি বাক্যের বিবৃতি বেরোয়। ‘যে প্রক্রিয়া অনুসরণের নিয়ম রয়েছে তা অনুসরণ করা হয়েছে।’ হাউস অব কমন্সের যৌথ কমিটি ১৯৯৯ সালে সর্বশেষ প্রিভিলেজ বিষয়ে বড় প্রতিবেদন দেয়। এতে বলা হয়, সংসদের সীমা ‘নট বি এ হেভেন ফ্রম দ্য ল’ বা ‘আইনের ঊর্ধ্বের কোনো স্বর্গ নয়’। আমাদের সাংসদ ইলিয়াছ উদ্দিন মোল্লাহ-সমর্থক সাহারা খাতুন কিংবা বিরোধীদলীয় চিফ হুইফ জয়নাল আবেদীনের মতো সাংসদ শহীদ উদ্দীন চৌধুরীর মুরব্বিবর্গ স্বর্গবাসে অভ্যস্ত হতে পারেন। সে কারণেই তাঁদের বোলচালে কোনো ফারাক নেই।
সংসদীয় প্রিভিলেজের বাইবেল হলো অ্যারিস্কন মে-র গ্রন্থ। এতে লেখা আছে, ‘সংসদীয় প্রিভিলেজ কখনো ফৌজদারি আইনের কোনো প্রয়োগকে প্রতিরোধ করেনি।’ বড় কৌতূহলী ছিলাম এটা জানতে যে সংসদীয় সীমানায় সাংসদ গ্রেপ্তারে স্পিকারের অনুমতি লাগবে কেন। উপমহাদেশে এটা এল কোথা থেকে। আমার ধারণা ছিল, এর উৎস নিশ্চয় মধ্য যুগীয় ইংল্যান্ড হবে। ১৭৭০ সালে ইংল্যান্ড প্রথম প্রিভিলেজ অ্যাক্ট পাস করেছিল। কিন্তু না, তাদের আইনে কোথাও এমন কিছু দেখলাম না। সেখানে ১৯৮৭ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত পুলিশ যে ১৫ সাংসদকে গ্রেপ্তার করেছে তার তথ্য স্পিকারকে অবহিত করেছে। মোট কথা ফৌজদারি অভিযোগে সাধারণ নাগরিক ও সাংসদের মধ্যে পার্থক্য থাকবে একটি। সাংসদ হলে স্পিকারকে জানাতে হবে। এর বেশি নয়। আমরা অবিলম্বে ’৬৩ ও ’৬৫-র আইন এবং ১৭৪ ও ১৭৫ বিধির বিলোপ দাবি করি।
কিন্তু হায়, এসব করবে কে? আমাদের এখানে এসব কী হচ্ছে? এসব আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে?
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments