মিডিয়া ভাবনা-সব সৃজনশীল শাখায় জাতীয় পুরস্কার চাই by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

কয়েক দিন আগে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০০৮’ প্রদান করা হয়েছে। টিভির কল্যাণে সারা দেশের মানুষ এই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান উপভোগ করেছে। চলচ্চিত্রশিল্পের এই বার্ষিক মূল্যায়ন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমল থেকে হয়ে আসছে।


পরবর্তী সরকারগুলো যে এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছে, এ জন্য সরকারপ্রধানদের ধন্যবাদ জানাই। ভালো কাজ, তা যে সরকারই চালু করুক না কেন, তা অব্যাহত রাখা দেশের স্বার্থেই প্রয়োজন। আমাদের রাজনৈতিক সরকারগুলো অনেক সময় এই গণতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয় দিতে পারে না। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের ক্ষেত্রে পরবর্তী সরকারগুলো যে এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পেরেছে, এ জন্য তারা প্রশংসার দাবিদার।
চলচ্চিত্র একটি সৃজনশীল শিল্প। একই সঙ্গে এটা একান্ত বেসরকারি খাতের একটা বিষয়। সরকার চলচ্চিত্র তৈরি করে না, তবে ভালো চলচ্চিত্রের জন্য সরকার অনুদান দেয়। সরকার পরিচালিত এফডিসি স্টুডিও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের নানাভাবে সহায়তা করে। এফডিসির সেবা ছাড়া চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে সরকারের কোনো প্রত্যক্ষ যোগ নেই। চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকার সহায়ক ভূমিকা পালন করে মাত্র।
চলচ্চিত্রের নায়ক, নায়িকা, পরিচালক, কাহিনিকার, সংগীতপরিচালক, সেট ডিজাইনার, চিত্রগ্রাহক, গীতিকার, কণ্ঠশিল্পী, শিশুশিল্পী এমনকি মেকআপম্যান পর্যন্ত ‘জাতীয় পুরস্কার’-এ সম্মানিত হন। এটা নিঃসন্দেহে সরকারের একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। সরকার যে ব্যক্তির সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করতে চায়, এটা তার প্রমাণ।
আমাদের দেশে সৃজনশীলতায় চলচ্চিত্র খুব বেশি অবদান রাখতে পারেনি। অন্তত অন্যান্য শিল্পের তুলনায়। পাকিস্তান আমলে যতটুকু অবদান রেখেছিল, বাংলাদেশ আমলে সেটাও পারেনি। স্বাধীনতা-উত্তরকালে শিল্পমান উত্তীর্ণ চলচ্চিত্রের সংখ্যা খুব বেশি নয়। আশির দশকের পরে চলচ্চিত্রশিল্পে এক বিরাট মন্দা নেমে এসেছিল। নকল ছবি, অশ্লীল দৃশ্য, কাটপিস ইত্যাদি কারণে চলচ্চিত্রের একটা বড় অংশ দূষিত হয়ে পড়েছিল। সমাজসচেতন, শিক্ষিত, রুচিমান দর্শক সপরিবারে সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল। নব্বইয়ের দশকের পর চলচ্চিত্রশিল্পে ক্ষীণভাবে আবার ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে শুরু করে। গত এক দশকে কয়েকটি ভালো ছবি নির্মিত হয়েছে। অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ চলচ্চিত্র পরিচালনা ও অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। এই পরিবর্তনে টিভি চ্যানেলগুলোরও বড় অবদান রয়েছে।
চলচ্চিত্রশিল্পের এই ওঠানামার মধ্যেও ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’ প্রদান বন্ধ থাকেনি। অর্থাৎ নিম্নমান ও অশ্লীল ছবি নির্মাণের সময়ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।
সৃজনশীলতা শুধু চলচ্চিত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; শিল্পকলা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, মিডিয়া, প্রকাশনা—সব ক্ষেত্রেই সৃজনশীলতা রয়েছে। কাজেই সরকার চলচ্চিত্রের মতো সব সৃজনশীল শাখায় বার্ষিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে ‘জাতীয় পুরস্কার’ প্রচলন করতে পারে। যে যুক্তিতে প্রতিবছর সরকার ‘চলচ্চিত্র পুরস্কার’ দিচ্ছে, একই যুক্তিতে অন্যান্য ক্ষেত্রেও ‘জাতীয় পুরস্কার’ দেওয়া উচিত। চলচ্চিত্রের মতো সেসব ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এই পুরস্কারের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকবে। প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে পুরস্কার দেবেন। বিটিভি পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান সরাসরি সমপ্রচার করবে। অর্থাৎ প্রতিটি অনুষ্ঠানের মান ও মর্যাদা একই রকম হওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রীর সময়াভাবের প্রশ্ন যদি আসে তাহলে আমি প্রস্তাব করব: সব জাতীয় পুরস্কার রাষ্ট্রপতির হাত থেকে নিলেই ভালো হয়। রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রতীক। প্রধানমন্ত্রীর হাতে সময় থাকলে তিনি কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেন, তাতে অনুষ্ঠানের মর্যাদা বাড়বে।
বলা বাহুল্য, আমি যে পুরস্কারের কথা বলছি তা ‘একুশে পদক’ বা ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’-এ মতো পুরস্কার নয়। এ দুটি জাতীয় পুরস্কার দেওয়ার জন্য কোনো বিশেষ বার্ষিক অবদানকে চিহ্নিত করতে হয় না। মন্ত্রণালয়ের কমিটি তাদের বিবেচনামতো তা নির্ধারণ করে। অনেক সময় রাজনৈতিক কারণে বা বিশেষ বিবেচনায় এই পদক দেওয়া হয়েছে। এ জন্য ইদানীং এ দুটি জাতীয় পুরস্কার আর তেমন সম্মান বা স্বীকৃতি বহন করে না। সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।
আমি যে ‘জাতীয় পুরস্কার’-এর কথা বলছি, তা বার্ষিক কাজের জন্য দেওয়া হবে। ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’-এর নীতিমালা এখানে অনুসরণ করা যায়। তবে প্রতিটি বিভাগ হবে সৃজনশীল কাজের শাখা; যেমন—কবিতাগ্রন্থ, গল্পগ্রন্থ, উপন্যাস, প্রবন্ধগ্রন্থ, গবেষণা, গান রচনা, সুর, কণ্ঠ, নৃত্যনাট্য, নাটক, টেলিভিশন অনুষ্ঠানের বিভিন্ন শাখা, বেতার অনুষ্ঠানের বিভিন্ন শাখা ইত্যাদি। চলচ্চিত্র পরিচালনা, অভিনয়, সেট ডিজাইন বা মেকআপের চেয়ে উল্লিখিত কাজগুলো কম সৃজনশীল নয়। তাহলে এসব কাজ বার্ষিক মূল্যায়নে জাতীয় স্বীকৃতি বা সম্মান পাবে না কেন?
বাংলাদেশে জাতীয় পুরস্কারের বাইরে ‘বাংলা একাডেমী’ ও ‘শিল্পকলা একাডেমী’ কিছু পুরস্কার দিয়ে থাকে। বাংলা একাডেমীর পুরস্কার বার্ষিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে হয় না। শিল্পকলা একাডেমীর পুরস্কারও নয়। আমার দাবি, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের মতো বার্ষিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে অন্যান্য সৃজনশীল শাখায় পুরস্কার দেওয়া হোক। যদি সরকার অন্যান্য ক্ষেত্রে জাতীয় পুরস্কার প্রবর্তন না করে, তাহলে বুঝতে হবে সরকার অন্যান্য সৃজনশীল কাজের প্রতি গুরুত্ব দেয় না। অন্য ক্ষেত্রে সৃজনশীল ব্যক্তিরা সরকারের দৃষ্টিতে অচ্ছ্যুত। এ ব্যাপারে সব মাধ্যমের সৃজনশীল ব্যক্তিদের যুক্তিসহকারে সোচ্চার হওয়ার জন্য আমি অনুরোধ জানাই।
বাংলাদেশে একমাত্র ‘মেরিল-প্রথম আলো’ পুরস্কারই বার্ষিক ভিত্তিতে সৃজনশীল কাজের জন্য বড় পুরস্কার। তবে এটা বেসরকারি পুরস্কার। এই পুরস্কারেরও নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অধিকাংশ পুরস্কার দেওয়া হয় পত্রিকার ফরম পূরণের ভিত্তিতে। দর্শকদের ভোটে দেওয়া পুরস্কার সব সময় মানের দিক দিয়ে যথাযথ নাও হতে পারে। সমালোচক পুরস্কার হিসেবে মাত্র চারটি বিভাগে পুরস্কার দেওয়া হয়। ‘মেরিল-প্রথম আলো’ পুরস্কারের একটা বাণিজ্যিক ভঙ্গি। সবাই এই ভঙ্গির সঙ্গে একমত নাও হতে পারে। তা ছাড়া এই পুরস্কারের জন্য সৃজনশীল সব শাখা ও টেলিভিশন অনুষ্ঠান বিবেচিত হয়নি। অথচ টিভি অনুষ্ঠানই এখন দেশের প্রধান বিনোদন।
তবে ‘মেরিল-প্রথম আলো’ পুরস্কারের বড় বৈশিষ্ট্য হলো, সৃজনশীল অনেক ক্ষেত্রে এটা একটা বার্ষিক মূল্যায়ন। একটা পদ্ধতির মাধ্যমে এই মূল্যায়ন করা হয়। কোনো মন্ত্রী কমিটি বা রাজনৈতিক বিবেচনায় এখানে সিদ্ধান্ত হয় না।
আমাদের দেশে পাকিস্তান আমলে চলচ্চিত্র ছিল বিনোদনের প্রধান মাধ্যম। স্বাধীনতার পর ক্রমে ক্রমে তা সেই স্থান হারিয়েছে। এক দিকে নিম্নমানের ছবি প্রযোজনা, অন্য দিকে টিভি অনুষ্ঠানের (নাটক, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, টক শো, খবর) আকর্ষণ দর্শককে সিনেমাবিমুখ করে তুলেছে। এক দশক ধরে আবার চেষ্টা হচ্ছে ভালো ভালো ছবি তৈরি করে দর্শককে সিনেমা হলে নিয়ে যেতে। এখনো তা সফল হয়নি। টিভিই আমাদের প্রধান বিনোদনের মাধ্যম হয়ে থাকবে। অথচ সেই টিভি অনুষ্ঠান ও কলাকুশলী কোনো জাতীয় পুরস্কার পান না। ব্যতিক্রম শুধু টিভি নাটক। একসময় সরকারিভাবে ‘জাতীয় টেলিভিশন পুরস্কার’ দেওয়া হতো। তিন-চার বছর দেওয়ার পর অজ্ঞাত কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। তথ্য মন্ত্রণালয় কি এই পুরস্কার আবার প্রবর্তন করতে পারে না?
সাহিত্যও আমাদের দেশে অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি সৃজনশীল শাখা। ‘একুশের বইমেলা’ দেশের সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক আয়োজন। অথচ সেই সাহিত্য বা সাহিত্যিকেরা কোনো জাতীয় পুরস্কার পান না।

পুরস্কার: দাতা ও গ্রহীতা
জাতীয় পুরস্কার ছাড়াও আজকাল অনেক রকমের বেসরকারি পুরস্কারের চল হয়েছে। কয়েকটি পুরস্কার বেশ সম্মানজনক। একটা ব্যাপার লক্ষ করছি, কোনো কোনো অনুষ্ঠানে পুরস্কারগ্রহীতাকে পুরস্কার প্রদান করেন তাঁরই সমবয়সী বা সামান্য জ্যেষ্ঠ কোনো শিল্পী। পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রে এটাকে ঠিক মানানসই বলতে পারছি না। পুরস্কার পাওয়া যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি কার কাছ থেকে পুরস্কার নেওয়া হচ্ছে সেটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অনেকে সারা জীবন গর্বভরে স্মরণ করেন ছাত্রজীবনে কার কাছ থেকে পুরস্কার নিয়েছিলেন। শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও পুরস্কার কার কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে সেটা কোনো হেলাফেলার বিষয় নয়।
পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে পুরস্কার তুলে দেওয়ার জন্য রাজ্যের লোককে মঞ্চে তুলতে হবে, এটাও কোনো কাজের কথা নয়। মনে হয়, আয়োজকেরা পুরস্কার তুলে দেওয়ার নামে একটা স্থূল ‘জনসংযোগে’ ব্যস্ত। কোনো একজন প্রবীণ, সম্মানীয় শিল্পী বা সাহিত্যিক বা দেশবরেণ্য ব্যক্তিত্বকে দিয়ে সব পুরস্কার প্রদান করা যায়, যাঁর কাছ থেকে পুরস্কার নিয়ে যেকোনো শিল্পী নিজেকে সম্মানিত বোধ করবেন। সমবয়সীর কাছ থেকে পুরস্কার নেওয়ার মধ্যে কোনো গৌরব নেই।
উদ্যোক্তারা যদি বৈচিত্র্যের জন্য অনেক তারকাকে মঞ্চে ওঠাতে চান, তাহলে আমি বলব: চলচ্চিত্র, টিভি, বেতার, ক্রীড়া, সাহিত্য, জনসেবা ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে অনেক প্রবীণ ‘তারকা’ রয়েছেন, যাঁরা এখন প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালে জীবন যাপন করছেন, তাঁদের আমন্ত্রণ জানান। তাঁদের হাত দিয়ে পুরস্কার দিন এ কালের তারকাদের। সেটাও বেশ গর্বের বিষয় হবে, অন্য দিকে সাবেক তারকারাও নিজেদের সম্মানিত বোধ করবেন। এভাবে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানটি সাবেক ও বর্তমান শিল্পীদের মধ্যে একটা সেতু গড়ে তুলবে।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের অর্থের অঙ্কটা খুবই নিন্দনীয়। এক লাখ টাকার কম (২০১০ সালে) কোনো জাতীয় পুরস্কারের অর্থ হওয়া উচিত নয়। যদি সরকারের টাকার অভাব থাকে, তাহলে টাকা না দেওয়াই উচিত। শুধু মেডেল, ক্রেস্ট ও সনদই যথেষ্ট। টাকার জন্য কেউ জাতীয় পুরস্কারের আশা করেন না।
জাতীয় পুরস্কারের সীমানা বৃদ্ধি, অন্যান্য সংস্থার পুরস্কার দেওয়ার পদ্ধতি, পুরস্কার কার হাত থেকে নেওয়া হবে, পুরস্কারের টাকা ইত্যাদি সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট মহলের আরও ভাবনাচিন্তা করা উচিত। যেভাবে কাজটা হচ্ছে, সেটা সঠিক—এমন ভাবার কোনো কারণ নেই।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।

No comments

Powered by Blogger.