খোলা চোখে-ক্ষমা করব কি করব না by হাসান ফেরদৌস
১৯৯৪ সালে আফ্রিকার রুয়ান্ডায় মাত্র তিন মাসের মধ্যে প্রায় আট লাখ মানুষ নিহত হয়। নিহত লোকজনের অধিকাংশই টুটসি সম্প্রদায়ের, ঘাতকেরা প্রায় সবাই প্রতিদ্বন্দ্বী হুটু সম্প্রদায়ের। কামান-বন্দুক নয়, অধিকাংশ মানুষই মারা গিয়েছিল চাকু, ছুরি আর কাস্তে জাতীয় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে। মহিলা, শিশু কেউ নিস্তার পায়নি।
নিরাপদ ভেবে অনেকে আশ্রয় নিয়েছিল গির্জায়। হুটু পাদ্রিরা নিজেরাই খুনিদের আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসেন, তাঁদের চোখের সামনে কচুকাটা করা হয় প্রতিটি আশ্রয়প্রার্থীকে। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বাড়িঘর, গ্রামের পর গ্রাম জ্বলে খাক হয়। এমন নির্মম জাতিহত্যার তুলনা মেলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ফ্যাসিস্ট জার্মানির হাতে ইহুদি হত্যায় এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ও তার দোসরদের হাতে বাঙালি নিধনে। রুয়ান্ডার সেই গণহত্যা নিয়ে কয়েক বছর আগে ফিলিপ গুরিইয়েভিচ একটি অসাধারণ প্রামাণ্য গ্রন্থ লিখেছিলেন, নাম আই উইশ টু ইনফরম ইউ দ্যাট টুমরো উই উইল বি কিলড উইথ আওয়ার ফামিলিস (পিকাডোর, ১৯৯৮)।
হুটু ও টুটসি দুই সম্প্রদায়ের মানুষ দেখতে প্রায় একই রকম। তাদের ধর্ম এক, সংস্কৃতিও এক। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই কে কোন সম্প্রদায়ের। পাশাপাশি বাড়িতে, একই গ্রামে থেকেছে বছরের পর বছর। আন্তসাম্প্রদায়িক বিয়ে ও আত্মীয়তা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। জাতিগত তফাত না থাকলেও শ্রেণীগত দূরত্ব অবশ্য ছিল। টুটসিরা সংখ্যায় কম, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে অধিক বলবান। বেলজিয়ান ঔপনিবেশিক প্রভুরা এই টুটসিদের পেয়েছিল তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে। যে অর্ধশতকেরও বেশি সময় বেলজিয়াম দেশটি দখল করে রাখে, সে সময় সংখ্যায় বেশি হয়েও হুটুরা রাজনৈতিক ও অর্থনেতিকভাবে ছিল অবহেলিত। ফলে এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ঠোকাঠুকি অনেক আগে থেকে লেগেই ছিল। এই নিয়ে বড় ধরনের রক্তপাত ঘটে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে। সে সময় কয়েক হাজার টুটসি নিহত হয়, তাদের অনেকে পালিয়ে আশ্রয় নেয় প্রতিবেশী উগান্ডায়। ১৯৬২ সালে স্বাধীনতা পাওয়ার পর রুয়ান্ডায় ক্ষমতা দখল করে হুটুরা। প্রতিদ্বন্দ্বী টুটসিদের সঙ্গে মৈত্রীর বদলে তারা সংঘর্ষ জিইয়ে রাখে মুখ্যত রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের লক্ষ্যে। নির্বাসিত টুটসি নেতাদের অনেকেও জাতিবিদ্বেষের আগুনে ঘি ঢালতে দ্বিধা করেননি। এই রেষারেষি পুরোদস্তুর যুদ্ধে গড়ায় ১৯৯৪ সালে। সে বছর এপ্রিলে রুয়ান্ডার হুটু প্রেসিডেন্ট রাজধানী কিগালেতে এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। বলা হলো, টুটসিদের নেতা পল কাগামে ও তাঁর মিত্রদের হাতেই তিনি নিহত হয়েছেন। অমনি দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল জাতিবিদ্বেষের আগুন।
টুটসিদের বিরুদ্ধে জাতিহত্যায় নেতৃত্ব দেয় হুটুদের নিয়ন্ত্রিত সেনাবাহিনী, বিশেষত প্রেসিডেনশিয়াল গার্ড বাহিনী। তারা তড়িঘড়ি করে একটি হুটু মিলিশিয়া বা আধাসামরিক বাহিনী গড়ে তোলে, একাত্তরে যেমন গড়ে তোলা হয় রাজাকার-আলবদর। প্রায় ৩০ হাজার সদস্যবিশিষ্ট এই হুটু মিলিশিয়া বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয় অস্ত্র ও নগদ টাকা-পয়সা। সেনাসদস্যরা পাহারা বসান, কিন্তু খুনের কাজটা মূলত করে এই মিলিশিয়া বাহিনী। এদিকে বিদেশে অবস্থানরত টুটসিদের নেতৃত্বে শুরু হয় পালটা আক্রমণ। তাতে মদদ মেলে প্রতিবেশী একাধিক দেশের তরফ থেকে। শেষ পর্যন্ত হুটুরা পরাজিত হয়, ক্ষমতা দখল করে নেয় টুটসি ও মধ্যপন্থী হুটুদের একটি সম্মিলিত দল। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পান পল কাগামে।
রুয়ান্ডার ইতিহাসে এরপর যা ঘটল, তা আমাদের আজকের বিবেচ্য বিষয় বোঝার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। টুটসিদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে খুনে হুটুদের অনেকেই দেশ ছেড়ে পালাল, কেউ কেউ আশ্রয় নিল প্রতিবেশী জায়ের ও কঙ্গোতে। আর যারা রয়ে গেল, তাদের মধ্যে চিহ্নিত অপরাধী, বিশেষত মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্য, এমন হাজার হাজার হুটুকে পোরা হলো জেলে। নতুন দেশ, অর্থনীতি বিপর্যস্ত, কোষাগার প্রায় শূন্য। এ অবস্থায় হাজার হাজার লোককে জেলে পুরে রাখা বা তাদের বিচারকাজ সম্পন্ন করা সরকারের পক্ষে অসম্ভব। ঠিক হলো, তাদের মধ্যে যারা নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা ভিক্ষা করবে, তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। এক ধাক্কায় ৪০ হাজার খুনে হুটুকে ছেড়েও দেওয়া হলো। সরকারের উদ্যোগে, বেসরকারি সংস্থার সমর্থনে এবং চার্চের পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হলো হুটু-টুটসি বিবাদ মিটিয়ে ফেলার লক্ষ্যে সম্প্রীতি-বৈঠক। গ্রামে গ্রামে বসল সে বৈঠক। এক দিকে চিহ্নিত খুনি, তার সামনে বসে নিহত পরিবারের বেঁচে-যাওয়া সদস্যরা, যাদের বাড়িঘর লুট হয়েছে, যারা ধর্ষণের শিকার এমন নারী ও পুরুষ।
প্রথম যখন পত্রিকায় এ সম্প্রীতি বৈঠকের কথা পড়ি, ব্যাপারটা বিশ্বাস করিনি। আমরা জানি, দক্ষিণ আফ্রিকায় সাদা-কলোদের বিভেদ দূর করতে একই ধরনের সম্মিলনী বৈঠকের আয়োজন করা হয়, সে দেশের সরকারি তত্ত্বাবধানে গঠিত ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের নেতৃত্বে। একই রকম ট্রুথ কমিশন কাজ করেছে হাইতি ও নিকারাগুয়ায়। এসব দেশে এই মিলমিশের ব্যাপারটা পুরোটাই হয়েছে রাজনৈতিক সমঝোতার অংশ হিসেবে, ক্ষমতা ভাগাভাগির দর-কষাকষির মধ্য দিয়ে। মতভেদ, এমনকি জাতিভেদ থাকলেও এবং বিস্তর খুনাখুনি হলেও এসব দেশের কোথাও ঠিক জাতিহত্যা ঘটেনি। রুয়ান্ডার অবস্থা ভিন্ন। নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য ধরে রাখার জন্য সেখানে ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয় একজন-দুজন নয়, হাজার হাজার মানুষকে। গণধর্ষণের শিকার হয় হাজার হাজার নারী। বললাম ‘ক্ষমা করো’, আর অমনি ক্ষমা হয়ে গেল? এও কি সম্ভব?
অথচ ঠিক তাই ঘটেছে। রুয়ান্ডার এই সম্মিলনী প্রক্রিয়ার ওপর একটি অসাধারণ তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন লরা ওয়াটারস হিনসন। ছবির নাম অ্যাজ উই ফরগিভ। রুয়ান্ডা গণহত্যার ১৫তম বার্ষিকী উপলক্ষে সম্প্রতি এ ছবিটি দেখার সুযোগ হলো।
এক ঘণ্টারও কম সময়, তারই মধ্যে রুয়ান্ডার জাতিভেদের ইতিহাস এবং ১৯৯৪ সালের গণহত্যার রাজনৈতিক পটভূমি এতে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু ছবির আসল নজর সম্প্রীতি-প্রক্রিয়ার ওপর। অনেক লোকের কথা না বলে এ তথ্যচিত্রে দুই মহিলার কথা বলা হয়েছে, গণহত্যায় তাঁরা উভয়েই সবকিছু—স্বামী, সন্তান, সংসার নির্বাহের উপায়, সবই হারিয়েছেন। পাশাপাশি তাঁদের দুই ঘাতক। কৃতকর্মের জন্য উভয়েই জেলে গিয়েছিল, গণক্ষমার ভিত্তিতে তারা ছাড়া পেয়েছে। একই গ্রামের বাসিন্দা, ফলে চাও বা না চাও, একে-অপরের দেখা হবেই। খুনি দুজন প্রকাশ্যে একাধিকবার স্বীকার করেছে, তারা কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত। মহিলা দুজনের হাত ধরে ক্ষমার সানুনয় প্রার্থনা করতেও তারা প্রস্তুত। সরকারি উদ্যোগে, গির্জার সমর্থনে সম্প্রীতি-সভায় তাদের সবাইকে টেনে আনার চেষ্টা হয়েছে কয়েকবার। কিন্তু যাদের হাতে রক্তের দাগ, যারা স্বীকৃত খুনি, তাদের সঙ্গে মহিলা দুটি একই গাছের নিচে বসে সভা করে কী করে?
এ তথ্যচিত্রে আমরা আলাদাভাবে এই চারজনের সঙ্গে পরিচিত হই। তাদের নিজের বর্ণনায় শুনি গভীর ক্ষত ও বেদনার কথা, শুনি আন্তরিক মনস্তাপ ও মনঃপীড়নের কথা। কীভাবে এমন পাষণ্ডের মতো নির্মম হত্যার কাজ তারা করতে পারল? এ প্রশ্ন ঘাতক দুজন নিজেরাই নিজেদের করে। তার উত্তরও আমরা পাই। নিজেদের দায়ভার লঘু করার লক্ষ্যে নয়, বাস্তবতা বোঝানোর জন্য আমরা পরিচিত হই ১৯৯৪ সালের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে। যারা ক্ষমতায় বসেছিল, এই খাণ্ডবদাহের মন্ত্রদাতা তারাই। সরকারি মদদে পরিচালিত একটি রেডিও স্টেশন থেকে অহর্নিশ টুটসিদের বিরুদ্ধে প্রচার চলেছে। যে মিলিশিয়া বাহিনী গড়ে তোলা হয়, তাদের অর্থ ও অস্ত্র দেওয়া ছাড়াও আদর্শগতভাবে তৈরি করে নেওয়া হয়। ঔপনিবেশিক আমল থেকে হুটু-টুটসির সাম্প্রদায়িক বৈরিতা ছিল। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তাতে ঘৃতাহুতি দেওয়া হয়। আর তারই প্রভাবে ভেবে না ভেবে হুটুরা ঝাঁপিয়ে পড়ে টুটসিদের ওপর। এক সময় টুটুসিরা জোতদার ছিল। তাদের বিরুদ্ধে শ্রেণীগত বৈষম্যও উসকে দেওয়া হয়।
ক্ষমতা গ্রহণের পর স্বীকৃত ঘাতকদের ক্ষমা ও সম্প্রীতি-প্রক্রিয়ার সিদ্ধান্ত আসে নতুন টুটসি-হুটু যৌথ সরকারের কাছ থেকে। বিচারের প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত সব অপরাধীকে জেলে পুরে রাখা অসম্ভব জেনে সাধারণ ক্ষমার সিদ্ধান্ত হলো। কিন্তু সরকারি ক্ষমাই তো যথেষ্ট নয়। মুক্ত এসব হাজার হাজার মানুষকে যদি সমাজে সমন্বিত না করা হয়, রুয়ান্ডার বুকের ক্ষত মিটবে না, রাজনৈতিক বিভক্তিও রয়ে যাবে। পল কাগামে ও তাঁর সমর্থক টুটসিরা চাইলে এ বিভক্তি রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে পারতেন। তা করেননি, বরং সে ক্ষত মেটাতে সম্প্রীতি-প্রক্রিয়ার অভিনব প্রস্তাব সমর্থন করেছেন। এ কাজে মন্ত্রী হিসেবে যাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাঁর পরিবারের প্রতিটি মানুষ সেই গণহত্যায় নিহত হয়। অথচ তিনিই ক্ষমা ও সম্প্রীতির কথা বলছেন সবচেয়ে উঁচু গলায়, তা দেখে ক্ষমাপ্রাপ্ত হুটুদের এ প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা জন্মায়। সাধারণ মানুষেরা, যাদের পাশাপাশি ঘরে প্রতিটি দিন কাটাতে হবে এই খুনেদের সঙ্গে, তাদের কাছ থেকেও সমর্থন মেলে।
তবে হঠাত্ বললাম আর ক্ষমা হলো, রুয়ান্ডায় ব্যাপারটা মোটেই তেমন হয়নি। যে দুই রমণীর কাহিনি আমরা এ তথ্যচিত্রে দেখি, প্রথম আমরা পরিচিত হই তাঁদের রক্তবর্ণ চোখের সঙ্গে, পরিচিত হই তাঁদের অনিঃশেষ কান্নার সঙ্গে। পাশাপাশি দেখি খুনি দুজনের মনস্তাপ। সম্প্রীতি-প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দুই মহিলার একজনের ভাঙা ঘর মেরামত করা হয়। অন্য মহিলার খেতের ফসল কেটে আনতে সাহায্য করা হয়। ঘাতক দুই পুরুষও তাতে অংশ নেয়। এভাবে একধরনের আদান-প্রদানের আবহ সৃষ্টি হয়, সামাজিকভাবে ওঠাবসা শুরু হয়। অবশেষে মুখোমুখি উপস্থিত হয় ঘাতক ও তার শিকার। তারা উভয়েই খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী। যিশুর ক্ষমাবোধের সঙ্গে তারা পরিচিত। শেষ পর্যন্ত সেই ক্ষমতাবোধই তাদের দ্বিধার শেষ দেয়াল ডিঙাতে সাহায্য করে।
আমি জানি না এ তথ্যচিত্র থেকে আমাদের শেখার বা জানার কিছু আছে কি না। একাত্তরের ঘাতক ও দালালদের সরকারিভাবে সাধারণ ক্ষমা করা হয়েছিল, কিন্তু সে ক্ষমা ঘোষণার আগে আমাদের মতামত কেউ চায়নি। ক্ষমাপ্রাপ্ত সেসব ঘাতকের মনস্তাপের কথাও আমরা শুনিনি। আমরা, আমি নিজেও বরাবর ঘাতক ও খুনেদের প্রতি আমাদের অনিঃশেষ ঘৃণার কথাই বলে এসেছি। সারা পৃথিবীও যদি ক্ষমা করে, আমরা তাদের ক্ষমা করব না, এমন কথাও বলেছি।
কিন্তু তারপর? তারপর কী?
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
হুটু ও টুটসি দুই সম্প্রদায়ের মানুষ দেখতে প্রায় একই রকম। তাদের ধর্ম এক, সংস্কৃতিও এক। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই কে কোন সম্প্রদায়ের। পাশাপাশি বাড়িতে, একই গ্রামে থেকেছে বছরের পর বছর। আন্তসাম্প্রদায়িক বিয়ে ও আত্মীয়তা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। জাতিগত তফাত না থাকলেও শ্রেণীগত দূরত্ব অবশ্য ছিল। টুটসিরা সংখ্যায় কম, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে অধিক বলবান। বেলজিয়ান ঔপনিবেশিক প্রভুরা এই টুটসিদের পেয়েছিল তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে। যে অর্ধশতকেরও বেশি সময় বেলজিয়াম দেশটি দখল করে রাখে, সে সময় সংখ্যায় বেশি হয়েও হুটুরা রাজনৈতিক ও অর্থনেতিকভাবে ছিল অবহেলিত। ফলে এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ঠোকাঠুকি অনেক আগে থেকে লেগেই ছিল। এই নিয়ে বড় ধরনের রক্তপাত ঘটে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে। সে সময় কয়েক হাজার টুটসি নিহত হয়, তাদের অনেকে পালিয়ে আশ্রয় নেয় প্রতিবেশী উগান্ডায়। ১৯৬২ সালে স্বাধীনতা পাওয়ার পর রুয়ান্ডায় ক্ষমতা দখল করে হুটুরা। প্রতিদ্বন্দ্বী টুটসিদের সঙ্গে মৈত্রীর বদলে তারা সংঘর্ষ জিইয়ে রাখে মুখ্যত রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের লক্ষ্যে। নির্বাসিত টুটসি নেতাদের অনেকেও জাতিবিদ্বেষের আগুনে ঘি ঢালতে দ্বিধা করেননি। এই রেষারেষি পুরোদস্তুর যুদ্ধে গড়ায় ১৯৯৪ সালে। সে বছর এপ্রিলে রুয়ান্ডার হুটু প্রেসিডেন্ট রাজধানী কিগালেতে এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। বলা হলো, টুটসিদের নেতা পল কাগামে ও তাঁর মিত্রদের হাতেই তিনি নিহত হয়েছেন। অমনি দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল জাতিবিদ্বেষের আগুন।
টুটসিদের বিরুদ্ধে জাতিহত্যায় নেতৃত্ব দেয় হুটুদের নিয়ন্ত্রিত সেনাবাহিনী, বিশেষত প্রেসিডেনশিয়াল গার্ড বাহিনী। তারা তড়িঘড়ি করে একটি হুটু মিলিশিয়া বা আধাসামরিক বাহিনী গড়ে তোলে, একাত্তরে যেমন গড়ে তোলা হয় রাজাকার-আলবদর। প্রায় ৩০ হাজার সদস্যবিশিষ্ট এই হুটু মিলিশিয়া বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয় অস্ত্র ও নগদ টাকা-পয়সা। সেনাসদস্যরা পাহারা বসান, কিন্তু খুনের কাজটা মূলত করে এই মিলিশিয়া বাহিনী। এদিকে বিদেশে অবস্থানরত টুটসিদের নেতৃত্বে শুরু হয় পালটা আক্রমণ। তাতে মদদ মেলে প্রতিবেশী একাধিক দেশের তরফ থেকে। শেষ পর্যন্ত হুটুরা পরাজিত হয়, ক্ষমতা দখল করে নেয় টুটসি ও মধ্যপন্থী হুটুদের একটি সম্মিলিত দল। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পান পল কাগামে।
রুয়ান্ডার ইতিহাসে এরপর যা ঘটল, তা আমাদের আজকের বিবেচ্য বিষয় বোঝার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। টুটসিদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে খুনে হুটুদের অনেকেই দেশ ছেড়ে পালাল, কেউ কেউ আশ্রয় নিল প্রতিবেশী জায়ের ও কঙ্গোতে। আর যারা রয়ে গেল, তাদের মধ্যে চিহ্নিত অপরাধী, বিশেষত মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্য, এমন হাজার হাজার হুটুকে পোরা হলো জেলে। নতুন দেশ, অর্থনীতি বিপর্যস্ত, কোষাগার প্রায় শূন্য। এ অবস্থায় হাজার হাজার লোককে জেলে পুরে রাখা বা তাদের বিচারকাজ সম্পন্ন করা সরকারের পক্ষে অসম্ভব। ঠিক হলো, তাদের মধ্যে যারা নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা ভিক্ষা করবে, তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। এক ধাক্কায় ৪০ হাজার খুনে হুটুকে ছেড়েও দেওয়া হলো। সরকারের উদ্যোগে, বেসরকারি সংস্থার সমর্থনে এবং চার্চের পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হলো হুটু-টুটসি বিবাদ মিটিয়ে ফেলার লক্ষ্যে সম্প্রীতি-বৈঠক। গ্রামে গ্রামে বসল সে বৈঠক। এক দিকে চিহ্নিত খুনি, তার সামনে বসে নিহত পরিবারের বেঁচে-যাওয়া সদস্যরা, যাদের বাড়িঘর লুট হয়েছে, যারা ধর্ষণের শিকার এমন নারী ও পুরুষ।
প্রথম যখন পত্রিকায় এ সম্প্রীতি বৈঠকের কথা পড়ি, ব্যাপারটা বিশ্বাস করিনি। আমরা জানি, দক্ষিণ আফ্রিকায় সাদা-কলোদের বিভেদ দূর করতে একই ধরনের সম্মিলনী বৈঠকের আয়োজন করা হয়, সে দেশের সরকারি তত্ত্বাবধানে গঠিত ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের নেতৃত্বে। একই রকম ট্রুথ কমিশন কাজ করেছে হাইতি ও নিকারাগুয়ায়। এসব দেশে এই মিলমিশের ব্যাপারটা পুরোটাই হয়েছে রাজনৈতিক সমঝোতার অংশ হিসেবে, ক্ষমতা ভাগাভাগির দর-কষাকষির মধ্য দিয়ে। মতভেদ, এমনকি জাতিভেদ থাকলেও এবং বিস্তর খুনাখুনি হলেও এসব দেশের কোথাও ঠিক জাতিহত্যা ঘটেনি। রুয়ান্ডার অবস্থা ভিন্ন। নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য ধরে রাখার জন্য সেখানে ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয় একজন-দুজন নয়, হাজার হাজার মানুষকে। গণধর্ষণের শিকার হয় হাজার হাজার নারী। বললাম ‘ক্ষমা করো’, আর অমনি ক্ষমা হয়ে গেল? এও কি সম্ভব?
অথচ ঠিক তাই ঘটেছে। রুয়ান্ডার এই সম্মিলনী প্রক্রিয়ার ওপর একটি অসাধারণ তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন লরা ওয়াটারস হিনসন। ছবির নাম অ্যাজ উই ফরগিভ। রুয়ান্ডা গণহত্যার ১৫তম বার্ষিকী উপলক্ষে সম্প্রতি এ ছবিটি দেখার সুযোগ হলো।
এক ঘণ্টারও কম সময়, তারই মধ্যে রুয়ান্ডার জাতিভেদের ইতিহাস এবং ১৯৯৪ সালের গণহত্যার রাজনৈতিক পটভূমি এতে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু ছবির আসল নজর সম্প্রীতি-প্রক্রিয়ার ওপর। অনেক লোকের কথা না বলে এ তথ্যচিত্রে দুই মহিলার কথা বলা হয়েছে, গণহত্যায় তাঁরা উভয়েই সবকিছু—স্বামী, সন্তান, সংসার নির্বাহের উপায়, সবই হারিয়েছেন। পাশাপাশি তাঁদের দুই ঘাতক। কৃতকর্মের জন্য উভয়েই জেলে গিয়েছিল, গণক্ষমার ভিত্তিতে তারা ছাড়া পেয়েছে। একই গ্রামের বাসিন্দা, ফলে চাও বা না চাও, একে-অপরের দেখা হবেই। খুনি দুজন প্রকাশ্যে একাধিকবার স্বীকার করেছে, তারা কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত। মহিলা দুজনের হাত ধরে ক্ষমার সানুনয় প্রার্থনা করতেও তারা প্রস্তুত। সরকারি উদ্যোগে, গির্জার সমর্থনে সম্প্রীতি-সভায় তাদের সবাইকে টেনে আনার চেষ্টা হয়েছে কয়েকবার। কিন্তু যাদের হাতে রক্তের দাগ, যারা স্বীকৃত খুনি, তাদের সঙ্গে মহিলা দুটি একই গাছের নিচে বসে সভা করে কী করে?
এ তথ্যচিত্রে আমরা আলাদাভাবে এই চারজনের সঙ্গে পরিচিত হই। তাদের নিজের বর্ণনায় শুনি গভীর ক্ষত ও বেদনার কথা, শুনি আন্তরিক মনস্তাপ ও মনঃপীড়নের কথা। কীভাবে এমন পাষণ্ডের মতো নির্মম হত্যার কাজ তারা করতে পারল? এ প্রশ্ন ঘাতক দুজন নিজেরাই নিজেদের করে। তার উত্তরও আমরা পাই। নিজেদের দায়ভার লঘু করার লক্ষ্যে নয়, বাস্তবতা বোঝানোর জন্য আমরা পরিচিত হই ১৯৯৪ সালের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে। যারা ক্ষমতায় বসেছিল, এই খাণ্ডবদাহের মন্ত্রদাতা তারাই। সরকারি মদদে পরিচালিত একটি রেডিও স্টেশন থেকে অহর্নিশ টুটসিদের বিরুদ্ধে প্রচার চলেছে। যে মিলিশিয়া বাহিনী গড়ে তোলা হয়, তাদের অর্থ ও অস্ত্র দেওয়া ছাড়াও আদর্শগতভাবে তৈরি করে নেওয়া হয়। ঔপনিবেশিক আমল থেকে হুটু-টুটসির সাম্প্রদায়িক বৈরিতা ছিল। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তাতে ঘৃতাহুতি দেওয়া হয়। আর তারই প্রভাবে ভেবে না ভেবে হুটুরা ঝাঁপিয়ে পড়ে টুটসিদের ওপর। এক সময় টুটুসিরা জোতদার ছিল। তাদের বিরুদ্ধে শ্রেণীগত বৈষম্যও উসকে দেওয়া হয়।
ক্ষমতা গ্রহণের পর স্বীকৃত ঘাতকদের ক্ষমা ও সম্প্রীতি-প্রক্রিয়ার সিদ্ধান্ত আসে নতুন টুটসি-হুটু যৌথ সরকারের কাছ থেকে। বিচারের প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত সব অপরাধীকে জেলে পুরে রাখা অসম্ভব জেনে সাধারণ ক্ষমার সিদ্ধান্ত হলো। কিন্তু সরকারি ক্ষমাই তো যথেষ্ট নয়। মুক্ত এসব হাজার হাজার মানুষকে যদি সমাজে সমন্বিত না করা হয়, রুয়ান্ডার বুকের ক্ষত মিটবে না, রাজনৈতিক বিভক্তিও রয়ে যাবে। পল কাগামে ও তাঁর সমর্থক টুটসিরা চাইলে এ বিভক্তি রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে পারতেন। তা করেননি, বরং সে ক্ষত মেটাতে সম্প্রীতি-প্রক্রিয়ার অভিনব প্রস্তাব সমর্থন করেছেন। এ কাজে মন্ত্রী হিসেবে যাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাঁর পরিবারের প্রতিটি মানুষ সেই গণহত্যায় নিহত হয়। অথচ তিনিই ক্ষমা ও সম্প্রীতির কথা বলছেন সবচেয়ে উঁচু গলায়, তা দেখে ক্ষমাপ্রাপ্ত হুটুদের এ প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা জন্মায়। সাধারণ মানুষেরা, যাদের পাশাপাশি ঘরে প্রতিটি দিন কাটাতে হবে এই খুনেদের সঙ্গে, তাদের কাছ থেকেও সমর্থন মেলে।
তবে হঠাত্ বললাম আর ক্ষমা হলো, রুয়ান্ডায় ব্যাপারটা মোটেই তেমন হয়নি। যে দুই রমণীর কাহিনি আমরা এ তথ্যচিত্রে দেখি, প্রথম আমরা পরিচিত হই তাঁদের রক্তবর্ণ চোখের সঙ্গে, পরিচিত হই তাঁদের অনিঃশেষ কান্নার সঙ্গে। পাশাপাশি দেখি খুনি দুজনের মনস্তাপ। সম্প্রীতি-প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দুই মহিলার একজনের ভাঙা ঘর মেরামত করা হয়। অন্য মহিলার খেতের ফসল কেটে আনতে সাহায্য করা হয়। ঘাতক দুই পুরুষও তাতে অংশ নেয়। এভাবে একধরনের আদান-প্রদানের আবহ সৃষ্টি হয়, সামাজিকভাবে ওঠাবসা শুরু হয়। অবশেষে মুখোমুখি উপস্থিত হয় ঘাতক ও তার শিকার। তারা উভয়েই খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী। যিশুর ক্ষমাবোধের সঙ্গে তারা পরিচিত। শেষ পর্যন্ত সেই ক্ষমতাবোধই তাদের দ্বিধার শেষ দেয়াল ডিঙাতে সাহায্য করে।
আমি জানি না এ তথ্যচিত্র থেকে আমাদের শেখার বা জানার কিছু আছে কি না। একাত্তরের ঘাতক ও দালালদের সরকারিভাবে সাধারণ ক্ষমা করা হয়েছিল, কিন্তু সে ক্ষমা ঘোষণার আগে আমাদের মতামত কেউ চায়নি। ক্ষমাপ্রাপ্ত সেসব ঘাতকের মনস্তাপের কথাও আমরা শুনিনি। আমরা, আমি নিজেও বরাবর ঘাতক ও খুনেদের প্রতি আমাদের অনিঃশেষ ঘৃণার কথাই বলে এসেছি। সারা পৃথিবীও যদি ক্ষমা করে, আমরা তাদের ক্ষমা করব না, এমন কথাও বলেছি।
কিন্তু তারপর? তারপর কী?
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments