খোলা চোখে-বাংলাদেশ: এখনো ব্যর্থ রাষ্ট্র? by হাসান ফেরদৌস
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান দ্য ফান্ড ফর পিস এবং তাদের সহযোগী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মাসিক জার্নাল ফরেন পলিসি তাদের ২০১০ সালের ‘ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকা’ প্রকাশ করেছে। এই তালিকায় পৃথিবীর দেশগুলোকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে: অত্যন্ত সংকটাপন্ন, প্রায় সংকটাপন্ন, মাঝামাঝি, স্থিতিশীল ও সম্পূর্ণ স্থিতিশীল।
সোমালিয়া, চাদ ও সুদান হলো সবচেয়ে সংকটাপন্ন রাষ্ট্রের তালিকার প্রথম তিনটি দেশ। একই তালিকায় রয়েছে পাকিস্তান, ১০ নম্বরে। বাংলাদেশকে রাখা হয়েছে দ্বিতীয় ভাগে, অর্থাৎ প্রায় সংকটাপন্ন দেশের তালিকায়, ২৪ নম্বরে। তার ঠিক পরই রয়েছে শ্রীলঙ্কা ও নেপাল। দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র ভারত রয়েছে স্থিতিশীলদের তালিকায়, তার অবস্থান ৮৭ নম্বরে।
এই হিসাব দেখে উদ্বিগ্ন হবেন না। ফরেন পলিসি পত্রিকা বলল আর আমরা প্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হলাম, এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই। প্রকৃতপক্ষে প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশের জন্য বেশ কিছু সুখবরও রয়েছে। পূর্ব নির্ধারিত কতিপয় ‘ইন্ডিকেটরের’ ভিত্তিতে প্রতিবেদনটিতে তালিকাভুক্ত রাষ্ট্রসমূহের স্থিতাবস্থা নির্ণীত হয়েছে। সেই হিসাবে যেকোনো পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় সামাজিক খাতে বাংলাদেশে অধিক অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে বলে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনটি স্বীকার করেছে, গত এক দশকে বাংলাদেশ লক্ষণীয় অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করেছে, যদিও এর মোদ্দা অবস্থা এখনো ভঙ্গুর। জনসেবা খাতগুলোগুলো এখনো পিছিয়ে রয়েছে। সুপেয় জলের অভাব রয়েছে, চিকিৎসা খাতও সংকটে। তবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। ক্ষমতার কেন্দ্রে এখন একটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার, ফলে রাষ্ট্রক্ষমতার বৈধতা আগের তুলনায় অধিক। মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকলেও বৈধ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাজনৈতিক সহিংসতা কমেছে।
এই প্রতিবেদনে রাষ্ট্রের স্থিতাবস্থার জন্য পাঁচটি মৌল প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত হয়েছে এবং তাদের বর্তমান হাল বিবেচনা করে সুনির্দিষ্ট মান নির্ণীত হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ পাঁচটি প্রতিষ্ঠান ও তাদের জন্য নির্ধারিত মান এ রকম: রাজনৈতিক নেতৃত্ব (দুর্বল), সেনাবাহিনী (দুর্বল), পুলিশ (খারাপ), বিচারব্যবস্থা (দুর্বল) এবং গণপ্রশাসন (খারাপ)। প্রতিবেদনটিতে মন্তব্য করা হয়েছে, ক্ষমতার কেন্দ্রে এখন একটি নির্বাচিত সরকার থাকলেও দুর্নীতি ও রাজনৈতিক বিভক্তি ঠেকানো সম্ভব না হলে দেশটি অদূর ভবিষ্যতে আবারও সংকটাবস্থায় নিক্ষিপ্ত হতে পারে।
বস্তুত, এই প্রতিবেদনে এমন কিছুই নেই, যার জন্য আমাদের চেয়ার ছেড়ে নড়েচড়ে বসতে হবে, অথবা ‘গেল গেল’ বলে মাথার চুল ছিঁড়তে হবে। প্রকৃতপক্ষে আমার উল্টোই মনে হয়েছে। দুই বছর আগেও ফরেন পলিসির এই ইনডেক্সে বাংলাদেশের স্থান ছিল ১২ নম্বরে। অর্থাৎ সবচেয়ে দুর্বল বা প্রায় ব্যর্থ, এমন ১২টি রাষ্ট্রের একটি। আর গত বছর অর্থাৎ ২০০৯ সালে বাংলাদেশের স্থান ছিল ১৯ নম্বরে। রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও আধাসামরিক দুঃশাসন কাটিয়ে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের ফলে বাংলাদেশ যে প্রাতিষ্ঠানিক সুব্যবস্থা অর্জনের পথে অগ্রসর হচ্ছে, এই প্রতিবেদনে সে কথা স্পষ্ট। কিন্তু পাশাপাশি এ কথাও বলা হচ্ছে, সাবধান, বিপদ কিন্তু এখনো কেটে যায়নি। দেশটির গণতান্ত্রিক অবকাঠামো এখনো দুর্বল। সেখানে মৌল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ পায়ে দাঁড়াতে পারেনি। বিচারব্যবস্থার মতো মৌলিক প্রতিষ্ঠান এখনো কার্যত স্থবির হয়ে রয়েছে। রাজনৈতিক এলিটদের মধ্যে কোন্দলের অভ্যাস বদলায়নি। এই অবস্থা না বদলালে সামনে দুঃসময়।
পুরো প্রতিবেদনটি আপনারা এই ঠিকানায় পড়ে দেখতে পারেন: htpwwwforeignpolicy. com/articles/2010/06/21/2020 failed states_mdex_ interactive_map_and_rankings
যখন বলা হয় কোনো দেশ ব্যর্থ রাষ্ট্র্র, তার মানে সে দেশটির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ বা অকার্যকর। সোমালিয়াকে এই তালিকায় এক নম্বরে রাখা হয়েছে। তার কারণ দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে টিকে থাকলেও জাতিরাষ্ট্র হিসেবে দেশটি এখন আর কার্যত টিকে নেই। এখানে কোনো কার্যকর সরকার নেই, আইন ও বিচারব্যবস্থা নেই, নাগরিক কল্যাণমূলক কোনো উদ্যোগ নেই। কেউ বলবে না, বাংলাদেশের অবস্থা এই রকম। এই প্রতিবেদনেও তেমন কোনো ইঙ্গিত নেই। বরং উল্টোটাই ঠিক।
ফরেন পলিসি পত্রিকা বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে তকমা এঁটে না দিলেও প্রায় সেই রকম একটি কাজ করেছে দ্য কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট। এটিও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান। এদের নজর দেশের তথ্যব্যবস্থার ওপর। সিপিজে সম্প্রতি তাদের ২০১০ সালের ‘ইমপিউনিটি ইনডেক্স’ প্রকাশ করেছে। এই তালিকার লক্ষ্য সেসব দেশকে ক্রমানুসারে চিহ্নিত করা, যেখানে সাংবাদিকদের ওপর সহিংস আক্রমণ সবচেয়ে বেশি এবং এসব সহিংস কার্যকলাপের কোনো বিচারব্যবস্থা নেই। এই ইনডেক্সের উপনাম দেওয়া হয়েছে ‘গেটিং অ্যাওয়ে উইথ মার্ডার’। অর্থাৎ খুন করে পার পেয়ে যাওয়া। এমন ১২টি দেশকে ক্রমানুসারে এই ইনডেক্সে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এই তালিকার এক নম্বরে রয়েছে ইরাক, আর ১১ নম্বরে বাংলাদেশ। একটি দেশের মোট জনসংখ্যার শতাংশ হিসাবে সাংবাদিক খুনের অমীমাংসিত ঘটনার সংখ্যা বিবেচনা করে তালিকাটি নির্মিত। ২০০০ সাল থেকে ডিসেম্বর ২০০৯ পর্যন্ত পৃথিবীর সব দেশে সংঘটিত সাংবাদিক খুনের হিসাব তারা নিয়েছে। এই সময়ে পাঁচ বা তার চেয়ে বেশিসংখ্যক অমীমাংসিত খুনের ঘটনা রয়েছে যেসব দেশে, এই তালিকায় কেবল তারাই স্থান পেয়েছে। খুবই অপমানজনক এবং একইসঙ্গে উদ্বেগজনক। এই তালিকার প্রথম ১২টি দেশ হলো (ক্রমানুসারে): ইরাক, সোমালিয়া, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, কলাম্বিয়া, আফগানিস্তান, নেপাল, রাশিয়া, মেক্সিকো, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারত।
এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জন্য একটা ভালো খবর হলো ২০০৫ সালের পর সিপিজের হিসাব মতে, বাংলাদেশে কোনো সাংবাদিক খুন হননি। কিন্তু এর আগে পাঁচ বছর যে সাতজন সাংবাদিক খুন হন বলে শনাক্ত করা হয়, তাঁদের একটির ক্ষেত্রেও চূড়ান্ত রায় ঘোষিত হয়নি। অর্থাৎ সুবিচার মেলেনি। সবশেষ যে খুনের ঘটনা ঘটে, তার শিকার ছিলেন সাংবাদিক গৌতম দাস। সমকাল-এর ফরিদপুর সংবাদদাতা এই সাংবাদিক ২০০৫ সালে নিজ দপ্তরে কর্মরত অবস্থায় খুন হন। পুলিশ বেশ কয়েকজন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করলেও এখন পর্যন্ত কেউ দোষী সাব্যস্ত হননি। খুন করে বিচার না পাওয়ার এই পরিস্থিতিকেই সিপিজে বলেছে, ‘গেটিং অ্যাওয়ে উইথ মার্ডার’।
ইন্টারনেটে এই প্রতিবেদনটি পাওয়া যাবে এখানে: http://www.cpj.org/reports/2010/04/cpj-2020-impunity-index-getting-away-with-murder.php#index
বাংলাদেশের কথা উল্লেখ করে সিপিজে অন্যত্র জানিয়েছে, সেখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হুমকির সম্মুখীন। এ দেশে ইন্টারনেটে তথ্যপ্রবাহের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ জারি হয়েছে, সাংবাদিক গ্রেপ্তার হয়েছেন, একাধিক পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, টিভি চ্যানেলের সম্প্রচারও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এসবই উদ্বেগের কথা। সিপিজে সরকারের কাছে জানতে চেয়েছে, এমন কী ঘটনা ঘটল যে বলা নেই, কওয়া নেই পত্রিকা ও টিভি চ্যানেঠ বন্ধের মতো পদক্ষেপ নিতে হলো? লক্ষণীয়, আটককৃত সাংবাদিক বা নিষিদ্ধ ঘোষিত পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল, তারা সবাই-ই বিরোধীদলীয়।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, সংবাদ প্রবাহের ওপর এই নিয়ন্ত্রণ ও সংবাদ কর্মীদের বিরুদ্ধে এই যে নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা, তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পেশাদার সাংবাদিকেরা কার্যত কিছুই করেননি। না, কথাটি ঠিক বলা হলো না। পত্রিকায় বিবৃতি গেছে, প্রতিবাদ সভা হয়েছে, মানববন্ধনের আয়োজনও হয়েছে। কিন্তু এসবই হয়েছে কিছুটা লোক দেখানো, দায়সারা গোছের। সহকর্মীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে সংবাদপত্র কর্মীরা একযোগে কর্মবিরতির ডাক দিতে পারতেন, রেডিও-টিভির টক শোতে অংশগ্রহণে অস্বীকার করতে পারতেন, রাস্তায় মিছিল করে তাঁদের প্রতিবাদ জানাতে পারতেন। এসবের কিছুই হয়নি। সবচেয়ে কঠিন যে বিবৃতি, তা এসেছে ওই সিপিজের কাছ থেকেই।
গণতন্ত্রের একটি প্রধান শর্ত, তথ্যব্যবস্থার স্বাধীনতা। পত্রপত্রিকা এবং রেডিও-টিভির মাধ্যমে দেশের পরিস্থিতি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে, সেই তথ্যের ভিত্তিতে চলতি রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যাপারে দেশের নাগরিক গোষ্ঠী তাদের মতামত নির্ধারণ করে। সরকার যখন সে তথ্য পরিবেশনের বিরুদ্ধে নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তখন বুঝতে হবে কোনো কোনো খবর দেশের মানুষ জানুক, সরকার তা চায় না। কিন্তু মুখ চেপে রেখে কি কথা বন্ধ করা যায়?
ধরা যাক, ধর্মের ওপর আক্রমণ করে বা দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি ব্যঙ্গ করে কোনো পত্রিকায় বা ইন্টারনেটে খবর বা ছবি ছাপা হলো। সরকার জাতীয় নিরাপত্তা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বা অন্য কোনো যুক্তি দেখিয়ে সেসব তথ্যমাধ্যম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। কিন্তু তেমন সিদ্ধান্ত নিলে এ নিয়ে খবর চালাচালি কি বন্ধ হয়ে যাবে? আগে কোনো একসময় তা সম্ভব হলেও এখন এই ইন্টারনেটের যুগে, তা এক কথায় অসম্ভব। ঢাকায় না হয় ইন্টারনেটের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হলো, কিন্তু বাকি পৃথিবীতে যে সে খবরের চালাচালি অব্যাহত রইল, তার কী হবে? ইরানিরা ও চীনারা সে চেষ্টা কম করেনি, কিন্তু খুব একটা সফল হয়েছে বলে মনে হয় না। এর বদলে অনেক বেশি কার্যকর ব্যবস্থা হলো নাগরিকদের হাতে প্রতিবাদের চাবিটি রেখে দেওয়া। কোন ধর্মকে যদি কেউ কটক্ষ করে, তো তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে, এমন লোক রয়েছে লক্ষ লক্ষ। প্রতিবাদটা ওই ইন্টারনেটের মাধ্যমেই, তাদেরই করতে দেওয়া হোক না। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর বিরুদ্ধে যদি কেউ গালি দেয়, তাহলে তাকে পাল্টা গালি দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে ওই নেত্রীর সমর্থক বা গুণমুগ্ধ নাগরিকদের। যদি নাগরিকদের তরফ থেকে পাল্টা তেমন কোনো ব্যবস্থা না আসে, তাহলে বুঝতে হবে নেতা-নেত্রীর পায়ের তলায় মাটি দুর্বল হয়ে এসেছে।
এই সহজ কথাটা যদি আমাদের রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকেরা কমবেশি মেনে নেন, তাহলে আমাদের দেশকে আর কোনো তালিকায়-ফালিকায় দেখে অকারণে মন খারাপ করতে হয় না।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
এই হিসাব দেখে উদ্বিগ্ন হবেন না। ফরেন পলিসি পত্রিকা বলল আর আমরা প্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হলাম, এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই। প্রকৃতপক্ষে প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশের জন্য বেশ কিছু সুখবরও রয়েছে। পূর্ব নির্ধারিত কতিপয় ‘ইন্ডিকেটরের’ ভিত্তিতে প্রতিবেদনটিতে তালিকাভুক্ত রাষ্ট্রসমূহের স্থিতাবস্থা নির্ণীত হয়েছে। সেই হিসাবে যেকোনো পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় সামাজিক খাতে বাংলাদেশে অধিক অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে বলে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনটি স্বীকার করেছে, গত এক দশকে বাংলাদেশ লক্ষণীয় অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করেছে, যদিও এর মোদ্দা অবস্থা এখনো ভঙ্গুর। জনসেবা খাতগুলোগুলো এখনো পিছিয়ে রয়েছে। সুপেয় জলের অভাব রয়েছে, চিকিৎসা খাতও সংকটে। তবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। ক্ষমতার কেন্দ্রে এখন একটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার, ফলে রাষ্ট্রক্ষমতার বৈধতা আগের তুলনায় অধিক। মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকলেও বৈধ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাজনৈতিক সহিংসতা কমেছে।
এই প্রতিবেদনে রাষ্ট্রের স্থিতাবস্থার জন্য পাঁচটি মৌল প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত হয়েছে এবং তাদের বর্তমান হাল বিবেচনা করে সুনির্দিষ্ট মান নির্ণীত হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ পাঁচটি প্রতিষ্ঠান ও তাদের জন্য নির্ধারিত মান এ রকম: রাজনৈতিক নেতৃত্ব (দুর্বল), সেনাবাহিনী (দুর্বল), পুলিশ (খারাপ), বিচারব্যবস্থা (দুর্বল) এবং গণপ্রশাসন (খারাপ)। প্রতিবেদনটিতে মন্তব্য করা হয়েছে, ক্ষমতার কেন্দ্রে এখন একটি নির্বাচিত সরকার থাকলেও দুর্নীতি ও রাজনৈতিক বিভক্তি ঠেকানো সম্ভব না হলে দেশটি অদূর ভবিষ্যতে আবারও সংকটাবস্থায় নিক্ষিপ্ত হতে পারে।
বস্তুত, এই প্রতিবেদনে এমন কিছুই নেই, যার জন্য আমাদের চেয়ার ছেড়ে নড়েচড়ে বসতে হবে, অথবা ‘গেল গেল’ বলে মাথার চুল ছিঁড়তে হবে। প্রকৃতপক্ষে আমার উল্টোই মনে হয়েছে। দুই বছর আগেও ফরেন পলিসির এই ইনডেক্সে বাংলাদেশের স্থান ছিল ১২ নম্বরে। অর্থাৎ সবচেয়ে দুর্বল বা প্রায় ব্যর্থ, এমন ১২টি রাষ্ট্রের একটি। আর গত বছর অর্থাৎ ২০০৯ সালে বাংলাদেশের স্থান ছিল ১৯ নম্বরে। রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও আধাসামরিক দুঃশাসন কাটিয়ে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের ফলে বাংলাদেশ যে প্রাতিষ্ঠানিক সুব্যবস্থা অর্জনের পথে অগ্রসর হচ্ছে, এই প্রতিবেদনে সে কথা স্পষ্ট। কিন্তু পাশাপাশি এ কথাও বলা হচ্ছে, সাবধান, বিপদ কিন্তু এখনো কেটে যায়নি। দেশটির গণতান্ত্রিক অবকাঠামো এখনো দুর্বল। সেখানে মৌল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ পায়ে দাঁড়াতে পারেনি। বিচারব্যবস্থার মতো মৌলিক প্রতিষ্ঠান এখনো কার্যত স্থবির হয়ে রয়েছে। রাজনৈতিক এলিটদের মধ্যে কোন্দলের অভ্যাস বদলায়নি। এই অবস্থা না বদলালে সামনে দুঃসময়।
পুরো প্রতিবেদনটি আপনারা এই ঠিকানায় পড়ে দেখতে পারেন: htpwwwforeignpolicy. com/articles/2010/06/21/2020 failed states_mdex_ interactive_map_and_rankings
যখন বলা হয় কোনো দেশ ব্যর্থ রাষ্ট্র্র, তার মানে সে দেশটির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ বা অকার্যকর। সোমালিয়াকে এই তালিকায় এক নম্বরে রাখা হয়েছে। তার কারণ দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে টিকে থাকলেও জাতিরাষ্ট্র হিসেবে দেশটি এখন আর কার্যত টিকে নেই। এখানে কোনো কার্যকর সরকার নেই, আইন ও বিচারব্যবস্থা নেই, নাগরিক কল্যাণমূলক কোনো উদ্যোগ নেই। কেউ বলবে না, বাংলাদেশের অবস্থা এই রকম। এই প্রতিবেদনেও তেমন কোনো ইঙ্গিত নেই। বরং উল্টোটাই ঠিক।
ফরেন পলিসি পত্রিকা বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে তকমা এঁটে না দিলেও প্রায় সেই রকম একটি কাজ করেছে দ্য কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট। এটিও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান। এদের নজর দেশের তথ্যব্যবস্থার ওপর। সিপিজে সম্প্রতি তাদের ২০১০ সালের ‘ইমপিউনিটি ইনডেক্স’ প্রকাশ করেছে। এই তালিকার লক্ষ্য সেসব দেশকে ক্রমানুসারে চিহ্নিত করা, যেখানে সাংবাদিকদের ওপর সহিংস আক্রমণ সবচেয়ে বেশি এবং এসব সহিংস কার্যকলাপের কোনো বিচারব্যবস্থা নেই। এই ইনডেক্সের উপনাম দেওয়া হয়েছে ‘গেটিং অ্যাওয়ে উইথ মার্ডার’। অর্থাৎ খুন করে পার পেয়ে যাওয়া। এমন ১২টি দেশকে ক্রমানুসারে এই ইনডেক্সে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এই তালিকার এক নম্বরে রয়েছে ইরাক, আর ১১ নম্বরে বাংলাদেশ। একটি দেশের মোট জনসংখ্যার শতাংশ হিসাবে সাংবাদিক খুনের অমীমাংসিত ঘটনার সংখ্যা বিবেচনা করে তালিকাটি নির্মিত। ২০০০ সাল থেকে ডিসেম্বর ২০০৯ পর্যন্ত পৃথিবীর সব দেশে সংঘটিত সাংবাদিক খুনের হিসাব তারা নিয়েছে। এই সময়ে পাঁচ বা তার চেয়ে বেশিসংখ্যক অমীমাংসিত খুনের ঘটনা রয়েছে যেসব দেশে, এই তালিকায় কেবল তারাই স্থান পেয়েছে। খুবই অপমানজনক এবং একইসঙ্গে উদ্বেগজনক। এই তালিকার প্রথম ১২টি দেশ হলো (ক্রমানুসারে): ইরাক, সোমালিয়া, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, কলাম্বিয়া, আফগানিস্তান, নেপাল, রাশিয়া, মেক্সিকো, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারত।
এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জন্য একটা ভালো খবর হলো ২০০৫ সালের পর সিপিজের হিসাব মতে, বাংলাদেশে কোনো সাংবাদিক খুন হননি। কিন্তু এর আগে পাঁচ বছর যে সাতজন সাংবাদিক খুন হন বলে শনাক্ত করা হয়, তাঁদের একটির ক্ষেত্রেও চূড়ান্ত রায় ঘোষিত হয়নি। অর্থাৎ সুবিচার মেলেনি। সবশেষ যে খুনের ঘটনা ঘটে, তার শিকার ছিলেন সাংবাদিক গৌতম দাস। সমকাল-এর ফরিদপুর সংবাদদাতা এই সাংবাদিক ২০০৫ সালে নিজ দপ্তরে কর্মরত অবস্থায় খুন হন। পুলিশ বেশ কয়েকজন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করলেও এখন পর্যন্ত কেউ দোষী সাব্যস্ত হননি। খুন করে বিচার না পাওয়ার এই পরিস্থিতিকেই সিপিজে বলেছে, ‘গেটিং অ্যাওয়ে উইথ মার্ডার’।
ইন্টারনেটে এই প্রতিবেদনটি পাওয়া যাবে এখানে: http://www.cpj.org/reports/2010/04/cpj-2020-impunity-index-getting-away-with-murder.php#index
বাংলাদেশের কথা উল্লেখ করে সিপিজে অন্যত্র জানিয়েছে, সেখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হুমকির সম্মুখীন। এ দেশে ইন্টারনেটে তথ্যপ্রবাহের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ জারি হয়েছে, সাংবাদিক গ্রেপ্তার হয়েছেন, একাধিক পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, টিভি চ্যানেলের সম্প্রচারও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এসবই উদ্বেগের কথা। সিপিজে সরকারের কাছে জানতে চেয়েছে, এমন কী ঘটনা ঘটল যে বলা নেই, কওয়া নেই পত্রিকা ও টিভি চ্যানেঠ বন্ধের মতো পদক্ষেপ নিতে হলো? লক্ষণীয়, আটককৃত সাংবাদিক বা নিষিদ্ধ ঘোষিত পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল, তারা সবাই-ই বিরোধীদলীয়।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, সংবাদ প্রবাহের ওপর এই নিয়ন্ত্রণ ও সংবাদ কর্মীদের বিরুদ্ধে এই যে নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা, তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পেশাদার সাংবাদিকেরা কার্যত কিছুই করেননি। না, কথাটি ঠিক বলা হলো না। পত্রিকায় বিবৃতি গেছে, প্রতিবাদ সভা হয়েছে, মানববন্ধনের আয়োজনও হয়েছে। কিন্তু এসবই হয়েছে কিছুটা লোক দেখানো, দায়সারা গোছের। সহকর্মীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে সংবাদপত্র কর্মীরা একযোগে কর্মবিরতির ডাক দিতে পারতেন, রেডিও-টিভির টক শোতে অংশগ্রহণে অস্বীকার করতে পারতেন, রাস্তায় মিছিল করে তাঁদের প্রতিবাদ জানাতে পারতেন। এসবের কিছুই হয়নি। সবচেয়ে কঠিন যে বিবৃতি, তা এসেছে ওই সিপিজের কাছ থেকেই।
গণতন্ত্রের একটি প্রধান শর্ত, তথ্যব্যবস্থার স্বাধীনতা। পত্রপত্রিকা এবং রেডিও-টিভির মাধ্যমে দেশের পরিস্থিতি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে, সেই তথ্যের ভিত্তিতে চলতি রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যাপারে দেশের নাগরিক গোষ্ঠী তাদের মতামত নির্ধারণ করে। সরকার যখন সে তথ্য পরিবেশনের বিরুদ্ধে নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তখন বুঝতে হবে কোনো কোনো খবর দেশের মানুষ জানুক, সরকার তা চায় না। কিন্তু মুখ চেপে রেখে কি কথা বন্ধ করা যায়?
ধরা যাক, ধর্মের ওপর আক্রমণ করে বা দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি ব্যঙ্গ করে কোনো পত্রিকায় বা ইন্টারনেটে খবর বা ছবি ছাপা হলো। সরকার জাতীয় নিরাপত্তা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বা অন্য কোনো যুক্তি দেখিয়ে সেসব তথ্যমাধ্যম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। কিন্তু তেমন সিদ্ধান্ত নিলে এ নিয়ে খবর চালাচালি কি বন্ধ হয়ে যাবে? আগে কোনো একসময় তা সম্ভব হলেও এখন এই ইন্টারনেটের যুগে, তা এক কথায় অসম্ভব। ঢাকায় না হয় ইন্টারনেটের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হলো, কিন্তু বাকি পৃথিবীতে যে সে খবরের চালাচালি অব্যাহত রইল, তার কী হবে? ইরানিরা ও চীনারা সে চেষ্টা কম করেনি, কিন্তু খুব একটা সফল হয়েছে বলে মনে হয় না। এর বদলে অনেক বেশি কার্যকর ব্যবস্থা হলো নাগরিকদের হাতে প্রতিবাদের চাবিটি রেখে দেওয়া। কোন ধর্মকে যদি কেউ কটক্ষ করে, তো তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে, এমন লোক রয়েছে লক্ষ লক্ষ। প্রতিবাদটা ওই ইন্টারনেটের মাধ্যমেই, তাদেরই করতে দেওয়া হোক না। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর বিরুদ্ধে যদি কেউ গালি দেয়, তাহলে তাকে পাল্টা গালি দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে ওই নেত্রীর সমর্থক বা গুণমুগ্ধ নাগরিকদের। যদি নাগরিকদের তরফ থেকে পাল্টা তেমন কোনো ব্যবস্থা না আসে, তাহলে বুঝতে হবে নেতা-নেত্রীর পায়ের তলায় মাটি দুর্বল হয়ে এসেছে।
এই সহজ কথাটা যদি আমাদের রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকেরা কমবেশি মেনে নেন, তাহলে আমাদের দেশকে আর কোনো তালিকায়-ফালিকায় দেখে অকারণে মন খারাপ করতে হয় না।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments