সরকারের আন্তরিকতাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে-মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার

একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার-প্রক্রিয়া এক বড় ধাক্কা খেল এই অপরাধ তদন্তে গঠিত সংস্থার প্রধান আবদুল মতীনের পদত্যাগের ঘটনায়। বার্তা সংস্থার খবরে বলা হয়েছে, আবদুল মতীন বুধবার স্বেচ্ছায় স্বরাষ্ট্রসচিবের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে একে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ বলা যাবে না।


কারণ, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা এবং এরপর এই পদত্যাগের ঘটনা ঘটল। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো, এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার প্রধান নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকার দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়নি। ঘটনাটি মানবতাবিরোধী বিচারের ব্যাপারে সরকারের আন্তরিকতাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলেছে, যা সরকারের ব্যর্থতা হিসেবেই বিবেচিত হবে।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে গত ২৫ মার্চ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে সরকার যখন আদালত, আইনজীবী প্যানেল ও তদন্ত সংস্থা নিয়োগ দেয়, তখনই নানা মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছিল। বিশেষ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত করতে যে পেশাগত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা প্রয়োজন, তা অনেকেরই নেই। আইনজীবীদের প্যানেলও জনমনে আশা জাগায়নি। ৩৯ বছর আগে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অনেক তথ্য-প্রমাণ ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে। অন্যদিকে যাঁরা এ বিচারের বিরোধী, তাঁরাও বসে নেই। তাঁরা বিদেশ থেকে আইনজীবী আনারও প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। তাঁদের মোকাবিলায় প্রয়োজন একদল অভিজ্ঞ ও চৌকস আইনজীবীর।
পদত্যাগী প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল মতীনের সমালোচনা হয়েছে নৈতিক অবস্থান থেকে। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা আলাউদ্দিন আহমেদ অভিযোগ করেছেন যে ষাটের দশকের প্রথমার্ধে তিনি বি এম কলেজের ছাত্র থাকাকালে জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আবদুল মতীন অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে আরও একটি অভিযোগ হচ্ছে, তিনি পাকিস্তান সরকারের অধীনে চাকরিতে ঢুকেছেন ১৯৭১ সালের অক্টোবরে, যা আবদুল মতীন নিজেও স্বীকার করেছেন। এটা যদি ন্যায়সংগত না হয়ে থাকে তবে আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁকে নিয়োগ দেওয়ার আগে এসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়নি কেন?
বোঝা যায় বিষয়টির গুরুত্ব যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পারেনি সরকার। মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্তে গঠিত কমিশনে গ্রহণযোগ্য এবং যোগ্যতা ও দক্ষতাসম্পন্ন এমন একজন খুঁজে পাওয়া নিশ্চয় কঠিন নয়, যাঁর বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ ওঠার সুযোগ ছিল না। তা ছাড়া মাস দেড়েক আগে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হলেও এখন পর্যন্ত তদন্তকাজ শুরু হয়নি; তদন্ত কর্মকর্তাদের জন্য অর্থ বরাদ্দ না করাও দুঃখজনক। এমন পরিস্থিতিতে অভিযোগ ওঠার পর তদন্ত সংস্থার প্রধানের পদত্যাগ একটি বড় ধাক্কা বলেই মানতে হচ্ছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের মতো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়ে এ ধরনের গাফিলতি অমার্জনীয়। যাদের ঔদাসীন্য ও ব্যর্থতার কারণে এ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটল, তাদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারেরই। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ব্যাপারে সরকার জাতির কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কারও গাফিলতি বা অদক্ষতায় এর বিচারকাজ ব্যাহত বা ভণ্ডুল হতে দেওয়া যায় না।

No comments

Powered by Blogger.