সাংস্কৃতিক পণ্য-ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানির নিষেধাজ্ঞা by মশিউলআলম
ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে—এরকম একটি খবর জাতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার পর দেশের চলচ্চিত্রশিল্পের সঙ্গে জড়িত নির্মাতা, শিল্পী ও কলাকুশলীদের মধ্যে ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেল।
২৫ এপ্রিল সকালে তাঁদের একটা বড় অংশ এফডিসিতে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে সরকারের ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানালেন। চলচ্চিত্র ঐক্য পরিষদ গঠন করে তাঁরা সিদ্ধান্তটি প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন-কর্মসূচি ঘোষণা করলেন।
সুখের বিষয়, সরকারকে কোনো আন্দোলনের মুখোমুখি হতে হলো না। চলচ্চিত্র ঐক্য পরিষদের প্রতিবাদের খবরটি যেদিন (২৬ এপ্রিল) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, সেদিনই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে চলছিল মন্ত্রিসভার বৈঠক। সে বৈঠক সূত্রের বরাতে পরদিন সংবাদপত্রে খবর ছাপা হলো, ‘ভারতীয় ছবি আসছে না: মন্ত্রিসভার বৈঠকে ভারতীয় ছবি আমদানি করা যাবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কয়েক দিন আগে বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান ভারতীয় ছবি আমদানি ও প্রদর্শনের সিদ্ধান্তের কথা জানান। এ কারণে গতকালের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বাণিজ্যমন্ত্রীর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সরকার এরকম কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বলে প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে জানান।’ (প্রথম আলো ২৭ এপিল ২০১০)
সরকারকে আন্দোলনের মুখে পড়তে হলো না, এটা ভালো কথা। কিন্তু সিদ্ধান্তটি সব অর্থেই ভালো হলো কি না—এরকম প্রশ্ন বোধ করি স্বাধীনতার ৩৯ বছর পরে তোলা যায়। কারণ স্বাধীন বাংলাদেশের এই পুরোটা সময়জুড়েই আমাদের চলচ্চিত্রশিল্প এই বিশেষ সুরক্ষা পেয়ে আসছে যে তাকে বিদেশি, বিশেষত ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে না। ১৯৭২ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের আমদানি খাত যেসব আমদানি নীতি আদেশ দ্বারা পরিচালিত হয়ে এসেছে, তার সবগুলোতেই স্পষ্ট ভাষায় লেখা ছিল: ‘উপমহাদেশের ভাষায় প্রস্তুতকৃত কোনো ছায়াছবি (সাব-টাইটেলসহ বা সাব-টাইটেল ব্যতীত) আমদানি করা যাইবে না।’ ভারতের নাম নেই, তবে উদ্দেশ্যটা যে ছিল বোম্বাই চলচ্চিত্র বা বলিউডি সিনেমার ‘আগ্রাসন’, বা সঠিক অর্থে প্রতিযোগিতা থেকে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের নবীন চলচ্চিত্রশিল্পকে মুক্ত রাখা, তা বুঝতে কষ্ট হয় না। ইংরেজি ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র সাব-টাইটেল ছাড়া এবং অন্যান্য ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র বাংলা বা ইংরেজি সাব-টাইটেলসহ আমদানি করা যাইবে—এই উপ-ধারাটিতেও বন্ধনীর মধ্যে বলে দেওয়া হয়েছে ‘উপমহাদেশের ভাষায় প্রস্তুতকৃত ছায়াছবি ব্যতীত’। অর্থাৎ হলিউড বা অন্যান্য সব দেশের সব ভাষার চলচ্চিত্রের চেয়ে বেশি ঝুঁকি অনুভব করা হয়েছে বোম্বাই চলচ্চিত্রের দিক থেকে। তা থেকে আমাদের চলচ্চিত্রকে নিশ্ছিদ্র সুরক্ষার আইনি ব্যবস্থা রাখা হয়েছে গত ৩৮ বছর ধরে।
এ বছরের জানুয়ারি মাসে গৃহীত আমদানি নীতি আদেশ ২০০৯-২০১২-এ এই ধারাটি বিলোপ করা হয়; ফলে উপমহাদেশের ভাষায় নির্মিত কোনো চলচ্চিত্র সাব-টাইটেলসহ বা সাব-টাইটেল ছাড়া আমদানি করার ক্ষেত্রে আর কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকে না। এতকাল ধরে নিশ্ছিদ্র সুরক্ষায় লালিত আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পের লোকেরা যথার্থই হুমকি দেখতে পেয়েছেন আমদানি নীতির এই পরিবর্তনে: তাঁদের প্রতিবাদ-আন্দোলনের কারণ ও যুক্তিগুলো খুব সহজেই বোঝা যায়। তাঁরা ভারতীয়, বিশেষত বলিউডি চলচ্চিত্রের ‘আগ্রাসনের’ হুমকিতে বাস্তবিক বিপণ্নতা বোধ করেছেন। সেদিক থেকে বলা যায়, এরকম সুরক্ষার প্রয়োজন ছিল।
কিন্তু এই সুরক্ষার ফল কী? প্রতিযোগিতা থেকে মুক্ত রাখার ফলে আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পের কি উন্নতি হয়েছে? ব্যবসায়িক, কারিগরি ও শিল্পমান—কোনো বিবেচনায় কি বাংলাদেশের মূলধারার চলচ্চিত্র বিকশিত হয়েছে? নাকি উল্টো পথে যেতে যেতে এ দেশের চলচ্চিত্র আজ অনেকটাই পরিত্যক্ত হতে চলেছে, বিশেষত নির্মল রুচির দর্শকদের কাছে? আজ কি কোনো ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলার পক্ষে পরিবার-পরিজন নিয়ে সিনেমা হলে যাওয়ার উপায় আছে? না, শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণী আজ আর সিনেমা হলে যেতে পারে না। সেটা শুধু সিনেমা হলের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার অভাবের কারণে নয়; নির্মল, সুস্থ বিনোদনমূলক চলচ্চিত্রের অভাবের কারণে। বাংলাদেশের মূলধারার চলচ্চিত্রে যে নিম্নরুচির প্রতিযোগিতা চলে আসছে, তা সুস্থ বিনোদন-প্রত্যাশী দর্শককে সিনেমা হল তথা দেশি চলচ্চিত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করেছে।
এখন এ দেশের দর্শকেরা তো প্রশ্ন তুলতে পারেন, সিনেমা হলে গিয়ে বড় পর্দায় বিদেশি চলচ্চিত্র উপভোগের অধিকার থেকে আমরা আর কতকাল বঞ্চিত থাকব? কী যুক্তিতে এ দেশের চলচ্চিত্র নির্মাতারা অনন্তকাল ধরে এই সুরক্ষা দাবি করে যাবেন? কোনো শিল্প যদি রাষ্ট্রের কাছে বিশেষ সুবিধা চায় এবং পায়, তবে সে রাষ্ট্রের জনগণের কাছে তার কিছু দায়বদ্ধতা অবশ্যই থাকতে হয়। আমাদের চলচ্চিত্রশিল্প কি সেই দায়বদ্ধতা বোধ করে? চলচ্চিত্র ঐক্য পরিষদের নামে যাঁরা আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, জনগণের কাছে তাঁদের দায়বদ্ধতা কোথায়? দর্শকদের প্রতি তাঁদের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার থাকা উচিত, যে-সুরক্ষা তাঁরা এত বছর ধরে পেয়ে আসছেন, এবং প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের ফলে আন্দোলন শুরু না করেই যে সুরক্ষা পাওয়া অব্যাহত থাকছে, তার বিনিময়ে তাঁরা দর্শকদের কী দেবেন। তাঁরা আর কত বছর সুরক্ষা পেলে এমন শত শত ছবি নির্মাণ করতে পারবেন, যা দেখতে বাংলাদেশের সর্বস্তরের দর্শকেরা সপরিবারে সিনেমাহলে ভীড় জমাবেন, সিনেমাহলগুলো আগের মতো জমজমাট হয়ে উঠবে? ভারত বিভাগের পর পাকিস্তানি আমলে এ দেশের মানুষ সিনেমা হলে গিয়ে দেশ-বিদেশের চলচ্চিত্র উপভোগ করেছে। ঢাকাই, পাকিস্তানি, ভারতীয়সহ বিশ্বের অনেক দেশের চলচ্চিত্র তখন একই সঙ্গে চলত। সারা বিশ্বের সেরা চলচ্চিত্রগুলো এদেশের মানুষ সিনেমা হলে গিয়ে উপভোগ করতেন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত বিশ্বের সকল দেশের চলচ্চিত্রের প্রতিযোগিতার মধ্যেই এ দেশীয় চলচ্চিত্রশিল্প গড়ে উঠেছে, বিকশিত হয়েছে।
শুধু দর্শক নয়, চলচ্চিত্রশিল্পের আরও একটি বড় পক্ষ আছে: সিনেমা হল বা প্রেক্ষাগৃহগুলোর মালিকেরা। জেলা ও মহশহরগুলোতে ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হলগুলোর দুর্দশা দেখলে এ বিষয়ে বেশি কিছু বলার প্রয়োজন পড়ে না। এমনকি খোদ রাজধানীতেই ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হলগুলোর আজ কী দশা। গুলিস্তান সিনেমা হলের জন্যই যে এলাকার নাম হয়েছে গুলিস্তান, সেখানে এখন আর এই নামে কোনো সিনেমা হল নেই। সিনেমা হল ভেঙে সেখানে নির্মিত হয়েছে বাণিজ্যিক ভবন। শ্যামলী সিনেমা হল নিশ্চিহ্ন: বহুতল বিপণিবিতান নির্মিত হচ্ছে সেখানেও। ফার্মগেটের আনন্দ ও ছন্দ সিনেমা হলের দুর্দশা অবর্ণনীয়, মধুমিতাসহ অন্যান্য হলগুলোর দশাও একই রকম। আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পের যে দশা চলছে, সেভাবেই যদি চলতে থাকে, তাহলে এসব কোনো সিনেমা হলের পক্ষেই টিকে থাকা সম্ভব হবে না। অচিরেই হয়তো সেসব স্থানে গড়ে উঠবে বাণিজ্যিক ভবন। সিনেমা হলের সংখ্যা খুব দ্রুত গতিতে কমে যাচ্ছে; ২০০০ সালে দেশে মোট সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল ১৬০০; দশ বছরের মধ্যে তা কমে গিয়ে নেমে এসেছে ৬০০ তে।
চলচ্চিত্রশিল্পের নির্মাতা, শিল্পী-কলাকুশলী ও অর্থলগ্নিকারীরা যদি এমন চলচ্চিত্র তৈরি অব্যাহত রাখেন, যা বিপুলসংখ্যক দর্শককে আকৃষ্ট করতে পারে না, তাহলে সিনেমাহলগুলো ব্যবসায়িকভাবে অলাভজনক, এমনকি লোকসানি প্রতিষ্ঠান হয়ে পড়বে। হলের মালিকেরা উপায়ন্তর না দেখে হলগুলোর জায়গায় এমন কিছু করবেন, যা তাঁদের বেশি মুনাফা জোগাবে, এটাই বাস্তবতা; চলচ্চিত্রশিল্পকে কোনো সুরক্ষা দিয়েই এ বাস্তবতা বদলানো যাবে না। রুচিসম্মত ভালো চলচ্চিত্র নির্মিত না হলে দর্শক সিনেমা হলে যাবে না, আর দর্শক না গেলে সিনেমাহলগুলো লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। ধীরে ধীরে সেগুলো ভেঙে ফেলা হবে। একটা সময় আসবে, যখন দেশে আর কোনো সিনেমা হলই থাকবে না। তাহলে, শেষ পর্যন্ত যদি সিনেমা হলগুলোই একে একে উঠে যায়, তবে চলচ্চিত্র নির্মাতারা কোথায় সেগুলো প্রদর্শন করবেন? তখন কি হল মালিকদের মতো চলচ্চিত্রের প্রযোজকেরাও অন্য ব্যবসার পথ খুঁজবেন না? তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াবে? প্রতিযোগিতাহীন নিরঙ্কুশ সুরক্ষার মধ্যে থেকে তিলে তিলে আত্মহত্যা?
কিন্তু মানুষ এখনো সিনেমা হলে গিয়ে বড় পর্দায় চলচ্চিত্র উপভোগ করতে চায়। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে কয়েকটি ভালো চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে (এফডিসিকেন্দ্রিক মূলধারার চলচ্চিত্রের বাইরে); সেগুলো দেখার জন্য বিপুলসংখ্যক মানুষ সিনেমা হলে যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের মূলধারা এটা এখনো নয়, হাতে গোনা এই ছবিগুলো সারা দেশের সিনেমা হলগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। চলচ্চিত্রশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে নির্মল বিনোদনের চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে—এর কোনো বিকল্পই নেই।
আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পের দুর্দশার কারণগুলো কী, তা খতিয়ে দেখা খুবই দরকার। যাঁরা এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত, কাজটা মূলত তাঁদেরই। টিকে থাকতে হলে বিকশিত হতে হয়; আমাদের চলচ্চিত্রশিল্প বিকশিত হয়নি, সামগ্রিক অর্থে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। প্রতিযোগিতাহীন নিরঙ্কুশ সুরক্ষা এর অন্যতম কারণ বলে মনে হয়। কিন্তু এই ক্ষয় অব্যাহত থাকলে পুরো চলচ্চিত্রশিল্প বিলুপ্ত হতে বেশি সময় লাগবে না।
বিদেশি চলচ্চিত্র আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তা করার সময় এসেছে। কারণ এই নিষেধাজ্ঞার ফলে দেশের চলচ্চিত্রশিল্প বিকশিত না হয়ে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে হতে বিলুপ্তির দিকে এগোলে বিষয়টি হবে শেষবিচারে আত্মঘাতী। এখন সীমিত পরিসরে (হলগুলো মোট প্রদর্শন দিবসের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বিদেশি চলচ্চিত্র প্রদর্শন করতে পারবে এমন শর্তে) আমদানির সুযোগ দেওয়া যায় কিনা তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। এতে যে প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি হবে, তার ফলে এ দেশের চলচ্চিত্র নির্মার্তাদের টিকে থাকার স্বার্থেই ভালো ছবি নির্মাণে তৎপর হতে হবে।
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
সুখের বিষয়, সরকারকে কোনো আন্দোলনের মুখোমুখি হতে হলো না। চলচ্চিত্র ঐক্য পরিষদের প্রতিবাদের খবরটি যেদিন (২৬ এপ্রিল) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, সেদিনই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে চলছিল মন্ত্রিসভার বৈঠক। সে বৈঠক সূত্রের বরাতে পরদিন সংবাদপত্রে খবর ছাপা হলো, ‘ভারতীয় ছবি আসছে না: মন্ত্রিসভার বৈঠকে ভারতীয় ছবি আমদানি করা যাবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কয়েক দিন আগে বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান ভারতীয় ছবি আমদানি ও প্রদর্শনের সিদ্ধান্তের কথা জানান। এ কারণে গতকালের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বাণিজ্যমন্ত্রীর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সরকার এরকম কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বলে প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে জানান।’ (প্রথম আলো ২৭ এপিল ২০১০)
সরকারকে আন্দোলনের মুখে পড়তে হলো না, এটা ভালো কথা। কিন্তু সিদ্ধান্তটি সব অর্থেই ভালো হলো কি না—এরকম প্রশ্ন বোধ করি স্বাধীনতার ৩৯ বছর পরে তোলা যায়। কারণ স্বাধীন বাংলাদেশের এই পুরোটা সময়জুড়েই আমাদের চলচ্চিত্রশিল্প এই বিশেষ সুরক্ষা পেয়ে আসছে যে তাকে বিদেশি, বিশেষত ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে না। ১৯৭২ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের আমদানি খাত যেসব আমদানি নীতি আদেশ দ্বারা পরিচালিত হয়ে এসেছে, তার সবগুলোতেই স্পষ্ট ভাষায় লেখা ছিল: ‘উপমহাদেশের ভাষায় প্রস্তুতকৃত কোনো ছায়াছবি (সাব-টাইটেলসহ বা সাব-টাইটেল ব্যতীত) আমদানি করা যাইবে না।’ ভারতের নাম নেই, তবে উদ্দেশ্যটা যে ছিল বোম্বাই চলচ্চিত্র বা বলিউডি সিনেমার ‘আগ্রাসন’, বা সঠিক অর্থে প্রতিযোগিতা থেকে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের নবীন চলচ্চিত্রশিল্পকে মুক্ত রাখা, তা বুঝতে কষ্ট হয় না। ইংরেজি ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র সাব-টাইটেল ছাড়া এবং অন্যান্য ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র বাংলা বা ইংরেজি সাব-টাইটেলসহ আমদানি করা যাইবে—এই উপ-ধারাটিতেও বন্ধনীর মধ্যে বলে দেওয়া হয়েছে ‘উপমহাদেশের ভাষায় প্রস্তুতকৃত ছায়াছবি ব্যতীত’। অর্থাৎ হলিউড বা অন্যান্য সব দেশের সব ভাষার চলচ্চিত্রের চেয়ে বেশি ঝুঁকি অনুভব করা হয়েছে বোম্বাই চলচ্চিত্রের দিক থেকে। তা থেকে আমাদের চলচ্চিত্রকে নিশ্ছিদ্র সুরক্ষার আইনি ব্যবস্থা রাখা হয়েছে গত ৩৮ বছর ধরে।
এ বছরের জানুয়ারি মাসে গৃহীত আমদানি নীতি আদেশ ২০০৯-২০১২-এ এই ধারাটি বিলোপ করা হয়; ফলে উপমহাদেশের ভাষায় নির্মিত কোনো চলচ্চিত্র সাব-টাইটেলসহ বা সাব-টাইটেল ছাড়া আমদানি করার ক্ষেত্রে আর কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকে না। এতকাল ধরে নিশ্ছিদ্র সুরক্ষায় লালিত আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পের লোকেরা যথার্থই হুমকি দেখতে পেয়েছেন আমদানি নীতির এই পরিবর্তনে: তাঁদের প্রতিবাদ-আন্দোলনের কারণ ও যুক্তিগুলো খুব সহজেই বোঝা যায়। তাঁরা ভারতীয়, বিশেষত বলিউডি চলচ্চিত্রের ‘আগ্রাসনের’ হুমকিতে বাস্তবিক বিপণ্নতা বোধ করেছেন। সেদিক থেকে বলা যায়, এরকম সুরক্ষার প্রয়োজন ছিল।
কিন্তু এই সুরক্ষার ফল কী? প্রতিযোগিতা থেকে মুক্ত রাখার ফলে আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পের কি উন্নতি হয়েছে? ব্যবসায়িক, কারিগরি ও শিল্পমান—কোনো বিবেচনায় কি বাংলাদেশের মূলধারার চলচ্চিত্র বিকশিত হয়েছে? নাকি উল্টো পথে যেতে যেতে এ দেশের চলচ্চিত্র আজ অনেকটাই পরিত্যক্ত হতে চলেছে, বিশেষত নির্মল রুচির দর্শকদের কাছে? আজ কি কোনো ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলার পক্ষে পরিবার-পরিজন নিয়ে সিনেমা হলে যাওয়ার উপায় আছে? না, শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণী আজ আর সিনেমা হলে যেতে পারে না। সেটা শুধু সিনেমা হলের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার অভাবের কারণে নয়; নির্মল, সুস্থ বিনোদনমূলক চলচ্চিত্রের অভাবের কারণে। বাংলাদেশের মূলধারার চলচ্চিত্রে যে নিম্নরুচির প্রতিযোগিতা চলে আসছে, তা সুস্থ বিনোদন-প্রত্যাশী দর্শককে সিনেমা হল তথা দেশি চলচ্চিত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করেছে।
এখন এ দেশের দর্শকেরা তো প্রশ্ন তুলতে পারেন, সিনেমা হলে গিয়ে বড় পর্দায় বিদেশি চলচ্চিত্র উপভোগের অধিকার থেকে আমরা আর কতকাল বঞ্চিত থাকব? কী যুক্তিতে এ দেশের চলচ্চিত্র নির্মাতারা অনন্তকাল ধরে এই সুরক্ষা দাবি করে যাবেন? কোনো শিল্প যদি রাষ্ট্রের কাছে বিশেষ সুবিধা চায় এবং পায়, তবে সে রাষ্ট্রের জনগণের কাছে তার কিছু দায়বদ্ধতা অবশ্যই থাকতে হয়। আমাদের চলচ্চিত্রশিল্প কি সেই দায়বদ্ধতা বোধ করে? চলচ্চিত্র ঐক্য পরিষদের নামে যাঁরা আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, জনগণের কাছে তাঁদের দায়বদ্ধতা কোথায়? দর্শকদের প্রতি তাঁদের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার থাকা উচিত, যে-সুরক্ষা তাঁরা এত বছর ধরে পেয়ে আসছেন, এবং প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের ফলে আন্দোলন শুরু না করেই যে সুরক্ষা পাওয়া অব্যাহত থাকছে, তার বিনিময়ে তাঁরা দর্শকদের কী দেবেন। তাঁরা আর কত বছর সুরক্ষা পেলে এমন শত শত ছবি নির্মাণ করতে পারবেন, যা দেখতে বাংলাদেশের সর্বস্তরের দর্শকেরা সপরিবারে সিনেমাহলে ভীড় জমাবেন, সিনেমাহলগুলো আগের মতো জমজমাট হয়ে উঠবে? ভারত বিভাগের পর পাকিস্তানি আমলে এ দেশের মানুষ সিনেমা হলে গিয়ে দেশ-বিদেশের চলচ্চিত্র উপভোগ করেছে। ঢাকাই, পাকিস্তানি, ভারতীয়সহ বিশ্বের অনেক দেশের চলচ্চিত্র তখন একই সঙ্গে চলত। সারা বিশ্বের সেরা চলচ্চিত্রগুলো এদেশের মানুষ সিনেমা হলে গিয়ে উপভোগ করতেন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত বিশ্বের সকল দেশের চলচ্চিত্রের প্রতিযোগিতার মধ্যেই এ দেশীয় চলচ্চিত্রশিল্প গড়ে উঠেছে, বিকশিত হয়েছে।
শুধু দর্শক নয়, চলচ্চিত্রশিল্পের আরও একটি বড় পক্ষ আছে: সিনেমা হল বা প্রেক্ষাগৃহগুলোর মালিকেরা। জেলা ও মহশহরগুলোতে ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হলগুলোর দুর্দশা দেখলে এ বিষয়ে বেশি কিছু বলার প্রয়োজন পড়ে না। এমনকি খোদ রাজধানীতেই ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হলগুলোর আজ কী দশা। গুলিস্তান সিনেমা হলের জন্যই যে এলাকার নাম হয়েছে গুলিস্তান, সেখানে এখন আর এই নামে কোনো সিনেমা হল নেই। সিনেমা হল ভেঙে সেখানে নির্মিত হয়েছে বাণিজ্যিক ভবন। শ্যামলী সিনেমা হল নিশ্চিহ্ন: বহুতল বিপণিবিতান নির্মিত হচ্ছে সেখানেও। ফার্মগেটের আনন্দ ও ছন্দ সিনেমা হলের দুর্দশা অবর্ণনীয়, মধুমিতাসহ অন্যান্য হলগুলোর দশাও একই রকম। আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পের যে দশা চলছে, সেভাবেই যদি চলতে থাকে, তাহলে এসব কোনো সিনেমা হলের পক্ষেই টিকে থাকা সম্ভব হবে না। অচিরেই হয়তো সেসব স্থানে গড়ে উঠবে বাণিজ্যিক ভবন। সিনেমা হলের সংখ্যা খুব দ্রুত গতিতে কমে যাচ্ছে; ২০০০ সালে দেশে মোট সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল ১৬০০; দশ বছরের মধ্যে তা কমে গিয়ে নেমে এসেছে ৬০০ তে।
চলচ্চিত্রশিল্পের নির্মাতা, শিল্পী-কলাকুশলী ও অর্থলগ্নিকারীরা যদি এমন চলচ্চিত্র তৈরি অব্যাহত রাখেন, যা বিপুলসংখ্যক দর্শককে আকৃষ্ট করতে পারে না, তাহলে সিনেমাহলগুলো ব্যবসায়িকভাবে অলাভজনক, এমনকি লোকসানি প্রতিষ্ঠান হয়ে পড়বে। হলের মালিকেরা উপায়ন্তর না দেখে হলগুলোর জায়গায় এমন কিছু করবেন, যা তাঁদের বেশি মুনাফা জোগাবে, এটাই বাস্তবতা; চলচ্চিত্রশিল্পকে কোনো সুরক্ষা দিয়েই এ বাস্তবতা বদলানো যাবে না। রুচিসম্মত ভালো চলচ্চিত্র নির্মিত না হলে দর্শক সিনেমা হলে যাবে না, আর দর্শক না গেলে সিনেমাহলগুলো লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। ধীরে ধীরে সেগুলো ভেঙে ফেলা হবে। একটা সময় আসবে, যখন দেশে আর কোনো সিনেমা হলই থাকবে না। তাহলে, শেষ পর্যন্ত যদি সিনেমা হলগুলোই একে একে উঠে যায়, তবে চলচ্চিত্র নির্মাতারা কোথায় সেগুলো প্রদর্শন করবেন? তখন কি হল মালিকদের মতো চলচ্চিত্রের প্রযোজকেরাও অন্য ব্যবসার পথ খুঁজবেন না? তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াবে? প্রতিযোগিতাহীন নিরঙ্কুশ সুরক্ষার মধ্যে থেকে তিলে তিলে আত্মহত্যা?
কিন্তু মানুষ এখনো সিনেমা হলে গিয়ে বড় পর্দায় চলচ্চিত্র উপভোগ করতে চায়। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে কয়েকটি ভালো চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে (এফডিসিকেন্দ্রিক মূলধারার চলচ্চিত্রের বাইরে); সেগুলো দেখার জন্য বিপুলসংখ্যক মানুষ সিনেমা হলে যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের মূলধারা এটা এখনো নয়, হাতে গোনা এই ছবিগুলো সারা দেশের সিনেমা হলগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। চলচ্চিত্রশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে নির্মল বিনোদনের চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে—এর কোনো বিকল্পই নেই।
আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পের দুর্দশার কারণগুলো কী, তা খতিয়ে দেখা খুবই দরকার। যাঁরা এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত, কাজটা মূলত তাঁদেরই। টিকে থাকতে হলে বিকশিত হতে হয়; আমাদের চলচ্চিত্রশিল্প বিকশিত হয়নি, সামগ্রিক অর্থে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। প্রতিযোগিতাহীন নিরঙ্কুশ সুরক্ষা এর অন্যতম কারণ বলে মনে হয়। কিন্তু এই ক্ষয় অব্যাহত থাকলে পুরো চলচ্চিত্রশিল্প বিলুপ্ত হতে বেশি সময় লাগবে না।
বিদেশি চলচ্চিত্র আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তা করার সময় এসেছে। কারণ এই নিষেধাজ্ঞার ফলে দেশের চলচ্চিত্রশিল্প বিকশিত না হয়ে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে হতে বিলুপ্তির দিকে এগোলে বিষয়টি হবে শেষবিচারে আত্মঘাতী। এখন সীমিত পরিসরে (হলগুলো মোট প্রদর্শন দিবসের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বিদেশি চলচ্চিত্র প্রদর্শন করতে পারবে এমন শর্তে) আমদানির সুযোগ দেওয়া যায় কিনা তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। এতে যে প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি হবে, তার ফলে এ দেশের চলচ্চিত্র নির্মার্তাদের টিকে থাকার স্বার্থেই ভালো ছবি নির্মাণে তৎপর হতে হবে।
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
No comments