বিচারপ্রক্রিয়া-অভিযোগের বোঝা কত দিন বয়ে বেড়ানো সম্ভব by মলয় ভৌমিক
সংবিধান নাগরিকের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করেছে। কিন্তু বিচারের নামে দীর্ঘসূত্রতা ও চরম ভোগান্তির হাত থেকে সাধারণ নাগরিককে রক্ষার কার্যকর পন্থা আজও বের করা যায়নি। মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষই নিঃস্ব হয়ে গেছে—এমন ঘটনা এখন আর বিরল নয়।
প্রবাদ আছে, ‘বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা আর পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা’। এ প্রবাদটির সাম্প্রতিক সংস্করণ হলো, ‘বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা আর মামলায় ছুঁলে বাহাত্তর ঘা’। মানুষের চলমান জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ এসব উক্তিকে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বা ‘অবমাননাকর’ উক্তির ভয় দেখিয়ে ঠেকানো যাবে না; মানুষ তাদের মতো করেই ভাববে। নানা অন্যায়-অনিয়মের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য মানুষ আদালতের আশ্রয়ে যায়। কিন্তু আদালতপাড়ার অকথনীয় অব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত গজালের মতো তাদের বুকের মধ্যে এমনভাবে ঢুকে পড়ে যে নিঃশ্বাস বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত তাকে আর টেনে বের করা যায় না। আদালতপাড়ার এ চরম নৈরাজ্যিক অবস্থা কিন্তু এবার খোদ দেশের সর্বোচ্চ আদালত তথা বিচারব্যবস্থাকেই ধাক্কা মেরে বসল। সম্প্রতি ১৭ অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগ এবং তাঁদের মধ্যে ১৫ জনের শপথ গ্রহণের বিষয়টিকে কেন্দ্র করে যে ‘বিতর্ক’ জমে উঠেছে, তার মধ্যেই রয়ে গেছে এই ধাক্কা মারার ঘটনা। এবং ঘটনাটি মানুষের কর্মজীবনের প্রায় পুরোটা জুড়ে অভিযোগ ঘাড়ে বয়ে চলার অসংখ্য ঘটনার একটি উল্লেখযোগ্য নজির হওয়া সত্ত্বেও তা কারও নজরে এসেছে বলে মনে হয় না।
এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ১৭ জন অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগদানের পর তাঁদের দুজনের ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন এবং বিএনপি ও জামায়াতপন্থী আইনজীবীরা আপত্তি উত্থাপন করেন। এ আপত্তির মুখে গত ১৮ এপ্রিল ১৭ অতিরিক্ত বিচারকের মধ্য থেকে শপথ গ্রহণ করেন ১৫ জন। বাকি দুজনের বিষয়টি এখনো আটকে আছে। আইনজীবীদের একাংশ এখন বলছে, ওই দুই বিচারককে শপথবাক্য পাঠ করানো হলে তাঁরা আন্দোলনে যাবেন। অন্য অংশ বলছে, রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেওয়ার পর এভাবে শপথ না করানোর রেওয়াজ নেই। এদিকে বিচারক বাছাইপ্রক্রিয়া এবং দুজনকে শপথ গ্রহণ করানোর সিদ্ধান্তকে ঘিরে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আপিল বিভাগের মতানৈক্য হয়েছে বলেও জানা যাচ্ছে। সম্ভবত সে কারণে আপিল বিভাগের অনেক বিচারক শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থেকেছেন। ঘটনার পক্ষে-বিপক্ষে বিস্তর লেখালেখি ও কথাবার্তা হচ্ছে। কিন্তু সেসব বিষয় নিয়ে এ লেখা নয়। শপথ না নেওয়া দুই বিচারকের যোগ্যতা-অযোগ্যতা বা তাঁদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের পক্ষে বা বিপক্ষেও কিছু বলার নেই। তবে যা বলার আছে তার সঙ্গে ওই ১৭ অতিরিক্ত বিচারকের একজনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও ভোগান্তির কথা উঠে এলেও তা আসবে সামগ্রিক অবস্থার একটি নমুনা-ঘটনা হিসেবে; তাঁকে কেন্দ্র করে নয়।
যে দুজন অতিরিক্ত বিচারক শপথ নেননি, তাঁদের একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, তিনি একটি ফৌজদারি মামলার আসামি (যদিও গত ৮ এপ্রিল তাঁকে ওই মামলার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়)। মামলাটি একটি হত্যা মামলা। অন্যজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, তিনি সর্বোচ্চ আদালতের ফটকে লাথি মারছেন—এমন একটি ছবি সংবাদপত্রের পাতায় ছাপা হয়েছে। ‘অভিযুক্ত’ প্রথম ব্যক্তি রুহুল কুদ্দুস রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন এবং পরপর দুবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের (রাকসু) সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৮৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এক ছাত্র সংঘর্ষের ঘটনায় ছাত্রশিবিরের কর্মী আসলাম নিহত হন। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অন্য অনেকের সঙ্গে রুহুল কুদ্দুসকেও অভিযুক্ত করে আদালতে মামলা করা হয়।
আইন ও দীর্ঘদিনের প্রচলিত রেওয়াজ এ নিশ্চয়তা দেয় যে কোনো ব্যক্তি আদালত কর্তৃক দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাঁর সব অধিকার সংরক্ষণ করতে হবে। রুহুল কুদ্দুস আদালতে দোষী সাব্যস্ত হননি, বরং আদালত অভিযোগ থেকে তাঁকে সম্প্রতি অব্যাহতি দিয়েছেন। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগে রুহুল কুদ্দুসের বিরুদ্ধে আইনজীবীদের একাংশ অভিযোগ তুললেন কেন? কেন স্বয়ং আইনজীবীরাই আইন ও প্রচলিত রেওয়াজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেলেন? এ প্রশ্নের জবাব প্রধানত দুটি। এক. এটি দেশে প্রচলিত প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কুিসত রাজনৈতিক সংস্কৃতির ফলেই ঘটেছে এবং যা থেকে আইনজীবীদের একটি বড় অংশও মুক্ত নয়। দুই. এ ঘটনার পেছনে রয়েছে কাউকে দোষী বা নির্দোষ প্রমাণের ক্ষেত্রে এ দেশের বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতার সংস্কৃতি।
এ ক্ষেত্রে কিন্তু দ্বিতীয় কারণটিই প্রথম কারণ ঘটার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। রুহুল কুদ্দুসের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছিল ১৯৮৮ সালে। সেই থেকে ২০১০ পর্যন্ত ২২ বছর। এ দেশের বিচারব্যবস্থা দীর্ঘ ২২ বছরেও অভিযোগটির নিষ্পত্তি করতে পারেনি। অতিসম্প্রতি এর মীমাংসা হলেও দীর্ঘ ২২ বছর ধরে বিষয়টি ঝুলে থাকায় রুহুল কুদ্দুসের প্রতি সমাজের যে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তারই প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর বিরোধিতার মাধ্যমে। অথচ রুহুল কুদ্দুস এখানে অসহায়। সময়মতো আদালত বিষয়টি মিটিয়ে দিলে আজ এ ব্যাপারে অভিযোগ উত্থাপনের কোনো সুযোগ থাকত না।
রাজনীতির আরেক কদর্য খেলার প্রতিফল বিষয়ও এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য বইকি। যেকোনো ঘটনায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য তাঁদের নামে মামলা ঠুকে দেওয়ার চল এ দেশে পুরোনো। প্রকৃত অপরাধীকে ধরার চেয়ে প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার বাসনাই এতে মুখ্য হয়ে ওঠে। এমনকি দেশের বর্তমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত এ খেলার শিকার হয়েছেন ও হচ্ছেন। রুহুল কুদ্দুসের বেলায়ও যে এমনটিই ঘটেছিল, তা অন্তত ১৯৮৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার সময় যাঁরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা নিশ্চয়ই মানবেন। এ দেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার এ খেলায় ঘটনার সময় দেশের বাইরে ছিলেন, এমন ব্যক্তিকেও শিকার হতে দেখা গেছে।
সবচেয়ে যে মৌলিক প্রশ্নটি এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এবং যা নিয়ে অনেকেই ভাবেন না তা হলো, একজন সুস্থ মানুষের পক্ষে কত দিন একটি গুরুতর অভিযোগের বোঝা বয়ে বেড়ানো সম্ভব; বিশেষ করে সেই মানুষের পক্ষে, যিনি নিজে জানেন যে তিনি অপরাধী নন? অপরাধী নন, অথচ সমাজের চোখে অপরাধের দায় বয়ে বেড়াতে হচ্ছে, এমন ভুক্তভোগী ব্যক্তির মনস্তত্ত্বের ব্যাপারে কী জবাব আছে এ দেশের বিচারব্যবস্থার হাতে? আদালতের কাজ অভিযুক্ত ব্যক্তি হয় দোষী, না হয় নির্দোষ—এটা প্রমাণ করা। মাঝামাঝি অবস্থান নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এ দেশে যুগের পর যুগ এমন মাঝামাঝি অবস্থানে ঝুলে থেকে কত অসংখ্য ব্যক্তি তাঁদের স্বপ্ন-কল্পনা, সুখ-দুঃখ আর মায়া-মমতায় ঘেরা জীবন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, নিজের সন্তানসন্ততি, আত্মীয়স্বজন ও সমাজের চোখে হেয় হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, ঘুণে ধরা এ ব্যবস্থা তার খোঁজ রাখছে কি? সংবিধান বর্ণিত নাগরিক অধিকারের চিত্র কি এমনটাই? এমন দুঃসহ অবস্থায় ব্যক্তির স্বাধীন বিকাশই শুধু ব্যাহত হচ্ছে না, সমাজ ও রাষ্ট্রও ওই ব্যক্তির সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বিচারপ্রক্রিয়ার এ অস্বাভাবিক দীর্ঘসূত্রতা যাঁরা নিরপরাধ ব্যক্তির পাশে দাঁড়াতে চান, তাঁদেরও চরম মানসিক নির্যাতনের মধ্যে ঠেলে দেয়। এ ক্ষেত্রে উল্লিখিত রুহুল কুদ্দুসকে ঘিরে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরতে হচ্ছে। কিছুটা বিব্রতবোধ করা সত্ত্বেও বিষয়টি ব্যক্তিক নয়, এ বিবেচনায় তা তুলে ধরতে হলো। রুহুল কুদ্দুসের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাটি দায়ের হয় ১৯৮৮ সালে। ১৯৮৯ সালে রুহুল কুদ্দুস যখন রাকসুর জিএস, তখন তিনিসহ অন্য অভিযুক্তরা জামিনের জন্য রাজশাহীর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দাঁড়ান। এ মামলায় আসামিপক্ষের আইনজীবী ছিলেন সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ট্রাইব্যুনালের সরকারপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি গোলাম আরিফ। তিনি আমাকে ফোনে জানালেন, প্রয়োজনে জামিনের পক্ষে কথা বলার জন্য আদালতে একজন শিক্ষক থাকলে ভালো হয়—‘তুমি আদালতে চলে এসো।’ কোনো ছাত্র নিরপরাধ বিবেচিত হলে তাঁর পাশে দাঁড়ানো একজন শিক্ষকের নৈতিক দায়িত্ব (যেকোনো নাগরিকের জন্যও তাই), এই বিবেকবোধ থেকে সেদিন আমি আদালতে গিয়েছিলাম। রুহুল কুদ্দুসসহ অনেকের জামিনও হয়েছিল। কিন্তু আমি যে একজন নিরপরাধ ছাত্রের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম, তা ২২ বছরেও প্রমাণ করার সুযোগ হয়নি এ দেশের বিচারব্যবস্থার কারণে। মামলাটি রাজনৈতিক হওয়ায় নানা অপপ্রচার গত ২২ বছর ধরে শাখা-প্রশাখা গজিয়েছে। সন্দেহ দানা বেঁধেছে অভিযুক্ত রুহুল কুদ্দুস এবং আমরা যাঁরা তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলাম, তাঁদের ঘিরে। ফলে মানসিক পীড়ন বয়ে বেড়াতে হয়েছে দীর্ঘকাল ধরে। আর এটা ঘটেছে এ দেশের বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতার কারণেই।
শুধু অভিযুক্ত ব্যক্তি আর তাঁদের শুভাকাঙ্ক্ষীই নন, আজ বিচার বিভাগের এ অব্যবস্থা উচ্চ আদালতকেও স্পর্শ করল। কী জবাব দেবেন উচ্চ আদালত? এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার পথ কি কখনোই মিলবে না?
মলয় ভৌমিক: শিক্ষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; নাট্যকার।
এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ১৭ জন অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগদানের পর তাঁদের দুজনের ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন এবং বিএনপি ও জামায়াতপন্থী আইনজীবীরা আপত্তি উত্থাপন করেন। এ আপত্তির মুখে গত ১৮ এপ্রিল ১৭ অতিরিক্ত বিচারকের মধ্য থেকে শপথ গ্রহণ করেন ১৫ জন। বাকি দুজনের বিষয়টি এখনো আটকে আছে। আইনজীবীদের একাংশ এখন বলছে, ওই দুই বিচারককে শপথবাক্য পাঠ করানো হলে তাঁরা আন্দোলনে যাবেন। অন্য অংশ বলছে, রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেওয়ার পর এভাবে শপথ না করানোর রেওয়াজ নেই। এদিকে বিচারক বাছাইপ্রক্রিয়া এবং দুজনকে শপথ গ্রহণ করানোর সিদ্ধান্তকে ঘিরে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আপিল বিভাগের মতানৈক্য হয়েছে বলেও জানা যাচ্ছে। সম্ভবত সে কারণে আপিল বিভাগের অনেক বিচারক শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থেকেছেন। ঘটনার পক্ষে-বিপক্ষে বিস্তর লেখালেখি ও কথাবার্তা হচ্ছে। কিন্তু সেসব বিষয় নিয়ে এ লেখা নয়। শপথ না নেওয়া দুই বিচারকের যোগ্যতা-অযোগ্যতা বা তাঁদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের পক্ষে বা বিপক্ষেও কিছু বলার নেই। তবে যা বলার আছে তার সঙ্গে ওই ১৭ অতিরিক্ত বিচারকের একজনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও ভোগান্তির কথা উঠে এলেও তা আসবে সামগ্রিক অবস্থার একটি নমুনা-ঘটনা হিসেবে; তাঁকে কেন্দ্র করে নয়।
যে দুজন অতিরিক্ত বিচারক শপথ নেননি, তাঁদের একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, তিনি একটি ফৌজদারি মামলার আসামি (যদিও গত ৮ এপ্রিল তাঁকে ওই মামলার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়)। মামলাটি একটি হত্যা মামলা। অন্যজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, তিনি সর্বোচ্চ আদালতের ফটকে লাথি মারছেন—এমন একটি ছবি সংবাদপত্রের পাতায় ছাপা হয়েছে। ‘অভিযুক্ত’ প্রথম ব্যক্তি রুহুল কুদ্দুস রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন এবং পরপর দুবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের (রাকসু) সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৮৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এক ছাত্র সংঘর্ষের ঘটনায় ছাত্রশিবিরের কর্মী আসলাম নিহত হন। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অন্য অনেকের সঙ্গে রুহুল কুদ্দুসকেও অভিযুক্ত করে আদালতে মামলা করা হয়।
আইন ও দীর্ঘদিনের প্রচলিত রেওয়াজ এ নিশ্চয়তা দেয় যে কোনো ব্যক্তি আদালত কর্তৃক দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাঁর সব অধিকার সংরক্ষণ করতে হবে। রুহুল কুদ্দুস আদালতে দোষী সাব্যস্ত হননি, বরং আদালত অভিযোগ থেকে তাঁকে সম্প্রতি অব্যাহতি দিয়েছেন। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগে রুহুল কুদ্দুসের বিরুদ্ধে আইনজীবীদের একাংশ অভিযোগ তুললেন কেন? কেন স্বয়ং আইনজীবীরাই আইন ও প্রচলিত রেওয়াজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেলেন? এ প্রশ্নের জবাব প্রধানত দুটি। এক. এটি দেশে প্রচলিত প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কুিসত রাজনৈতিক সংস্কৃতির ফলেই ঘটেছে এবং যা থেকে আইনজীবীদের একটি বড় অংশও মুক্ত নয়। দুই. এ ঘটনার পেছনে রয়েছে কাউকে দোষী বা নির্দোষ প্রমাণের ক্ষেত্রে এ দেশের বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতার সংস্কৃতি।
এ ক্ষেত্রে কিন্তু দ্বিতীয় কারণটিই প্রথম কারণ ঘটার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। রুহুল কুদ্দুসের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছিল ১৯৮৮ সালে। সেই থেকে ২০১০ পর্যন্ত ২২ বছর। এ দেশের বিচারব্যবস্থা দীর্ঘ ২২ বছরেও অভিযোগটির নিষ্পত্তি করতে পারেনি। অতিসম্প্রতি এর মীমাংসা হলেও দীর্ঘ ২২ বছর ধরে বিষয়টি ঝুলে থাকায় রুহুল কুদ্দুসের প্রতি সমাজের যে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তারই প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর বিরোধিতার মাধ্যমে। অথচ রুহুল কুদ্দুস এখানে অসহায়। সময়মতো আদালত বিষয়টি মিটিয়ে দিলে আজ এ ব্যাপারে অভিযোগ উত্থাপনের কোনো সুযোগ থাকত না।
রাজনীতির আরেক কদর্য খেলার প্রতিফল বিষয়ও এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য বইকি। যেকোনো ঘটনায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য তাঁদের নামে মামলা ঠুকে দেওয়ার চল এ দেশে পুরোনো। প্রকৃত অপরাধীকে ধরার চেয়ে প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার বাসনাই এতে মুখ্য হয়ে ওঠে। এমনকি দেশের বর্তমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত এ খেলার শিকার হয়েছেন ও হচ্ছেন। রুহুল কুদ্দুসের বেলায়ও যে এমনটিই ঘটেছিল, তা অন্তত ১৯৮৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার সময় যাঁরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা নিশ্চয়ই মানবেন। এ দেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার এ খেলায় ঘটনার সময় দেশের বাইরে ছিলেন, এমন ব্যক্তিকেও শিকার হতে দেখা গেছে।
সবচেয়ে যে মৌলিক প্রশ্নটি এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এবং যা নিয়ে অনেকেই ভাবেন না তা হলো, একজন সুস্থ মানুষের পক্ষে কত দিন একটি গুরুতর অভিযোগের বোঝা বয়ে বেড়ানো সম্ভব; বিশেষ করে সেই মানুষের পক্ষে, যিনি নিজে জানেন যে তিনি অপরাধী নন? অপরাধী নন, অথচ সমাজের চোখে অপরাধের দায় বয়ে বেড়াতে হচ্ছে, এমন ভুক্তভোগী ব্যক্তির মনস্তত্ত্বের ব্যাপারে কী জবাব আছে এ দেশের বিচারব্যবস্থার হাতে? আদালতের কাজ অভিযুক্ত ব্যক্তি হয় দোষী, না হয় নির্দোষ—এটা প্রমাণ করা। মাঝামাঝি অবস্থান নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এ দেশে যুগের পর যুগ এমন মাঝামাঝি অবস্থানে ঝুলে থেকে কত অসংখ্য ব্যক্তি তাঁদের স্বপ্ন-কল্পনা, সুখ-দুঃখ আর মায়া-মমতায় ঘেরা জীবন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, নিজের সন্তানসন্ততি, আত্মীয়স্বজন ও সমাজের চোখে হেয় হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, ঘুণে ধরা এ ব্যবস্থা তার খোঁজ রাখছে কি? সংবিধান বর্ণিত নাগরিক অধিকারের চিত্র কি এমনটাই? এমন দুঃসহ অবস্থায় ব্যক্তির স্বাধীন বিকাশই শুধু ব্যাহত হচ্ছে না, সমাজ ও রাষ্ট্রও ওই ব্যক্তির সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বিচারপ্রক্রিয়ার এ অস্বাভাবিক দীর্ঘসূত্রতা যাঁরা নিরপরাধ ব্যক্তির পাশে দাঁড়াতে চান, তাঁদেরও চরম মানসিক নির্যাতনের মধ্যে ঠেলে দেয়। এ ক্ষেত্রে উল্লিখিত রুহুল কুদ্দুসকে ঘিরে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরতে হচ্ছে। কিছুটা বিব্রতবোধ করা সত্ত্বেও বিষয়টি ব্যক্তিক নয়, এ বিবেচনায় তা তুলে ধরতে হলো। রুহুল কুদ্দুসের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাটি দায়ের হয় ১৯৮৮ সালে। ১৯৮৯ সালে রুহুল কুদ্দুস যখন রাকসুর জিএস, তখন তিনিসহ অন্য অভিযুক্তরা জামিনের জন্য রাজশাহীর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দাঁড়ান। এ মামলায় আসামিপক্ষের আইনজীবী ছিলেন সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ট্রাইব্যুনালের সরকারপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি গোলাম আরিফ। তিনি আমাকে ফোনে জানালেন, প্রয়োজনে জামিনের পক্ষে কথা বলার জন্য আদালতে একজন শিক্ষক থাকলে ভালো হয়—‘তুমি আদালতে চলে এসো।’ কোনো ছাত্র নিরপরাধ বিবেচিত হলে তাঁর পাশে দাঁড়ানো একজন শিক্ষকের নৈতিক দায়িত্ব (যেকোনো নাগরিকের জন্যও তাই), এই বিবেকবোধ থেকে সেদিন আমি আদালতে গিয়েছিলাম। রুহুল কুদ্দুসসহ অনেকের জামিনও হয়েছিল। কিন্তু আমি যে একজন নিরপরাধ ছাত্রের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম, তা ২২ বছরেও প্রমাণ করার সুযোগ হয়নি এ দেশের বিচারব্যবস্থার কারণে। মামলাটি রাজনৈতিক হওয়ায় নানা অপপ্রচার গত ২২ বছর ধরে শাখা-প্রশাখা গজিয়েছে। সন্দেহ দানা বেঁধেছে অভিযুক্ত রুহুল কুদ্দুস এবং আমরা যাঁরা তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলাম, তাঁদের ঘিরে। ফলে মানসিক পীড়ন বয়ে বেড়াতে হয়েছে দীর্ঘকাল ধরে। আর এটা ঘটেছে এ দেশের বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতার কারণেই।
শুধু অভিযুক্ত ব্যক্তি আর তাঁদের শুভাকাঙ্ক্ষীই নন, আজ বিচার বিভাগের এ অব্যবস্থা উচ্চ আদালতকেও স্পর্শ করল। কী জবাব দেবেন উচ্চ আদালত? এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার পথ কি কখনোই মিলবে না?
মলয় ভৌমিক: শিক্ষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; নাট্যকার।
No comments