সদরে অন্দরে-সরকারীকরণই কি শিক্ষার মানোন্নয়নের শর্ত by মোস্তফা হোসেইন

মানিকগঞ্জের একটি নিবন্ধিত প্রাথমিক বিদ্যালয়। সকাল ১১টায় সেই স্কুলে হাজির মাত্র একজন শিক্ষক। শিক্ষার্থীও তেমন দেখা যাচ্ছে না। সাংবাদিককে উপস্থিত শিক্ষকের জবাব, একজন শিক্ষক গেছেন বেতন তোলার জন্য আর অন্যজন গেছেন ছাত্রের বাড়ি। বেতন তোলার বিষয়টি না হয় বোঝা গেল।


ছাত্রের বাড়ি কেন? শিক্ষক বললেন, ছেলেরা স্কুলে আসতে চায় না। তাই ধরে নিয়ে আসতে গেছেন।
এমনই একটি সংবাদ চোখে পড়েছিল একসময়। বছরকয়েক আগে আরেকটি সংবাদ প্রকাশ হয়েছিল নিবন্ধিত প্রাথমিক বিদ্যালয় সম্পর্কে। বাংলাদেশে মোট চার হাজারেরও বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থীই প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় বৃত্তি পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেনি। এর মধ্যে দুই হাজার ২০০টিই নিবন্ধিত প্রাথমিক বিদ্যালয়। অথচ এখন প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা হয় আগের চেয়ে অনেক উদারভাবে। কোটা পদ্ধতির কারণে একটু মনোযোগসহ লেখাপড়া করলেই বৃত্তি পাওয়া সম্ভব। এমন পরিস্থিতিতে বিশালসংখ্যক স্কুল থেকে কোনো শিক্ষার্থীর বৃত্তি না পাওয়াটা শিক্ষার মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়।
এই হচ্ছে নিবন্ধিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি চিত্র। নিশ্চয়ই এটি সামগ্রিক চিত্র নয়। সারা দেশে এই নিবন্ধিত স্কুলগুলো আমাদের প্রায় ৪০ লাখের বেশি শিক্ষার্থীর ঠিকানা। স্কুলের খাতায় নাম আছে তাদের। কিছু স্কুল ভালোও করছে। শিক্ষকদের আন্তরিকতাও আছে। বাংলাদেশকে ২০১৪ সালের মধ্যে নিরক্ষরমুক্ত করতে হলে এই ২৪ হাজার স্কুলের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। ৩৭ হাজার ৬৭১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে যদি এই ২৪ হাজার স্কুলকে উন্নত না করা যায়, তাহলে সরকারের এই লক্ষ্য অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। শুধু তা-ই নয়, দেশের ৪০ লাখ শিক্ষার্থীর জীবনও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
সবচেয়ে বড় কথা, শিক্ষার আলো সমাজের নিম্ন আয়ভুক্ত মানুষের দুয়ারে পৌঁছে দিতে হলে নিবন্ধিত স্কুলগুলোর দিকে নজর দিতে হবে। কারণ এসব স্কুলে সাধারণত খেটে খাওয়া এবং গরিব মানুষের সন্তানদেরই পাঠানো হয়। অধিকাংশ শিক্ষার্থীই এমন পরিবার থেকে আসে, যাদের পরিবারে শিক্ষার ছোঁয়া লাগেনি।
অধিকাংশ স্কুলই শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানে আন্তরিক। যার প্রমাণ পাওয়া যায় বৃত্তিপ্রাপ্তির সংখ্যা থেকেও। আন্তরিকতার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রথমে উল্লিখিত মানিকগঞ্জের সেই স্কুলটির সংবাদ থেকেও। সেখানে একজন শিক্ষককে শিক্ষার্থীর বাড়ি যাওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে শিক্ষার্থীদের প্রতি তাঁদের নজর দেওয়ার বিষয়টি তাঁরা মনেপ্রাণেই লালন করেন।
সবচেয়ে বড় কথা, দেশের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে তাঁরা শিক্ষা দান করছেন। এমন ভালো-মন্দ অবস্থানে থাকা নিবন্ধিত ২৪ হাজার স্কুলের ৯৬ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা এখন সংঘবদ্ধ। আন্দোলন করেছেন। সম্প্রতি পত্রিকায় তাঁদের আন্দোলনের চিত্রও ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষ করে ঢাকায় আন্দোলনরত শিক্ষকদের ওপর পুলিশ বাহিনীর অমানবিক আচরণ এবং জামালপুরে শিক্ষক আজিজুর রহমানের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে প্রচারমাধ্যমে ভিন্নমাত্রা পায় নিবন্ধিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এ আন্দোলন।
আশার কথা, প্রধানমন্ত্রী এ ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যেই ঘোষণা করেছেন, নিবন্ধিত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো সরকারীকরণ করা হবে। আপাতদৃষ্টে শিক্ষকদের আন্দোলন সফল বলে মনে করা যেতে পারে। যদিও সন্দেহ দূর হয়নি শিক্ষকদের। সন্দেহ দূর না হওয়ার কারণ এর আগে প্রদত্ত অনেক আশ্বাস কার্যকর না হওয়া।
প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস কার্যকর হবে কি না তা বোঝা যাবে সপ্তাহকালের মধ্যে। জাতীয় বাজেটে নিশ্চয়ই তা প্রতিফলিত হবে। বোঝা যাবে শিক্ষা খাতে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, প্রায় এক লাখ শিক্ষককে সরকারি করার মাধ্যমে শিক্ষা সম্প্রসারণের পাশাপাশি শিক্ষা উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা কতটা অর্জন হবে, তা নিয়ে। প্রায় অর্ধকোটি শিক্ষার্থীর ঠিকানা যদি শক্তিশালী করা যায়, তাহলে নিশ্চয়ই শিক্ষার উন্নয়নে বড় ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু তাদের বর্তমান অবস্থা দেখে সন্দেহ এবং প্রশ্ন দুই-ই আমাদের সামনে হাজির হয়। প্রশ্ন আসে, এই স্কুলগুলোকে সরকারীকরণের মাধ্যমেই কি লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে? সরকার হয়তো তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করার জন্য প্রায় এক লাখ শিক্ষককে সরকারি চাকুরে বানিয়ে দিল। কিন্তু সেসব স্কুলের শিক্ষকদের যোগ্যতা এবং তাঁদের বছরের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করতে হবে। অধিকাংশ স্কুলে শিক্ষক নিয়োগকালে কোনো নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি। যোগ্যতার চেয়ে স্থানীয় প্রশাসন কিংবা রাজনৈতিক শক্তিই নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছে। সংগত কারণেই প্রশ্ন আসে, নিবন্ধিত স্কুল হলেই কি স্কুলটিকে সরকারীকরণ করা হবে? নিবন্ধিত স্কুলগুলোয় শিক্ষক নিয়োগকালে যে অনিয়ম হয়েছে, তেমনি অনিয়মের পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আশা করি, এ বিষয়ে সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে।
নিবন্ধিত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশই প্রতিষ্ঠা হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। হয়তো পাশেই একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। সেই স্কুলে হয়তো শিক্ষার্থীকে পাঠদানে কোনো অসুবিধাও নেই। কিন্তু স্থানীয় সংসদ সদস্য কিংবা উপজেলা চেয়ারম্যান সেখানে আরেকটি নিবন্ধিত স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। ইতিমধ্যে প্রমাণ হয়ে গেছে, বাড়তি স্কুল প্রতিষ্ঠা অনেক সময়ই সাধারণ মানুষের জন্য কোনো উপকার বয়ে আনে না। তাই সরকারীকরণের সময় স্কুলের উপযোগিতাকে আমলে আনতে হবে। শিক্ষকের দক্ষতা এবং যোগ্যতা প্রয়োজনমতো না হলে তাঁদের সরকারীকরণের যুক্তি নেই। তাই ঢালাওভাবে সবাইকে যেন সরকারি চাকুরে না করা হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের ১৪ হাজার গ্রামে কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। এসব গ্রামের জরিপ পরিচালনা করে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে। স্কুল প্রতিষ্ঠায় জনসংখ্যা একটি অন্যতম শর্ত হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেবল জনসংখ্যা বিবেচনা করা ঠিক হবে না। বিশেষ করে পার্বত্য ও হাওর অঞ্চলে লোকসংখ্যা খুবই কম। কিন্তু কয়েক কিলোমিটারের মধ্যেও হয়তো কোনো স্কুল নেই। এমন পরিস্থিতিতে জনসংখ্যার হিসাব না করে এলাকার হিসাব করতে হবে। নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গেলে দুর্গম এলাকার প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে।
শিক্ষকদের চাকরি সরকারীকরণ কিংবা অধিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেই দেশের মানুষ শিক্ষিত হবে না কিংবা শিক্ষার মানও উন্নয়ন হবে না। এই ২৪ হাজার স্কুলে যাতে দক্ষ শিক্ষকদের জায়গা হয়, সেদিকেও নজর দিতে হবে। গরু চড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে কোনো শিক্ষক স্কুলে আসেন আবার চলে যান- এমন অবস্থা যেন না হয়। শিক্ষকরা সংঘবদ্ধ হয়ে তাঁদের চাকরিসূত্রে প্রাপ্য সুবিধাগুলো আদায় করার প্রত্যয়ে আন্দোলন করছেন। চাকরির সুবিধা বৃদ্ধির আন্দোলন তাঁরা করতেই পারেন। এটা তাঁদের মৌলিক অধিকার। কিন্তু তাঁদের দেশের আগামী কর্ণধারদের সুন্দর জীবনের কথাও চিন্তা করতে হবে। তাঁরা নিজেদের জীবন সুন্দর করার জন্য যেমন আন্দোলন করেন, তেমনি দেশের আগামী নাগরিকদের সুন্দরভাবে গড়ে তোলার ভারও তাঁদের নিতে হবে। নিবন্ধিত স্কুলগুলোর শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও রাষ্ট্রকে করতে হবে।
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.