চালের দাম-সরকারের সামনে বিকল্প সুযোগ রয়েছে by উত্তম দেব

এক সপ্তাহ ধরে বাজারে চালের দাম বাড়ছে। দেখার বিষয় কেন বাড়ছে এবং সরকার কী করতে পারে? বাজারভিত্তিক অর্থনীতিতে যেকোনো পণ্যের মূল্য ঠিক হয় মূলত চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে। চাহিদার তুলনায় জোগান কম হলেও দাম বাড়ে। বাজার যদি সম্পূর্ণভাবে বাজারভিত্তিক প্রক্রিয়ায় চলে তাহলে দাম চাহিদা ও জোগান দ্বারা নির্ধারিত হয়।


কিন্তু সরকার অথবা ব্যবসায়ীরা কোনো দাম বেঁধে দিলে সেটাই হয়ে ওঠে মূল মানদণ্ড। তবে চালের চাহিদা যেহেতু তুলনামূলকভাবে অস্থিতিস্থাপক, তাই দামের কমা-বাড়ার সঙ্গে চাহিদার খুব একটা ওঠানামা লক্ষ করা যায় না। বর্তমান বছরে চালের উৎপাদন পরিস্থিতি সন্তোষজনক হওয়ায় আমাদের সরবরাহব্যবস্থায় খুব একটা ঘাটতি নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, তার পরও দাম কেন বাড়ছে?
সরকার গত ৪ জুলাই চাল ব্যবসায়ীদের কেজিপ্রতি তিন টাকা উৎসাহ বোনাস ঘোষণা দেওয়ার পর চালের সংগ্রহমূল্য কেজিপ্রতি পূর্বনির্ধারিত ২৫ টাকার জায়গায় ২৮ টাকা হয়ে যাচ্ছে। এটাও দাম বৃদ্ধির একটা কারণ। সংবাদপত্র থেকে জানা যায়, চালকলের মালিকেরা ঘোষণা দিয়েছেন, তাঁদের প্রতি কেজি চালে তিন টাকা উৎসাহ বোনাস দেওয়া না হলে এক সপ্তাহের মধ্যে তাঁরা সারা দেশে সরকারি গুদামে চাল সরবরাহ বন্ধ করে দেবেন। এ ধরনের ঘোষণা বাজার ব্যবস্থাপনার নীতিনৈতিকতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। নৈতিক ও আইনি কোনো কাঠামোয় এ ধরনের হুমকি কখনোই সমর্থনীয় নয়। আশা করি, চালকলের মালিকেরা বিষয়টা দ্রুতই অনুধাবন করবেন এবং তাঁদের আচরণ ও ঘোষণায় আরও সংযমী ও দায়িত্বশীল হবেন।
মুনাফা করা ব্যবসার উদ্দেশ্য হলেও নিয়মিত সরবরাহের সেবা ও যৌক্তিক আচরণের মাধ্যমেই তা করা শ্রেয়। এ ক্ষেত্রে অযৌক্তিক মুনাফা দাবি করার কোনো সুযোগ নেই। ইচ্ছামতো মুনাফা অর্জনের জন্য ব্যবসায়ীরা সরকার বা ভোক্তাদের জিম্মি করতে পারেন না।
সরকারের সঙ্গে চালকলের মালিকদের আগে করা চুক্তিমাফিক চাল ব্যবসায়ীরা সরকারকে চাল সরবরাহে অনিচ্ছুক হলে সরকারের বেকায়দায় পড়ার কথা নয়। সরকার চাইলে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সরকারি খাদ্য সরবরাহ কর্মসূচির জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহের পরিমাণ বাড়াতে পারে। বর্তমানে দেশভেদে এবং চালের গুণগতমানের ওপর ভিত্তি করে টনপ্রতি ৩১০ থেকে ৪০০ ডলারে চাল পাওয়া যাচ্ছে। গমের দামও প্রতি মেট্রিক টন ১৫৮ ডলার। অর্থাৎ এক মেট্রিক টন চালের মূল্যে দুই মেট্রিক টন গম আমদানি করে সরকার খাদ্যের প্রাপ্যতা বাড়াতে পারে। এর মাধ্যমে যাকে এক কেজি চাল দেওয়ার কথা তাকে দুই কেজি গম দিতে পারে অথবা একজনের জায়গায় দুজনকেও দিতে পারে। এ অবস্থায় সরকার সরকারি বিতরণব্যবস্থার জন্য বেশি পরিমাণে গম আমদানি করতে পারে। এতে করে খাদ্যের প্রাপ্যতা বাড়বে এবং বাজারে কোনো চাপ সৃষ্টি হবে না।
এ বছর আমন ধানের উৎপাদন ভালো, বোরোরও তা-ই। অভ্যন্তরীণ বাজারে চালের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় কম থাকায় আমদানিও খুব একটা করতে হয়নি। চালের দাম বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম চাল উৎপাদক ও রপ্তানিকারক দেশগুলোতেও কমছে। এ অবস্থায় চালের মূল্যবৃদ্ধি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
তা ছাড়া আগামী মৌসুমে আমন ধানের উৎপাদন যাতে ভালো হয় সে জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও নেওয়া যায়: যেমন উৎপাদন উপকরণের সরবরাহ নিশ্চিত করা, কোনো কারণে খরা দেখা দিলে সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা করা এবং উচ্চফলনশীল জাতের বীজ সরবরাহ করা। এ ছাড়া মাঠপর্যায়ে ফসলের অবস্থা সম্পর্কে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে গণমাধ্যমে কৃষকদের পরামর্শ দিয়েও উৎপাদনের ধারা বজায় রাখা যায়। এসবের ফলে ভবিষ্যতেও চালের সরবরাহ নিশ্চিত রাখা যায়। মোদ্দা কথা, গুদামে চাল ধরে রেখে কেউ যাতে ফায়দা নিতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। এর পরও ব্যবসায়ীরা যদি সহযোগিতা না করেন তাহলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও পথ আছে, যদিও সেটা কাঙ্ক্ষিত নয়।
সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে তা মেনে চলাই ব্যবসায়ীদের দায়িত্ব, হুমকি দেওয়া নয়। তাঁরা যদি মনে করেন ওই চুক্তিমাফিক তাঁদের লাভ হবে না, সে ক্ষেত্রে সরকারের জন্য সুযোগ রয়েছে বিদেশ থেকে আমদানি করার। ব্যবসায়ীদের বোঝাতে হবে এই চাল ধরে রেখে তাঁরা লাভ করতে পারবেন না।
বর্তমান উৎপাদন মৌসুমে বিশ্বের উৎপাদন পরিস্থিতি ভালো হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাই ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। বর্তমানে আমদানি না হলেও প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে চালের বেলায় কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। খাদ্যবিতরণ কর্মসূচির চাহিদা মেটানোর জন্য আমদানি করা হলে সরকারের আর বাড়তি আর্থিক দায় না নিলেও চলে। গম বেশি পরিমাণ আমদানি করলে, বাজারে খাদ্যপ্রাপ্যতা বাড়লে, চালের দম স্থিতিশীল থাকবে।
ব্যবসায়ীদের যুক্তি হলো, সরকার ঘোষিত সংগ্রহমূল্যে ধান ও চালের দামের অনুপাতের মধ্যে অসামঞ্জস্য ছিল। অর্থাৎ দেড় কেজি ধানে এক কেজি চাল হলে সেই অনুপাতে ধানের সরকারি সংগ্রহমূল্য কম ছিল। তাও যদি হয়, তাহলে তাঁরা নির্ধারিত মূল্যে চাল সরবরাহ করবেন বলে চুক্তি করলেন কেন? সুতরাং ব্যবসায়ীদের যুক্তি সঠিক নয় অথচ সেই যুক্তি মেনে তিন টাকা উৎসাহ বোনাস দেওয়া হলো। কিন্তু এতে তো প্রতিকার হয়নি, বরং এতে করে বাজারে দামের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ল। বিষয়টি খেয়ালে রাখা দরকার ছিল। আবার একে ব্যবহার করে দাম বৃদ্ধি করে বাজারকে অস্থিতিশীল করাও ব্যবসায়ীদের তরফে অনুচিত। আসলে সরকারের যেহেতু ধান-চাল সংগ্রহ ভালো হয়নি, এটা বুঝে তাঁরা সুযোগ নিচ্ছেন।
এদিকে আগামী নভেম্বরের মধ্যেই নতুন ফসল আসতে যাচ্ছে। তখন লাখ লাখ কৃষকের কাছ থেকেও সরকার সরাসরি খাদ্য সংগ্রহ করতে পারবে। ২০০৮-এ তেমনই হয়েছিল। তখনো ব্যবসায়ীরা চাল ধরে রেখেছিলেন কিন্তু পরে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
সরকারের উচিত, হয় চুক্তিমাফিক আচরণের জন্য চালকলের মালিকদের চাপ প্রয়োগ করা নতুবা আমদানি করে সরকারের খাদ্য মজুদ ঠিক রাখা। খাদ্যবিতরণ কর্মসূচির চাহিদা মেটানোর জন্য আমদানি করলে সরকারেরও আর বাড়তি আর্থিক দায় না নিলেও চলে। বেশি পরিমাণে গম আমদানি করলে বাজারে খাদ্যপ্রাপ্যতা বাড়বে এবং চালের দামও স্থিতিশীল থাকবে।
উত্তম দেব: সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক।

No comments

Powered by Blogger.