অবহেলিত ইতিহাস

একাত্তরে বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে মানুষ খুন হয়েছে। খুনি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা। সহযোগীর ভূমিকায় ছিল এ দেশেরই কিছু মানুষ। মানুষ খুন হয়েছে নিজের বাড়িতে, পথে-প্রান্তরে; যেখানেই মুখোমুখি হয়েছে পাকিস্তানি বাহিনীর। এর বাইরেও তারা মানুষ খুন করেছে। জল্লাদখানা কিংবা বধ্যভূমি ছিল সেসব খুনের জায়গা।


মানুষ হত্যার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা বেছে নিয়েছিল খুনিরা। নির্বিচারে নারী, শিশু ও সাধারণ মানুষকে খুন করে তারা অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায়। কত মানুষ এভাবে তারা খুন করেছে বধ্যভূমিগুলোতে নিয়ে এর সঠিক পরিসংখ্যান তুলে ধরা কঠিন। কিন্তু কোন কোন জায়গায় এভাবে মানুষ খুন করা হয়েছে তা চিহ্নিত করা মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছর পরও অসম্ভব কিছু নয়। আমাদের ইতিহাসের অংশ হিসেবে এসব বধ্যভূমি চিহ্নিত করা অত্যন্ত জরুরি। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব বধ্যভূমিতে মানুষ খুন করা হয়েছে সেগুলোর অধিকাংশই এখনো চিহ্নিত হয়নি। এমনও বধ্যভূমি আছে, যেখানে জমির মালিক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন কখন সরকারিভাবে কেউ এসে সেই জায়গাটুকুতে উন্নয়নমূলক কাজ করবেন। কিন্তু ৪০ বছর গত হয়ে যাওয়ার পথে স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স। কেউ সেখানে যাননি। আবার কোথাও কোথাও সরকারিভাবে স্মৃতিসৌধ হবে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরও কোনো অগ্রগতি হয়নি।
স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলের সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণে স্বাভাবিক কারণেই মানুষের প্রত্যাশা বেশি। সাধারণ মানুষের আশা ছিল, হয়তো মুক্তিযুদ্ধের স্মারকগুলো চিহ্নিত ও সংরক্ষণের আধুনিক ব্যবস্থাপনার অধীনে নিয়ে আসা হবে। কিন্তু এও দুর্ভাগ্যজনক, খুবই কমসংখ্যক বধ্যভূমিই চিহ্নিত করার পর সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত করার মাধ্যমে সৌধ নির্মাণসহ কিছু উন্নয়নমূলক কাজের পরিকল্পনাও গ্রহণ করেছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। আর এগোয়নি। মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে_কোনো কোনো বধ্যভূমি এলাকায় জমি-সংক্রান্ত জটিলতা থাকার কারণে সেখানে কাজ করা যাচ্ছে না। কোথাও আবার স্থান চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষদর্শীদের বিষয়টি সবচেয়ে আগে আসে। অনেক জায়গাতেই প্রত্যক্ষদর্শী এমনকি বধ্যভূমি থেকে ফিরে আসা মানুষজনও এখন পর্যন্ত জীবিত রয়েছেন। তাঁরা এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। স্বাভাবিক কারণেই তাঁদেরকে হারাতে হবে আমাদের। তখন স্থান চিহ্নিত করার কাজটি আর হয়ে উঠবে না। কিংবা হলেও খুবই কঠিন হয়ে পড়বে। তাই বধ্যভূমি, গণকবরগুলো শিগগিরই চিহ্নিত করা এবং সেখানে সৌধ নির্মাণ করা জরুরি।
বধ্যভূমি কিংবা গণকবর সংরক্ষণ বিষয়ে প্রায়ই সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। এটা ঠিক, সরকারকে দায়িত্ব নিয়েই এসব যুদ্ধস্মৃতি সংরক্ষণ করতে হবে। কিন্তু এমনও দেখা গেছে যে কোনো পরিবারের দুয়েকজন ছাড়া আর সবাই শহীদ হন। কিন্তু বেঁচে থাকা সেই সদস্যদের কেউ তাঁদের পূর্বপুরুষের কবর সংরক্ষণের উদ্দেশে সামান্যতম চেষ্টাও করেননি। তাঁদের ধারণা, গণকবরগুলোর সংরক্ষণের দায়িত্ব এককভাবে সরকারের। অবহেলার চিত্র দেখা যায় সৌধ নির্মাণ হয়েছে এমন বধ্যভূমিতেও। বধ্যভূমি কিংবা গণকবরগুলোতে অনেক কাজ হয় যা সেসব স্থানের পবিত্রতা নষ্ট করে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে গণসচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। নিকটজনের কবর যাতে অপবিত্র না হয় তা দেখার প্রথম দায়িত্ব শহীদের পরিবারের সদস্যদের। যদিও রাষ্ট্রের দায় অস্বীকার করার উপায় নেই। সরকার ও জনগণ যদি এ বিষয়ে সচেতন এবং আন্তরিক হয় তাহলেই আমাদের ইতিহাস অমোচনীয় থাকবে।

No comments

Powered by Blogger.