চারদিক-কালের মাইলফলক by শান্তা তাওহিদা

ঢাকা গেটের কথা নিশ্চয় শুনেছেন। ঢাকার ৪০০ বছরের ঐতিহ্যের এই ঢাকা গেট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই, দোয়েল চত্বরের পাশেই। ঢাকা শহরের শেষ প্রান্তের ঢাকা গেটের তিনটি থাম আজও অক্ষত রয়েছে। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকার এক প্রান্তে, ঢাকা গেটের কাছেই।


ব্রিটিশ শাসনামলের কিছু সিটেফোঁটা এখনো খুঁজে পাওয়া যাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। টিএসসির ভেতরের মাঠে এবং পুরোনো সুইমিংপুলে এখনো রয়েছে দুটি ব্রিটিশ স্থাপত্য।
১৯২১ থেকে ২০১০—এই দীর্ঘ ৯০ বছরে বহু ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে উঠেছে এ প্রাঙ্গণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন, কার্জন হল, টিএসসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একেকটি হল যেন একেকটি স্মৃতির কথা বলে। প্রতিটিই যেন একেকটি স্মৃতিময় প্রাঙ্গণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুদৃশ্য সিনেট ভবনটি যাঁর নামে, তিনি নওয়াব আলী চৌধুরী। তাঁর অবদান কোনো দিন ভুলবে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি ছিলেন জমিদার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতে তিনি তাঁর জমিদারি বন্ধক রেখে বিশ্ববিদ্যালয়কে ৩৫ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। সেই টাকা আর তিনি শোধ করতে পারেননি বলে ফিরে পাননি জমিদারি। এমন বহু মানুষ, বহু ঘটনার স্মৃতিচিহ্ন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
আজকের যে কার্জন হল, এটি কিন্তু ছিল ঢাকা কলেজ। আর শহীদুল্লাহ হলের নাম ছিল ঢাকা হল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নবাবদের স্মৃতিও। আজকের মধুর ক্যানটিন ছিল নবাবদের ব্যবহূত একটি স্থাপনা। মধুর ক্যানটিনের সামনের যে কূপটি, তাও বহু পুরোনো। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত যে ভাষা আন্দোলন, তা এ প্রাঙ্গণেই বেগবান হয়ে উঠেছিল। ১৯৫২ সালে যে আমতলায় তখনকার ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতে করতে এগিয়ে চলেছিলেন, রাজপথে তা ছিল বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ গেটে। আমতলাটি আজ আর নেই। তবে সে আমগাছটির কিছু অংশের দেখা মিলবে ডাকসু সংগ্রহশালায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ভাষাশহীদ বরকত স্মৃতি জাদুঘরটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়েছিল কোথায় জানেন? আমাদের কলাভবনের ডান পাশের ছাদে।
আনন্দের পাশাপাশি বহু বেদনাগাথাও আছে এ প্রাঙ্গণে। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পাশাপাশি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে জগন্নাথ হলের ছাত্র-কর্মচারীদের ওপর করা হয়েছিল বর্বর হামলা। সেই স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে আজও রয়েছে জগন্নাথ হলের ভেতরের গণকবরটি, যেখানে একটি স্মৃতিফলক করা হয়েছে। হলের মেয়েরাও রক্ষা পাননি সেদিন পাকিস্তানি বর্বর সেনাদের হাত থেকে। সারা দেশের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়ে সব শিক্ষার্থীই একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন স্বদেশকে মুক্ত করতে। তার প্রতীক হিসেবে অপরাজেয় বাংলা, সোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরের দেখা পাবেন আমাদের প্রাঙ্গণে। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর দেশকে মেধাশূন্য করার ষড়যন্ত্রে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষককে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। মুনীর চৌধুরী, গোবিন্দচন্দ্র দেব, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য, গিয়াসউদ্দিন আহমেদসহ আরও অনেককে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে উপাচার্যের বাংলোর সামনেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু বিখ্যাত ব্যক্তির স্মৃতিও। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ১৯২৭ সালে জগন্নাথ হলে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। ১৯৩০ সালে কাজী নজরুল ইসলামকে সংবর্ধনা জানানো হয়েছিল এখানে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শায়িত আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই।
এই স্মৃতিচিহ্নগুলো নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেন একটি স্মৃতি জাদুঘর। আরও শতবর্ষ বেঁচে থাকুক এ চিহ্নগুলো। হোক না বেদনার, তবু বেঁচে থাকুক স্মৃতিময় এ প্রাঙ্গণ। কারণ স্মৃতিই তো আমাদের পথ চলার শক্তি।

No comments

Powered by Blogger.