তারাকান্দর গণহত্যা দিবস by প্রশান্ত অধিকারী
গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার কান্দি ইউনিয়নের একটি গ্রাম তারাকান্দর কোটালীপাড়ার বৃহত্তর বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালের জুন মাস। বাংলা ১৯ জ্যৈষ্ঠ। কোটালীপাড়া থানা থেকে তিনটি গানবোটে ঘাঘর নদী দিয়ে পাক আর্মি গোপালপুর আসে।
সেখানে পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে অপেক্ষা করছিল স্থানীয় দোসর রাজাকার আহমদ চেয়ারম্যান, আফতাব উদ্দিন [আপ্ট্তু মিয়া], বারেক মাস্টার, সোবহানসহ আরও অনেকে। তাদের ইশারায় পাকবাহিনী মেশিনগানের গুলি ও মর্টার শেল ছুড়তে থাকে তারাকান্দর দিকে। প্রাণভয়ে গ্রামবাসী পালাতে থাকে। এই সুযোগে রাজাকার, আলবদররা পাকবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকে পড়ে তারাকান্দর গ্রামে। মানুষ আশ্রয় নেয় ডোবায়, ঝোপঝাড়ে, পুকুরে কচুরিপানার মধ্যে। সেখানে পালিয়েও বাঁচতে পারেনি তারা। তাদের নির্মমভাবে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে পাক দোসররা। সকাল ১১টায় শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত নারকীয় হত্যাযজ্ঞে শহীদ হন শতাধিক নারী-পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধ। হানাদারদের সেই নির্মম নৃশংসতার সাক্ষী মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জগদীশ বৈদ্য। মাঠে ও পুকুর পাড়ে সারি সারি লাশ। যেসব শহীদের লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয় তাদের মধ্যে রাধিকা বৈদ্য, বিশ্বনাথ বৈদ্যর স্ত্রী পরিষ্কার বৈদ্য এবং তার দুই মেয়ে, পচু মণ্ডলের স্ত্রী, কুটিশ্বর মণ্ডল, লক্ষ্মণ বিশ্বাস, দীনেশ হালদার, পোকাই, কালু বালা, বিমল ঢালীর মা, মহেন্দ্র বৈদ্য, তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে এবং রাজেশ বাড়ৈর স্ত্রী। এ ছাড়াও নাম না জানা এলাকা ও এলাকার বাইরের বহু লোককে সেদিন এই তারাকান্দর বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। এভাবে নারকীয় হত্যাকাণ্ড, অগি্নসংযোগ ও লুটপাট করতে করতে পশ্চিম তারাকান্দ থেকে পূর্ব তারাকান্দর হয়ে নলভিটা পর্যন্ত যায় পাকবাহিনী।
জগদীশ বৈদ্যের বয়স এখন ৭০ ছুঁই ছুঁই। শত্রুর তাড়া খেয়ে ওইদিন আশ্রয় নিয়েছিলেন একটা কচুরিপানাভর্তি ডোবার মধ্যে। তার হাতে রামদা। মনে প্রতিজ্ঞা_ মরার আগে একটা শত্রু হলেও খতম করবেন। কিন্তু শত্রুরা তাকে দেখে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে। তাকে উপর্যুপরি কুপিয়ে, মৃত্যু নিশ্চিত জেনে তারা চলে যায়। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে ৩৪টি কোপ খেয়েও এখনও বেঁচে আছেন জগদীশ বৈদ্য। পঁচাত্তর সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর পার্শ্ববর্তী এলাকার রাজাকার-আলবদররা তাকে নানাভাবে ভয়ভীতি ও হুমকি দিতে শুরু করে। নিরাপত্তার জন্য পৈতৃক ভিটেমাটি ছেড়ে যশোরের বাসুন্দিয়ায় আশ্রয় নেন। সেখানে এখন দিনমজুরি করে সংসার চলে তার।
স্বামী-স্ত্রী এবং ছয় মেয়ে নিয়ে তার সংসার। ইতিমধ্যে তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বাকি তিন মেয়ে স্থানীয় চাল-ডালের মিলে কাজ করেন। সেই ভয়াল অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়লে কুঁকড়ে ওঠেন। বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের কাছে তার চাওয়া, সরকার যেন তাকে মৃত্যুর আগে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। জগদীশ বৈদ্য কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে ক্ষোভের সঙ্গে বলেন_ 'শুনেছি কোটালীপাড়ায় কত রাজাকার মুক্তিযোদ্ধা হইছে। আর আমি দ্যাশের জন্যি যুদ্ধ কইরা, মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ কইরা বাঁইচা থাইকাও কি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাব না! মরার আগে হেই দ্যাশ আমারে বলুক, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা।'
জগদীশ বৈদ্যর মতো সেদিনের সেসব শহীদের কথা কেউ মনে রাখেনি। কোনো স্মৃতিফলক নির্মিত হয়নি। স্থানীয় মানুষের দাবি, এসব শহীদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে শহীদদের তালিকা খুঁজে বের করে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হোক।
proadhikary@yahoo.com
জগদীশ বৈদ্যের বয়স এখন ৭০ ছুঁই ছুঁই। শত্রুর তাড়া খেয়ে ওইদিন আশ্রয় নিয়েছিলেন একটা কচুরিপানাভর্তি ডোবার মধ্যে। তার হাতে রামদা। মনে প্রতিজ্ঞা_ মরার আগে একটা শত্রু হলেও খতম করবেন। কিন্তু শত্রুরা তাকে দেখে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে। তাকে উপর্যুপরি কুপিয়ে, মৃত্যু নিশ্চিত জেনে তারা চলে যায়। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে ৩৪টি কোপ খেয়েও এখনও বেঁচে আছেন জগদীশ বৈদ্য। পঁচাত্তর সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর পার্শ্ববর্তী এলাকার রাজাকার-আলবদররা তাকে নানাভাবে ভয়ভীতি ও হুমকি দিতে শুরু করে। নিরাপত্তার জন্য পৈতৃক ভিটেমাটি ছেড়ে যশোরের বাসুন্দিয়ায় আশ্রয় নেন। সেখানে এখন দিনমজুরি করে সংসার চলে তার।
স্বামী-স্ত্রী এবং ছয় মেয়ে নিয়ে তার সংসার। ইতিমধ্যে তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বাকি তিন মেয়ে স্থানীয় চাল-ডালের মিলে কাজ করেন। সেই ভয়াল অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়লে কুঁকড়ে ওঠেন। বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের কাছে তার চাওয়া, সরকার যেন তাকে মৃত্যুর আগে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। জগদীশ বৈদ্য কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে ক্ষোভের সঙ্গে বলেন_ 'শুনেছি কোটালীপাড়ায় কত রাজাকার মুক্তিযোদ্ধা হইছে। আর আমি দ্যাশের জন্যি যুদ্ধ কইরা, মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ কইরা বাঁইচা থাইকাও কি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাব না! মরার আগে হেই দ্যাশ আমারে বলুক, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা।'
জগদীশ বৈদ্যর মতো সেদিনের সেসব শহীদের কথা কেউ মনে রাখেনি। কোনো স্মৃতিফলক নির্মিত হয়নি। স্থানীয় মানুষের দাবি, এসব শহীদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে শহীদদের তালিকা খুঁজে বের করে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হোক।
proadhikary@yahoo.com
No comments