নির্বাচন-সন্ধিক্ষণে ব্রিটেনের রাজনীতি by টনি উড
৬ মের নির্বাচন ব্রিটিশ রাজনীতিতে একটি সন্ধিক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। দীর্ঘ ১৩ বছর ক্ষমতায় থাকার পর নিউ লেবারের অর্থনৈতিক মডেল আজ বিধ্বস্ত। কিন্তু হিসাব চুকানোর কাজটি ভোটের পর পর্যন্ত বিলম্বিত হবে। ‘স্বাভাবিকতা’ বজায় রাখার উদ্দেশ্যে সরকারের নানা পদক্ষেপ যেমন—ব্যাংক বেইল আউট,
সম্পদের নিশ্চয়তা ও ‘পরিমাণগত স্বস্তিবিধান’-এর জন্য ৯৫০ বিলিয়ন পাউন্ড প্রদান সরকারি অর্থসংস্থানের ক্ষেত্রে এক বিরাট শূন্যতা তৈরি করেছে। বর্তমান ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে জিডিপির ১২ দশমিক ৮ শতাংশ। এই পরিমাণ গ্রিসের থেকে বেশি। আর আগামী বছর নাগাদ সরকারি ঋণের পরিমাণ জিডিপির ৮২ শতাংশে পৌঁছাবে। ২০০৯ সালের শেষে বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। বর্তমান সময় কৌতূহলোদ্দীক এক কালান্তরের সন্ধিক্ষণ। ব্লেয়ার/ব্রাউন মডেল নিয়ে সন্দেহ দানা বেঁধেছে। আর্থিক বাজার খুলে দেওয়ার যে পথ নিউ লেবার এত দিন অনুসরণ করেছে, সেই পথ এখন আর খোলা নেই। তবে এর বদলে কী ধরনের পরিবর্তন আসবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে দেখলে, ক্ষমতায় থাকাকালীন নিউ লেবারের মুখ্য বৈশিষ্ট্যগুলো কী ছিল? প্রথমত, সরকারের মেয়াদ: নব্বইয়ের দশকে যেসব তৃতীয় পন্থার সরকার ক্ষমতাসীন হয়, তাদের সবাইকে ছাপিয়ে গেছে লেবার। দ্বিতীয়ত, মুক্তবাজার-ব্যবস্থাকে সর্বান্তঃকরণে আলিঙ্গন: ইউরোপীয় অনুরূপ দলগুলোর চেয়ে লেবার এ ক্ষেত্রে অনেক উদার ও উৎসাহী। তবে সবচেয়ে স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্য ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের ধারাবাহিক সামরিক আগ্রাসনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে কাজ করা: এ ক্ষেত্রে লেবার জার্মানির এসপিডিকেই শুধু ছাড়িয়ে যায়নি, ছাড়িয়ে গেছে ফ্রান্স, ইতালি, স্পেনের মধ্য ডানপন্থী সরকারগুলোকেও। তা ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে নির্যাতন ও নিপীড়নের রাস্তা দেখিয়েছে নিউ লেবার।
নিউ লেবারের এমন দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার পেছনে অনেকাংশে ভূমিকা রেখেছে কনজারভেটিভ পার্টির নজিরবিহীন অনুজ্জ্বল উপস্থিতি।
প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কনজারভেটিভরা না থাকা যেমন লেবারের আধিপত্যের নেতিবাচক ভিত্তি তৈরি করেছে, তেমনি মেজরের সরকারের অধীনে যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি শুরু হয়, তার থেকে আসে ইতিবাচক ভিত্তি। এই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ডাউনিং স্ট্রিট সুবিধা পেতে থাকে। এই সময়ে জনগণের তাৎপর্যপূর্ণ একটি অংশের পরোক্ষ সমর্থন লেবারের প্রতি এভাবে নিশ্চিত হয়। অন্যদিকে বাকি অংশের কাছ থেকে শক্ত কোনো চ্যালেঞ্জের মুখেও পড়তে হয়নি। পূর্ববর্তী কনজারভেটিভ সরকারের অর্থনৈতিক উত্তরাধিকারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার সঙ্গে নিউ লেবারের মতাদর্শিক চরিত্রের নির্ধারকগুলো অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নয়া উদারবাদী ব্যবস্থার সঙ্গে ইউরোপের অন্য সব মধ্য বামপন্থী দলের চেয়ে লেবারের সম্পর্ক অনেক বেশি প্রত্যক্ষ।
সাধারণ নির্বাচনের আগে আগে নিউ লেবারের সমর্থকেরা দলের সমর্থনে নানা যুক্তি দাঁড় করাচ্ছেন। সবকিছুর পরও লেবারকে ভোট দেওয়ার জন্য যেসব যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, সেগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম যুক্তি হলো: লেবারের রেকর্ড আসলে ভালো, কিন্তু শুধু সাফল্যগাথা প্রচারে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। দ্বিতীয় যুক্তি হলো: লেবার পার্টির স্বাতন্ত্র্যসূচক সামাজিক-গণতান্ত্রিক অবস্থানে ফিরতে হলে ক্ষমতায় লেবারের অবস্থান দীর্ঘতর করাই একমাত্র রাস্তা। তৃতীয় যুক্তিটি হলো: ব্লেয়ার ও ব্রাউন যতটাই খারাপ হোন না কেন, কনজারভেটিভ তার চেয়েও খারাপ।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নিউ লেবারের সবচেয়ে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এর উদ্দীপনাময় যুদ্ধবাজ অবস্থান। পূর্বসূরি কনজারভেটিভদের থেকে পার্থক্যের সবচেয়ে স্পষ্ট জায়গাও এটা। মেজর সরকারের বড় সময়জুড়ে বৈদেশিক নীতি ছিল উত্তর আমেরিকার দেশগুলোর সঙ্গে রীতিমাফিক সহযোগিতার। তারা নির্দ্বিধায় প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল এবং ১৯৯৬ সালে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলার সহযাত্রী হয়েছিল। কিন্তু ক্লিনটন প্রশাসনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল শীতল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হার্ড ও রিফকিন্ড উভয়েই বসনিয়ায় যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি এবং সার্ব আস্তানায় বোমাবর্ষণের বিষয়ে আপত্তি তুলেছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যিক অভিলাষের শুধু অনুসারী হয়ে না থেকে ব্লেয়ার এর সক্রিয় সমর্থক হয়ে ওঠেন। নয়-এগারোর পর বুশের রিক্রুটিং সার্জেন্টের ভূমিকায় নামেন ব্লেয়ার। আফগানিস্তানে হামলা চালানোর জন্য সমর্থক জোগাড় করতে মাত্র দুই মাসে ৫০ হাজার মাইল পাড়ি জমান। আফগানিস্তানে ৪০টি দেশ থেকে সেনা মোতায়েন করার বন্দোবস্তের কৃতিত্ব অনেকাংশে নিউ লেবারের। ব্রিটিশ গোয়েন্দারা বন্দী নির্যাতনে আমেরিকানদের বলিষ্ঠ সহায়তা দিয়েছে, গুয়ানতানামোতে ব্রিটিশ নাগরিকদের পাঠানো নিয়েও কোনো আপত্তি তোলা হয়নি।
ব্রিটিশ রাষ্ট্র ঐতিহ্যগতভাবে বৈদেশিক বিষয়াবলিকে অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছে—উত্তর-সাম্রাজ্যিক সময়ে অধিপতির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করার মাধ্যমে ব্রিটেনের সাম্রাজ্যিক মহত্ত্ব জারি রাখার অভিলাষ বা বৈশ্বিক মর্যাদা বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা আছে। কিন্তু আগের কনজারভেটিভ বা লেবার সরকারগুলো সার্বভৌম নীতি প্রণয়নের জন্য একটি সীমা রক্ষা করত। উইলসন ভিয়েতনামে ব্রিটিশ সেনা পাঠাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন; ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় হিথ যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীকে আকাশসীমা ব্যবহারের অনুমতি দেননি; আমেরিকার পরামর্শ না শুনে থ্যাচার আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন; যুগোস্লাভিয়া প্রশ্নে মেজর সামনের সারিতে ছিলেন না। নিউ লেবার এই পথ পরিহার করল। ব্লেয়ার সরকার নজিরবিহীন অতি-অধীনস্থ ভূমিকায় নামল। অবশ্য এই পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করে স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর একাধিপত্যিক বৈশ্বিক পরিস্থিতি। পাশাপাশি দলের ভেতর ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রভাবও কমতে থাকে। দলের ‘আধুনিকায়ন’ তাদের দুর্বল করে দেয়।
লেবারের পৌরোহিত্যে সিয়েরা লিয়ন, যুগোস্লাভিয়া, আফগানিস্তান ও ইরাকে যুদ্ধের সময়ে হত্যার শিকার হওয়া বেসামরিক ব্যক্তিদের পুরো সংখ্যা কখনো জানা যাবে না, কিন্তু সম্ভবত তা সাড়ে সাত লাখের মতো; লেবারকে বিদায় জানানোর জন্য এই একটি কারণই যথেষ্ট।
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লেবারের আগ্রাসী সহনেতৃত্বের প্রতিফলন অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও পড়েছে। টুইন টাওয়ার হামলার পর নাগরিক স্বাধীনতার ওপর একের পর এক আঘাত আসতে থাকে। ব্রিটিশ ও বিদেশি মুসলমানদের অনেক বেশি নজরদারি ও সন্দেহের চোখে দেখা শুরু হয়। লেবারের বিদেশনীতির কারণেই ছোট ছোট অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়, কিছুদিন আগেও যাদের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এসব মোকাবিলায় সরকার যথারীতি শাস্তিমূলক আইনের ওপরই জোর দেয়।
লক্ষণীয় যে ব্রিটিশ ভোটাররা নিউ লেবারের প্রতি অপছন্দের মনোভাব দেখালেও কনজারভেটিভদের প্রতি প্রবল উৎসাহও দেখাননি। যাঁরা লেবারকে কম মন্দ মনে করেন, তাঁদের বিবেচনা কতগুলো ভ্রান্ত অনুমানের ওপর দাঁড়িয়ে। প্রথমত, লেবারের প্রতি আনুগত্যের আদর্শগত সামাজিক বা রাজনৈতিক ভিত্তি আছে: এমন ধারণা এককালে যে অর্থ বহন করত, এখনকার পরিপ্রেক্ষিতে তা আর চলে না। দলটি ক্ষমতায় যাওয়ার বাসনায় নিজের যে ধরনের রূপান্তর ঘটিয়েছে, তাতে এর সত্যিকারের আধেয় এখন শূন্য হয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, নিউ লেবারকে প্রত্যাখ্যানের অর্থ কনজারভেটিভকে জেতানো: এ ক্ষেত্রে ভোটদানে বিরত থাকা, ভোট নষ্ট করা বা ছোট দলের প্রার্থীকে ভোটদান অবশ্যই সম্মানজনক বিকল্প। তৃতীয়ত, যাঁরা লেবারকে আরও একবার সুযোগ দিতে চান, তাঁরা ভুলে যান, যে ব্যবস্থায় দুই দলের মধ্যে সত্যিকারের রাজনৈতিক পার্থক্য নেই বললেই চলে, সেখানে কোনো সরকারকে অনির্দিষ্টকাল ক্ষমতায় থাকতে দেওয়া উচিত নয়। তা করা হলে তাদের দুর্নীতি উদ্দাম হয়ে ওঠে। একদফা বিরোধী দলে থাকা ক্ষমতাসীন দলের জন্যই উপকারী হয়।
নিউ লেবারের বিরুদ্ধে প্রধান যুক্তি একটি সরল গণতান্ত্রিক নীতির প্রশ্ন। যদি ভোটের মাধ্যমে জনগণের কাছে জবাবদিহি কোনো অর্থ বহন করে, তাহলে এতটাই খারাপ রেকর্ডধারী সরকারের ভোটের মাধ্যমে শাস্তিই প্রাপ্য।
নিউ লেফট রিভিউ থেকে নেওয়া। সংক্ষেপিত রূপান্তর: আহসান হাবীব
টনি উড: নিউ লেফট রিভিউয়ের ডেপুটি এডিটর।
No comments