চারদিক-ধুম লেগেছে মধুবনে by আজাদুর রহমান
সাতক্ষীরা রেঞ্জের বুড়িগোয়ালিনীকে মধুরেঞ্জ বললে ভুল হয় না। মৌমাছির বড় আখড়া এটি। পুরো সুন্দরবনের দুই-তৃতীয়াংশ মধুই নাকি আহরিত হয় এখান থেকে। মধুর সময় এখন। জ্যৈষ্ঠের মাঝ থেকে পরের দুই মাস। প্রথমে ফোটে গরান আর খলসে ফুল। তারপর একে একে ফুটতে থাকে গেওয়া, বাইন, কাঁকড়া, কেওড়া, পশুর।
হরিনগরের মধুয়ালদের মনে মনে ধুম পড়ে যায় তখন। সেসব মধুমনা মৌয়ালের খোঁজে বেরোলে চুনোপুঁটির মন নিয়ে কাজ হবে না। আপাতত টার্গেট বনঘেঁষা মুন্সীগঞ্জ বাজার। জেলা শহর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ। মাঝে পেরোতে হবে দেবহাটা এবং কালীগঞ্জ উপজেলা, তারপর লম্বা শ্যামনগরের পায়ের কাছে বনবতী মুন্সীগঞ্জ। এখন এই আগবেলাতে দলাপাকানো মেঘ চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাচ্ছে আষাঢ়ের বাতাস। টালমাটাল রোদ সামলে নেওয়ার আগেই মেঘের স্পঞ্জ চিপে দরদর করে বৃষ্টিধারা। জলভারে নুয়ে পড়েছে কিশোরী রেইনট্রি। ছিপছিপে কালো কেউটে পিচ ধরে হু-হু করে ছুটছে মোটরসাইকেল। পেছনের সিটে জ্যাবজ্যাবে বগুড়ার ব্যাকব্রাশি সালেক আহমেদ। ভেজা কদমপাতার মতো তাঁর বুকজামা লেপ্টে আছে আমার পিঠে। সুবিধা হলো, টানা পথের পুরোটাই পিচ। এমনকি মুন্সীগঞ্জ নামার পর বাজারের লোকজন ঠোঁট উঁচিয়ে, হাত নাড়িয়ে হরিনগর বাজারের যে পথটা দেখাল, সেটিও সরু পিচগলি।
বনজ বাজারের কোমর ধরে বেয়ে ওঠা হরিনগরের সঙ্গে সুন্দরবনের পার্থক্য কেবলই চুনকুড়ি নদী। নদী সাঁতরে হামেশাই বাঘ এসে হানা দেয় এখানে। তারপর দু-চারজনকে হত-আহত করে জায়গামতো ফিরে যায়। দুর্ভাগ্যবশত সেসব বাঘের কেউ কেউ আক্রোশী গ্রামবাসীর গণপিটুনিতে মারাও পড়ে। ফিতে নদীটির প্রায় শুরুতেই মহব্বত সাজুনির বাড়ি। ‘সাজুনি’ মানে সর্দার। পরিচয়পালা সারা হলে সাজুনির বাড়িতেই সবার ডাক পড়ল। মহব্বতের ঘোমটামুখো বউ বারান্দাতলে চার-পাঁচটা মাদুর পেতে দিলে গোল হয়ে বসে পড়ি। হরিনগরের বাচ্চাগুলো বেশ মিশুক-মনের। সহজেই এরা অচেনা মানুষের গায়ের সঙ্গে গা ঘেঁষে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। শুনতে থাকে আলাপসালাপ। এদিক-ওদিক কথাবার্তা চালাচালির পর একসময় গল্পগুলো মৌয়ালদের জীবনের দিকে বয়ে যেতে আরম্ভ করে। এক রকম শ্রদ্ধাবোধের কারণে এরা সরাসরি মৌমাছির নাম ধরে না, মৌমাছি না বলে, বলে মধুপোকা। মধুর জন্য তারা গভীর বনে বাসা বাঁধে আর জলে ভেসে সংসার সাজায়। বনজীবনে বাঘের দেখা পায়নি কিংবা বাঘের কবলে কোনো নিকটাত্মীয়ের প্রাণ যায়নি, এমন কেউ নেই। বাঘ ছাড়াও বিষাক্ত সাপ ও পোকামাকড়ের মতো বিবিধ ভয়ংকর প্রাণী মোকাবিলা করে মধুর খোঁজে বনে নামতে হয়। ম্যানগ্রোভ ভেঙে এগোতে হয় ঘন জঙ্গলের গহিনে। একদল মৌয়াল সেসব বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা আমাকে শোনাতে থাকে। খেই হারানোর আগেই সহমৌয়ালেরা সায় দিয়ে গল্পের সুতো তুলে দেয়। ফলে গল্পগুলো আর একঘেয়েমিতে আটকা পড়ে না, বরং সুরত, ছুন্নত, মোরশেখ, রহমান ও গনি গাজিদের মুখ থেকে মুখে লাফাতে থাকে। গত বছর সুন্নতের ছেলেকে বাঘে ধরেছিল। দু-একটা থাবা দিয়ে তেমন আর সুযোগ নিতে পারেনি। একযোগে দা-লাঠি দিয়ে বাঘটাকে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল ওরা। ভয়ংকর সেসব বিপদ-কাহিনীর বর্ণনা করতে গিয়ে মহব্বতের মুখটা দর্পময় হয়ে ওঠে, ‘শোনেন, এখানে আপনার কলিজার ওজন যদি এক কেজি হয়, বনে নামার পর হয়ে যাবে দুই কেজি। আপনার সাহস অটোমেটিক বেড়ে যাবে।’
১২ জনে এক নৌকার মৌদল। বনে পা দিয়ে সাজুনি পুরো দলকে ‘ছাটা (কাজ) বিলি’ করে। দুজন ধামা ধরে, অন্য দুজন চাক কাটে। একজন কাঁচা পাতা পুড়ে ধোমা (ধোঁয়া) তোলে। বাকিরা হাতে লাঠি আর মুখে জিকির তুলে সমানে এগিয়ে চলে। মৌমাছির গতিবিধি সম্পর্কে তাদের এক প্রকার ঠিকানা হয়ে গেছে। গনি গাজি মর্জিমতো ব্যাখ্যা করেন, ‘বনের ভিতিরে দাঁড়িয়ে থাকলি পরে পোকা কোন দিহে যাইচ্ছে আর কোন দিহে থেকে আইসতিছে ও আপনের পোকা দেখলেই বোজা যায়। মধু বোজাই পোকা একভাবে চলে আর যারা মধু আহরণি তারা চলে আরেকভাবে।’ চলতিপথে কেউ মৌচাক দেখে ফেললে জোরে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে হাঁক ছাড়ে। হাঁক শুনে সহমৌয়ালেরা যে যার জায়গামতো দাঁড়িয়ে পড়ে। এবার লাইন থেকে চারজন বেরিয়ে মৌচাকের দিকে এগিয়ে যায়। কপাল ভালো হলে এক চাকে এক-দুই মণ মধুও পাওয়া যায়। সংগ্রহ শেষে মৌয়ালেরা আবার লাইনমতো হাঁটা দেয়। সাজুনি ছাড়াও দলে একজন ‘বাউরচি’ থাকে। দল বনে ঢুকলে সে রান্না করে আর চলার সময় নৌকার হাল ধরে। এ ছাড়া তার হাতে মোষের শিং ধরিয়ে দেওয়া হয়। বিপদ টের পেলে বাউরচি গায়ের জোরে শিংয়ে ফুঁ দিতে থাকে। আওয়াজ শুনে বনে ঢোকা মৌয়াল দল তখন তাড়াতাড়ি নৌকায় ফিরে আসে।
দিন শেষে নৌকা নোঙরে রেখে গাদাগাদি মৌয়াল দল ঘুমিয়ে পড়ে। মাঝনদীও একেবারে ভয়হীন হয় না। বাঘ সাঁতরে আসে নৌকার কাছে।
এত মৃত্যু সম্ভব জেনেও কেন যান? এ রকম প্রশ্নের জবাবে এরা বলে, ‘করবটা কী! জমিজিরাত নেই যে আবাদ করব। বছরে দুই-তিন মাস বনে থাহি। বাদবাকি মাসগুলোতে মাছ ধরি।’ মহাজনের দাদনের টাকায় পুরো মাসের রসদ নিয়ে তবে বনে ঢোকে মৌয়ালেরা। নেশা এমন প্রবল যে মধুমাসে বনে না গিয়ে তারা ঠিক থাকতে পারে না। বউয়েরাও জানে বছরের তিন মাস স্বামীদের পাওয়া যাবে না। সুন্দরবনই তখন তাদের বাড়িঘর।
বনজ বাজারের কোমর ধরে বেয়ে ওঠা হরিনগরের সঙ্গে সুন্দরবনের পার্থক্য কেবলই চুনকুড়ি নদী। নদী সাঁতরে হামেশাই বাঘ এসে হানা দেয় এখানে। তারপর দু-চারজনকে হত-আহত করে জায়গামতো ফিরে যায়। দুর্ভাগ্যবশত সেসব বাঘের কেউ কেউ আক্রোশী গ্রামবাসীর গণপিটুনিতে মারাও পড়ে। ফিতে নদীটির প্রায় শুরুতেই মহব্বত সাজুনির বাড়ি। ‘সাজুনি’ মানে সর্দার। পরিচয়পালা সারা হলে সাজুনির বাড়িতেই সবার ডাক পড়ল। মহব্বতের ঘোমটামুখো বউ বারান্দাতলে চার-পাঁচটা মাদুর পেতে দিলে গোল হয়ে বসে পড়ি। হরিনগরের বাচ্চাগুলো বেশ মিশুক-মনের। সহজেই এরা অচেনা মানুষের গায়ের সঙ্গে গা ঘেঁষে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। শুনতে থাকে আলাপসালাপ। এদিক-ওদিক কথাবার্তা চালাচালির পর একসময় গল্পগুলো মৌয়ালদের জীবনের দিকে বয়ে যেতে আরম্ভ করে। এক রকম শ্রদ্ধাবোধের কারণে এরা সরাসরি মৌমাছির নাম ধরে না, মৌমাছি না বলে, বলে মধুপোকা। মধুর জন্য তারা গভীর বনে বাসা বাঁধে আর জলে ভেসে সংসার সাজায়। বনজীবনে বাঘের দেখা পায়নি কিংবা বাঘের কবলে কোনো নিকটাত্মীয়ের প্রাণ যায়নি, এমন কেউ নেই। বাঘ ছাড়াও বিষাক্ত সাপ ও পোকামাকড়ের মতো বিবিধ ভয়ংকর প্রাণী মোকাবিলা করে মধুর খোঁজে বনে নামতে হয়। ম্যানগ্রোভ ভেঙে এগোতে হয় ঘন জঙ্গলের গহিনে। একদল মৌয়াল সেসব বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা আমাকে শোনাতে থাকে। খেই হারানোর আগেই সহমৌয়ালেরা সায় দিয়ে গল্পের সুতো তুলে দেয়। ফলে গল্পগুলো আর একঘেয়েমিতে আটকা পড়ে না, বরং সুরত, ছুন্নত, মোরশেখ, রহমান ও গনি গাজিদের মুখ থেকে মুখে লাফাতে থাকে। গত বছর সুন্নতের ছেলেকে বাঘে ধরেছিল। দু-একটা থাবা দিয়ে তেমন আর সুযোগ নিতে পারেনি। একযোগে দা-লাঠি দিয়ে বাঘটাকে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল ওরা। ভয়ংকর সেসব বিপদ-কাহিনীর বর্ণনা করতে গিয়ে মহব্বতের মুখটা দর্পময় হয়ে ওঠে, ‘শোনেন, এখানে আপনার কলিজার ওজন যদি এক কেজি হয়, বনে নামার পর হয়ে যাবে দুই কেজি। আপনার সাহস অটোমেটিক বেড়ে যাবে।’
১২ জনে এক নৌকার মৌদল। বনে পা দিয়ে সাজুনি পুরো দলকে ‘ছাটা (কাজ) বিলি’ করে। দুজন ধামা ধরে, অন্য দুজন চাক কাটে। একজন কাঁচা পাতা পুড়ে ধোমা (ধোঁয়া) তোলে। বাকিরা হাতে লাঠি আর মুখে জিকির তুলে সমানে এগিয়ে চলে। মৌমাছির গতিবিধি সম্পর্কে তাদের এক প্রকার ঠিকানা হয়ে গেছে। গনি গাজি মর্জিমতো ব্যাখ্যা করেন, ‘বনের ভিতিরে দাঁড়িয়ে থাকলি পরে পোকা কোন দিহে যাইচ্ছে আর কোন দিহে থেকে আইসতিছে ও আপনের পোকা দেখলেই বোজা যায়। মধু বোজাই পোকা একভাবে চলে আর যারা মধু আহরণি তারা চলে আরেকভাবে।’ চলতিপথে কেউ মৌচাক দেখে ফেললে জোরে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে হাঁক ছাড়ে। হাঁক শুনে সহমৌয়ালেরা যে যার জায়গামতো দাঁড়িয়ে পড়ে। এবার লাইন থেকে চারজন বেরিয়ে মৌচাকের দিকে এগিয়ে যায়। কপাল ভালো হলে এক চাকে এক-দুই মণ মধুও পাওয়া যায়। সংগ্রহ শেষে মৌয়ালেরা আবার লাইনমতো হাঁটা দেয়। সাজুনি ছাড়াও দলে একজন ‘বাউরচি’ থাকে। দল বনে ঢুকলে সে রান্না করে আর চলার সময় নৌকার হাল ধরে। এ ছাড়া তার হাতে মোষের শিং ধরিয়ে দেওয়া হয়। বিপদ টের পেলে বাউরচি গায়ের জোরে শিংয়ে ফুঁ দিতে থাকে। আওয়াজ শুনে বনে ঢোকা মৌয়াল দল তখন তাড়াতাড়ি নৌকায় ফিরে আসে।
দিন শেষে নৌকা নোঙরে রেখে গাদাগাদি মৌয়াল দল ঘুমিয়ে পড়ে। মাঝনদীও একেবারে ভয়হীন হয় না। বাঘ সাঁতরে আসে নৌকার কাছে।
এত মৃত্যু সম্ভব জেনেও কেন যান? এ রকম প্রশ্নের জবাবে এরা বলে, ‘করবটা কী! জমিজিরাত নেই যে আবাদ করব। বছরে দুই-তিন মাস বনে থাহি। বাদবাকি মাসগুলোতে মাছ ধরি।’ মহাজনের দাদনের টাকায় পুরো মাসের রসদ নিয়ে তবে বনে ঢোকে মৌয়ালেরা। নেশা এমন প্রবল যে মধুমাসে বনে না গিয়ে তারা ঠিক থাকতে পারে না। বউয়েরাও জানে বছরের তিন মাস স্বামীদের পাওয়া যাবে না। সুন্দরবনই তখন তাদের বাড়িঘর।
No comments