কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া জরুরি-মন্ত্রণালয়ের অযাচিত পদক্ষেপ

দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কিছু দক্ষ ও শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকার কোনো বিকল্প নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হলো এ ধরনেরই একটি সংস্থা। এ সংস্থা মুদ্রানীতি পরিচালনা ও দেশের আর্থিক খাত তদারকির দায়িত্ব পালন করে। এ দায়িত্ব পালনের সফলতা নির্ভর করে সংস্থাটিকে সরকারি প্রভাববলয় থেকে মুক্ত রেখে স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে দেওয়ার ওপর।


সে কারণেই উন্নত দেশগুলোয় তো বটেই, অনেক উন্নয়নশীল দেশেও এ ধরনের সংস্থাকে যথেষ্ট গুরুত্ব ও স্বাধীনতা-সহকারে দায়িত্ব পালনে খোদ সরকারই সহায়তা দেয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে এ চর্চার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে; বরং উল্টোটাই ঘটতে দেখা যায়। এর সর্বশেষ উদাহরণ হলো, অর্থ মন্ত্রণালয়ে ব্যাংকিং বিভাগ খুলে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণ করার সরকারি উদ্যোগ।
প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রায় সব ধরনের যুক্তি-বুদ্ধি-বাস্তবতা উপেক্ষা করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে এ বিভাগ খোলা হয়েছে। এর ফলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান তথা আর্থিক খাতের তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা স্পষ্টতই খর্ব করা হয়েছে। আশঙ্কার আরেকটি দিক হলো, এ বিভাগের মাধ্যমে আর্থিক খাতে রাজনৈতিক প্রভাব ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বেড়ে যেতে পারে, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যখন পুনর্গঠন ও সংস্কারের জন্য কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়েছে, তখন আবার মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি করা এ ব্যাংকগুলোর অর্থবহ সংস্কারকে পিছিয়ে দেবে।
বস্তুত, অর্থ মন্ত্রণালয়ের এ ধরনের কর্তৃত্ব বাড়ানোর প্রচেষ্টা অনেক দিন ধরেই লক্ষ করা যাচ্ছে। রাজস্ব নীতি অর্থ মন্ত্রণালয় দেখবে আর মুদ্রানীতি দেখবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক—এটাই অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় স্বীকৃত বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দিক থেকে মুদ্রানীতি নির্ধারণ ও পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর চাপ তৈরি করা হয়েছে। নতুন এ বিভাগের কার্যপরিধির মধ্যে মুদ্রানীতি দেখভাল করাকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ঠিক বুঝে ওঠা যাচ্ছে না যে অযাচিতভাবে এসব কাজের মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়কে কেন এত গভীরভাবে যুক্ত হতে হবে? কেন আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বাড়ানোর দিকে এত উত্সাহ?
আবার মন্ত্রণালয়ের যে এসব কাজে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, সেটা যুক্তিপূর্ণ ও জোরালোভাবে বোঝানোর দায়িত্বটিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপরই বর্তায়। বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ, ১৯৭২-এ কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বেশ খানিকটা আইনি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করার সামর্থ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই প্রদর্শন করতে হবে। সাহস, সামর্থ্য ও যোগ্যতা দিয়েই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তা বোঝাতে হবে যে তারা এ বিষয়গুলোতে যথেষ্ট দক্ষ। তবে এটা করার মানে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কোনো বিরোধে জড়িয়ে পড়া নয়। বরং মন্ত্রণালয়কে বোঝানো যে যার যা কাজ, সে তা করলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলাই আসবে। কয়েক বছর আগে ভারতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তত্কালীন অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরম একপর্যায়ে কিছুটা ক্ষিপ্ত হয়ে গণমাধ্যমে বলেছিলেন যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি সমন্বয় করতে হবে। এর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার তত্কালীন গভর্নর ভেনুগোপাল রেড্ডি গণমাধ্যমে পাল্টা বলেছিলেন, আগে অর্থমন্ত্রীর উচিত রাজস্ব নীতি সমন্বয় করা।

No comments

Powered by Blogger.