কালের পুরাণ-মন্ত্রীর সুবচন, নেতার হুঁশিয়ারি ও সাংসদের লম্বা হাত by সোহরাব হাসান
সব সরকারেই কিছু কাজের মন্ত্রী থাকেন, কিছু কথার মন্ত্রী। মন্ত্রণালয়ের কাজকর্ম কীভাবে চলছে সে সম্পর্কে তারা খোঁজখবর না রাখলেও সুযোগ পেলেই গণমাধ্যম তথা সাংবাদিকদের একহাত নিতে ছাড়েন না। বিএনপি আমলে কাজটি করতেন ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, তিনি ছিলেন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে।
তাঁর সময়ে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি না হলেও মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির মহা উন্নতি হয়েছিল। মন্ত্রী মহোদয় পাঁচ বছর ধরে জনগণকে উড়াল ট্রেন, ঘুরাল ট্রেন, পাতাল ট্রেনের স্বপ্ন দেখালেও কাজের কাজ কিছুই করেননি। করেননি বলাও ঠিক হবে না। মন্ত্রীর ক্ষমতাবলে তিনি স্ত্রীর সংস্থাকে রেলওয়ের জমি লিজের ব্যবস্থা করেছিলেন, ফজলুল হক হলের পূর্ব সড়কের পাশে সেই সাইনবোর্ডটি এখনো ঝুলছে। অণুবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে অন্যান্য বিএনপি নেতার দুর্নীতি অনুসন্ধান করলেও এ ব্যাপারে সরকার নীরব। এর পেছনে কি কোনো গূঢ় রহস্য আছে?
বর্তমান সরকারে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। বাংলাদেশে কিছু রাজনৈতিক পরিবার আছে, যারা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে থাকে, যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন সেই পরিবারের কেউ না কেউ থাকবেন। বিএনপি আমলে যে গুটি কয়েক বিরোধী সাংসদ সরকারের কাছ থেকে বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কাদের সিদ্দিকীর নাম সবার মুখে মুখে। তাঁর ঠিকাদারিতে করা অধিকাংশ সেতু অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এ নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হলেও কাজ হয়নি। ২০০১ সালে টাঙ্গাইলে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বিপর্যয়ে কাদের সিদ্দিকীর অবদান কম নয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বঙ্গবীর সুবিধা করতে পারেননি। কিন্তু তাঁর ভাই লতিফ সিদ্দিকী বিএনপি প্রার্থীকে হারিয়ে সাংসদ ও মন্ত্রী হয়েছেন। গত ১৮ মাসে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের সাফল্য প্রায় শূন্যের কোঠায়। পাটের জীবনরহস্য উদ্ঘাটনেও তাঁর কোনো ভূমিকা ছিল বলে আমাদের জানা নেই। ভূমিকা রেখেছেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। প্রথম আলোয় খবর দেখে তিনি বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমকে দেশে ফিরিয়ে এনে গবেষণাকাজের তহবিল জোগাড় করে দিয়েছেন। পাটমন্ত্রী পাটের গবেষণায় অবদান রাখতে না পেরে সম্ভবত ‘সাংবাদিক গবেষণা’য় অবদান রাখছেন। কী চমৎকার!
সম্প্রতি আওয়ামী সাংস্কৃতিক ফোরাম আয়োজিত এক সেমিনারে তিনি ছাত্রলীগের মারামারিকে সমর্থনই করেননি, বিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলোকে শায়েস্তা করতে প্ররোচনাও দেন এবং বলেন, ‘নিজেরা নিজেরা মারামারি করো, ওদের দুই-চারটার সঙ্গে মারামারি করো না কেন?’...ছাত্রলীগের ছেলেরা কি এই খুনখারাবি করেছে? এরা (ছাত্রলীগ) কি সবাই খারাপ? ছাত্রলীগের সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন, ‘ওই ছেলেদের আমরা বাদ দেব কেন? ছাত্রলীগ বন্ধ করব কেন? ছাত্রলীগ বন্ধ করে দেব, আর মাঠ দখল করে নেবেন?’ এরপর সাংবাদিকদের কঠোর সমালোচনা করে মন্ত্রী বলেন, ‘...পত্রিকায় নিউজ আসবে, সেই ভয়ে আমি অস্থির হয়ে যাব না। পত্রিকা-টেলিভিশনওয়ালারা শেখ হাসিনাকে জেতায়নি।’(প্রথম আলো, ১৭ জুলাই ২০১০)
এক-এগারো-পরবর্তী সময়ে সাংবাদিকদের ভূমিকার সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘ঘটনার নায়কদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সাংবাদিকেরা ওয়ান-ইলেভেনকে আশীর্বাদ জানিয়েছিল। ওই সময় টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যানরা টাকা না দিলে আমাদের খবর ও ছবি দেখাত না। টিভি ও পত্রিকার মালিকেরা আসলে সুবিধাভোগী।’(প্রথম আলো, ১৭ জুলাই ২০১০)
মন্ত্রীর দাবি সত্য হলে, উৎকোচ ছাড়া সাংবাদিকেরা রাজনীতিকদের (তিনি শুধু নিজের কথা বলেননি, বলেছেন বহুবচনে) খবর প্রচার করতেন না, টিভিতে ছবি দেখাতেন না। কারা টাকা খেয়ে খবর প্রচার করতেন, ছবি প্রকাশ করতেন, সে কথাটি প্রকাশ করলে তিনি ভালো করতেন। গয়রহ অভিযোগ করলে সে অভিযোগের মূল্য থাকে না। সে সময়ে লতিফ সিদ্দিকীসহ যাঁদের খবর প্রচারিত হয়েছে সবাই কি টাকা দিয়ে তা করিয়েছেন? সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের ঢালাও অভিযোগ এনে তিনি কেবল সাংবাদিকদেরই ছোট করেননি, হেয় করেছেন রাজনীতিকদেরও। উৎকোচদাতা ও গ্রহীতা—দুজনই সমান অপরাধী।
এ ছাড়া পাটমন্ত্রী একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারেরও বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি যুদ্ধাপরাধ স্বীকারই করি না। এ ক্ষেত্রে আমি মুজাহিদদের (জামায়াত নেতা) সঙ্গে একমত পোষণ করি। তাঁরা কেউ যুদ্ধাপরাধী নন। তাঁদের বিচার করতে জেনেভা কনভেনশন কেন?’ অর্থাৎ পাটমন্ত্রী প্রচলিত ফৌজদারি আইনেই তাঁদের বিচার চান। এ বক্তব্যের মাধ্যমে মন্ত্রী মহোদয় দুটি সিদ্ধান্তে এলেন: ১. জামায়াত নেতারা যুদ্ধাপরাধ করেননি, ২. যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সরকারের উদ্যোগের সরাসরি বিরোধিতা করলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তাঁকে অনুরোধ করব ষড়যন্ত্র খুঁজতে বেশি দূরে যেতে হবে না, মন্ত্রিসভাতেই তো বিচারের বিরোধী লোক আছেন।
পরদিন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের একই স্থানে অপর এক সেমিনারে মন্ত্রীর বক্তব্যের বিরোধিতা করে বলেছেন, ‘এক-এগারোর পর রাজনীতির অন্ধকার সময়ে আশার আলো সাংবাদিকেরাই জ্বালিয়েছিলেন, রাজনীতিকেরা নন। তাই কথা বলার ক্ষেত্রে রাজনীতিকদের পরিমিতিবোধ থাকা উচিত।’ (প্রথম আলো, ১৮ জুলাই, ২০১০) তিনি আরও বলেছেন, ‘চাঁদাবাজি আমরা কে কতটা করি, তা ব্যবসায়ীরা ভালো জানেন। তাই কাচের ঘরে ঢিল ছুড়ে লাভ নেই। ১৮ মাসে যাঁরা যোগ্যতা-দক্ষতা দেখাতে পারেননি, তাঁরা ১৮ বছরেও পারবেন না।’
মন্ত্রী হেদায়েত করেছেন সাংবাদিকদের। আর আওয়ামী লীগ নেতা নসিহত করেছেন মন্ত্রীদের। এসব কথা সাংবাদিক বা বিরোধী দলের কেউ করলে হয়তো রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করত। ভাগ্যিস, ঝগড়াটা মন্ত্রী বনাম নেতার মধ্যে হয়েছে।
লতিফ সিদ্দিকী আজ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেপথ্য শক্তি অর্থাৎ সেনাবাহিনীর দালালির অভিযোগ এনেছেন। স্বৈরাচারী এরশাদ যে সংসদে তাঁর সব অন্যায় অধ্যাদেশ জায়েজ করে নিয়েছিলেন, তাঁর পক্ষে কারা ভোট দিয়েছিলেন তাও কিন্তু আমাদের অজানা নয়। অজানা নয়, সপ্তম সংশোধনী বিল পাসের পর কীভাবে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী জেল থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন, কীভাবে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত মামলা প্রত্যাহার হয়ে গিয়েছিল। অতএব ওবায়দুল কাদের যথার্থই বলেছেন, ‘কাচের ঘরে বসে ওপরে ঢিল ছুড়লে তা নিজের গায়ে পড়ার সম্ভাবনাই বেশি।’
মন্ত্রী-নেতার পর এবার আসি সাংসদের কথায়। ঢাকা-১৬ আসনের সাংসদ ইলিয়াস মোল্লাহর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন পুলিশ সার্জেন্ট মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম। গত ৩০ জুন সাংসদ আশুলিয়া-বাইপাইল সড়ক দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেখানে দায়িত্ব পালন করছিলেন ওই সার্জেন্ট। সাংসদ সার্জেন্টকে ডেকে নিয়ে প্রথমে গালাগাল ও পরে তাঁর জামার কলার ধরে টানাটানি ও মারধর করেন। মামলায় তিনি সাংসদের বিরুদ্ধে পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ এনেছেন। এ ঘটনা ঘটেছে দিনদুপুরে, আরও অনেকের সামনে।
এর আগে বিএনপিদলীয় সাংসদ শহীদ উদ্দীন চৌধুরীর বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ এনেছে পুলিশ। ২৭ জুন হরতালের সময় তাঁর নেতৃত্বে হরতাল-সমর্থকেরা পুলিশের কাজে বাধা দিয়েছে। পুলিশের কাজে বাধা দিলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার তাদের আছে। কিন্তু সেদিন ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা কী করেছিল? তারা হামলা চালানোর পরই হরতাল-সমর্থকেরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং পিজি হাসপাতালে হামলা চালায়। অতএব হাঙ্গামার দায় তারাও এড়াতে পারে না। কিন্তু পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে আহত সাংসদ শহীদ উদ্দীন চৌধুরীকে টানাহেঁচড়া করেছে। একজন আইনপ্রণেতার ওপর পুলিশ এভাবে চড়াও হতে পারে না। বিএনপি ও তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে শহীদ উদ্দীন চৌধুরীকে বিদেশে পাঠানোর আবেদন জানানো হয়েছে। অনুরোধ জানিয়েছেন জাতীয় সংসদের স্পিকারও। তার পরও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। হাইকোর্ট চিকিৎসার জন্য তাঁকে কেন বারডেম হাসপাতালে পাঠানো হবে না, সে সম্পর্কে একটি রুলও জারি করেছেন। জানি না, সরকার এর কী জবাব দেবে?
দুজনই সাংসদ। একজন সরকারি দলের, একজন বিরোধী দলের। দুজনের বিরুদ্ধেই পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ এসেছে। প্রথমজনকে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন জানানো হয়েছে। টিভিতে দেখলাম স্ট্রেচারে করে শহীদ উদ্দীন চৌধুরীকে হাসপাতাল থেকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কিন্তু অসুস্থতার কারণে এজলাসে ওঠানো সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে ইলিয়াস মোল্লাহ বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শহীদ উদ্দীন চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু ইলিয়াস মোল্লাহর বিরুদ্ধে পুলিশ সার্জেন্ট যে অভিযোগ এনেছেন তা অনেকেই দেখেছেন। তার পরও এক যাত্রায় ভিন্ন ফল।
আমরা আশা করেছিলাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী অভিযোগকারী ট্রাফিক সার্জেন্টকে বাহবা দেবেন আইনানুগ কাজের জন্য। এখন দেখা যাচ্ছে, তাঁকে পরোক্ষভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কেন মামলা করলেন, তা নিয়ে তদন্ত হবে জানিয়েছেন। সার্জেন্টের পক্ষে বিবৃতির জন্য পুলিশ কর্মকর্তা সমিতির কাছে কৈফিয়ত চাওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘সাংসদেরা সম্মানিত ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি। তাঁদের বিরুদ্ধে হুট করে মামলা নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঠিক নয়।’ একই যুক্তি কেন শহীদ উদ্দীন চৌধুরীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না? তিনি বিএনপির সাংসদ বলে? কে কোন দলের সাংসদ, সেটি এখানে বিবেচ্য হতে পারে না।
সরকারদলীয় একজন সাংসদের বিরুদ্ধে মামলা করায় পুলিশের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আসলে চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে পুলিশ মামলা করেছে বলে নয়, তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দেওয়ার কারণে। এভাবে গণতন্ত্র বা আইনের শাসন চলতে পারে না, দলীয় শাসন বা স্বৈরতন্ত্র চলতে পারে। স্বাধীনতার পর এক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা পত্রিকায় লিখে দাবি জানিয়েছিলেন, ‘আইনের শাসন চাই না, মুজিবের শাসন চাই।’ ক্ষমতাসীন দলের অনেকে এখনো আইনের শাসন চান না, আওয়ামী লীগের শাসন চান। বিএনপি আমলেও একশ্রেণীর লোক আইন-আদালত উপেক্ষা করে স্বেচ্ছাচারী কায়দায় দেশ চালাতে চেয়েছিলেন। জনগণ সেটি পছন্দ করেনি বলেই ভোটের মাধ্যমে তাঁদের জবাব দিয়েছে। ইলিয়াস মোল্লাহর ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে অবস্থান নিয়েছে, তাতে সাংসদদের লম্বা হাত আরও লম্বা হবে, কোনো আইন, আইন রক্ষাকারী বাহিনী বা আদালতও তাঁদের স্পর্শ করতে পারবে না। গণতন্ত্র ও আইনের শাসন অধরাই থেকে যাবে।
সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
বর্তমান সরকারে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। বাংলাদেশে কিছু রাজনৈতিক পরিবার আছে, যারা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে থাকে, যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন সেই পরিবারের কেউ না কেউ থাকবেন। বিএনপি আমলে যে গুটি কয়েক বিরোধী সাংসদ সরকারের কাছ থেকে বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কাদের সিদ্দিকীর নাম সবার মুখে মুখে। তাঁর ঠিকাদারিতে করা অধিকাংশ সেতু অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এ নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হলেও কাজ হয়নি। ২০০১ সালে টাঙ্গাইলে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বিপর্যয়ে কাদের সিদ্দিকীর অবদান কম নয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বঙ্গবীর সুবিধা করতে পারেননি। কিন্তু তাঁর ভাই লতিফ সিদ্দিকী বিএনপি প্রার্থীকে হারিয়ে সাংসদ ও মন্ত্রী হয়েছেন। গত ১৮ মাসে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের সাফল্য প্রায় শূন্যের কোঠায়। পাটের জীবনরহস্য উদ্ঘাটনেও তাঁর কোনো ভূমিকা ছিল বলে আমাদের জানা নেই। ভূমিকা রেখেছেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। প্রথম আলোয় খবর দেখে তিনি বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমকে দেশে ফিরিয়ে এনে গবেষণাকাজের তহবিল জোগাড় করে দিয়েছেন। পাটমন্ত্রী পাটের গবেষণায় অবদান রাখতে না পেরে সম্ভবত ‘সাংবাদিক গবেষণা’য় অবদান রাখছেন। কী চমৎকার!
সম্প্রতি আওয়ামী সাংস্কৃতিক ফোরাম আয়োজিত এক সেমিনারে তিনি ছাত্রলীগের মারামারিকে সমর্থনই করেননি, বিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলোকে শায়েস্তা করতে প্ররোচনাও দেন এবং বলেন, ‘নিজেরা নিজেরা মারামারি করো, ওদের দুই-চারটার সঙ্গে মারামারি করো না কেন?’...ছাত্রলীগের ছেলেরা কি এই খুনখারাবি করেছে? এরা (ছাত্রলীগ) কি সবাই খারাপ? ছাত্রলীগের সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন, ‘ওই ছেলেদের আমরা বাদ দেব কেন? ছাত্রলীগ বন্ধ করব কেন? ছাত্রলীগ বন্ধ করে দেব, আর মাঠ দখল করে নেবেন?’ এরপর সাংবাদিকদের কঠোর সমালোচনা করে মন্ত্রী বলেন, ‘...পত্রিকায় নিউজ আসবে, সেই ভয়ে আমি অস্থির হয়ে যাব না। পত্রিকা-টেলিভিশনওয়ালারা শেখ হাসিনাকে জেতায়নি।’(প্রথম আলো, ১৭ জুলাই ২০১০)
এক-এগারো-পরবর্তী সময়ে সাংবাদিকদের ভূমিকার সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘ঘটনার নায়কদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সাংবাদিকেরা ওয়ান-ইলেভেনকে আশীর্বাদ জানিয়েছিল। ওই সময় টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যানরা টাকা না দিলে আমাদের খবর ও ছবি দেখাত না। টিভি ও পত্রিকার মালিকেরা আসলে সুবিধাভোগী।’(প্রথম আলো, ১৭ জুলাই ২০১০)
মন্ত্রীর দাবি সত্য হলে, উৎকোচ ছাড়া সাংবাদিকেরা রাজনীতিকদের (তিনি শুধু নিজের কথা বলেননি, বলেছেন বহুবচনে) খবর প্রচার করতেন না, টিভিতে ছবি দেখাতেন না। কারা টাকা খেয়ে খবর প্রচার করতেন, ছবি প্রকাশ করতেন, সে কথাটি প্রকাশ করলে তিনি ভালো করতেন। গয়রহ অভিযোগ করলে সে অভিযোগের মূল্য থাকে না। সে সময়ে লতিফ সিদ্দিকীসহ যাঁদের খবর প্রচারিত হয়েছে সবাই কি টাকা দিয়ে তা করিয়েছেন? সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের ঢালাও অভিযোগ এনে তিনি কেবল সাংবাদিকদেরই ছোট করেননি, হেয় করেছেন রাজনীতিকদেরও। উৎকোচদাতা ও গ্রহীতা—দুজনই সমান অপরাধী।
এ ছাড়া পাটমন্ত্রী একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারেরও বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি যুদ্ধাপরাধ স্বীকারই করি না। এ ক্ষেত্রে আমি মুজাহিদদের (জামায়াত নেতা) সঙ্গে একমত পোষণ করি। তাঁরা কেউ যুদ্ধাপরাধী নন। তাঁদের বিচার করতে জেনেভা কনভেনশন কেন?’ অর্থাৎ পাটমন্ত্রী প্রচলিত ফৌজদারি আইনেই তাঁদের বিচার চান। এ বক্তব্যের মাধ্যমে মন্ত্রী মহোদয় দুটি সিদ্ধান্তে এলেন: ১. জামায়াত নেতারা যুদ্ধাপরাধ করেননি, ২. যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সরকারের উদ্যোগের সরাসরি বিরোধিতা করলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তাঁকে অনুরোধ করব ষড়যন্ত্র খুঁজতে বেশি দূরে যেতে হবে না, মন্ত্রিসভাতেই তো বিচারের বিরোধী লোক আছেন।
পরদিন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের একই স্থানে অপর এক সেমিনারে মন্ত্রীর বক্তব্যের বিরোধিতা করে বলেছেন, ‘এক-এগারোর পর রাজনীতির অন্ধকার সময়ে আশার আলো সাংবাদিকেরাই জ্বালিয়েছিলেন, রাজনীতিকেরা নন। তাই কথা বলার ক্ষেত্রে রাজনীতিকদের পরিমিতিবোধ থাকা উচিত।’ (প্রথম আলো, ১৮ জুলাই, ২০১০) তিনি আরও বলেছেন, ‘চাঁদাবাজি আমরা কে কতটা করি, তা ব্যবসায়ীরা ভালো জানেন। তাই কাচের ঘরে ঢিল ছুড়ে লাভ নেই। ১৮ মাসে যাঁরা যোগ্যতা-দক্ষতা দেখাতে পারেননি, তাঁরা ১৮ বছরেও পারবেন না।’
মন্ত্রী হেদায়েত করেছেন সাংবাদিকদের। আর আওয়ামী লীগ নেতা নসিহত করেছেন মন্ত্রীদের। এসব কথা সাংবাদিক বা বিরোধী দলের কেউ করলে হয়তো রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করত। ভাগ্যিস, ঝগড়াটা মন্ত্রী বনাম নেতার মধ্যে হয়েছে।
লতিফ সিদ্দিকী আজ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেপথ্য শক্তি অর্থাৎ সেনাবাহিনীর দালালির অভিযোগ এনেছেন। স্বৈরাচারী এরশাদ যে সংসদে তাঁর সব অন্যায় অধ্যাদেশ জায়েজ করে নিয়েছিলেন, তাঁর পক্ষে কারা ভোট দিয়েছিলেন তাও কিন্তু আমাদের অজানা নয়। অজানা নয়, সপ্তম সংশোধনী বিল পাসের পর কীভাবে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী জেল থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন, কীভাবে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত মামলা প্রত্যাহার হয়ে গিয়েছিল। অতএব ওবায়দুল কাদের যথার্থই বলেছেন, ‘কাচের ঘরে বসে ওপরে ঢিল ছুড়লে তা নিজের গায়ে পড়ার সম্ভাবনাই বেশি।’
মন্ত্রী-নেতার পর এবার আসি সাংসদের কথায়। ঢাকা-১৬ আসনের সাংসদ ইলিয়াস মোল্লাহর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন পুলিশ সার্জেন্ট মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম। গত ৩০ জুন সাংসদ আশুলিয়া-বাইপাইল সড়ক দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেখানে দায়িত্ব পালন করছিলেন ওই সার্জেন্ট। সাংসদ সার্জেন্টকে ডেকে নিয়ে প্রথমে গালাগাল ও পরে তাঁর জামার কলার ধরে টানাটানি ও মারধর করেন। মামলায় তিনি সাংসদের বিরুদ্ধে পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ এনেছেন। এ ঘটনা ঘটেছে দিনদুপুরে, আরও অনেকের সামনে।
এর আগে বিএনপিদলীয় সাংসদ শহীদ উদ্দীন চৌধুরীর বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ এনেছে পুলিশ। ২৭ জুন হরতালের সময় তাঁর নেতৃত্বে হরতাল-সমর্থকেরা পুলিশের কাজে বাধা দিয়েছে। পুলিশের কাজে বাধা দিলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার তাদের আছে। কিন্তু সেদিন ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা কী করেছিল? তারা হামলা চালানোর পরই হরতাল-সমর্থকেরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং পিজি হাসপাতালে হামলা চালায়। অতএব হাঙ্গামার দায় তারাও এড়াতে পারে না। কিন্তু পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে আহত সাংসদ শহীদ উদ্দীন চৌধুরীকে টানাহেঁচড়া করেছে। একজন আইনপ্রণেতার ওপর পুলিশ এভাবে চড়াও হতে পারে না। বিএনপি ও তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে শহীদ উদ্দীন চৌধুরীকে বিদেশে পাঠানোর আবেদন জানানো হয়েছে। অনুরোধ জানিয়েছেন জাতীয় সংসদের স্পিকারও। তার পরও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। হাইকোর্ট চিকিৎসার জন্য তাঁকে কেন বারডেম হাসপাতালে পাঠানো হবে না, সে সম্পর্কে একটি রুলও জারি করেছেন। জানি না, সরকার এর কী জবাব দেবে?
দুজনই সাংসদ। একজন সরকারি দলের, একজন বিরোধী দলের। দুজনের বিরুদ্ধেই পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ এসেছে। প্রথমজনকে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন জানানো হয়েছে। টিভিতে দেখলাম স্ট্রেচারে করে শহীদ উদ্দীন চৌধুরীকে হাসপাতাল থেকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কিন্তু অসুস্থতার কারণে এজলাসে ওঠানো সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে ইলিয়াস মোল্লাহ বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শহীদ উদ্দীন চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু ইলিয়াস মোল্লাহর বিরুদ্ধে পুলিশ সার্জেন্ট যে অভিযোগ এনেছেন তা অনেকেই দেখেছেন। তার পরও এক যাত্রায় ভিন্ন ফল।
আমরা আশা করেছিলাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী অভিযোগকারী ট্রাফিক সার্জেন্টকে বাহবা দেবেন আইনানুগ কাজের জন্য। এখন দেখা যাচ্ছে, তাঁকে পরোক্ষভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কেন মামলা করলেন, তা নিয়ে তদন্ত হবে জানিয়েছেন। সার্জেন্টের পক্ষে বিবৃতির জন্য পুলিশ কর্মকর্তা সমিতির কাছে কৈফিয়ত চাওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘সাংসদেরা সম্মানিত ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি। তাঁদের বিরুদ্ধে হুট করে মামলা নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঠিক নয়।’ একই যুক্তি কেন শহীদ উদ্দীন চৌধুরীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না? তিনি বিএনপির সাংসদ বলে? কে কোন দলের সাংসদ, সেটি এখানে বিবেচ্য হতে পারে না।
সরকারদলীয় একজন সাংসদের বিরুদ্ধে মামলা করায় পুলিশের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আসলে চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে পুলিশ মামলা করেছে বলে নয়, তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দেওয়ার কারণে। এভাবে গণতন্ত্র বা আইনের শাসন চলতে পারে না, দলীয় শাসন বা স্বৈরতন্ত্র চলতে পারে। স্বাধীনতার পর এক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা পত্রিকায় লিখে দাবি জানিয়েছিলেন, ‘আইনের শাসন চাই না, মুজিবের শাসন চাই।’ ক্ষমতাসীন দলের অনেকে এখনো আইনের শাসন চান না, আওয়ামী লীগের শাসন চান। বিএনপি আমলেও একশ্রেণীর লোক আইন-আদালত উপেক্ষা করে স্বেচ্ছাচারী কায়দায় দেশ চালাতে চেয়েছিলেন। জনগণ সেটি পছন্দ করেনি বলেই ভোটের মাধ্যমে তাঁদের জবাব দিয়েছে। ইলিয়াস মোল্লাহর ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে অবস্থান নিয়েছে, তাতে সাংসদদের লম্বা হাত আরও লম্বা হবে, কোনো আইন, আইন রক্ষাকারী বাহিনী বা আদালতও তাঁদের স্পর্শ করতে পারবে না। গণতন্ত্র ও আইনের শাসন অধরাই থেকে যাবে।
সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments