রাজধানী উন্নয়ন-মহানগরের সুশাসন কীভাবে উন্নত হবে by এ এম এম শওকত আলী
ঢাকা মহানগরের সুশাসন নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। অতীতে বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ের মধ্যেই সীমিত ছিল। আইনশৃঙ্খলাসহ জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৭৬ সালে সৃষ্টি করা হয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। সে লক্ষ্য অর্জন করা এখনো সম্ভব হয়নি।
মহানগরের ধারণাগত বৈশিষ্ট্য নগরভিত্তিক স্থানীয় সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেও ওই সালে যে আইনটি করা হয়েছিল, তা পুলিশ ব্যবস্থাপনার মধ্যেই সীমিত ছিল। অতীতে এবং বর্তমানেও বিভিন্ন মহানগরের সিটি করপোরেশনের মেয়ররা ২০০০ সাল-পরবর্তী সময় থেকে মহানগর সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি করেন। তাঁদের দাবির ভিত্তি ছিল, এ ধরনের কাঠামো স্থাপনের মাধ্যমে সরকারি ও আধাসরকারি বিভিন্ন সংস্থার কার্যাবলির সমন্বয়ের মাধ্যমে নাগরিক সুবিধাদি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সুশাসনের ক্ষেত্রে বর্তমানে যুক্ত হয়েছে আরও কয়েকটি বিষয়। যেমন, এক. ঝুঁকিপূর্ণ ইমারত, দুই. সুপরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জলাভূমিসহ নদী-তীরবর্তী এলাকা সংরক্ষণ। তিন. গৃহহীন বস্তিবাসীর আবাসন। চার. যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ। পাঁচ. ঘন ঘন অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ। ছয়. গৃহনির্মাণ নিয়ন্ত্রণ। এসব বিষয় নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্থাসহ বিভিন্ন ধরনের আইনও রয়েছে। কিন্তু সেগুলো অনেকাংশে অকার্যকর। যখনই কোনো বড় ধরনের দুর্ঘটনা হয়, তখনই সব দোষ পড়ে সরকারের ওপর। কিন্তু এ ক্ষেত্রে নতুন আইনের প্রয়োজন রয়েছে। যেমন, ভূমি ব্যবহারনীতি প্রণয়ন করা হয়েছিল। কিন্তু তারপর আর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অর্থাৎ কোনো আইন করা হয়নি। তা সত্ত্বেও বলা যায় যে পূর্ত মন্ত্রণালয় ও রাজউকের নগরসংক্রান্ত যেসব আইন রয়েছে, সেগুলোও মানা হয় না।
এর ফলে আবাসিক এলাকার মধ্যে বাণিজ্যিক এলাকা গড়ে উঠেছে। আবাসিক এলাকার ভবনের প্রকৃতিও পাল্টে গেছে। একমাত্র আইন দিয়ে এটা রোধ করা যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট নাগরিকদের সচেতনতাসহ কার্যকর পদক্ষেপ। অনেকেই বলেন, জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপের ফলেই এ ধরনের দৃশ্য একটি প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা। কিন্তু বড় ধরনের দুর্ঘটনা, যেমনটি ঘটেছে সম্প্রতি নিমতলীতে; তার জন্য কি কিছুই করার নেই? বেগুনবাড়ির ঝুঁকিপূর্ণ বহুতল বাসগৃহ সম্পর্কে বলা হয়েছে, অননুমোদিত বহুতল ভবন ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার; তবে বেশ কিছু প্রাণহানির পর। সরকারি সূত্রে বলা হয়েছে, বেগুনবাড়ির বাড়িটি আগে ভাঙার চেষ্টা করলেও আদালতের নিষেধাজ্ঞার ফলে তা করা সম্ভব হয়নি। আমরা বিচারবহির্ভূত হত্যার কথা বলি। কিন্তু বিচারিক প্রক্রিয়ায় প্রাণহানি হলে তাকে কী বলা যাবে?
আদালত যে জনস্বার্থ রক্ষায় একেবারেই সংবেদনশীল নন, সে কথা বলা যাবে না। সম্প্রতি নদী-তীরবর্তী অঞ্চলে ইমারত নির্মাণ অবৈধ ঘোষণা করে সেগুলো ভেঙে দেওয়ার নির্দেশ আদালতই দিয়েছিলেন। কিছু কাজও হয়েছে।
সে ক্ষেত্রে যে বিষয়টি দৃশ্যমান নয়, তা হলো উদ্ধার করা এলাকা ভবিষ্যতে সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় সরকারি বিনিয়োগ এবং জনস্বার্থে তার ব্যবহার। এ কাজটি না করা হলে এসব পরিবেশ ও জনস্বার্থের জন্য সংরক্ষিত এলাকা পুনরায় বেদখল হয়ে যাবে। অতীতের অভিজ্ঞতা সে বিষয়টিই স্মরণ করিয়ে দেয়। এমন আইন কি করা যায় না, যার ফলে যেসব ব্যক্তি বা সংস্থা এ ধরনের কাজ করে, তাদের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হয়? এ ধরনের অপরাধের জন্য প্রয়োজন বিশেষ সংক্ষিপ্ত বা দ্রুত বিচার আদালত।
সার্বিকভাবে দেখতে গেলে বিষয়টি ভূমি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত। নগর উন্নয়ন ও ভূমিসংক্রান্ত বহুবিধ আইনের মধ্যে যোগসূত্র ক্ষীণ। এ-সংক্রান্ত সংস্থার যেমন রাজউক ও ভূমি বোর্ডের সঙ্গেও কোনো যোগাযোগ নেই। সরকার বিল্ডিং কোড প্রণয়ন করেছে বহু আগেই। এ কোড কতটুকু কার্যকর, তা অনুসন্ধানযোগ্য। কথায় কথায় আমরা আইন অমান্যকারীদের কঠোর শাস্তি প্রদানের বিষয় উত্থাপন করি। কিন্তু যে আইনগুলো অমান্য করা হয়, তার জন্য কাঠামোগত দুর্বলতা দূর করার কথা খুব কমই বলা হয়। বেগুনবাড়ির ক্ষেত্রে সম্প্রতি রাজউকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীর স্বল্পতা। কিন্তু তাদের নির্ধারিত কাজ নিশ্চিত করার জন্য জবাবদিহির বিষয় উল্লেখ করা হয় না।
যদি ধরেও নেওয়া হয় যে আরও অধিকসংখ্যক লোকবলের প্রয়োজন, তা হলেও প্রত্যাশিত সুফল পাওয়ার আশা করা যাবে না। কারণ একটাই, নিয়োগ-বাণিজ্যের অবাধ প্রসার। আরব দেশের ঘোড়া এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঘোড়ার কর্মক্ষমতার পার্থক্য থাকবেই। নিয়োগ-বাণিজ্য শেষোক্ত বিষয়টিই নিশ্চিত করবে।
কয়েক বছর ধরেই ঝুঁকিপূর্ণ ইমারতের তালিকাসহ অননুমোদিত ইমারত নির্মাণের তালিকা প্রণয়নের কথা রাজউক বলে আসছে। ঝুঁকিপূর্ণ ইমারতের জন্য কোন সংস্থা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে, তা স্পষ্ট নয়। কয়েক বছর আগে শাঁখারীপট্টির কয়েকটি বাড়ির বিষয়ে রাজউক ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের মধ্যে যে মতবিরোধ হয়েছে, তা পত্রিকান্তরে প্রকাশ করা হয়েছিল। এ মতপার্থক্যের নিরসন হয়েছে কি না, জানা নেই। বিষয়টি স্পষ্ট করা প্রয়োজন। এ-সংক্রান্ত আইনের কোনো সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে কি না, সে বিষয়টিও পরীক্ষা করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি ভিত্তিতে না নিলে শুরু হবে সংস্থাভিত্তিক দোষারোপের বুলি, যা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দৃশ্যমান। এতে আসল কাজ দ্রুত গতিতে করা যাবে না।
প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী রাজউক এখন ঝুঁকিপূর্ণ ইমারত চিহ্নিত করার তালিকা প্রণয়নে উদ্যোগ নিয়েছে। অথচ একই তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে কয়েক বছর আগে। সংবাদে এও দেখা যায়, পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার ও তাঁতীবাজারের ৯০ শতাংশ বাড়িই ঝুঁকিপূর্ণ। এ কথা রাজউক বলেছে।
ঝুঁকিপূর্ণ বাড়িগুলো ভাঙা প্রয়োজন বসবাসকারীদের নিরাপত্তার স্বার্থে। সমস্যা হলো ভাঙার পর পুনর্গঠনের বিষয়টি—ওই অঞ্চলে বসবাসকারী বাসিন্দারা অথবা যারা ওই সব জায়গায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করছে, তাদের অন্তর্বর্তীকালীন পুনর্বাসনের সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান। এর জন্য সরকার কী চিন্তাভাবনা করছে জানা নেই। জনস্বার্থে তাদের জন্য সরকারি সাহায্যের প্রয়োজন হবে।
রাজধানীসংলগ্ন জলাভূমি ভরাট ও জবরদখলের মাধ্যমে ভূমিদস্যুদের আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের বিরুদ্ধেও সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। তবে সহজে সরকার এটা করতে পারবে কি না, সে বিষয় নিয়ে জনমনে সংশয় রয়েছে। আশার কথা হলো, সরকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) অনুমোদন ও বাস্তবায়ন করতে দৃঢ় মনোভাব ব্যক্ত করেছে।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। অগ্নিনির্বাপক অধিদপ্তরের অভিযোগ, বহুতল ভবনে এ ধরনের ঘটনায় আইনানুগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেই। অর্থাৎ কেউ আইন মানে না। অথচ বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য রাজউক অনুমতিদান অব্যাহত রেখেছে। এ ধরনের ঘটনায় গতানুগতিকভাবে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পান্থপথে একটি বহুতল বাণিজ্যিক ভবনের অগ্নিকাণ্ডসংক্রান্ত ঘটনার পর তদন্ত কমিটির অভিযোগ, যা মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছিল যে ইমারত কর্তৃপক্ষ তদন্তে সহযোগিতা করেনি। এ কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে এর আইনি প্রতিকার কি নেই? কিছুদিন আগে অগ্নিনির্বাপক অধিদপ্তর ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অগ্নিনির্বাপণ-সংক্রান্ত আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল। অনেকে আশা করেছিল, এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। মনে হয়, এ উদ্যোগ স্তিমিত হয়ে গেছে।
নিমতলীর ভয়াবহ ঘটনার পরমুহূর্তেই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ সভা করে দুটি টাস্কফোর্স গঠন করে এবং এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো তৎপর হয়েছে। রাজউক অননুমোদিত ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙায় এখন তৎপর। অবশ্য বাড়ির মালিকেরা পিছিয়ে নেই। নাখালপাড়ার হেলে পড়া একটি বহুতল ভবনের মালিক নিজেই এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছেন। এ থেকে স্পষ্ট, এসব বিষয়ে নাগরিক-সচেতনতা দুর্ঘটনা রোধের সহায়ক শক্তি। প্রয়োজন শুধু রাজউকসহ অন্যান্য সরকারি সংস্থার সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা।
এ এম এম শওকত আলী: সাবেক সচিব; তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।
এর ফলে আবাসিক এলাকার মধ্যে বাণিজ্যিক এলাকা গড়ে উঠেছে। আবাসিক এলাকার ভবনের প্রকৃতিও পাল্টে গেছে। একমাত্র আইন দিয়ে এটা রোধ করা যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট নাগরিকদের সচেতনতাসহ কার্যকর পদক্ষেপ। অনেকেই বলেন, জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপের ফলেই এ ধরনের দৃশ্য একটি প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা। কিন্তু বড় ধরনের দুর্ঘটনা, যেমনটি ঘটেছে সম্প্রতি নিমতলীতে; তার জন্য কি কিছুই করার নেই? বেগুনবাড়ির ঝুঁকিপূর্ণ বহুতল বাসগৃহ সম্পর্কে বলা হয়েছে, অননুমোদিত বহুতল ভবন ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার; তবে বেশ কিছু প্রাণহানির পর। সরকারি সূত্রে বলা হয়েছে, বেগুনবাড়ির বাড়িটি আগে ভাঙার চেষ্টা করলেও আদালতের নিষেধাজ্ঞার ফলে তা করা সম্ভব হয়নি। আমরা বিচারবহির্ভূত হত্যার কথা বলি। কিন্তু বিচারিক প্রক্রিয়ায় প্রাণহানি হলে তাকে কী বলা যাবে?
আদালত যে জনস্বার্থ রক্ষায় একেবারেই সংবেদনশীল নন, সে কথা বলা যাবে না। সম্প্রতি নদী-তীরবর্তী অঞ্চলে ইমারত নির্মাণ অবৈধ ঘোষণা করে সেগুলো ভেঙে দেওয়ার নির্দেশ আদালতই দিয়েছিলেন। কিছু কাজও হয়েছে।
সে ক্ষেত্রে যে বিষয়টি দৃশ্যমান নয়, তা হলো উদ্ধার করা এলাকা ভবিষ্যতে সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় সরকারি বিনিয়োগ এবং জনস্বার্থে তার ব্যবহার। এ কাজটি না করা হলে এসব পরিবেশ ও জনস্বার্থের জন্য সংরক্ষিত এলাকা পুনরায় বেদখল হয়ে যাবে। অতীতের অভিজ্ঞতা সে বিষয়টিই স্মরণ করিয়ে দেয়। এমন আইন কি করা যায় না, যার ফলে যেসব ব্যক্তি বা সংস্থা এ ধরনের কাজ করে, তাদের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হয়? এ ধরনের অপরাধের জন্য প্রয়োজন বিশেষ সংক্ষিপ্ত বা দ্রুত বিচার আদালত।
সার্বিকভাবে দেখতে গেলে বিষয়টি ভূমি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত। নগর উন্নয়ন ও ভূমিসংক্রান্ত বহুবিধ আইনের মধ্যে যোগসূত্র ক্ষীণ। এ-সংক্রান্ত সংস্থার যেমন রাজউক ও ভূমি বোর্ডের সঙ্গেও কোনো যোগাযোগ নেই। সরকার বিল্ডিং কোড প্রণয়ন করেছে বহু আগেই। এ কোড কতটুকু কার্যকর, তা অনুসন্ধানযোগ্য। কথায় কথায় আমরা আইন অমান্যকারীদের কঠোর শাস্তি প্রদানের বিষয় উত্থাপন করি। কিন্তু যে আইনগুলো অমান্য করা হয়, তার জন্য কাঠামোগত দুর্বলতা দূর করার কথা খুব কমই বলা হয়। বেগুনবাড়ির ক্ষেত্রে সম্প্রতি রাজউকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীর স্বল্পতা। কিন্তু তাদের নির্ধারিত কাজ নিশ্চিত করার জন্য জবাবদিহির বিষয় উল্লেখ করা হয় না।
যদি ধরেও নেওয়া হয় যে আরও অধিকসংখ্যক লোকবলের প্রয়োজন, তা হলেও প্রত্যাশিত সুফল পাওয়ার আশা করা যাবে না। কারণ একটাই, নিয়োগ-বাণিজ্যের অবাধ প্রসার। আরব দেশের ঘোড়া এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঘোড়ার কর্মক্ষমতার পার্থক্য থাকবেই। নিয়োগ-বাণিজ্য শেষোক্ত বিষয়টিই নিশ্চিত করবে।
কয়েক বছর ধরেই ঝুঁকিপূর্ণ ইমারতের তালিকাসহ অননুমোদিত ইমারত নির্মাণের তালিকা প্রণয়নের কথা রাজউক বলে আসছে। ঝুঁকিপূর্ণ ইমারতের জন্য কোন সংস্থা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে, তা স্পষ্ট নয়। কয়েক বছর আগে শাঁখারীপট্টির কয়েকটি বাড়ির বিষয়ে রাজউক ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের মধ্যে যে মতবিরোধ হয়েছে, তা পত্রিকান্তরে প্রকাশ করা হয়েছিল। এ মতপার্থক্যের নিরসন হয়েছে কি না, জানা নেই। বিষয়টি স্পষ্ট করা প্রয়োজন। এ-সংক্রান্ত আইনের কোনো সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে কি না, সে বিষয়টিও পরীক্ষা করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি ভিত্তিতে না নিলে শুরু হবে সংস্থাভিত্তিক দোষারোপের বুলি, যা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দৃশ্যমান। এতে আসল কাজ দ্রুত গতিতে করা যাবে না।
প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী রাজউক এখন ঝুঁকিপূর্ণ ইমারত চিহ্নিত করার তালিকা প্রণয়নে উদ্যোগ নিয়েছে। অথচ একই তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে কয়েক বছর আগে। সংবাদে এও দেখা যায়, পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার ও তাঁতীবাজারের ৯০ শতাংশ বাড়িই ঝুঁকিপূর্ণ। এ কথা রাজউক বলেছে।
ঝুঁকিপূর্ণ বাড়িগুলো ভাঙা প্রয়োজন বসবাসকারীদের নিরাপত্তার স্বার্থে। সমস্যা হলো ভাঙার পর পুনর্গঠনের বিষয়টি—ওই অঞ্চলে বসবাসকারী বাসিন্দারা অথবা যারা ওই সব জায়গায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করছে, তাদের অন্তর্বর্তীকালীন পুনর্বাসনের সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান। এর জন্য সরকার কী চিন্তাভাবনা করছে জানা নেই। জনস্বার্থে তাদের জন্য সরকারি সাহায্যের প্রয়োজন হবে।
রাজধানীসংলগ্ন জলাভূমি ভরাট ও জবরদখলের মাধ্যমে ভূমিদস্যুদের আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের বিরুদ্ধেও সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। তবে সহজে সরকার এটা করতে পারবে কি না, সে বিষয় নিয়ে জনমনে সংশয় রয়েছে। আশার কথা হলো, সরকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) অনুমোদন ও বাস্তবায়ন করতে দৃঢ় মনোভাব ব্যক্ত করেছে।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। অগ্নিনির্বাপক অধিদপ্তরের অভিযোগ, বহুতল ভবনে এ ধরনের ঘটনায় আইনানুগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেই। অর্থাৎ কেউ আইন মানে না। অথচ বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য রাজউক অনুমতিদান অব্যাহত রেখেছে। এ ধরনের ঘটনায় গতানুগতিকভাবে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পান্থপথে একটি বহুতল বাণিজ্যিক ভবনের অগ্নিকাণ্ডসংক্রান্ত ঘটনার পর তদন্ত কমিটির অভিযোগ, যা মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছিল যে ইমারত কর্তৃপক্ষ তদন্তে সহযোগিতা করেনি। এ কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে এর আইনি প্রতিকার কি নেই? কিছুদিন আগে অগ্নিনির্বাপক অধিদপ্তর ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অগ্নিনির্বাপণ-সংক্রান্ত আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল। অনেকে আশা করেছিল, এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। মনে হয়, এ উদ্যোগ স্তিমিত হয়ে গেছে।
নিমতলীর ভয়াবহ ঘটনার পরমুহূর্তেই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ সভা করে দুটি টাস্কফোর্স গঠন করে এবং এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো তৎপর হয়েছে। রাজউক অননুমোদিত ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙায় এখন তৎপর। অবশ্য বাড়ির মালিকেরা পিছিয়ে নেই। নাখালপাড়ার হেলে পড়া একটি বহুতল ভবনের মালিক নিজেই এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছেন। এ থেকে স্পষ্ট, এসব বিষয়ে নাগরিক-সচেতনতা দুর্ঘটনা রোধের সহায়ক শক্তি। প্রয়োজন শুধু রাজউকসহ অন্যান্য সরকারি সংস্থার সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা।
এ এম এম শওকত আলী: সাবেক সচিব; তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।
No comments