চারদিক-চা-শ্রমিকদের কথা by আকমল হোসেন

রাস্তার পাশে বিশাল একটি পোস্টার। তাতে এক তরুণী চা-কন্যা চা-গাছের সমুদ্রে যেন ভাসছে। ঠোঁটে চকচক করা চায়ের পাতার মতোই চোখকাড়া হাসি। চোখভরা সরল প্রকাশ। চা-পাতার গাঢ় সবুজের মাঝে তাম্রবর্ণের সেই তরুণী বহুকাল ধরে যেন এভাবেই বুকের ধনের মতো আগলে আছে চা-গাছ, চায়ের বাগান।


তার শ্রমজীবী আঙুল নাচের মুদ্রায় চায়ের পাতা তুলছে, আর সেই পাতা দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ছে। ক্লান্তিনাশা পানীয়র তৃপ্তি মেটাতে ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে। সেই পোস্টারের সূত্র ধরেই মৌলভীবাজার পাবলিক লাইব্রেরির সৈয়দ মুজতবা আলী মিলনায়তনে প্রবেশ করা। সেখানে ঢুকেই বোঝা গেল, চেনা-জানা সবুজ টিলায় মোড়া যে বিস্তীর্ণ চা-বাগান, টিলার ভাঁজে ভাঁজে সবুজের যে ঢেউ, সেই ঢেউয়ের বুকে ছুটে বেড়ানো চা-শ্রমিক নারী ও পুরুষের যে বিশাল কর্মযজ্ঞ, সেই বিশাল জগৎটিকে মিলনায়তনের ক্ষুদ্র আয়তনে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে।
ছবিতে ছবিতে উঠে এসেছে চা-শ্রমিক নারী ও পুরুষের সেই সাতসকালের কাজের সূচনা থেকে কর্মমুখরতার পুরো দিনের নানা পর্ব। ছবিই যেন এখানে কথা বলছে। অনেক কথা। চা-শ্রমিকদের জীবনযাপনের নানা দিক, চা-শ্রমিকদের সমস্যা, তাদের জীবনমান, শিক্ষা, বাসস্থান ও সাংস্কৃতিক পরিচয় উঠে এসেছে একেকটি ছবিতে। সম্প্রতি (২০ থেকে ২৪ জুন) সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (সেড) ‘চা-শ্রমিকদের কথা’ শীর্ষক এই আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে। আর এই প্রদর্শনীতে আদিবাসীদের নিয়ে কাজ করা ফিলিপ গাইনের ৩৬টি ছবি সেখানে প্রদর্শন করা হয়েছে। এমনিতে চা-বাগানের যে মায়াবী রূপ, তাতে কেবলই চোখ জুড়ানোর এক জগৎ। সাধারণত চা-কন্যাদের পাতা তোলা, কাঁধের ঝাঁপিতে পাতা বয়ে নিয়ে যাওয়াসহ নানারকম কাজ দেখে ভিন্ন এক কর্মযজ্ঞ যে কারও জন্যই নতুন এক অভিজ্ঞতা। কিন্তু এই চায়ের পাতা হয়ে ওঠার পেছনে যে এক ঘাম-ঝরানো, রক্ত জল করা গোপন এক সংগ্রাম আছে, আছে তাদের নিজেদের মতো করে এক সাংস্কৃতিক দুনিয়া, যে দুনিয়ায় তারা নিজেদের মতো করে বিচরণ করে, এই দুনিয়ার অনেকটাই চা-বাগান দর্শনের মুগ্ধতার আড়ালে পড়ে থাকে। তা অনেকের জানার সুযোগ নেই। প্রদর্শনীর ছবিগুলো নীরবে সেই কথাগুলোই যেন বলতে চাইছে। আবার ছবির এই কথাগুলোই যেন ভাষায় প্রকাশ করলেন আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে উপস্থিত মৌলভীবাজার চা-জনগোষ্ঠী আদিবাসী ফোরামের সমাজকল্যাণ সম্পাদক বিদ্যাসাগর দাস। তিনি বলেন, ‘আমাদের নিজেদের কিছু কৃষ্টি-কালচার আছে। এখনো এগুলোকে মূল্যায়ন দেওয়া হয় না। সুযোগ পেলে আমরা আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি সবার সামনে তুলে ধরতে পারি। অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠী প্রধান সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। আমরা পাচ্ছি না। জনসাধারণের সামনে আমাদের জীবনযাপনকে তুলে ধরতেই এই প্রদর্শনীর আয়োজন।’
শুধু যে ছবি দিয়েই প্রদর্শনীর কামরাটি সাজানো হয়েছে, তা নয়। চা-শ্রমিকদের জীবন সংগ্রাম, তাদের সাংস্কৃতিক তৎপরতা নিয়ে লেখা বিভিন্ন ধরনের বই প্রদর্শনীতে দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়। এর বাইরে প্রদর্শনীতে মৌলভীবাজার চা জনগোষ্ঠী আদিবাসী ফ্রন্টের পক্ষ থেকে চা-শ্রমিকদের ব্যবহূত নানা ধরনের যন্ত্রপাতি, শিকার করার ও আত্মরক্ষার অস্ত্র প্রদর্শন করা হয়েছে। প্রদর্শন করা হয়েছে চা-শ্রমিকদের ব্যবহূত নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র। আয়োজকেরা জানালেন, প্রদর্শনীতে তুলে ধরা হয়েছে ব্রিটিশ আমল থেকে চা-শ্রমিকেরা ধারাবাহিকভাবে ব্যবহার করে আসছে, এমন সব যন্ত্রপাতি। প্রযুক্তির উন্নয়নে এসব যন্ত্রপাতির অনেকটা এখন আর ব্যবহার করা হয় না, এটা যেমন ঠিক, তেমনি চা-শ্রমিকদের আদিম শিকারের অনেক যন্ত্র এখনো সচল আছে। প্রদর্শনীতে সেই যন্ত্রপাতির অনেকগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে আছে বিভিন্ন সময়ে চা-শ্রমিকদের ব্যবহূত পয়সা, চা-কন্যাদের ব্যবহার করা গলার হাঁসুলি, পায়ের লোহার বেড়ি, কাঁচি, কাটা কোদাল, টেপার, নিড়ানি, খুন্তি, গাঁইতি কোদাল, চাঁদ কোদাল, বরিং, বাঁশের বাঁশি, পাশ কোদাল, পাতি গামছা, ছোপি (বেতের তৈরি মাথাল বা ছাতা), সরদারের লাঠি। এ ছাড়া শিকার ও আত্মরক্ষার যন্ত্রপাতির মধ্যে ছিল মোরগ ফাই (বনমোরগ বা বন্য প্রাণী ধরার ফাঁদ), পারসা, পুলিশ (স্থানীয়ভাবে পরিচিত কুচিয়া মাছ বা ইলফিস ধরার যন্ত্র), তীর-ধনুক এবং বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে ছিল ঢাক-ঢোল ইত্যাদি। আয়োজকেরা জানালেন, এর বাইরেও চা-শ্রমিকদের ব্যবহূত অনেক যন্ত্রপাতি আছে, যা নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি।
প্রদর্শনীতে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা যেমন ছবির দিকে মগ্ন হয়ে চোখ মেলে রেখেছেন, তেমনি ব্যবহূত যন্ত্রপাতি দেখেছেন। এটা আসলে ইতিহাসেরও এক নীরব পরিক্রমা। চা-শ্রমিকদের ফেলে আসা দিনগুলো, তাদের জীবন-জীবিকার হাতিয়ার হয়তো সময়ের সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে থাকার, অগ্রসর হওয়ার কথাগুলোই এখানে তুলে ধরেছে। প্রদর্শনী দেখতে আসা কবি শহীদ সাগ্নিক বললেন, ‘এটি একটি ভালো উদ্যোগ। ছবির মাধ্যমে চা-শ্রমিকদের জীবন-দুর্দশার চিত্র ফুটে উঠেছে। এতে মানুষ তাদের সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হবে।’ চা যদি কৃষিজাত শিল্প হয়, চায়ের বাগান সরল নিসর্গের উদ্যান—তাহলে এই সরলতাকে যারা ঘাম ঝরিয়ে রূপলাবণ্যে প্রাণ দিয়ে থাকে, তাদের জীবন কেন প্রাণবন্ত হবে না, ‘চা-শ্রমিকদের কথা’ সবার সামনে যেন সেই নীরব প্রশ্নটিই রেখে চলছে।

No comments

Powered by Blogger.