শিক্ষাঙ্গন-এ কোন জাহাঙ্গীরনগর? by ইসরাত জাহান
জাহাঙ্গীরনগরে এসব কী হচ্ছে? সকালে পত্রিকা খুলেই মনে হলো, এটা কি কোনো স্বাধীন, সভ্য দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ? বিগত বিএনপি সরকারের অরাজকতায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া দেশবাসী অনেক আশা করে ভোট দিয়েছিল আওয়ামী লীগকে।
ভোটের আগে যেসব আশ্বাস মানুষকে দিয়েছিল তার কিছুই তারা এ পর্যন্ত পূরণ করতে পারেনি। এটা অবশ্য একটু বুঝদার মানুষ মাত্রই জানেন, বিএনপি বা আওয়ামী লীগ যা-ই বলেন, সবই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। তার পরও আশাই তো এ দেশের হতভাগা মানুষের বাঁচার একমাত্র ভেলা। তাই বারবারই ওই ভেলায় চড়ে তারা। আর প্রতিবারই নতুন সরকার তাদের স্বেচ্ছাচারের জোয়ারে ভরাডুবি ঘটায়।
দেশবাসী হয়তো সরকারগুলোর নৈরাজ্যে এরই মধ্যে পাথর হয়ে গেছে। তা না হলে কীভাবে এসব নৈরাজ্য সয়ে তারা বেঁচে আছে? কবেই তো এসব সরকারকে ছুড়ে ফেলার কথা তাদের। তার পরও চলছে দিন। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ যে বিভীষিকার জন্ম দিয়েছে, তা পাথর বুকে বেঁধে রাখা দেশবাসীর বুকেও ধাক্কা দিয়েছে নিঃসন্দেহে।
বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে ৩৫ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত। ভিসি লাঞ্ছিত। একজন প্রক্টরও আহত। সংঘর্ষে মারামারি, লাঠালাঠি, গোলাগুলি, কোপাকুপির সঙ্গে এবারের নৃশংসতায় আরেকটু নতুনত্ব যোগ করেছে ছাত্রলীগ। আত্মরক্ষার জন্য ছাদে আশ্রয় নেওয়া প্রতিপক্ষকে ধরে ধরে চারতলার ওপর থেকে ছুড়ে ফেলেছে নিচে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে পাওয়া ছবিতে দেখা গেল, যেখানে দেহগুলো নিথর পড়ে আছে, তার পাশেই কাঁটাতারের বেড়া। কোনো ছবিতে আবার দেখা গেল, ওপর থেকে ছুড়ে ফেলেই ক্ষান্ত হয়নি রোষ, ওই নিথর দেহগুলোকেই আরও পেটানো হচ্ছে প্রতিশোধের নেশায়। হতাহতের সংখ্যা এত বেশি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাম্বুলেন্সে জায়গা হয়নি তাঁদের। বাসে করে কোনোমতে গুরুতর আহত ছাত্রলীগের এসব কর্মীকে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে নেওয়া হচ্ছে। আল-বেরুনী হলের ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে এ ঘটনা।
জাহাঙ্গীরনগরে ক্ষমতা দখল নিয়ে ছাত্রলীগের এই কামড়াকামড়ি নতুন কিছু নয়। এবারও আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরপরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের পর সেখানকার কমিটি স্থগিত করা হয়। কিন্তু বছরখানেক পরই গত ১৯ মে এই নতুন কমিটি গঠন করা হয়। দেড় মাসের মাথায় ক্ষমতা দখলের লড়াইটা হলো কমিটির সভাপতি রাশেদুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক নির্ঝর আলম গ্রুপের মধ্যে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সারা দেশেই ছাত্রলীগ যখন বেপরোয়া এবং খোদ শেখ হাসিনাও নাকি দলের এ অঙ্গসংগঠনটির ওপর নাখোশ, তখন কার স্বার্থে রক্তক্ষয়ী একটা সংঘর্ষের এক বছরের মধ্যে আবার এ রকম একটি পরিস্থিতি তৈরির জন্য নতুন কমিটি করা হলো? ছাত্রলীগের কমিটি স্থগিত করার পর কি বিশ্ববিদ্যালয়টি অচল হয়ে পড়েছিল? না এখানকার সাধারণ শিক্ষার্থীরা শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কোনো কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন?
প্রকৃত সত্য হচ্ছে, জাহাঙ্গীরনগরে ক্ষমতা মানেই হচ্ছে টাকার ঝনঝনানি। এখানে যে দল ক্ষমতায় থাকে বিশ্ববিদ্যালয়টির যাবতীয় ঠিকাদারি তো বটেই, আশপাশের সব ঠিকাদারির নিয়ন্ত্রণও থাকে তাদের হাতে। ঠিকাদারি ছাড়াও সংলগ্ন এলাকায় যত অর্থনৈতিক কার্যক্রম চলে তা এক বা দুই নম্বরি যা-ই হোক তার বড় একটি ভাগ পায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতায় থাকা ছাত্রসংগঠন। নীতি-নৈতিকতার চর্চাহীন আওয়ামী লীগ বা বিএনপির ছাত্রসংগঠনগুলোর এ অর্থলিপ্সাই সম্বল!
বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর কার্যক্রম কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। অতীতে দেখা গেছে, বাম সংগঠনগুলো যখন শক্তিশালী ভূমিকায় থাকে তখনো দেশের মূল রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির ছাত্রসংগঠন এখানকার ক্ষমতায় থাকে। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে বাম সংগঠনগুলো সোচ্চার থাকায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের নীরব সমর্থন থাকে বামদের প্রতি। ফলে সাধারণের স্বার্থহানিকর কোনো কর্মকাণ্ডে জড়াতে ক্ষমতাসীনদের একটু হলেও ভাবতে হয়। অতীত অভিজ্ঞতা এও বলে, ক্ষমতাসীনেরা বেপরোয়া হয়ে উঠলে বামদের সঙ্গে মিলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যাম্পাসছাড়া পর্যন্ত করে ছাড়ে। ক্ষমতাসীনেরা হাজারও অস্ত্রে সজ্জিত হয়েও তখন সংগঠিত সাধারণ শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড়াতে পারে না।
এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে গেছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশব্যাপী ছাত্রলীগের নির্লজ্জ কামড়াকামড়ি থামাতে খোদ প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত ব্যর্থ। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তো কোন ছাড়। এসব বেপরোয়া দখলদারি থেকে জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার পরিবেশ রক্ষায়, সবুজ ক্যাম্পাসটিকে রক্তে লাল নয়, তারুণ্যে সবুজই রাখতে দরকার নীতি-আদর্শের চর্চাকারী ছাত্রসংগঠনের বলিষ্ঠ কার্যক্রম। আর তাদের পাশে প্রয়োজন অধিকার-সচেতন, সংগ্রামী সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনোবল।
ইসরাত জাহান: প্রাক্তন শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
দেশবাসী হয়তো সরকারগুলোর নৈরাজ্যে এরই মধ্যে পাথর হয়ে গেছে। তা না হলে কীভাবে এসব নৈরাজ্য সয়ে তারা বেঁচে আছে? কবেই তো এসব সরকারকে ছুড়ে ফেলার কথা তাদের। তার পরও চলছে দিন। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ যে বিভীষিকার জন্ম দিয়েছে, তা পাথর বুকে বেঁধে রাখা দেশবাসীর বুকেও ধাক্কা দিয়েছে নিঃসন্দেহে।
বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে ৩৫ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত। ভিসি লাঞ্ছিত। একজন প্রক্টরও আহত। সংঘর্ষে মারামারি, লাঠালাঠি, গোলাগুলি, কোপাকুপির সঙ্গে এবারের নৃশংসতায় আরেকটু নতুনত্ব যোগ করেছে ছাত্রলীগ। আত্মরক্ষার জন্য ছাদে আশ্রয় নেওয়া প্রতিপক্ষকে ধরে ধরে চারতলার ওপর থেকে ছুড়ে ফেলেছে নিচে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে পাওয়া ছবিতে দেখা গেল, যেখানে দেহগুলো নিথর পড়ে আছে, তার পাশেই কাঁটাতারের বেড়া। কোনো ছবিতে আবার দেখা গেল, ওপর থেকে ছুড়ে ফেলেই ক্ষান্ত হয়নি রোষ, ওই নিথর দেহগুলোকেই আরও পেটানো হচ্ছে প্রতিশোধের নেশায়। হতাহতের সংখ্যা এত বেশি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাম্বুলেন্সে জায়গা হয়নি তাঁদের। বাসে করে কোনোমতে গুরুতর আহত ছাত্রলীগের এসব কর্মীকে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে নেওয়া হচ্ছে। আল-বেরুনী হলের ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে এ ঘটনা।
জাহাঙ্গীরনগরে ক্ষমতা দখল নিয়ে ছাত্রলীগের এই কামড়াকামড়ি নতুন কিছু নয়। এবারও আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরপরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের পর সেখানকার কমিটি স্থগিত করা হয়। কিন্তু বছরখানেক পরই গত ১৯ মে এই নতুন কমিটি গঠন করা হয়। দেড় মাসের মাথায় ক্ষমতা দখলের লড়াইটা হলো কমিটির সভাপতি রাশেদুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক নির্ঝর আলম গ্রুপের মধ্যে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সারা দেশেই ছাত্রলীগ যখন বেপরোয়া এবং খোদ শেখ হাসিনাও নাকি দলের এ অঙ্গসংগঠনটির ওপর নাখোশ, তখন কার স্বার্থে রক্তক্ষয়ী একটা সংঘর্ষের এক বছরের মধ্যে আবার এ রকম একটি পরিস্থিতি তৈরির জন্য নতুন কমিটি করা হলো? ছাত্রলীগের কমিটি স্থগিত করার পর কি বিশ্ববিদ্যালয়টি অচল হয়ে পড়েছিল? না এখানকার সাধারণ শিক্ষার্থীরা শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কোনো কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন?
প্রকৃত সত্য হচ্ছে, জাহাঙ্গীরনগরে ক্ষমতা মানেই হচ্ছে টাকার ঝনঝনানি। এখানে যে দল ক্ষমতায় থাকে বিশ্ববিদ্যালয়টির যাবতীয় ঠিকাদারি তো বটেই, আশপাশের সব ঠিকাদারির নিয়ন্ত্রণও থাকে তাদের হাতে। ঠিকাদারি ছাড়াও সংলগ্ন এলাকায় যত অর্থনৈতিক কার্যক্রম চলে তা এক বা দুই নম্বরি যা-ই হোক তার বড় একটি ভাগ পায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতায় থাকা ছাত্রসংগঠন। নীতি-নৈতিকতার চর্চাহীন আওয়ামী লীগ বা বিএনপির ছাত্রসংগঠনগুলোর এ অর্থলিপ্সাই সম্বল!
বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর কার্যক্রম কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। অতীতে দেখা গেছে, বাম সংগঠনগুলো যখন শক্তিশালী ভূমিকায় থাকে তখনো দেশের মূল রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির ছাত্রসংগঠন এখানকার ক্ষমতায় থাকে। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে বাম সংগঠনগুলো সোচ্চার থাকায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের নীরব সমর্থন থাকে বামদের প্রতি। ফলে সাধারণের স্বার্থহানিকর কোনো কর্মকাণ্ডে জড়াতে ক্ষমতাসীনদের একটু হলেও ভাবতে হয়। অতীত অভিজ্ঞতা এও বলে, ক্ষমতাসীনেরা বেপরোয়া হয়ে উঠলে বামদের সঙ্গে মিলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যাম্পাসছাড়া পর্যন্ত করে ছাড়ে। ক্ষমতাসীনেরা হাজারও অস্ত্রে সজ্জিত হয়েও তখন সংগঠিত সাধারণ শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড়াতে পারে না।
এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে গেছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশব্যাপী ছাত্রলীগের নির্লজ্জ কামড়াকামড়ি থামাতে খোদ প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত ব্যর্থ। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তো কোন ছাড়। এসব বেপরোয়া দখলদারি থেকে জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার পরিবেশ রক্ষায়, সবুজ ক্যাম্পাসটিকে রক্তে লাল নয়, তারুণ্যে সবুজই রাখতে দরকার নীতি-আদর্শের চর্চাকারী ছাত্রসংগঠনের বলিষ্ঠ কার্যক্রম। আর তাদের পাশে প্রয়োজন অধিকার-সচেতন, সংগ্রামী সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনোবল।
ইসরাত জাহান: প্রাক্তন শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments