কালের পুরাণ-দেশ কি সঠিক পথে চলছে? by সোহরাব হাসান
প্রথমেই কবুল করে নিচ্ছি, শেখ হাসিনার মহাজোট সরকার পূর্ববর্তী খালেদা জিয়ার চারদলীয় জোট সরকারের মতো অথর্ব নয়, কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে না, সমস্যা এড়িয়ে চলার চেয়ে মোকাবিলার চেষ্টা তাদের আছে। কৃষি ও শিক্ষাসহ কয়েকটি খাতে সরকার গত ১৮ মাসে যে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছে, তাতেও সন্দেহ নেই।
জ্বালানি-সংকট সমাধানেও নেওয়া হয়েছে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি বেশ কিছু পরিকল্পনা। খালেদা জিয়ার কথিত ‘পূর্বমুখী কূটনীতি’র স্থলে শেখ হাসিনার ‘দুই বিশাল প্রতিবেশী’র সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে চলার উদ্যোগও সর্বমহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে।
এত সব ইতিবাচক দিক সত্ত্বেও সরকার আগামী সাড়ে তিন বছর দেশ সুষ্ঠুভাবে চালাতে পারবে কি না, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো রক্ষায় তারা সফল হবে কি না সে ব্যাপারে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। এ জন্যই দেড় বছরের মাথায় প্রশ্ন উঠেছে, দেশ কি সঠিক পথে চলছে? বিরোধী দলের প্রতি সরকারের আচরণ কি যুক্তিসংগত? তারা কি কাজের চেয়ে অকাজকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে না (যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে আমরা কোনোভাবে অকাজ বলে মনে করছি না)? ক্ষমতাসীনদের সাম্প্রতিক কিছু কর্মকাণ্ড দেশবাসীকে শঙ্কিত করে তুলেছে।
বিএনপি আমলে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রদল ও শিবিরের সন্ত্রাস-দখলবাজি ছিল, এ কথা কেউ অস্বীকার করবে না। সে সময়ে দেশে দুঃশাসন, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, বোমাবাজি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তাও সত্য। জোট সরকার শুরু থেকে বিরোধী দলকে দমন-পীড়নে ব্যস্ত ছিল। তুলনায় শেখ হাসিনার সরকার প্রথম ১৫ মাস মোটামুটি সহনীয় রাজনৈতিক পরিবেশ বজায় রাখতে পেরেছিল বলা যায়। কিন্তু জীবনানন্দের কবিতার ভাষায় ‘হঠাৎ কোন ভূত’ সরকারের ঘাড়ে চেপে বসল? রাস্তায়, ঘরে—যেখানেই পাচ্ছে সরকারের র্যাব-পুলিশ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের লাঠিপেটা করছে, রিমান্ডে নিচ্ছে। অন্যদিকে সরকার-সমর্থক যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বিরোধী দলের ওপর চড়াও হচ্ছে। এসব কিসের আলামত?
সরকারের মন্ত্রী-সাংসদেরা বক্তৃতা-বিবৃতিতে বিএনপি আমলের সন্ত্রাস-মাস্তানির কথা ফলাও প্রচার করলেও নিজেদের আমল সম্পর্কে কিছু বলেন না। কেউ কেউ আওয়ামী রাজনীতির শতভাগ বিশুদ্ধতা প্রমাণ করতে এমন প্রচারও চালান যে বঙ্গবন্ধুর সৈনিকেরা কোনো অন্যায় করতে পারে না। ছাত্রদল ও শিবির কর্মীরা নাকি সরকারি দলে অনুপ্রবেশ করে এসব মাস্তানি-চাঁদাবাজি চালাচ্ছেন। তাঁদের এসব দাবি যে কত অসার, বিভিন্ন স্থানে সরকারি ছাত্র ও যুব সংগঠন কর্তৃক দখলবাজি ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপর্যুপরি সংঘাত-সংঘর্ষই তার প্রমাণ। প্রধানমন্ত্রীর ‘মৃদু ও কঠোর ধমক’ও ছাত্রলীগ নামধারী সংগঠনটিকে সন্ত্রাস-সংঘর্ষ থেকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। যার সর্বশেষ উদাহরণ জাহাঙ্গীরনগর ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মারামারি। শেখ হাসিনা বিরোধী দলে থাকতে একবার ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতে বইখাতা তুলে দিয়েছিলেন; কিন্তু এখনকার ছাত্রলীগের কর্মীরা সেই বইখাতা ছুড়ে ফেলে ছুরি, চাকু, কিরিচ, রামদা ও আগ্নেয়াস্ত্র হাতে প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। গত ১৮ মাসে কেবল জাহাঙ্গীরনগরেই তাঁরা ৫০ বার সংঘাতে লিপ্ত হয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ যতই প্রগতিশীল ও একমুখী শিক্ষানীতি জাতিকে উপহার দিন না কেন, ছাত্রলীগের কর্মীরা অস্ত্রমুখী শিক্ষাঙ্গন প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত। তাঁদের সন্ত্রাসের কারণে দেশের বেশ কটি বিশ্বদ্যািলয় এখন বন্ধ। আমরা ১৯৭৪ সালে ছাত্রলীগের অন্তর্দ্বন্দ্বে মুহসীন হলের সাত ছাত্র হত্যার কথা স্মরণ করতে পারি। সে সময়ও ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ ছিল ছাত্রলীগ, এখনো।
২৭ জুন হরতালের দিন পুলিশের আচরণ ছিল মারমুখী। এর পক্ষে না হয় জনজীবনের নিরাপত্তার যুক্তি ছিল। কিন্তু ৭ জুলাই এক ঘণ্টার মানববন্ধনের মতো নিরীহ কর্মসূচি পণ্ড করার কী কারণ থাকতে পারে? এ ধরনের চণ্ডনীতি সরকারের গোঁয়ার্তুমি বজায় রাখলেও রাজনৈতিক সংঘাত বাড়াবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হরতালের দিন ছাত্রলীগের মাস্তানির দায় নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তাঁর কথা মেনে নিলে ছাত্রদলের সন্ত্রাসীর জন্য বিএনপিকে এবং শিবিরের সন্ত্রাসের জন্য জামায়াতকে দোষারোপ করা যায় না।
ঢাকা শহর রক্ষায় ড্যাপ (ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান) বাস্তবায়নের যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে, তাতে সাধারণ মানুষ আশ্বস্ত হয়েছিল। বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সোয়া কোটি মানুষকে রক্ষায় এর বিকল্প নেই বলে মনে করেন বিশেজ্ঞরা। প্রধানমন্ত্রীও এর বাস্তবায়ন চান। কিন্তু সরকারি দলের স্থানীয় সাংসদদের ভূমিকা কী? তাঁরা শুধু ড্যাপ বাস্তবায়নেরই বিরোধিতা করছেন না, সরাসরি ‘ভূমিদস্যুদের’ পক্ষ নিয়েছেন, জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। এত দিন সরকারের ভালো ও জনকল্যাণমুখী উদ্যোগের বিরোধিতা করতেন আমলারা। এখন সেই ভূমিকায় নেমেছেন সাংসদেরা। তা হলে ডিজিটাল বাংলাদেশ হবে কীভাবে?
আমরা হরতালের রাজনীতির বিরোধিতা করি। কেন করি? পিকেটিংয়ের নামে হরতালে গাড়ি ভাঙচুর করা হয়, মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থামিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সরকারি দলের সাংসদ কিংবা নেতারা যখন একই কাজ করেন, তখন তা কী করে সমর্থনযোগ্য হয়? ৩ জুলাই গাজীপুরে দুই সাংসদের নেতৃত্বে ড্যাপের বিরুদ্ধে সমাবেশ ডাকা হয়েছিল। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার অধিকার সবার আছে। কিন্তু সাংসদদ্বয়ের সমাবেশটি আর শান্তিপূর্ণ থাকেনি। বিক্ষুব্ধ কর্মীরা ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক অবরোধ ও দুই শতাধিক গাড়ি ভাঙচুর করেন। কেবল ড্যাপ নয়, সরকারের আরও অনেক গণমুখী পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে বসেছে সরকারি দলের সাংসদদের অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপে। তাঁদের হাতে সাধারণ মানুষ নাজেহাল হচ্ছে। নদী, খাল, বিল ও জলাভূমিও দখল হয়ে যাচ্ছে।
বিএনপি-জামায়াত সরকার দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়েছিল বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন চালানোর কারণে। ভিন্নমতের লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষক, মানবাধিকারকর্মীদের মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে অন্যায়ভাবে তারা গ্রেপ্তার করেছে, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালিয়েছে। তারা জজ মিয়ার কল্পকাহিনি সাজিয়েছে। এখনো যদি সেই একই প্রক্রিয়ায় বিরোধী দল ও ভিন্নমতের লোকদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হয়, তা হলে ‘জঙ্গি তোষণকারী’ বিএনপি ও ‘সাচ্চা গণতন্ত্রী’ আওয়ামী লীগের মধ্যে পার্থক্য থাকল কোথায়?
বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের নামে বিনা বিচারে মানুষ মারার নাম আইনের শাসন নয়। কোনো সভ্য দেশে এটি চলতে পারে না। উচ্চ আদালতের নির্দেশ, মানবাধিকার কমিশনের উদ্বেগ, বিদেশিদের ভর্ৎসনাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৌরাত্ম্য থামাতে পারছে না। সরকারের দাবি, নির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ধরা হচ্ছে। সেই তথ্যপ্রমাণ তারা আদালতে হাজির করুক। অপরাধ প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত শাস্তি ভোগ করবেন। দিনের পর দিন রিমান্ডে নিয়ে জবানবন্দি নেওয়ার তো প্রয়োজন নেই। গয়রহ মামলা বিচারের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।
বিএনপির যে কর্মীরা আগুনে পুড়িয়ে গরিব ট্যাক্সিচালককে হত্যা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে সরকার আইনগত ব্যবস্থা নিলে সবাই সমর্থন জানাবে। কেউ আপত্তি করবে না। কিন্তু একটি ঘটনার দায় পুরো দলের নেতৃত্বের ওপর চাপিয়ে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিলে তা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হিসেবেই চিহ্নিত হবে। তা ছাড়া রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান রাজনৈতিকভাবেই করতে হয়। পুলিশি অভিযানে বুমেরাং হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যত সরকার (নির্বাচিত ও অনির্বাচিত) এসেছে, সবাই পূর্ববর্তী সরকারের দুঃশাসন-দুর্নীতিকে হাতিয়ার করেছে। কিন্তু বিদায় নেওয়ার সময় তারা নিজেদের অন্যায়-দুর্নীতি ও দুঃশাসনে এতটাই ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে যে, জনগণ আগের কথা ভুলে গেছে। খুব দূরের উদাহরণ দেব না, ২০০১ ও ২০০৮ সালের কথা ভাবুন।
মহাজোট সরকার মাত্র দেড় বছর পার করেছে। সরকারের সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে চূড়ান্ত রায় দেওয়ার সময় আসেনি। তবে পিলখানা ট্র্যাজেডি সত্ত্বেও প্রথম বছরে যেভাবে সরকার পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছিল, তা প্রশংসার দাবি রাখে। দ্বিতীয় বছরে এসে মনে হচ্ছে, তারা তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। একের পর এক বিরোধীদের জন্য এত ফ্রন্ট খুলেছে যে সামাল দেওয়াই কঠিন হয়ে পড়েছে। জনগণ যুদ্ধাপরাধসহ সব অপরাধের বিচার চায়। বিচার না চাইলেও বিচার করা সরকার বা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। সে দায়িত্ব পালনে তাকে সব রাগ বা অনুরাগের ঊর্ধ্বে থাকতে হবে।
দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে পিপলস পারস্পেকটিভ বা জনগণের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টিও সরকারকে মাথায় রাখতে হয়। সামরিক শাসকেরা যত ভালো কাজই করুন না কেন, শেষ বিচারে বৈধতা পায় না। এমনকি ১/১১-পরবর্তী সামরিক বাহিনী-সমর্থিত জরুরি সরকারও বৈধতা লাভে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান সরকারের বড় শক্তি জনসমর্থন, পুলিশ বা র্যাব নয়। ইতিমধ্যে সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী ও নেতা আপন ‘কৃতিত্বে’ এতটাই মশগুল যে তাঁরা ভাবছেন, আগামী দু-চার মেয়াদে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকা কোনো ব্যাপারই নয়। বিএনপির নেতারাও একই মনোভাব পোষণ করতেন। জনগণই যে শেষ বিচারক, সে কথাটি ক্ষমতাসীনেরা প্রায়শ ভুলে যান। না হলে বিএনপি আমলের মতো মন্ত্রী ও সাংসদেরা সোনার চাবি উপহার নেওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু করতেন না।
সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সহকারী সচিব উইলিয়াম জে চার্লস সার্টিফিকেট দিয়েছেন, বাংলাদেশ নাকি ঠিকমতোই চলছে। প্রধানমন্ত্রীও মনে করেন, দেশ সঠিকভাবেই চলছে। সরকারি দলের নেতারা, মন্ত্রীরা সভা-সমাবেশে জোর হাততালি পাচ্ছেন। কিন্তু দেশ ঠিকভাবে চলছে না। চললে দেড় বছরের মাথায় হরতালের গজব আসবে কেন, সংসদে বিরোধী দলের আসনগুলো গাছ কেটে নেওয়ার পর শূন্য গুঁড়ির মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে কেন?
দেশ সঠিকভাবে চলা মানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় চলা নয়। দেশ সঠিকভাবে চলা মানে সরকার ও বিরোধী দলের চলা। দেশ সঠিকভাবে চলা মানে সংসদকে রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র করা, সব জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হওয়া। দেশ সঠিকভাবে চলা মানে অভিযুক্তকে ধরে নিয়ে রিমান্ডের নামে নির্যাতন চালানো নয়, অভিযুক্তেরও আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার নিশ্চিত করা। দেশ সঠিকভাবে চলা মানে সরকার ও বিরোধী দল, মন্ত্রী ও সাংসদের একযোগে কাজ করা। দেশ সঠিকভাবে চলা মানে সাংসদ ও উপজেলা চেয়ারম্যানের মুখোমুখি অবস্থান নয়, যাঁর যাঁর অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করা। দেশ সঠিকভাবে চলা মানে আইনকে নিজের হাতে তুলে নেওয়া নয়, সরকারি জমিজমা, নদী, খাল তথা সবকিছু দখল করা নয়।
দেশ কি সঠিকভাবে চলছে? এর সহজ উত্তর, চলছে না। এ জন্য কে বেশি বা কম দায়ী, সে বিতর্ক না করেও যে কথাটি বলতে চাই তা হলো, ‘এ আমার, এ তোমার পাপ’। আমাদের পাপের ভার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যাতে অনন্তকাল বইতে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে বলব মাননীয় সরকার ও সদাশয় বিরোধী দলকে। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
এত সব ইতিবাচক দিক সত্ত্বেও সরকার আগামী সাড়ে তিন বছর দেশ সুষ্ঠুভাবে চালাতে পারবে কি না, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো রক্ষায় তারা সফল হবে কি না সে ব্যাপারে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। এ জন্যই দেড় বছরের মাথায় প্রশ্ন উঠেছে, দেশ কি সঠিক পথে চলছে? বিরোধী দলের প্রতি সরকারের আচরণ কি যুক্তিসংগত? তারা কি কাজের চেয়ে অকাজকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে না (যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে আমরা কোনোভাবে অকাজ বলে মনে করছি না)? ক্ষমতাসীনদের সাম্প্রতিক কিছু কর্মকাণ্ড দেশবাসীকে শঙ্কিত করে তুলেছে।
বিএনপি আমলে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রদল ও শিবিরের সন্ত্রাস-দখলবাজি ছিল, এ কথা কেউ অস্বীকার করবে না। সে সময়ে দেশে দুঃশাসন, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, বোমাবাজি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তাও সত্য। জোট সরকার শুরু থেকে বিরোধী দলকে দমন-পীড়নে ব্যস্ত ছিল। তুলনায় শেখ হাসিনার সরকার প্রথম ১৫ মাস মোটামুটি সহনীয় রাজনৈতিক পরিবেশ বজায় রাখতে পেরেছিল বলা যায়। কিন্তু জীবনানন্দের কবিতার ভাষায় ‘হঠাৎ কোন ভূত’ সরকারের ঘাড়ে চেপে বসল? রাস্তায়, ঘরে—যেখানেই পাচ্ছে সরকারের র্যাব-পুলিশ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের লাঠিপেটা করছে, রিমান্ডে নিচ্ছে। অন্যদিকে সরকার-সমর্থক যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বিরোধী দলের ওপর চড়াও হচ্ছে। এসব কিসের আলামত?
সরকারের মন্ত্রী-সাংসদেরা বক্তৃতা-বিবৃতিতে বিএনপি আমলের সন্ত্রাস-মাস্তানির কথা ফলাও প্রচার করলেও নিজেদের আমল সম্পর্কে কিছু বলেন না। কেউ কেউ আওয়ামী রাজনীতির শতভাগ বিশুদ্ধতা প্রমাণ করতে এমন প্রচারও চালান যে বঙ্গবন্ধুর সৈনিকেরা কোনো অন্যায় করতে পারে না। ছাত্রদল ও শিবির কর্মীরা নাকি সরকারি দলে অনুপ্রবেশ করে এসব মাস্তানি-চাঁদাবাজি চালাচ্ছেন। তাঁদের এসব দাবি যে কত অসার, বিভিন্ন স্থানে সরকারি ছাত্র ও যুব সংগঠন কর্তৃক দখলবাজি ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপর্যুপরি সংঘাত-সংঘর্ষই তার প্রমাণ। প্রধানমন্ত্রীর ‘মৃদু ও কঠোর ধমক’ও ছাত্রলীগ নামধারী সংগঠনটিকে সন্ত্রাস-সংঘর্ষ থেকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। যার সর্বশেষ উদাহরণ জাহাঙ্গীরনগর ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মারামারি। শেখ হাসিনা বিরোধী দলে থাকতে একবার ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতে বইখাতা তুলে দিয়েছিলেন; কিন্তু এখনকার ছাত্রলীগের কর্মীরা সেই বইখাতা ছুড়ে ফেলে ছুরি, চাকু, কিরিচ, রামদা ও আগ্নেয়াস্ত্র হাতে প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। গত ১৮ মাসে কেবল জাহাঙ্গীরনগরেই তাঁরা ৫০ বার সংঘাতে লিপ্ত হয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ যতই প্রগতিশীল ও একমুখী শিক্ষানীতি জাতিকে উপহার দিন না কেন, ছাত্রলীগের কর্মীরা অস্ত্রমুখী শিক্ষাঙ্গন প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত। তাঁদের সন্ত্রাসের কারণে দেশের বেশ কটি বিশ্বদ্যািলয় এখন বন্ধ। আমরা ১৯৭৪ সালে ছাত্রলীগের অন্তর্দ্বন্দ্বে মুহসীন হলের সাত ছাত্র হত্যার কথা স্মরণ করতে পারি। সে সময়ও ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ ছিল ছাত্রলীগ, এখনো।
২৭ জুন হরতালের দিন পুলিশের আচরণ ছিল মারমুখী। এর পক্ষে না হয় জনজীবনের নিরাপত্তার যুক্তি ছিল। কিন্তু ৭ জুলাই এক ঘণ্টার মানববন্ধনের মতো নিরীহ কর্মসূচি পণ্ড করার কী কারণ থাকতে পারে? এ ধরনের চণ্ডনীতি সরকারের গোঁয়ার্তুমি বজায় রাখলেও রাজনৈতিক সংঘাত বাড়াবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হরতালের দিন ছাত্রলীগের মাস্তানির দায় নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তাঁর কথা মেনে নিলে ছাত্রদলের সন্ত্রাসীর জন্য বিএনপিকে এবং শিবিরের সন্ত্রাসের জন্য জামায়াতকে দোষারোপ করা যায় না।
ঢাকা শহর রক্ষায় ড্যাপ (ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান) বাস্তবায়নের যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে, তাতে সাধারণ মানুষ আশ্বস্ত হয়েছিল। বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সোয়া কোটি মানুষকে রক্ষায় এর বিকল্প নেই বলে মনে করেন বিশেজ্ঞরা। প্রধানমন্ত্রীও এর বাস্তবায়ন চান। কিন্তু সরকারি দলের স্থানীয় সাংসদদের ভূমিকা কী? তাঁরা শুধু ড্যাপ বাস্তবায়নেরই বিরোধিতা করছেন না, সরাসরি ‘ভূমিদস্যুদের’ পক্ষ নিয়েছেন, জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। এত দিন সরকারের ভালো ও জনকল্যাণমুখী উদ্যোগের বিরোধিতা করতেন আমলারা। এখন সেই ভূমিকায় নেমেছেন সাংসদেরা। তা হলে ডিজিটাল বাংলাদেশ হবে কীভাবে?
আমরা হরতালের রাজনীতির বিরোধিতা করি। কেন করি? পিকেটিংয়ের নামে হরতালে গাড়ি ভাঙচুর করা হয়, মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থামিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সরকারি দলের সাংসদ কিংবা নেতারা যখন একই কাজ করেন, তখন তা কী করে সমর্থনযোগ্য হয়? ৩ জুলাই গাজীপুরে দুই সাংসদের নেতৃত্বে ড্যাপের বিরুদ্ধে সমাবেশ ডাকা হয়েছিল। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার অধিকার সবার আছে। কিন্তু সাংসদদ্বয়ের সমাবেশটি আর শান্তিপূর্ণ থাকেনি। বিক্ষুব্ধ কর্মীরা ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক অবরোধ ও দুই শতাধিক গাড়ি ভাঙচুর করেন। কেবল ড্যাপ নয়, সরকারের আরও অনেক গণমুখী পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে বসেছে সরকারি দলের সাংসদদের অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপে। তাঁদের হাতে সাধারণ মানুষ নাজেহাল হচ্ছে। নদী, খাল, বিল ও জলাভূমিও দখল হয়ে যাচ্ছে।
বিএনপি-জামায়াত সরকার দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়েছিল বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন চালানোর কারণে। ভিন্নমতের লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষক, মানবাধিকারকর্মীদের মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে অন্যায়ভাবে তারা গ্রেপ্তার করেছে, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালিয়েছে। তারা জজ মিয়ার কল্পকাহিনি সাজিয়েছে। এখনো যদি সেই একই প্রক্রিয়ায় বিরোধী দল ও ভিন্নমতের লোকদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হয়, তা হলে ‘জঙ্গি তোষণকারী’ বিএনপি ও ‘সাচ্চা গণতন্ত্রী’ আওয়ামী লীগের মধ্যে পার্থক্য থাকল কোথায়?
বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের নামে বিনা বিচারে মানুষ মারার নাম আইনের শাসন নয়। কোনো সভ্য দেশে এটি চলতে পারে না। উচ্চ আদালতের নির্দেশ, মানবাধিকার কমিশনের উদ্বেগ, বিদেশিদের ভর্ৎসনাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৌরাত্ম্য থামাতে পারছে না। সরকারের দাবি, নির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ধরা হচ্ছে। সেই তথ্যপ্রমাণ তারা আদালতে হাজির করুক। অপরাধ প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত শাস্তি ভোগ করবেন। দিনের পর দিন রিমান্ডে নিয়ে জবানবন্দি নেওয়ার তো প্রয়োজন নেই। গয়রহ মামলা বিচারের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।
বিএনপির যে কর্মীরা আগুনে পুড়িয়ে গরিব ট্যাক্সিচালককে হত্যা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে সরকার আইনগত ব্যবস্থা নিলে সবাই সমর্থন জানাবে। কেউ আপত্তি করবে না। কিন্তু একটি ঘটনার দায় পুরো দলের নেতৃত্বের ওপর চাপিয়ে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিলে তা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হিসেবেই চিহ্নিত হবে। তা ছাড়া রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান রাজনৈতিকভাবেই করতে হয়। পুলিশি অভিযানে বুমেরাং হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যত সরকার (নির্বাচিত ও অনির্বাচিত) এসেছে, সবাই পূর্ববর্তী সরকারের দুঃশাসন-দুর্নীতিকে হাতিয়ার করেছে। কিন্তু বিদায় নেওয়ার সময় তারা নিজেদের অন্যায়-দুর্নীতি ও দুঃশাসনে এতটাই ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে যে, জনগণ আগের কথা ভুলে গেছে। খুব দূরের উদাহরণ দেব না, ২০০১ ও ২০০৮ সালের কথা ভাবুন।
মহাজোট সরকার মাত্র দেড় বছর পার করেছে। সরকারের সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে চূড়ান্ত রায় দেওয়ার সময় আসেনি। তবে পিলখানা ট্র্যাজেডি সত্ত্বেও প্রথম বছরে যেভাবে সরকার পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছিল, তা প্রশংসার দাবি রাখে। দ্বিতীয় বছরে এসে মনে হচ্ছে, তারা তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। একের পর এক বিরোধীদের জন্য এত ফ্রন্ট খুলেছে যে সামাল দেওয়াই কঠিন হয়ে পড়েছে। জনগণ যুদ্ধাপরাধসহ সব অপরাধের বিচার চায়। বিচার না চাইলেও বিচার করা সরকার বা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। সে দায়িত্ব পালনে তাকে সব রাগ বা অনুরাগের ঊর্ধ্বে থাকতে হবে।
দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে পিপলস পারস্পেকটিভ বা জনগণের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টিও সরকারকে মাথায় রাখতে হয়। সামরিক শাসকেরা যত ভালো কাজই করুন না কেন, শেষ বিচারে বৈধতা পায় না। এমনকি ১/১১-পরবর্তী সামরিক বাহিনী-সমর্থিত জরুরি সরকারও বৈধতা লাভে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান সরকারের বড় শক্তি জনসমর্থন, পুলিশ বা র্যাব নয়। ইতিমধ্যে সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী ও নেতা আপন ‘কৃতিত্বে’ এতটাই মশগুল যে তাঁরা ভাবছেন, আগামী দু-চার মেয়াদে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকা কোনো ব্যাপারই নয়। বিএনপির নেতারাও একই মনোভাব পোষণ করতেন। জনগণই যে শেষ বিচারক, সে কথাটি ক্ষমতাসীনেরা প্রায়শ ভুলে যান। না হলে বিএনপি আমলের মতো মন্ত্রী ও সাংসদেরা সোনার চাবি উপহার নেওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু করতেন না।
সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সহকারী সচিব উইলিয়াম জে চার্লস সার্টিফিকেট দিয়েছেন, বাংলাদেশ নাকি ঠিকমতোই চলছে। প্রধানমন্ত্রীও মনে করেন, দেশ সঠিকভাবেই চলছে। সরকারি দলের নেতারা, মন্ত্রীরা সভা-সমাবেশে জোর হাততালি পাচ্ছেন। কিন্তু দেশ ঠিকভাবে চলছে না। চললে দেড় বছরের মাথায় হরতালের গজব আসবে কেন, সংসদে বিরোধী দলের আসনগুলো গাছ কেটে নেওয়ার পর শূন্য গুঁড়ির মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে কেন?
দেশ সঠিকভাবে চলা মানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় চলা নয়। দেশ সঠিকভাবে চলা মানে সরকার ও বিরোধী দলের চলা। দেশ সঠিকভাবে চলা মানে সংসদকে রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র করা, সব জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হওয়া। দেশ সঠিকভাবে চলা মানে অভিযুক্তকে ধরে নিয়ে রিমান্ডের নামে নির্যাতন চালানো নয়, অভিযুক্তেরও আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার নিশ্চিত করা। দেশ সঠিকভাবে চলা মানে সরকার ও বিরোধী দল, মন্ত্রী ও সাংসদের একযোগে কাজ করা। দেশ সঠিকভাবে চলা মানে সাংসদ ও উপজেলা চেয়ারম্যানের মুখোমুখি অবস্থান নয়, যাঁর যাঁর অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করা। দেশ সঠিকভাবে চলা মানে আইনকে নিজের হাতে তুলে নেওয়া নয়, সরকারি জমিজমা, নদী, খাল তথা সবকিছু দখল করা নয়।
দেশ কি সঠিকভাবে চলছে? এর সহজ উত্তর, চলছে না। এ জন্য কে বেশি বা কম দায়ী, সে বিতর্ক না করেও যে কথাটি বলতে চাই তা হলো, ‘এ আমার, এ তোমার পাপ’। আমাদের পাপের ভার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যাতে অনন্তকাল বইতে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে বলব মাননীয় সরকার ও সদাশয় বিরোধী দলকে। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments