মমতার এক বছর : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি by সুব্রত আচার্য্য

আজ থেকে এক বছর আগে পরিবর্তনের স্লোগান নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় বসেছিল। স্লোগান ছিল 'বদলা নয় বদল চাই'। দলতন্ত্র নয় গণতন্ত্র চাই। আমরা কিংবা ওরা নয়। কলকাতা লন্ডন হবে। সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক কৃষকের জমি ফেরত হবে। জঙ্গলমহলে ঢালাও উন্নয়ন হবে। পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ফিরে আসবে।


আরো অনেক স্লোগান ছিল।
প্রতিশ্রুতির জোয়ারে মানুষের মধ্যে পর্বতসম প্রত্যাশা তৈরি করে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় বসেছিল গত বছর ২০ মে।
প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির ভারসাম্য মেলানো অবশ্য এক বছরের মধ্যে সম্ভব নয়। আর রাজ্য সরকারের ক্ষমতায় আসা অনভিজ্ঞ রাজনৈতিক দল তৃণমূল কংগ্রেস। ফলে এই সরকারের প্রতি মানুষের খানিকটা সহানূভূতি এখনো রয়েছে।
যা হোক, বলা যায় ভালো-মন্দে কেটেছে মমতার এক বছর। মন্ত্রিসভা গঠন করে প্রথম ক্যাবিনেট বৈঠক সেরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা ছিল, 'সিঙ্গুরে টাটাদের কাছ থেকে ৪০০ একর জমি ফিরিয়ে নেওয়া হবে। অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দেওয়া হবে।' বাস্তবতা হচ্ছে, গত এক বছরেও সিঙ্গুরের জমি জটিলতা মেটাতে পারেননি। অনিচ্ছুক কৃষকদের জমিও ফেরত দেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে যাঁরা জমি ফেরত পাওয়ার আশায় পরিবর্তনের মিছিলে পা মিলিয়েছিলেন, তাঁদের একটি ক্ষুদ্র অংশের মুখে এখন মমতাবিরোধী কথাই শোনা যাচ্ছে।
মমতা আরো বলেছিলেন, ৯০ দিনের মধ্যে পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে উত্তপ্ত দার্জিলিংয়ে শান্তি ফিরিয়ে আনা হবে। গোর্খাল্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন টেরিটোরিয়াল বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে চুক্তি হলেও এখন পর্যন্ত সেই চুক্তির গায়ে কেন্দ্রীয় সিলমোহর পড়েনি। ফলে এখনো সেখানে মাঝেমধ্যেই আগুন জ্বলে ওঠে।
এ ছাড়া সেদিনের প্রথম মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে ছিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানো, রাজনৈতিক বন্দি মুক্তি এবং জঙ্গলমহলের উন্নয়ন। এসব ক্ষেত্রে অবশ্য এক বছরে বেশ ভালো সাফল্য এসেছে সরকারের। শুধু কর্মসূচির মধ্যে বেঁধে রেখে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়া যে তাঁর লক্ষ্য নয়, সেটি এ পর্যন্ত তিনবার জঙ্গলমহলে গিয়ে প্রমাণ করেছেন মমতা। এ ছাড়া খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের নানা প্যাকেজ ঘোষণা করে এরই মধ্যে সেগুলো বাস্তবায়ন হয়েছে অনেকটা।
নির্বাচনী ইশতেহারে রাজ্যে ১০ লাখ কর্মসংস্থানের কথা বলেছিলেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার গত এক বছরের মধ্যে ছয় লাখ মানুষের কর্মসংস্থান করেছেন বলে দাবি করছে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার এবং সরকারের পক্ষে পত্রপত্রিকাগুলো। বলা হচ্ছে, চলতি অর্থবছর ২০১২-১৩ আরো ১০ লাখ কর্মসংস্থানের প্রস্তাবও করেছেন মমতা। কিন্তু এ মুহূর্তে রাজ্যের শূন্যপদের পরিমাণ কত? কোথায় কোথায় কর্মসংস্থান করা হবে- এসব তথ্য অবশ্য মানুষের কাছে এখনো অজানা। রয়েছে চরম ধোঁয়াশাও।
কলকাতাকে লন্ডন করার উদ্যোগ নিয়ে বামফ্রন্ট যতই হাসাহাসি করুক না কেন, এক বছরে কিন্তু এ ক্ষেত্রে বেশ ভালো নম্বর পেতে পারে রাজ্য সরকার। ইতিমধ্যে কলকাতার আশপাশে গঙ্গার দুই ধার পরিষ্কার করে সেখানে লন্ডনের রাস্তার মতো ত্রিমুখী আলোর ব্যবস্থা করেছে কলকাতা করপোরেশন।
কলকাতা এবং বিধাননগর পৌরসভার প্রায় ৮০ শতাংশ জায়গায় একই রকম লাইট পোস্ট দেখা যাবে। তবে কলকাতার বেশ কিছু রাস্তায় কলকাতা ইলেকট্রি সাপ্লাই বা সিএসসির নিজস্ব লাইট পোস্টের নিচে লাগানো হয়েছে সৌন্দর্যবর্ধনকল্পে লাগানো মূল্যবান এই লাইট পোস্টগুলো। এ নিয়ে বিতর্কও রয়েছে।
অবশ্য শুরু থেকেই সরকার নানা রকম বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে সরকার শুরুর মাত্র চার মাসের মধ্যে কলকাতার প্রথম শ্রেণীর দু-একটি সংবাদপত্রের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরাসরি সংঘাতে নেমে পড়েন। বর্তমান পত্রিকা এ মুহূর্তে মমতার সরকারের সবচেয়ে সফল সমালোচক হিসেবে পরিচিত এই রাজ্যে। আনন্দবাজার গোষ্ঠীর সঙ্গেও সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। যদিও মুখ্যমন্ত্রী তাঁরই ঘনিষ্ঠ কয়েকটি টিভি চ্যানেলে আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, তাঁর কাছে কোনো বিশেষ সুযোগ চেয়েছিল এই গোষ্ঠী। কিন্তু সেটি তিনি দেননি। এরই জেরে তাঁর সরকার নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু করেছে পত্রিকাটি, তাদের টিভি চ্যানেল। অবশ্য এটিও ঠিক, নির্বাচনের আগে এবং পরে স্টার আনন্দ টিভির এক সিনিয়র সাংবাদিককে মমতার সঙ্গী হিসেবে দেখা যেত। কিন্তু হঠাৎ তাঁদের সুর পরিবর্তন নিয়ে রাজ্যের জনমানসেও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। বিতর্ক আরো আছে, বর্তমান ও আনন্দবাজার গোষ্ঠীর সঙ্গে এমন বিরোধ যখন রাজ্যটির মানুষের সামনে পরিষ্কার, ঠিক তখনই রাজ্য সরকার ফরমান জারি করে বলে, নির্দিষ্ট কিছু সংবাদপত্র ছাড়া বাকি কোনো সংবাদপত্রই সরকার এবং সরকারি অনুদান পাওয়া কোনো গ্রন্থাগারে রাখা চলবে না। আর এমন সিদ্ধান্তে রাজ্যজুড়ে তুমুল বিতর্ক তৈরি হয়।
পার্কস্ট্রিটের এক ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে তদন্ত শেষ না হওয়ার আগে আচমকাই মমতা বলে দিলেন, এটি ছোট্ট ঘটনা। রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বও রয়েছে মমতার কাঁধে। এমন মন্তব্য তদন্তে মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলতে পারে। এরই জেরে মমতা সরকারের সমালোচক টিভি চ্যানেল ও পত্রিকাগুলো ঢালাও সমালোচনা শুরু করে। পরিস্থিতি বুঝে অবশ্য মমতা এ নিয়ে পরে আর কোনো মন্তব্য করেননি।
তবে শুধুই যে বিতর্কে ঘেরা ছিল এক বছর তাও বলা যাবে না। কারণ নতুন এই সরকার বুদ্ধিজীবীদের যোগ্য সম্মান দেওয়ার জন্য প্রবর্তন করেছেন বঙ্গবিভূষণ কিংবা বঙ্গভূষণ সম্মানের মতো রাজ্যের সর্বোচ্চ সম্মান। শিল্পী-সাহিত্যিক-কবি-বাউল-নৃত্যশিল্পীদের পাশে নানাভাবে সরকার পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছে। ক্রীড়া ক্ষেত্রেও ব্যাপক উন্নয়ন করার চেষ্টা করছে পরিবর্তনের সরকার। রাজ্যের প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ এসেছে এক বছরে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগ আসা শুরু করেছে।
সংখ্যালঘুদের জন্য ঢালাও উন্নয়ন। ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের মাসিক ভাতা প্রদান। সংখ্যালঘু ছেলেমেয়েদের জন্য চাকরি। সরকারি অনুদান বাড়ানো। জেলায় জেলায় সংখ্যালঘু দপ্তর খোলা। ১০ হাজার মাদ্রাসাকে সরকারি অনুমোদন। রাজ্য সরকার কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম সার্ধশত বর্ষ উদ্যাপনসহ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামে নজরুল একাডেমী গড়ে নজির গড়েছেন। ২৫ মে সল্টলেকে নজরুল ভবনের উদ্বোধন করবেন মুখ্যমন্ত্রী।
শেষ কথা অবশ্য এখনই বলার সময় আসেনি পরিবর্তনের এক বছরের এই সরকার নিয়ে। প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকার দেনা রয়েছে বর্তমান রাজ্য সরকারের কাঁধে। এর মধ্যে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলার যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন রাজ্যটির প্রশাসনিক প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়- সেটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এক বছরে নানা ইস্যুতে মমতার সঙ্গে জোট শরিক কংগ্রেসের নেতৃত্বের দূরত্ব বেড়েছে। আগামী বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনে হয়তো কংগ্রেস এবং তৃণমূল একসঙ্গে লড়বে না। তারা একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়াবে। আর বিরোধী বামফ্রন্ট এ মুহূর্তে রাজ্যে ছত্রখান অবস্থা। এক বছরে তেমন কোনো ইস্যু না পেয়ে দলটির মধ্যে নিস্তেজভাব প্রতীয়মান। এর মধ্যে বিগত ৩৪ বছরের ভুলত্রুটি সংশোধন করতে দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের দল থেকে বহিষ্কার করে চরম টলমলে অবস্থা তাদের। সরকারের এক বছর পূর্তি নানা আয়োজনে বামফ্রন্টও তাদের হারের এক বছর পালন করবে বলেই খবর দিচ্ছে কলকাতার পত্রপত্রিকাগুলো।
তবে জেলায় জেলায় বিরোধীদের আক্রমণের নিশানা করছে তৃণমূলের স্থানীয় নেতারা। পুলিশের কাছে গিয়েও অভিযোগ লেখাতে পারছেন না বিরোধীরা। গণতন্ত্রের জন্য অবশ্য এটি খুব সুখবর নয়। যদিও দলতন্ত্র নয়, গণতন্ত্রের স্লোগান ছিল তৃণমূল কংগ্রেসের। এক বছরে স্লোগানটি অনেক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি তৃণমূল।

লেখক : সাংবাদিক, কলকাতা।
subrata.acharjee@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.