দূরদেশ-পাকিস্তান: অন্তহীন সংঘাত by আলী রীয়াজ

দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ সুমিত গাঙ্গুলীর লেখা একটি বইয়ের শিরোনাম কনফ্লিক্ট আনএনডিং-অন্তহীন সংঘাত। ২০০২ সালে প্রকাশিত এই বইয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সংঘাত ও সংঘর্ষ; জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যে উত্তেজনা ১৯৪৭ সাল থেকে চলে আসছে, তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন সুমিত গাঙ্গুলী।


বইটি যখন প্রকাশিত হয়, বিশেষ করে যখন লেখা হয়েছিল, তখনো হয়তো অনেকের মনে হয়নি যে এই শিরোনামটি সঞ্চয়ে রেখে দেওয়া দরকার ভবিষ্যতের জন্য। ভারত ও পাকিস্তানের সংঘাত যে অন্তহীনভাবে চলবে, তা সুমিত গাঙ্গুলী ঠিকই অনুমান করেছিলেন; কিন্তু সঞ্চয়ে রাখা দরকার ছিল এই কারণে যে পাকিস্তান তত দিনে এমন এক সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে, যার অবসান হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। সেই সংঘাত বা যুদ্ধ বাইরের কোনো শত্রুর সঙ্গে নয়, সে সংঘাত তার নিজের দেশের ভেতরে। পাকিস্তানের গত দুই দশকের ইতিহাসের দিকে তাকালে, বিশেষ করে ২০০৩ সালের পরের ঘটনাপ্রবাহ লক্ষ করলে এ কথা বুঝতে অসুবিধা হবে না, পাকিস্তান দেশের ভেতরে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে এমন এক লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছে, যার কোনো শেষ নেই। সুমিত গাঙ্গুলীর বইয়ের শিরোনাম ধার করে বলতে পারি, অন্তহীন সংঘাত।
পাকিস্তানের ভেতরে প্রতিদিন যে সংঘাত বা যুদ্ধ চলছে, তার খবর এখন আর সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় কিংবা টেলিভিশনের শীর্ষ সংবাদেও স্থান পায় না। প্রায় প্রতি সপ্তাহের কোনো না কোনো দিন পাকিস্তানের কোনো শহরে বড় ধরনের বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় কয়েক ডজন নিরীহ মানুষের মৃত্যুর খবর এখন প্রায় স্বাভাবিক ঘটনা। আফগানিস্তান বা ইরাক, যে দুটো দেশে বিদেশি সেনার উপস্থিতি রয়েছে; বিশেষত আফগানিস্তানে যেখানে একটা যুদ্ধ চলছে, তার চেয়ে খুব কম লোক পাকিস্তানে মারা যাচ্ছে, তা নয়। সর্বোপরি অনেকেরই হয়তো জানা নেই যে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শাসিত এলাকা ওরোকজাই পার্বত্য এলাকায় কয়েক মাস ধরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও পাকিস্তানি তালেবান জঙ্গিদের মধ্যে অব্যাহত লড়াই চলছে। ওরোকজাই পেশোয়ার থেকে খুব দূরে নয়। আফগানিস্তান-সীমান্তবর্তী এই অঞ্চলে সেনাদের অভিযান শুরু হয় মার্চ মাসে। জুন মাসের শুরুর দিকে পাকিস্তানি সেনারা ঘোষণা দেন যে, তাঁদের অভিযান সফল হয়েছে। কিন্তু সে দাবি যে খুব জোরালো নয়, সত্যতাও প্রশ্নাতীত নয়, তার প্রমাণ হলো এখনো প্রতিদিন সেখান থেকে হামলা-পাল্টা হামলার খবর আসে, পাকিস্তানি সেনারা হামলায় নিহত হন এবং বেসামরিক ব্যক্তিদের অনেকেই তাঁদের বাড়িঘরে ফিরতে পারছেন না। ওরোকজাইয়ে পাকিস্তানি সেনা অভিযান চালানোর প্রয়োজন দেখা দেয় গত বছরে দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে তাদের আংশিক সাফল্যের পর। দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে তালেবান জঙ্গি ও তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযানের ফলে নেতারা সেখান থেকে সরে এসে জায়গা করে নেন ওরোকজাইয়ে। দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে তালেবান জঙ্গিদের তৈরি পাল্টা হামলায় সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা নিহত হননি, আটকও হননি। তাঁরা এখনো নেতৃত্বের আসনেই বহাল আছেন।
ওরোকজাইয়ে পাকিস্তানি সেনাদের অভিযানের ফলে তালেবান ক্ষতিগ্রস্ত হলেও খুব বেশি লাভ হয়নি কেন্দ্রীয় সরকারের। বরং এখন তাদের জন্য বিপদ বেড়েছে আরও বেশি। জঙ্গিরা এখন তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে সরে এসে জায়গা করে নিচ্ছে অন্যান্য শহরে। এদের অন্যতম লক্ষ্য হয়ে উঠেছে লাহোর শহর। এ মাসের শুরুতে লাহোরে একটি দরগায় আত্মঘাতী বোমা হামলা তার একটি প্রমাণ। জঙ্গিদের এই আচরণ থেকে এখন এটা স্পষ্ট যে পাকিস্তানে তালেবান জঙ্গিরা গোটা দেশেই তাদের প্রভাব, আস্তানা ও সমর্থন বৃদ্ধি করেছে। পাকিস্তানি সেনাদের অভিযান তাদের কেবল জায়গা বদল করতে বাধ্য করছে; অন্যদিকে সেনা অভিযানের সময় বেসামরিক ব্যক্তিদের মৃত্যু ও বিপর্যয় সেনা অভিযানের প্রতি সমর্থনও হ্রাস করছে।
দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তান ও ওরোকজাইয়ে যুদ্ধের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়ার উদ্দেশ্য একটাই—লক্ষ করুন, কীভাবে পাকিস্তানের প্রতিটি এলাকায় জঙ্গিরা ছড়িয়ে পড়ছে। গত তিন বছরে কমপক্ষে সাড়ে তিন হাজার বেসামরিক ব্যক্তি জঙ্গিদের হামলায় মারা গেছেন। তা সত্ত্বেও জঙ্গিরা কেন তাদের কর্মকাণ্ড চালাতে পারছে, সেটাই এখন অনেকের কাছে বড় প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর অনেকের কাছেই খুব প্রীতিকর নয়, পাকিস্তানি সমাজে জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রতি সুস্পষ্ট সমর্থন আছে এবং তা গত বছরগুলোয় খুব কমেনি। উপরন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নতুন নতুন জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে। গাজী বাহিনী বলে যে নতুন জঙ্গিগোষ্ঠীটি এখন সক্রিয়, তার প্রতিষ্ঠা হয়েছে ২০০৭ সালে, ইসলামাবাদে লাল মসজিদে সেনা অভিযানের পর। পাকিস্তান তালেবান-তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাও হয়েছে ওই বছরই।
পাকিস্তানে জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠার ইতিহাস কমবেশি সবার জানা। আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসান মোকাবিল করতে যুক্তরাষ্ট্রের অপরিণামদর্শী নীতির হাত ধরে এদের আবির্ভাব। কিন্তু ইতিহাসের শেষ সেখানে নয়, নব্বইয়ের দশকে যুক্তরাষ্ট্র যখন আফগানিস্তান নিয়ে অনুৎসাহী হয়ে পড়ে, পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী এসব জঙ্গিকে লালন-পালন করেছে কাশ্মীর এবং আফগানিস্তানে পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষার জন্য। কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান-ভারত সংঘর্ষ কেবল এই অর্থেই অন্তহীন নয় যে, তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত থাকবে বরং অন্তহীন এই অর্থে যে তা পাকিস্তানকে ভেতর থেকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলবে। আফগানিস্তানে তালেবানদের সমর্থন করার নীতির পেছনেও যে পাকিস্তানের ভারতবিরোধিতাই কাজ করে, তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। এই নীতি থেকে পাকিস্তান এক বিন্দুও সরে আসেনি বলেই জুন মাসে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই আফগান তালেবানদের সাহায্য করে চলেছে। সেই সাহায্য তাদের দেশের ভেতরে জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযানে হাত-পা বেঁধে দিয়েছে। জুন মাসে পাকিস্তানিদের মধ্যস্থতায় তালেবান ও কারজাই সরকারের মধ্যে সমঝোতার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তার লক্ষ্য ছিল হাক্কানি গোষ্ঠী বলে আফগান তালেবানের এক অংশকে রাজি করানো। হাক্কানি গোষ্ঠীর ঘাঁটি পাকিস্তানে এবং স্পষ্টত পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। কিন্তু এই গোষ্ঠীটি একই সঙ্গে আল-কায়েদার সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধ সত্ত্বেও হাক্কানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সরকার অভিযান চালাতে রাজি হয়নি। একইভাবে আফগান তালেবান নেতৃত্ব, যা ‘কোয়েটা শুরা’ বলে পরিচিত, তাদের ঘাঁটিতে হামলা চালানোর জন্য পাকিস্তানি সরকার যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে সম্মত হয়নি।
আফগানিস্তান থেকে আগামী বছরের জুলাই মাসে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার শুরু হবে বলে প্রেসিডেন্ট ওবামার প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানভিত্তিক আফগান তালেবানরা অপেক্ষা করছে যে তারা এরপর অভিযান জোরদার করবে। তাদের আশা ও আস্থা যে পাকিস্তানের শাসকেরা তাদের সমর্থন দেবে। এটা কেবল অতীতের ইতিহাস ও বর্তমান যোগাযোগের কারণেই তারা মনে করে, তা নয়। পাকিস্তানি সরকার, সেনাবাহিনী ও বিশ্লেষকদের কথাবার্তায়ও তা স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র আফগান সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ভারতের সাহায্য নিয়েছে—এ খবরে পাকিস্তানের অনেক বিশ্লেষকই এই উপসংহার টেনেছেন যে যুক্তরাষ্ট্র চায়, ভারত আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তার করুক। অনেকের হয়তো মনে থাকবে যে সোভিয়েত আগ্রাসনের সময় আফগানিস্তানের সরকারের প্রতি ভারতের পূর্ণ সমর্থন ছিল। ফলে তালেবান ও জঙ্গিদের প্রশ্নটিকে পাকিস্তানি শাসকেরা এবং সাধারণ মানুষ পাকিস্তান-ভারত সম্পর্কের বাইরে বিবেচনা করতে পারেন না।
পাকিস্তানে জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রতি সমর্থন কেবল রাষ্ট্রের কাছ থেকে আসে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। এই গোষ্ঠীগুলো পাকিস্তানের মূলধারার রাজনীতির দলগুলোর সঙ্গেও যুক্ত। তদুপরি সাম্প্রদায়িক মনোভাব, বিশেষ করে শিয়া-সুন্নি সংঘাতের মনোভাব চাঙা রাখার জন্য এই গোষ্ঠীগুলোর ভূমিকা রয়েছে। গত নয় বছরে অব্যাহত আফগানিস্তান যুদ্ধের সূত্র ধরে পাকিস্তানে মার্কিন ড্রোন হামলা, পাকিস্তানি সরকারের প্রতি মার্কিন সমর্থন অনেক পাকিস্তানিকেই মার্কিনবিরোধী করে তুলেছে। এই মনোভাব থেকেও কেউ কেউ জঙ্গিগোষ্ঠীকে সমর্থন করেন। এ সবই পাকিস্তানি সমাজের বিভিন্ন স্তরে, বিভিন্ন কারণে স্থায়ী হয়ে উঠেছে। ফলে আফগান তালেবান, পাকিস্তানি তালেবান, জঙ্গিগোষ্ঠী—এগুলো আর আলাদা করে বিবেচনায় থাকছে না। এই আত্মঘাতী প্রবণতার মাশুল গুনছে পাকিস্তানের মানুষ। এই আত্মঘাতী ও অন্তহীন সংঘাতের ফলে প্রতিদিন মানুষেরই মৃত্যু ঘটছে তা নয়, রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের স্থায়িত্বও দুর্বল হয়ে পড়ছে। আগামী বছরে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার শুরু হলে এই অঞ্চলের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে। সেই অধ্যায়ে পাকিস্তানের ভূমিকা কতটা ইতিবাচক হবে, সেটাই প্রশ্ন।
আলী রীয়াজ: অধ্যাপক, রাজনীতি ও সরকার বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র।

No comments

Powered by Blogger.