নগর দর্পণ: চট্টগ্রাম-হিমাদ্রী হত্যা এবং তিন হিংস্র ডোবারম্যান by বিশ্বজিৎ চৌধুরী
পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিয়ে এসেছেন আমাদের মুসা, মুহিত, নিশাত ও ওয়াসফিয়া। আমাদের শুভ রায় কৃত্রিম কিডনি তৈরি করে চোখ কপালে তুলে দিয়েছেন পৃথিবীর তাবৎ চিকিৎসাবিজ্ঞানীর। সালমান খান নামের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তরুণটি তো আজ পৃথিবীর ১০০ জন প্রভাবশালী মানুষের একজন।
এসব দৃষ্টান্তের কথা বারবার উল্লেখ করতে ইচ্ছা করে। কেননা, এই জনসংখ্যার দেশে, অভাব-দারিদ্র্য ও ঘটনা-দুর্ঘটনার দেশে এসব তরুণই আমাদের চোখের সামনে আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছেন। কিন্তু যেখানে আমাদের সবচেয়ে বড় আশ্রয়, যাঁরা আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় আশা ও আশ্বাস, সেই তরুণেরাই যখন পথভ্রষ্ট বা বিপথগামী হন, তখন আমাদের সামনে হতাশার অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই থাকে না।
চট্টগ্রাম শহরে একটি মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘটে গেল কয়েক দিন আগে। হিমাদ্রী নামের একজন তরুণকে জুনায়েদ নামের আরেক তরুণ ও তার বন্ধুরা নির্যাতন ও হত্যা করেছে পৈশাচিক কায়দায়। এ নৃশংসতা আমরা হিন্দি ছবিতে দেখেছি। কিন্তু এ রকম ঘটনা বাস্তবেও ঘটতে পারে এবং কলেজপড়ুয়া একজন তরুণ এর হোতা—এ কথা ভাবলেই শরীরের রক্ত হিম হয়ে যায়। বিত্তবান বাবার সন্তান জুনায়েদের কয়েকজন সহযোগী এ লেভেলের ছাত্র হিমাদ্রীকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল তার বাড়িতে। বাড়ির ছাদে নিয়ে গিয়ে তাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল হিংস্র তিনটি জার্মান ডোবারম্যান কুকুরের সামনে। প্রাণভয়ে হিমাদ্রীর আর্তনাদে মন গলেনি জুনায়েদ ও তার বন্ধুদের; বরং আতঙ্কিত হিমাদ্রী ছাদের রেলিংয়ের ওপর উঠে পড়লে তাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিয়েছে তারা।
হাসপাতালের শয্যায় ২৭টি দুঃসহ যন্ত্রণার দিন কাটিয়ে অবশেষে মুক্তি পেয়েছে সে। হিমাদ্রী চলে গেছে, কিন্তু আমাদের সামনে রেখে গেছে অনেক প্রশ্ন। সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি তো এই: কোন সমাজে বাস করছি আমরা?
বিত্তবান পরিবারে কিছু কিছু সন্তানকে কীভাবে বড় করা হচ্ছে—জুনায়েদ ও তার বাবার আচরণ নিঃসন্দেহে এ প্রশ্নও তুলে ধরবে আমাদের সামনে। তিনটি হিংস্র ডোবারম্যান কুকুর কেন পুষতে হবে বাড়িতে? প্রতিদিন সেই হিংস্র পশুগুলোর আচরণ দেখে নিজের কম বয়সী ছেলেটার মধ্যেও এর কোনো প্রভাব পড়ল কি না, এসব ভাবার সময় কোথায় জুনায়েদের বাবার; বরং শাহ সেলিম ওরফে টিপু ঘটনার দুদিন পর ছেলেকে নিরাপদে লন্ডন পাঠিয়ে দিয়ে বাবার দায়িত্ব সম্পাদন করেছেন। টাকাপয়সা থাকলে থানা-প্রশাসনের গতিও যে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তা-ও জানেন টিপু সাহেব। এ কারণে ঘটনার এক মাস অতিবাহিত হলেও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এ ব্যাপারে তাঁদের কাছে বেশ জুতসই একটি কৈফিয়তও তৈরি আছে, ‘ভিকটিমের পরিবার থেকে কোনো সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না।’ অদ্ভুত অজুহাত!
শোকাহত ও ভীতসন্ত্রস্ত পরিবারটির কাছ থেকে কী সহযোগিতা চায় পুলিশ? যদি সত্যি কোনোভাবে তারা প্রভাবিত না হয়ে থাকে, তাহলে হিমাদ্রী যেদিন আহত হয়েছিল, সেদিন পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করতে গেলে তা না নিয়ে পাঁচলাইশ থানার পুলিশ শুধু অভিযোগ নিয়েছিল কেন?
হাসপাতালে আহত অবস্থায় বন্ধুদের কাছে পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে হিমাদ্রী। কারা তাকে ধরে নিয়ে গেছে জুনায়েদের বাড়িতে, কারা মারধর করার পর কুকুর লেলিয়ে দিয়েছে এবং ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে ছাদ থেকে—সব কথাই জানিয়েছে সে। হিমাদ্রীর বন্ধুদের প্রত্যুপন্নমতিত্ব ও বিচক্ষণতার প্রশংসা করতে হয়। তারা এসব কথা রেকর্ড করেছে। সেই অডিও ক্যাসেটের কপি পৌঁছে দিয়েছে সাংবাদিকদের কাছে। প্রকৃত ঘটনা জানতে এবং অপরাধীদের শনাক্ত করতে খোদ হিমাদ্রীর জবানবন্দির চেয়ে বড় আলামত আর কী হতে পারে?
হিমাদ্রীর হত্যার কারণ সম্পর্কে তার বন্ধুরা বলেছে, এলাকায় মাদক ব্যবসার বিরোধিতার কারণেই এ হত্যাকাণ্ড। ‘শিকড়’ নামের একটি মাদকবিরোধী সংগঠন গড়ে তুলেছিল হিমাদ্রী ও তার বন্ধুরা। শিকড়ের সাধারণ সম্পাদক জাওইদ আলী চৌধুরী সাংবাদিকদের কাছে বলেন, ‘গত বছরের জুন মাসে আমাদের সঙ্গে শাহ সেলিমের সংঘর্ষ হয়। তখন আমরা পাঁচলাইশ থানায় জিডি করেছিলাম। এরপর চার মাস আগে হিমাদ্রীর সঙ্গে সেলিমের ছেলেদের কথা-কাটাকাটি হয়। এ ঘটনার কারণেই তাকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে।’
পুলিশ বা সদ্য নিযুক্ত গোয়েন্দা সংস্থা কি এসব তথ্য আমলে নেবে, নাকি অপেক্ষা করতে থাকবে কখন কালের নিয়মে বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে যায় এ ঘটনা, কখন অন্য কোনো দুঃসংবাদ এসে সংবাদপত্রের পাতা থেকে সরিয়ে দেবে হিমাদ্রীর নাম?
২.
এবার অন্য একটি ঘটনার কথা বলি। কয়েক দিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল হাসনাত প্রতিপক্ষের ধাওয়া খেয়ে শাহজালাল হলের দোতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে মারাত্মক আহত হন। হাসনাতের বক্তব্য অনুসারে, তাঁর সেদিন পরীক্ষা ছিল। মৌখিক পরীক্ষা দিতে বিভাগে গেলে তাঁকে সেখান থেকে জোর করে তুলে নিয়ে যায় ‘ছাত্রলীগ নামধারী’ কয়েকজন ছাত্র। হলে নিয়ে বেদম পেটানো হয় তাঁকে। একপর্যায়ে প্রাণে বাঁচার জন্য দৌড়ে পালিয়ে তিনি দোতলা থেকে লাফিয়ে পড়েন। হাসনাতের পেছনে হিংস্র কুকুরের তাড়া ছিল না। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সহপাঠীর হিংস্রতা তাঁকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল মৃত্যুর মুখোমুখি। হাসনাতের মৃত্যু হলে হয়তো পত্রপত্রিকায় কয়েক দিন লেখালেখি হতো; বিচারের দাবিতে মানববন্ধনও হতো। কিন্তু এ যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গেলেন বলে তাঁর ওপর নির্যাতনকারীরা কি পার পেয়ে যাবে? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কি পারবে এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার করতে? নাকি ছাত্রলীগ নামধারী বলে সাত খুন মাফ হয়ে যাবে অপরাধীদের? এই আশঙ্কার একটি কারণ আছে। কিছুদিন আগে পুলিশের হাতে অস্ত্রসহ আটক এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্রলীগের দুই কর্মী আদালতে জামিন পেয়েছেন মাত্র ১৭ দিনের মাথায়। আইনজীবীরা বলেছেন, এটা অস্বাভাবিক। অস্ত্রসহ আটক হলে এক বছরের আগে জামিন পাওয়ার নজির চট্টগ্রাম আদালতে আর নেই। এ তো গেল আইনের কথা। কিন্তু এর বাইরেও যে ‘অস্বাভাবিক’ ঘটনা আমাদের প্রায় বাকরুদ্ধ করে দেয় তা হলো, ওই দুই ছাত্রের জামিনদার হয়েছেন খোদ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য!
হিমাদ্রীর ওপর কুকুর লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কুকুরের কাজ কুকুর করেছে। কথায় আছে, কুকুর পাগল হলে বিষ খাইয়ে মারতে হয়। কিন্তু যে তরুণেরা হিংস্রতায়-ক্রূূরতায় এসব হিংস্র প্রাণীকেও ছাড়িয়ে গেছে, তাদের জন্য প্রতিবিধান কী?
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি তো নিশ্চিত করতেই হবে, পাশাপাশি আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবার ও সমাজের কিছু ব্যর্থতার কথাও ভেবে দেখা দরকার। শিক্ষা ও বিনোদনের মাধ্যমে যে মানসিক পুষ্টি আমাদের শিশু-কিশোরদের পাওয়ার কথা, তা তারা পাচ্ছে না; বরং একদিকে প্রতিযোগিতার বেড়াজালে বন্দী তাদের শিক্ষা ও শৈশব, অন্যদিকে খোলা মাঠ ও মুক্ত জীবনের পরিবর্তে কম্পিউটারের মনিটর ও টিভির পর্দার মধ্যে সীমাবদ্ধ তাদের বিনোদনের জগৎ। এ রকম পরিবেশে কৈশোর ও তারুণ্যের পূর্ণ বিকাশ কি সম্ভব?
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com
চট্টগ্রাম শহরে একটি মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘটে গেল কয়েক দিন আগে। হিমাদ্রী নামের একজন তরুণকে জুনায়েদ নামের আরেক তরুণ ও তার বন্ধুরা নির্যাতন ও হত্যা করেছে পৈশাচিক কায়দায়। এ নৃশংসতা আমরা হিন্দি ছবিতে দেখেছি। কিন্তু এ রকম ঘটনা বাস্তবেও ঘটতে পারে এবং কলেজপড়ুয়া একজন তরুণ এর হোতা—এ কথা ভাবলেই শরীরের রক্ত হিম হয়ে যায়। বিত্তবান বাবার সন্তান জুনায়েদের কয়েকজন সহযোগী এ লেভেলের ছাত্র হিমাদ্রীকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল তার বাড়িতে। বাড়ির ছাদে নিয়ে গিয়ে তাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল হিংস্র তিনটি জার্মান ডোবারম্যান কুকুরের সামনে। প্রাণভয়ে হিমাদ্রীর আর্তনাদে মন গলেনি জুনায়েদ ও তার বন্ধুদের; বরং আতঙ্কিত হিমাদ্রী ছাদের রেলিংয়ের ওপর উঠে পড়লে তাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিয়েছে তারা।
হাসপাতালের শয্যায় ২৭টি দুঃসহ যন্ত্রণার দিন কাটিয়ে অবশেষে মুক্তি পেয়েছে সে। হিমাদ্রী চলে গেছে, কিন্তু আমাদের সামনে রেখে গেছে অনেক প্রশ্ন। সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি তো এই: কোন সমাজে বাস করছি আমরা?
বিত্তবান পরিবারে কিছু কিছু সন্তানকে কীভাবে বড় করা হচ্ছে—জুনায়েদ ও তার বাবার আচরণ নিঃসন্দেহে এ প্রশ্নও তুলে ধরবে আমাদের সামনে। তিনটি হিংস্র ডোবারম্যান কুকুর কেন পুষতে হবে বাড়িতে? প্রতিদিন সেই হিংস্র পশুগুলোর আচরণ দেখে নিজের কম বয়সী ছেলেটার মধ্যেও এর কোনো প্রভাব পড়ল কি না, এসব ভাবার সময় কোথায় জুনায়েদের বাবার; বরং শাহ সেলিম ওরফে টিপু ঘটনার দুদিন পর ছেলেকে নিরাপদে লন্ডন পাঠিয়ে দিয়ে বাবার দায়িত্ব সম্পাদন করেছেন। টাকাপয়সা থাকলে থানা-প্রশাসনের গতিও যে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তা-ও জানেন টিপু সাহেব। এ কারণে ঘটনার এক মাস অতিবাহিত হলেও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এ ব্যাপারে তাঁদের কাছে বেশ জুতসই একটি কৈফিয়তও তৈরি আছে, ‘ভিকটিমের পরিবার থেকে কোনো সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না।’ অদ্ভুত অজুহাত!
শোকাহত ও ভীতসন্ত্রস্ত পরিবারটির কাছ থেকে কী সহযোগিতা চায় পুলিশ? যদি সত্যি কোনোভাবে তারা প্রভাবিত না হয়ে থাকে, তাহলে হিমাদ্রী যেদিন আহত হয়েছিল, সেদিন পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করতে গেলে তা না নিয়ে পাঁচলাইশ থানার পুলিশ শুধু অভিযোগ নিয়েছিল কেন?
হাসপাতালে আহত অবস্থায় বন্ধুদের কাছে পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে হিমাদ্রী। কারা তাকে ধরে নিয়ে গেছে জুনায়েদের বাড়িতে, কারা মারধর করার পর কুকুর লেলিয়ে দিয়েছে এবং ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে ছাদ থেকে—সব কথাই জানিয়েছে সে। হিমাদ্রীর বন্ধুদের প্রত্যুপন্নমতিত্ব ও বিচক্ষণতার প্রশংসা করতে হয়। তারা এসব কথা রেকর্ড করেছে। সেই অডিও ক্যাসেটের কপি পৌঁছে দিয়েছে সাংবাদিকদের কাছে। প্রকৃত ঘটনা জানতে এবং অপরাধীদের শনাক্ত করতে খোদ হিমাদ্রীর জবানবন্দির চেয়ে বড় আলামত আর কী হতে পারে?
হিমাদ্রীর হত্যার কারণ সম্পর্কে তার বন্ধুরা বলেছে, এলাকায় মাদক ব্যবসার বিরোধিতার কারণেই এ হত্যাকাণ্ড। ‘শিকড়’ নামের একটি মাদকবিরোধী সংগঠন গড়ে তুলেছিল হিমাদ্রী ও তার বন্ধুরা। শিকড়ের সাধারণ সম্পাদক জাওইদ আলী চৌধুরী সাংবাদিকদের কাছে বলেন, ‘গত বছরের জুন মাসে আমাদের সঙ্গে শাহ সেলিমের সংঘর্ষ হয়। তখন আমরা পাঁচলাইশ থানায় জিডি করেছিলাম। এরপর চার মাস আগে হিমাদ্রীর সঙ্গে সেলিমের ছেলেদের কথা-কাটাকাটি হয়। এ ঘটনার কারণেই তাকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে।’
পুলিশ বা সদ্য নিযুক্ত গোয়েন্দা সংস্থা কি এসব তথ্য আমলে নেবে, নাকি অপেক্ষা করতে থাকবে কখন কালের নিয়মে বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে যায় এ ঘটনা, কখন অন্য কোনো দুঃসংবাদ এসে সংবাদপত্রের পাতা থেকে সরিয়ে দেবে হিমাদ্রীর নাম?
২.
এবার অন্য একটি ঘটনার কথা বলি। কয়েক দিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল হাসনাত প্রতিপক্ষের ধাওয়া খেয়ে শাহজালাল হলের দোতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে মারাত্মক আহত হন। হাসনাতের বক্তব্য অনুসারে, তাঁর সেদিন পরীক্ষা ছিল। মৌখিক পরীক্ষা দিতে বিভাগে গেলে তাঁকে সেখান থেকে জোর করে তুলে নিয়ে যায় ‘ছাত্রলীগ নামধারী’ কয়েকজন ছাত্র। হলে নিয়ে বেদম পেটানো হয় তাঁকে। একপর্যায়ে প্রাণে বাঁচার জন্য দৌড়ে পালিয়ে তিনি দোতলা থেকে লাফিয়ে পড়েন। হাসনাতের পেছনে হিংস্র কুকুরের তাড়া ছিল না। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সহপাঠীর হিংস্রতা তাঁকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল মৃত্যুর মুখোমুখি। হাসনাতের মৃত্যু হলে হয়তো পত্রপত্রিকায় কয়েক দিন লেখালেখি হতো; বিচারের দাবিতে মানববন্ধনও হতো। কিন্তু এ যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গেলেন বলে তাঁর ওপর নির্যাতনকারীরা কি পার পেয়ে যাবে? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কি পারবে এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার করতে? নাকি ছাত্রলীগ নামধারী বলে সাত খুন মাফ হয়ে যাবে অপরাধীদের? এই আশঙ্কার একটি কারণ আছে। কিছুদিন আগে পুলিশের হাতে অস্ত্রসহ আটক এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্রলীগের দুই কর্মী আদালতে জামিন পেয়েছেন মাত্র ১৭ দিনের মাথায়। আইনজীবীরা বলেছেন, এটা অস্বাভাবিক। অস্ত্রসহ আটক হলে এক বছরের আগে জামিন পাওয়ার নজির চট্টগ্রাম আদালতে আর নেই। এ তো গেল আইনের কথা। কিন্তু এর বাইরেও যে ‘অস্বাভাবিক’ ঘটনা আমাদের প্রায় বাকরুদ্ধ করে দেয় তা হলো, ওই দুই ছাত্রের জামিনদার হয়েছেন খোদ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য!
হিমাদ্রীর ওপর কুকুর লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কুকুরের কাজ কুকুর করেছে। কথায় আছে, কুকুর পাগল হলে বিষ খাইয়ে মারতে হয়। কিন্তু যে তরুণেরা হিংস্রতায়-ক্রূূরতায় এসব হিংস্র প্রাণীকেও ছাড়িয়ে গেছে, তাদের জন্য প্রতিবিধান কী?
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি তো নিশ্চিত করতেই হবে, পাশাপাশি আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবার ও সমাজের কিছু ব্যর্থতার কথাও ভেবে দেখা দরকার। শিক্ষা ও বিনোদনের মাধ্যমে যে মানসিক পুষ্টি আমাদের শিশু-কিশোরদের পাওয়ার কথা, তা তারা পাচ্ছে না; বরং একদিকে প্রতিযোগিতার বেড়াজালে বন্দী তাদের শিক্ষা ও শৈশব, অন্যদিকে খোলা মাঠ ও মুক্ত জীবনের পরিবর্তে কম্পিউটারের মনিটর ও টিভির পর্দার মধ্যে সীমাবদ্ধ তাদের বিনোদনের জগৎ। এ রকম পরিবেশে কৈশোর ও তারুণ্যের পূর্ণ বিকাশ কি সম্ভব?
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com
No comments