ধর্ম-মিরাজের প্রকৃতি ও শিক্ষা by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
পৃথিবীর ইতিহাসে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা হলো মিরাজ; এর আভিধানিক অর্থ সিঁড়ি, সোপান, ঊর্ধ্বগমন, বাহন, আরোহণ, উত্থান প্রভৃতি। অন্য অর্থে ঊর্ধ্বলোকে আরোহণ বা মহামিলন। যা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বিশেষ মুজিযা এবং মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলার কুদরতের একটি মহা নিদর্শন।
সমগ্র নবীকুলের মধ্যে একমাত্র বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে এই অনন্য মর্যাদা প্রদান করা হয়। যাতে তিনি মহান সৃষ্টিকর্তার ঊর্ধ্বজগতের নিদর্শনাবলি ও তাঁর নিয়ামতরাজি স্বচক্ষে অবলোকন করে উম্মতকে তা সবিস্তারে বর্ণনা করতে পারেন। নবী করিম (সা.)-এর সফরের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘পবিত্র ও মহিমান্বিত তিনি, যিনি তাঁর বান্দা (মুহাম্মদ)-কে এক রজনীতে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় পরিভ্রমণ করিয়েছিলেন, যার চারপাশ আমি বরকতময় করেছিলাম তাকে আমার নিদর্শন পরিদর্শন করার জন্য, নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ১)
হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ৫০ বছর বয়সে রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে মিরাজের বিস্ময়কর ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। ওই রাত্রিতে তিনি পবিত্র কা’বা শরিফের চত্বরে (হাতীমে), কারও কারও মতে, উম্মে হানীর ঘরে শায়িত ও নিদ্রিত ছিলেন। এমন সময় জিব্রাঈল (আ.) সেখানে এসে তাঁকে ঘুম থেকে জাগালেন, ওজু করালেন, তাঁর সীনা চাক করলেন এবং বোরাকে চড়িয়ে মুহূর্তের মধ্যে বায়তুল মোকাদ্দাস পৌঁছলেন। সেখানে তাঁকে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করতে বললেন, যে নামাজে নবীজি সমস্ত নবী-রাসূলগণের ইমামতি করলেন। তারপর তিনি আবার বোরাকে চড়ে সপ্ত আকাশ পরিভ্রমণ করলেন এবং এ ভ্রমণে তাঁর সঙ্গে হজরত আদম (আ.), হজরত ঈসা (আ.), হজরত ইয়াহ্ইয়া (আ.), হজরত ইউসুফ (আ.), হজরত ইদ্রিস (আ.), হজরত হারুন (আ.), হজরত মূসা (আ.) ও হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও সালাম বিনিময় হলো। নবীদের সংবর্ধনা শেষে সেখান থেকে সপ্তম আকাশের ওপর ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ নামক স্থানে পৌঁছলেন, যেখানে ফেরেশতা জিব্রাঈল (আ.) থেমে গেলেন এবং নবীজি একাকী রফরফে চড়ে বায়তুল মামুরে গিয়ে উপনীত হলেন।
এরপর নবীজি একাই রফরফে চড়ে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হন। তিনি এখানে শুধু একটি পর্দার আড়ালে থেকে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করলেন। সেখানে তিনি প্রভুর সঙ্গে একান্ত আলাপে মিলিত হন। আশেক ও মাশুকের মধ্যে নানাবিধ কথোপকথন হলো। আল্লাহ তাআলা তাঁকে সমগ্র সৃষ্টিরহস্য বুঝিয়ে দিলেন এবং বেহেশত-দোজখ দেখিয়ে দিলেন, যাতে এ সম্বন্ধে কথা বলতে তাঁর মনে কোনো সন্দেহের উদ্রেক না হয়। সবশেষে তিনি আল্লাহর কাছ থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের বিধান নিয়ে আবার বোরাকে আরোহণ করে মুহূর্তের মধ্যে ধরণির বুকে ফিরে এলেন। সংক্ষেপে এই হলো মিরাজের ঘটনা। এ মর্মে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর সে (মুহাম্মদ) তাঁর নিকটবর্তী হলো, অতি নিকটবর্তী; ফলে তাঁদের মধ্যে দুই ধনুকের ব্যবধান রইল অথবা তারও কম। তখন আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি যা কিছু প্রকাশ করার ছিল, তা প্রকাশ করলেন। ...নিশ্চয়ই সে তাকে (জিব্রাঈলকে) আরেকবার দেখেছিল সিদরাতুল মুনতাহার কাছে, যার সন্নিকটে রয়েছে জান্নাতুল মাওয়া। যখন বৃক্ষটি যদ্বারা আচ্ছাদিত হওয়ার তদ্বারা আচ্ছাদিত ছিল। এ সময় তার দৃষ্টিবিভ্রম হয়নি এবং লক্ষ্যচ্যুতও হয়নি। নিশ্চয়ই সে তার প্রতিপালকের মহা নিদর্শনাবলি স্বচক্ষে অবলোকন করেছিল।’ (সূরা আন-নাজম, আয়াত: ৮-১৮)
শবে মিরাজ বা লাইলাতুল মিরাজের প্রকৃতি এতই অস্বাভাবিক যে, সাধারণ মানুষের এটা বুঝে আসে না বা জ্ঞানে ধরে না। কিন্তু এ ঘটনা ঘটেছে এবং আরও অনেক অলৌকিক ঘটনার প্রমাণ পবিত্র কোরআন ও হাদিসে রয়েছে। যেমন, হজরত মূসা (আ.)-এর দলবলসহ হেঁটে নীলনদ পার হওয়া, হজরত ইব্রাহীম (আ.)-এর নমরুদের বিশাল অগ্নিকুণ্ড থেকে রক্ষা পাওয়া, হজরত ঈসা (আ)-এর আকাশে আরোহণ এবং আবারও দুনিয়াতে আগমন হবে, বিবি মরিয়মের স্বামী ব্যতীত পুত্রসন্তান লাভ এবং হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মিরাজ ভ্রমণ—এ সবই অস্বাভাবিক ঘটনা। কেউ কেউ মিরাজকে স্বপ্ন বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু এটা স্বপ্ন হলে নবীজি সোজাসুজি বলে দিতেন, গত রাতে তিনি এ ধরনের একটি স্বপ্ন দেখেছেন। সে ক্ষেত্রে ১৪০০ বছর যাবৎ এ নিয়ে এত তর্কবিতর্কের কোনো প্রয়োজন হতো না। আল্লাহ তাআলা এক বিশেষ উদ্দেশ্যে অর্থাৎ সৃষ্টিরহস্য ও বেহেশত-দোজখ সামনা-সামনি দেখিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁর প্রিয় হাবিবকে নিজের সান্নিধ্যে তুলে নিয়েছিলেন, যাতে তিনি প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে ইসলাম প্রচার করতে পারেন। মহান সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় এটা সংঘটিত হয়েছিল। মানুষ যদি তার জ্ঞান-বুদ্ধি বলে মহাশূন্যের এত বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে পারে, তাহলে সর্বময় ক্ষমতার আধার আল্লাহর পক্ষে তাঁর বন্ধুকে মিরাজে নেওয়া নিশ্চয়ই সম্ভব। তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের আলোকিত যুগে বসবাস করে কেউ মহানবী (সা.)-এর এ বিস্ময়কর ভ্রমণকে অস্বীকার করতে পারে না। এ মিরাজের সূত্র ধরে মানুষ মহাকাশ গবেষণায় বেশ সাফল্য পেয়েছে।
শবে মিরাজের উপহার সম্পর্কে বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ আছে যে, মিরাজের রাতে নবী করিম (সা.) ও তাঁর উম্মতের জন্য কয়েকটি জিনিস দান করা হয়—প্রথমত, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ; যা প্রথমে ৫০ ওয়াক্ত ছিল। দ্বিতীয়ত, তাঁর উম্মতের যেসব ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কারও শরিক করবে না, আল্লাহ তার ধ্বংসাত্মক পাপগুলো ক্ষমা করে দেবেন। তৃতীয়ত, সূরা আল-বাকারার শেষ অংশ। চতুর্থত, সূরা বনি ইসরাইলের ১৪ দফা নির্দেশ; যথা—১. একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করা ও তাঁর সঙ্গে কারও শরিক না করা, ২. পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা, ৩. আত্মীয়স্বজন, মিসকিন ও মুসাফিরের হক মেনে চলা, ৪. অপচয় না করা, ৫. যারা আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশী তারা যেন কোনো ফকির ও প্রার্থীকে বঞ্চিত না করে, ৬. সব সময় কিছু দান করা; হাতকে গুটিয়ে না রাখা, ৭. অন্যায়ভাবে কোনো মানুষকে হত্যা না করা, ৮. দারিদ্র্যের অজুহাতে যেন সন্তান হত্যা না করা হয়, ৯. ব্যাভিচারের নিকটবর্তীও না হওয়া, ১০. এতিমের সম্পদের ধারেকাছেও না যাওয়া, ১১. যে বিষয়ে জ্ঞান নেই তা অনুসন্ধান না করা, ১২. মেপে দেওয়ার সময় সঠিক ওজন দেওয়া, ১৩. প্রতিশ্রুতি পালন করা, ১৪. পৃথিবীতে দম্ভ ভরে চলাফেলা না করা। এসব দিকনির্দেশনা মেনে চললে ইহকালীন ও পারলৌকিক জীবনে অবশ্যই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যাবে।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মিরাজের প্রকৃতি ও অনুপম শিক্ষা বিভিন্ন দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্ববহ ও তাৎপর্যপূর্ণ। শবে মিরাজের মাধ্যমে ঊর্ধ্বলোকের উচ্চতম স্থানে মহান স্রষ্টার চরম, নিবিড় সান্নিধ্যে মহাবিশ্বে পরিভ্রমণের মাধ্যমে সৃষ্টিরহস্য উদ্ঘাটনের পরম সৌভাগ্য রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে প্রদান করে মানবমর্যাদার শ্রেষ্ঠত্ব বিধান করা হয়। ইসলাম ও মুসলমানদের ওপর উৎপীড়নের কাল সমাপ্তির দ্বারপ্রান্তে আদর্শ সমাজ ও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের বুনিয়াদি মূলনীতি মিরাজের মাধ্যমে মানবজাতির জন্য উপহার হিসেবে পাওয়া যায়, যা পবিত্র কোরআনের সূরা বনি ইসরাইলে মিরাজসংক্রান্ত আলোচনায় বিধৃত হয়েছে, যাকে ইসলামি মূলনীতির ১৪ দফা নামে অভিহিত করা যায়। নবী করিম (সা.) মিরাজ থেকে ফিরে এসে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজের আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে আদর্শ কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে জগৎবাসীকে বিশ্বশান্তির পথ প্রদর্শন করে সফল হয়েছিলেন। তাই আজকের অশান্ত পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মিরাজের ১৪ দফা ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নের শিক্ষা গ্রহণ করা দরকার। যদি মুসলমানদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুমহান জীবনাদর্শ ও মিরাজের শিক্ষামূলক অধ্যাদেশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে—একটি আদর্শ ও কল্যাণমুখী জাতি গঠনের রূপরেখা অনুযায়ী—নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নমুখী কাজ করা যায়, তাহলেই বিশ্ব মানবতার সর্বাঙ্গীণ শান্তি ও মুক্তি সম্ভব হবে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমী, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়; পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
dr.munimkhan@yahoo.com
হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ৫০ বছর বয়সে রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে মিরাজের বিস্ময়কর ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। ওই রাত্রিতে তিনি পবিত্র কা’বা শরিফের চত্বরে (হাতীমে), কারও কারও মতে, উম্মে হানীর ঘরে শায়িত ও নিদ্রিত ছিলেন। এমন সময় জিব্রাঈল (আ.) সেখানে এসে তাঁকে ঘুম থেকে জাগালেন, ওজু করালেন, তাঁর সীনা চাক করলেন এবং বোরাকে চড়িয়ে মুহূর্তের মধ্যে বায়তুল মোকাদ্দাস পৌঁছলেন। সেখানে তাঁকে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করতে বললেন, যে নামাজে নবীজি সমস্ত নবী-রাসূলগণের ইমামতি করলেন। তারপর তিনি আবার বোরাকে চড়ে সপ্ত আকাশ পরিভ্রমণ করলেন এবং এ ভ্রমণে তাঁর সঙ্গে হজরত আদম (আ.), হজরত ঈসা (আ.), হজরত ইয়াহ্ইয়া (আ.), হজরত ইউসুফ (আ.), হজরত ইদ্রিস (আ.), হজরত হারুন (আ.), হজরত মূসা (আ.) ও হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও সালাম বিনিময় হলো। নবীদের সংবর্ধনা শেষে সেখান থেকে সপ্তম আকাশের ওপর ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ নামক স্থানে পৌঁছলেন, যেখানে ফেরেশতা জিব্রাঈল (আ.) থেমে গেলেন এবং নবীজি একাকী রফরফে চড়ে বায়তুল মামুরে গিয়ে উপনীত হলেন।
এরপর নবীজি একাই রফরফে চড়ে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হন। তিনি এখানে শুধু একটি পর্দার আড়ালে থেকে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করলেন। সেখানে তিনি প্রভুর সঙ্গে একান্ত আলাপে মিলিত হন। আশেক ও মাশুকের মধ্যে নানাবিধ কথোপকথন হলো। আল্লাহ তাআলা তাঁকে সমগ্র সৃষ্টিরহস্য বুঝিয়ে দিলেন এবং বেহেশত-দোজখ দেখিয়ে দিলেন, যাতে এ সম্বন্ধে কথা বলতে তাঁর মনে কোনো সন্দেহের উদ্রেক না হয়। সবশেষে তিনি আল্লাহর কাছ থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের বিধান নিয়ে আবার বোরাকে আরোহণ করে মুহূর্তের মধ্যে ধরণির বুকে ফিরে এলেন। সংক্ষেপে এই হলো মিরাজের ঘটনা। এ মর্মে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর সে (মুহাম্মদ) তাঁর নিকটবর্তী হলো, অতি নিকটবর্তী; ফলে তাঁদের মধ্যে দুই ধনুকের ব্যবধান রইল অথবা তারও কম। তখন আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি যা কিছু প্রকাশ করার ছিল, তা প্রকাশ করলেন। ...নিশ্চয়ই সে তাকে (জিব্রাঈলকে) আরেকবার দেখেছিল সিদরাতুল মুনতাহার কাছে, যার সন্নিকটে রয়েছে জান্নাতুল মাওয়া। যখন বৃক্ষটি যদ্বারা আচ্ছাদিত হওয়ার তদ্বারা আচ্ছাদিত ছিল। এ সময় তার দৃষ্টিবিভ্রম হয়নি এবং লক্ষ্যচ্যুতও হয়নি। নিশ্চয়ই সে তার প্রতিপালকের মহা নিদর্শনাবলি স্বচক্ষে অবলোকন করেছিল।’ (সূরা আন-নাজম, আয়াত: ৮-১৮)
শবে মিরাজ বা লাইলাতুল মিরাজের প্রকৃতি এতই অস্বাভাবিক যে, সাধারণ মানুষের এটা বুঝে আসে না বা জ্ঞানে ধরে না। কিন্তু এ ঘটনা ঘটেছে এবং আরও অনেক অলৌকিক ঘটনার প্রমাণ পবিত্র কোরআন ও হাদিসে রয়েছে। যেমন, হজরত মূসা (আ.)-এর দলবলসহ হেঁটে নীলনদ পার হওয়া, হজরত ইব্রাহীম (আ.)-এর নমরুদের বিশাল অগ্নিকুণ্ড থেকে রক্ষা পাওয়া, হজরত ঈসা (আ)-এর আকাশে আরোহণ এবং আবারও দুনিয়াতে আগমন হবে, বিবি মরিয়মের স্বামী ব্যতীত পুত্রসন্তান লাভ এবং হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মিরাজ ভ্রমণ—এ সবই অস্বাভাবিক ঘটনা। কেউ কেউ মিরাজকে স্বপ্ন বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু এটা স্বপ্ন হলে নবীজি সোজাসুজি বলে দিতেন, গত রাতে তিনি এ ধরনের একটি স্বপ্ন দেখেছেন। সে ক্ষেত্রে ১৪০০ বছর যাবৎ এ নিয়ে এত তর্কবিতর্কের কোনো প্রয়োজন হতো না। আল্লাহ তাআলা এক বিশেষ উদ্দেশ্যে অর্থাৎ সৃষ্টিরহস্য ও বেহেশত-দোজখ সামনা-সামনি দেখিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁর প্রিয় হাবিবকে নিজের সান্নিধ্যে তুলে নিয়েছিলেন, যাতে তিনি প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে ইসলাম প্রচার করতে পারেন। মহান সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় এটা সংঘটিত হয়েছিল। মানুষ যদি তার জ্ঞান-বুদ্ধি বলে মহাশূন্যের এত বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে পারে, তাহলে সর্বময় ক্ষমতার আধার আল্লাহর পক্ষে তাঁর বন্ধুকে মিরাজে নেওয়া নিশ্চয়ই সম্ভব। তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের আলোকিত যুগে বসবাস করে কেউ মহানবী (সা.)-এর এ বিস্ময়কর ভ্রমণকে অস্বীকার করতে পারে না। এ মিরাজের সূত্র ধরে মানুষ মহাকাশ গবেষণায় বেশ সাফল্য পেয়েছে।
শবে মিরাজের উপহার সম্পর্কে বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ আছে যে, মিরাজের রাতে নবী করিম (সা.) ও তাঁর উম্মতের জন্য কয়েকটি জিনিস দান করা হয়—প্রথমত, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ; যা প্রথমে ৫০ ওয়াক্ত ছিল। দ্বিতীয়ত, তাঁর উম্মতের যেসব ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কারও শরিক করবে না, আল্লাহ তার ধ্বংসাত্মক পাপগুলো ক্ষমা করে দেবেন। তৃতীয়ত, সূরা আল-বাকারার শেষ অংশ। চতুর্থত, সূরা বনি ইসরাইলের ১৪ দফা নির্দেশ; যথা—১. একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করা ও তাঁর সঙ্গে কারও শরিক না করা, ২. পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা, ৩. আত্মীয়স্বজন, মিসকিন ও মুসাফিরের হক মেনে চলা, ৪. অপচয় না করা, ৫. যারা আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশী তারা যেন কোনো ফকির ও প্রার্থীকে বঞ্চিত না করে, ৬. সব সময় কিছু দান করা; হাতকে গুটিয়ে না রাখা, ৭. অন্যায়ভাবে কোনো মানুষকে হত্যা না করা, ৮. দারিদ্র্যের অজুহাতে যেন সন্তান হত্যা না করা হয়, ৯. ব্যাভিচারের নিকটবর্তীও না হওয়া, ১০. এতিমের সম্পদের ধারেকাছেও না যাওয়া, ১১. যে বিষয়ে জ্ঞান নেই তা অনুসন্ধান না করা, ১২. মেপে দেওয়ার সময় সঠিক ওজন দেওয়া, ১৩. প্রতিশ্রুতি পালন করা, ১৪. পৃথিবীতে দম্ভ ভরে চলাফেলা না করা। এসব দিকনির্দেশনা মেনে চললে ইহকালীন ও পারলৌকিক জীবনে অবশ্যই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যাবে।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মিরাজের প্রকৃতি ও অনুপম শিক্ষা বিভিন্ন দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্ববহ ও তাৎপর্যপূর্ণ। শবে মিরাজের মাধ্যমে ঊর্ধ্বলোকের উচ্চতম স্থানে মহান স্রষ্টার চরম, নিবিড় সান্নিধ্যে মহাবিশ্বে পরিভ্রমণের মাধ্যমে সৃষ্টিরহস্য উদ্ঘাটনের পরম সৌভাগ্য রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে প্রদান করে মানবমর্যাদার শ্রেষ্ঠত্ব বিধান করা হয়। ইসলাম ও মুসলমানদের ওপর উৎপীড়নের কাল সমাপ্তির দ্বারপ্রান্তে আদর্শ সমাজ ও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের বুনিয়াদি মূলনীতি মিরাজের মাধ্যমে মানবজাতির জন্য উপহার হিসেবে পাওয়া যায়, যা পবিত্র কোরআনের সূরা বনি ইসরাইলে মিরাজসংক্রান্ত আলোচনায় বিধৃত হয়েছে, যাকে ইসলামি মূলনীতির ১৪ দফা নামে অভিহিত করা যায়। নবী করিম (সা.) মিরাজ থেকে ফিরে এসে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজের আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে আদর্শ কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে জগৎবাসীকে বিশ্বশান্তির পথ প্রদর্শন করে সফল হয়েছিলেন। তাই আজকের অশান্ত পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মিরাজের ১৪ দফা ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নের শিক্ষা গ্রহণ করা দরকার। যদি মুসলমানদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুমহান জীবনাদর্শ ও মিরাজের শিক্ষামূলক অধ্যাদেশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে—একটি আদর্শ ও কল্যাণমুখী জাতি গঠনের রূপরেখা অনুযায়ী—নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নমুখী কাজ করা যায়, তাহলেই বিশ্ব মানবতার সর্বাঙ্গীণ শান্তি ও মুক্তি সম্ভব হবে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমী, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়; পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
dr.munimkhan@yahoo.com
No comments