মত দ্বিমত-দলীয় প্রভাবের বাইরে রাখতে হবে by এস এম এ ফায়েজ

ছাত্ররাজনীতির নামে শিক্ষাঙ্গনে যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে, তা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে ছাত্রসংগঠনগুলোর ভূমিকা কী হওয়া উচিত? এ ব্যাপারে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরই বা কী করণীয়? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক উপাচার্য।


বেশ কিছুদিন ধরে ছাত্ররাজনীতিতে সাংঘর্ষিক অবস্থা লক্ষ করা যাচ্ছে। সর্বশেষ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তা ভয়াবহ আকারে রূপ নিয়েছে। এ ঘটনা ছাত্র সংগঠনগুলো তো বটেই, সার্বিকভাবে শিক্ষাঙ্গনের জন্য উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। সরকারও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে বলে মনে করি। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে সরকার কঠোর হবে—এটাই জনগণ প্রত্যাশা করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা একান্ত মেধার পরিচয় দিয়েই পড়াশোনা করতে আসে। তারা চায় পড়াশোনার সুষ্ঠু পরিবেশ, নিয়মিত ক্লাস ও পরীক্ষা হবে। আর এ সব নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও সরকারের। কিন্তু বিশ্বদ্যািলয় পর্যায়ে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত হওয়ার পর অনেকেই সংঘাত-সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। এভাবে চলতে থাকলে ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে জনমনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হবে।
ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সততা ও স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে উদাহরণ সৃষ্টি করবে। কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ডে যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাতে ছাত্ররাজনীতির ওপর জনগণ আস্থা রাখতে পারছে না। সাধারণ ছাত্ররাও ছাত্র রাজনীতি সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছে।
ছাত্ররাজনীতির বর্তমান হাল আমাদের আরও বেশি শঙ্কিত করে এ কারণে যে, এরা ভবিষ্যতে যোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পারবে না। অথচ জাতি তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। ছাত্ররাজনীতির কথা বললে অবশ্যই ছাত্র সংসদগুলোর কথা আসবে। একসময় নির্বাচিত ছাত্র সংসদগুলোই ছাত্ররাজনীতিকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করত। আবারও আমাদের সেই অবস্থায় ফিরে যেতে হবে।
ছাত্ররাজনীতির বিপর্যয়ের কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ বলা কঠিন। তবে যারা ছাত্ররাজনীতিতে আসছে, তাদের বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে। মনিটরিং করতে হবে তারা কী করছে। ছাত্র সংগঠনগুলোকে দলীয় রাজনীতির বাইরে রাখতে পারলে অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যাবে। ছাত্রদল যে বিএনপির আর ছাত্রলীগ যে আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন নয়—এ কথা মুখে বললেই হবে না, কাজেও প্রমাণ দিতে হবে। প্রত্যেককে সাংগঠনিক বিষয়ে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।
ছাত্ররাজনীতিকে সঠিক পথে নিয়ে আসতে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। ছাত্ররাজনীতির নামে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে, তা কঠোর হাতে মোকাবিলা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেওয়া যাবে না। শিক্ষাঙ্গনে বর্তমানে যে অস্থিতিশীল পরিবেশ, তার উন্নয়নে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। অন্যথায় বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। ছাত্রদল বা ছাত্রলীগ যে-ই সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটাক না কেন, তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এখানে ব্যর্থতার কোনো সুযোগ নেই।
এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ক্যাম্পাসে সব ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। কে ছাত্রলীগ কে ছাত্রদল, তা আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। এটা নিশ্চিত করতে পারলে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে হানাহানি, গ্রুপিং, সাব-গ্রুপিং কমে আসবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর প্রতিও কর্তৃপক্ষকে তীক্ষ দৃষ্টি রাখতে হবে। ছোটখাটো সমস্যার তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান করতে হবে। প্রক্টরিয়াল টিমকে আরও সক্রিয় হতে হবে, যাতে হলে কেউ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে। ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে যাঁরা আছে, তাঁরা টেন্ডারবাজির সঙ্গে যাতে কোনোভাবেই জড়িত না হয়ে পড়ে, সেই নিশ্চয়তাও থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে ছাড় দিলে ছাত্রনেতাদের মধ্যেই স্বার্থ নিয়ে সংঘাত দেখা দেবে। আর এর পরিণাম কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তাও আমরা অতীতে দেখেছি।
আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সহাবস্থানের বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুষ্ঠু পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্র সংগঠনগুলোর সহাবস্থান নিশ্চিত করা গেলে একদিকে যেমন শিক্ষার সুন্দর পরিবেশ বজায় থাকবে, অন্যদিকে সংঘাত-সংঘর্ষও কমে আসবে।
এর পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে প্রশাসনের যোগাযোগ বাড়াতে হবে। দ্বিতীয় কথা হলো, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হবে স্বাধীন। তারা কারও মুখাপেক্ষী হবে না এবং যে সিদ্ধান্ত তারা নেবে, সেটি যাতে যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়, সে ব্যাপারে সরকারেরও সহযোগিতা প্রয়োজন। শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ এবং সুস্থ ছাত্ররাজনীতি ফিরিয়ে আনতে এর বিকল্প নেই। বিশ্ববিদ্যালয়, সাধারণ ছাত্র ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই আমি কথাগুলো বলছি।
সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ছাত্র সংগঠনগুলো বিষয়টি আমলে নিলে আমরা সবাই লাভবান হব।
এস এম এ ফায়েজ: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.