মানুষের মুখ-এক পুরিদাদুর গল্প by শারমিন নাহার
ঝুমবৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আমি আর আমার সঙ্গী রওনা হলাম। বাড়িটা খুঁজে বের করতে খানিকটা সময় লাগল। এরই মধ্যে বৃষ্টিটা ধরে এসেছে। আমরা যখন তাঁর ঘরে পা রাখি, তখন টুপটাপ বৃষ্টির পানি পড়ছে টিনের চালে। যেন সৃষ্টি হয়েছে এক সুরের মূর্ছনা। ঘরে ঢুকতেই নাকে এসে লাগল খিচুড়ির সুগন্ধ।
এক বৃদ্ধ জবুথবু হয়ে বসে আছেন ঘরের মধ্যে। তাঁর হাত কিন্তু বসে নেই। সুনিপুণভাবে তিনি তৈরি করছেন পুরির কিমা। হ্যাঁ, অশীতিপর এই বৃদ্ধের নাম নূর মিয়া। ছোট্ট গোপালগঞ্জ শহরে সবার কাছে তিনি পুরিদাদু নামেই বেশি পরিচিত। দীর্ঘ ৬০ বছর ধরে পুরি বিক্রি করছেন বলে জানালেন তিনি।
‘বয়স কত হলো, দাদু?’
দাদু উত্তর দেন, ‘হবে পিরায় ৮০-৮৫ বছর।’
বয়সের সঠিক হিসাবটা মনে নেই তাঁর। বয়সের ভারে স্মৃতিশক্তিও লোপ পেয়েছে খানিকটা। তবে তিন প্রজন্ম দেখেছেন এই দাদু। সেই হিসাবে তাঁর বয়স সত্যিই অনেক বেশি। নূর মিয়া জন্মসালটা মনে না থাকলেও আদি বাড়ি যে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থানায়, তা ঠিকই মনে আছে।
দাদু বলেন, ‘নদী আমাগো বসতবাড়ি ভাইঙ্গালাইছে। হ্যার পর ঢাকা চইলা আইলাম।’ এরপর আর মুন্সিগঞ্জ ফিরে যাওয়া হয়নি দাদুর। ঢাকাতেই চাকরি জুটিয়ে নেন এক আইনজীবীর পিয়ন পদে। নূর মিয়া বলতে থাকেন, ‘সাবে যেহেনে যাইত, আমিও তার লগে লগে সেহেনে যাইতাম।’ কাজের সুবাদে সেই আইনজীবী একসময় চলে আসেন গোপালগঞ্জে। যদিও তখন পর্যন্ত গোপালগঞ্জ নামে আলাদা কোনো জেলা ছিল না। বৃহত্তর ফরিদপুরের একটি অংশ ছিল গোপালগঞ্জ। সন-তারিখ ঠিকমতো বলতে না পারলেও স্মৃতি হাতড়ে দাদু বলেন, ‘তখন আইয়ুবের শাসন চলতেছিল।’
ইতিমধ্যে বিয়ের পাট চুকিয়ে ফেলেছেন নূর মিয়া। স্ত্রী জোহরা আর কন্যা ফাতেমাকে নিয়ে ছোট্ট সংসার তাঁর। এরই মধ্যে সেই আইনজীবী পেশা বদলে গোপালগঞ্জ শহর ছেড়েছেন। কিন্তু নূর মিয়ার মায়া পড়ে যায় গোপালগঞ্জের প্রতি। তাই এখানেই থেকে যান তিনি। সংসার চালানোর জন্য শুরু করেন বাবুর্চিগিরি। আর বিকেলে কলেজ রোড ও মধুমতীর পাড়ে পুরি বিক্রি শুরু করেন। বঙ্গবন্ধুকেও রান্না করে খাইয়েছেন বলে দাবি করেন নূর মিয়া। তিনি বলেন, ‘শেখ সাব গোপালগঞ্জ আইলে তো আমি পাকশাক কইরা খাওয়াইছি। শেখ সাব যে কত কতা কইত, দ্যাশ নিয়া স্বপ্ন দ্যাখত, তা কইয়া শ্যাষ করা যাইব না।’
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নূর মিয়া আশ্রয় নেন টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবের বাড়িতে। ‘কিন্তু শয়তানগুলা তো শেখের বাড়িতেই আগে আগুন দিল।’ সেখান থেকে পালিয়ে কখনো গর্তে লুকিয়ে কখনো আবার বাঁশের ঝোপে আশ্রয় খুঁজেছেন নূর মিয়া। প্রশ্ন করি, অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন কি না? তিনি বলেন, ‘না, তয় মুক্তিযোদ্ধাগো পাকশাক কইরা খাওয়াইতাম। হ্যারপর তো যুদ্ধ শেষে স্বাধীন হইলাম আমরা।’ নূর মিয়া বলেন, ‘স্বাধীন দেশে পতাকাও উড়াইছি।’ এসব কথা বলতে বলতে চোখ ভিজে আসে তাঁর। স্বাধীন দেশ পাওয়ার আনন্দ এখনো কাঁদায় তাঁকে। তবে সেই অশ্রু আনন্দের।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবারও সবকিছু নতুন করে শুরু করেন নূর মিয়া। দিনের বেলা করতেন বাবুর্চির কাজ আর বিকেল হলে বিক্রি করতেন পুরি। নূর মিয়া বলেন, প্রথমে পুরি বিক্রি করতেন এক আনা করে। এরপর দুই আনা, তিন আনা; এখন সেই পুরির দাম দুই টাকায় ঠেকেছে। ‘জিনিসপাতির দাম শুধু বাড়তিছে। আমাগো তো কোনো হাত নাই। তয় স্বাদ কিন্তু আগের মতো নাই।’ সময়ের পরিক্রমায় মেয়ে বড় হয়েছে। একসময় তাঁর বিয়েও দিয়েছেন। এরই মধ্যে স্ত্রীকে হারিয়েছেন নূর মিয়া।
নিজের কাজকর্ম নিজেই করেন নূর মিয়া। সকালের চাটা নিজেই তৈরি করেন তিনি। এরপর যান বাজারে। রান্না সেরে দুপুর থেকেই শুরু করেন পুরি বানানোর কাজ। এরপর পুরির সরঞ্জাম নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। স্থান সেই কলেজ রোড। মনের আনন্দে পুরি বানান আর ভাজেন তিনি। এ কাজ চলে রাত নয়টা পর্যন্ত।
নূর মিয়ার পুরির প্রশংসা করছিলেন পুরি কিনতে আসা রাজিবুর রহমান। তিনি বলেন, দাদুর পুরি এ শহরের সবচেয়ে স্বাদের পুরি। যখনই পুরি কিনতে আসি, দেখি ভিড় লেগেই আছে। এমন প্রশংসায় খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে নূর মিয়ার মুখমণ্ডল।
জীবনসায়াহ্নে দাঁড়িয়ে কী স্বপ্ন দেখেন নূর মিয়া? ফোকলা দাঁতে হেসে বৃদ্ধ উত্তর দেন, আসলে কী চাওয়ার আছে এখন। শুধু ভালো পুরি বানাইতে চাই। মানুষ যেন আমার পুরি খেয়ে ভালো কয়। বাড়িতে অতিথি, তাই আতিথেয়তার কমতি নেই নূর মিয়ার। প্লেটভর্তি গরম খিচুড়ি এনে দেন আমাদের সামনে। মৃদু হেসে নূর মিয়া বলেন, ‘খান, খাইলে খুশি হব। আমি নিজে রানছি। ডাল-চাইলের ভাত।’
‘বয়স কত হলো, দাদু?’
দাদু উত্তর দেন, ‘হবে পিরায় ৮০-৮৫ বছর।’
বয়সের সঠিক হিসাবটা মনে নেই তাঁর। বয়সের ভারে স্মৃতিশক্তিও লোপ পেয়েছে খানিকটা। তবে তিন প্রজন্ম দেখেছেন এই দাদু। সেই হিসাবে তাঁর বয়স সত্যিই অনেক বেশি। নূর মিয়া জন্মসালটা মনে না থাকলেও আদি বাড়ি যে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থানায়, তা ঠিকই মনে আছে।
দাদু বলেন, ‘নদী আমাগো বসতবাড়ি ভাইঙ্গালাইছে। হ্যার পর ঢাকা চইলা আইলাম।’ এরপর আর মুন্সিগঞ্জ ফিরে যাওয়া হয়নি দাদুর। ঢাকাতেই চাকরি জুটিয়ে নেন এক আইনজীবীর পিয়ন পদে। নূর মিয়া বলতে থাকেন, ‘সাবে যেহেনে যাইত, আমিও তার লগে লগে সেহেনে যাইতাম।’ কাজের সুবাদে সেই আইনজীবী একসময় চলে আসেন গোপালগঞ্জে। যদিও তখন পর্যন্ত গোপালগঞ্জ নামে আলাদা কোনো জেলা ছিল না। বৃহত্তর ফরিদপুরের একটি অংশ ছিল গোপালগঞ্জ। সন-তারিখ ঠিকমতো বলতে না পারলেও স্মৃতি হাতড়ে দাদু বলেন, ‘তখন আইয়ুবের শাসন চলতেছিল।’
ইতিমধ্যে বিয়ের পাট চুকিয়ে ফেলেছেন নূর মিয়া। স্ত্রী জোহরা আর কন্যা ফাতেমাকে নিয়ে ছোট্ট সংসার তাঁর। এরই মধ্যে সেই আইনজীবী পেশা বদলে গোপালগঞ্জ শহর ছেড়েছেন। কিন্তু নূর মিয়ার মায়া পড়ে যায় গোপালগঞ্জের প্রতি। তাই এখানেই থেকে যান তিনি। সংসার চালানোর জন্য শুরু করেন বাবুর্চিগিরি। আর বিকেলে কলেজ রোড ও মধুমতীর পাড়ে পুরি বিক্রি শুরু করেন। বঙ্গবন্ধুকেও রান্না করে খাইয়েছেন বলে দাবি করেন নূর মিয়া। তিনি বলেন, ‘শেখ সাব গোপালগঞ্জ আইলে তো আমি পাকশাক কইরা খাওয়াইছি। শেখ সাব যে কত কতা কইত, দ্যাশ নিয়া স্বপ্ন দ্যাখত, তা কইয়া শ্যাষ করা যাইব না।’
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নূর মিয়া আশ্রয় নেন টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবের বাড়িতে। ‘কিন্তু শয়তানগুলা তো শেখের বাড়িতেই আগে আগুন দিল।’ সেখান থেকে পালিয়ে কখনো গর্তে লুকিয়ে কখনো আবার বাঁশের ঝোপে আশ্রয় খুঁজেছেন নূর মিয়া। প্রশ্ন করি, অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন কি না? তিনি বলেন, ‘না, তয় মুক্তিযোদ্ধাগো পাকশাক কইরা খাওয়াইতাম। হ্যারপর তো যুদ্ধ শেষে স্বাধীন হইলাম আমরা।’ নূর মিয়া বলেন, ‘স্বাধীন দেশে পতাকাও উড়াইছি।’ এসব কথা বলতে বলতে চোখ ভিজে আসে তাঁর। স্বাধীন দেশ পাওয়ার আনন্দ এখনো কাঁদায় তাঁকে। তবে সেই অশ্রু আনন্দের।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবারও সবকিছু নতুন করে শুরু করেন নূর মিয়া। দিনের বেলা করতেন বাবুর্চির কাজ আর বিকেল হলে বিক্রি করতেন পুরি। নূর মিয়া বলেন, প্রথমে পুরি বিক্রি করতেন এক আনা করে। এরপর দুই আনা, তিন আনা; এখন সেই পুরির দাম দুই টাকায় ঠেকেছে। ‘জিনিসপাতির দাম শুধু বাড়তিছে। আমাগো তো কোনো হাত নাই। তয় স্বাদ কিন্তু আগের মতো নাই।’ সময়ের পরিক্রমায় মেয়ে বড় হয়েছে। একসময় তাঁর বিয়েও দিয়েছেন। এরই মধ্যে স্ত্রীকে হারিয়েছেন নূর মিয়া।
নিজের কাজকর্ম নিজেই করেন নূর মিয়া। সকালের চাটা নিজেই তৈরি করেন তিনি। এরপর যান বাজারে। রান্না সেরে দুপুর থেকেই শুরু করেন পুরি বানানোর কাজ। এরপর পুরির সরঞ্জাম নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। স্থান সেই কলেজ রোড। মনের আনন্দে পুরি বানান আর ভাজেন তিনি। এ কাজ চলে রাত নয়টা পর্যন্ত।
নূর মিয়ার পুরির প্রশংসা করছিলেন পুরি কিনতে আসা রাজিবুর রহমান। তিনি বলেন, দাদুর পুরি এ শহরের সবচেয়ে স্বাদের পুরি। যখনই পুরি কিনতে আসি, দেখি ভিড় লেগেই আছে। এমন প্রশংসায় খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে নূর মিয়ার মুখমণ্ডল।
জীবনসায়াহ্নে দাঁড়িয়ে কী স্বপ্ন দেখেন নূর মিয়া? ফোকলা দাঁতে হেসে বৃদ্ধ উত্তর দেন, আসলে কী চাওয়ার আছে এখন। শুধু ভালো পুরি বানাইতে চাই। মানুষ যেন আমার পুরি খেয়ে ভালো কয়। বাড়িতে অতিথি, তাই আতিথেয়তার কমতি নেই নূর মিয়ার। প্লেটভর্তি গরম খিচুড়ি এনে দেন আমাদের সামনে। মৃদু হেসে নূর মিয়া বলেন, ‘খান, খাইলে খুশি হব। আমি নিজে রানছি। ডাল-চাইলের ভাত।’
No comments