চারদিক-ঢাকার হারিয়ে যাওয়া কামান by স্বপন কুমার দাস
কামান দুটির গর্জনে শত্রুর বুকে কাঁপন ধরত। তোপে ধ্বংস হয়ে যেত আক্রমণকারীর রণতরী। এদের গগনবিদারী আওয়াজে ঢাকাবাসী যেন পেত শত্রুর আগমনবার্তা। তবে তাদের বিশ্বাস ছিল, কামান দুটি তাদের রক্ষা করবে। আর এ বিশ্বাস থেকেই কামান দুটির সঙ্গে ঢাকাবাসীর গড়ে ওঠে বিশেষ সম্পর্ক।
বিখ্যাত এ কামান দুটির একটির নাম কালে খাঁ জমজম এবং অন্যটির নাম বিবি মরিয়ম। ব্রিটিশ শাসকদের অবহেলায় কালে খাঁ জমজম বুড়িগঙ্গা নদীতে তলিয়ে যায়।
মগ, পর্তুগিজ ও আরাকানি জলদস্যুদের হাত থেকে ঢাকা শহরকে রক্ষার জন্য সতেরো শতকের ত্রিশের দশকে পূর্ববঙ্গে যেসব কামান তৈরি করা হয়েছিল, তার মধ্যে দুটি কামান ছিল বিখ্যাত। বিশালত্বে, নির্মাণশৈলীতে ও সৌন্দর্যে এগুলো ছিল ভারতখ্যাত। কামান দুটির নামকরণ কে করেছিলেন, তা কোথাও লেখা নেই। তবে বহুকাল থেকে এ দেশে ঐতিহ্য আছে যে নতুন কোনো যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করা হলে এর নামকরণ করা হয় কোনো বীর বা শহীদের নামে। সম্ভবত সে রীতি অনুসরণ করে সবচেয়ে বড় কামানটির নামকরণ করা হয় কালে খাঁ জমজম নামের কোনো বীর কিংবা শহীদের নামে। আর ছোট কামানটির নামকরণ করা হয় বিবি মরিয়মের নামে। সম্ভবত বিবি মরিয়ম কালে খাঁর স্ত্রী কিংবা সঙ্গিনী ছিলেন।
ধারণা করা হয়, কামান দুটি ঢাকাতেই তৈরি করা হয়েছিল। সে সময় ঢাকায় কামান তৈরির খুবই দক্ষ কারিগর ছিল। তখন ঢাকায় উন্নতমানের কামান তৈরি হতো। তবে এ কামান দুটির নকশা তৈরি ও নির্মাণকাজ তদারকি করেন মোগল কামান নির্মাতারা। নির্মিত হওয়ার পর কামান দুটিকে স্থাপন করা হয় সোয়ারী ঘাটের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা নদীর মধ্যে মোগলাই চরে। সেখানে স্থাপনের পর শুধুু ঢাকা শহর রক্ষাই নয়, দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে কামান দুটি দর্শনীয় বস্তুতে পরিণত হয়। বিশেষ করে কালে খাঁ জমজমকে দেখে মানুষ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেত।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে ভারতবর্ষের সর্ববৃহত্ কামানের যে তালিকা তৈরি করা হয়, তার মধ্যে কালে খাঁর নামও ছিল। কিন্তু মোগলাই চর বিলীন হয়ে গেলে কামানটিও তলিয়ে যায় বুড়িগঙ্গা নদীতে।
বিখ্যাত ভূগোলবিদ রেনেল তাঁর স্মৃতিকথায় কালে খাঁ জমজম সম্পর্কে বিস্তারিত লিখে গেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘খুব স্পর্শকারতার সঙ্গে কামানটিকে পরীক্ষা করি। আলাদা আলাদাভাবে প্রতিটি অংশের মাপ নিই। মরচে ধরে না এমন পেটানো লোহা দিয়ে কামানটি তৈরি। মোট ১২ খণ্ডের লোহার টুকরা একটির সঙ্গে অপরটি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে জোড়া দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে কামানটি তৈরি করা হয়েছে। কামানটির দৈর্ঘ্য ২২ ফুট সাড়ে ১০ ইঞ্চি। পেছন দিকের দৈর্ঘ্য তিন ফুট তিন ইঞ্চি। মুখের আয়তন দুই ফুট ১০ ইঞ্চি, ছিদ্রের ব্যাস এক ফুট তিন ইঞ্চি। প্রতিটি গোলার ওজন ছিল ছয় মণ। কামানটির ওজন কয়েক শ মণ, দেখতে একটি বিশাল টিউবের মতো তবে বেশ সুন্দর। এ কামানটির তুলনায় বিবি মরিয়ম ছিল অনুল্লেখ্য। ঢাকা শহরের উল্টোদিকে বুড়িগঙ্গা নদীর একটি চরে কামানটি ছিল। চরটির দুই কূল ভাঙছে। আমার বন্ধু জন কোয়ির (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রকৌশলী) সঙ্গে একবার পরিকল্পনা করি। একটি নৌযান তৈরি করে একে উদ্ধার করে কলকাতা পাঠাব। কিন্তু আমাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হওয়ার আগেই আমাদের বদলি হয়ে যেতে হয়।’
রবার্ট লিন্ডসে নামের এক তরুণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরি নিয়ে ১৭৭৬ সালে ঢাকা আসেন। তিনি লিখেছেন, ‘ঢাকায় গর্ব করার মতো তেমন কিছু নেই, শুধু একটি কামান ছাড়া। পানির আঘাতে চরটির তীর ভাঙছিল এবং নদী আস্তে আস্তে চরটিকে গ্রাস করে নিচ্ছিল। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা কামানটিকে রক্ষার ব্যাপারে অমার্জনীয় উদাসীন ছিলেন। ঢাকার মানুষ কামানটিকে খুবই ভালোবাসত। কামানটি সম্পর্কে তাদের জিজ্ঞাসা করলে তারা বলত, স্বর্গ থেকে কামানটি এসেছিল, তা আবার স্বর্গে চলে গেছে। তাদের মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, কামানটিকে তারা কত ভালোবাসত।’
এককালের ঢাকার গর্ব কালে খাঁ জমজম আজও শুয়ে আছে বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশে। আমাদের শাসকদের ইতিহাস-চেতনা আর ঐতিহ্যপ্রীতির অভাবের কারণে আজ পর্যন্ত কেউ কালে খাঁকে উদ্ধারে এগিয়ে আসেননি। অথচ বিজ্ঞানের আশীর্বাদে সাগরের তলদেশ থেকে এক টুকরো লোহাও খুঁজে বের করে আনা এখন কোনো বিষয় নয়। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে রাশিয়ার সাবমেরিন কুরস্ক বেরেন্টস সাগরে তলিয়ে গেলে নরওয়ের ডুবুরিদের চেষ্টায় মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই সেটি তুলে আনা সম্ভব হয়েছিল। তাই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কালে খাঁ জমজমকে নদীর তলদেশ থেকে তুলে আনা সম্ভব। বর্তমান সরকার কি কালে খাঁ জমজমকে উদ্ধারে সচেষ্ট হবে? বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রপ্রকৌশল বিভাগও কালে খাঁ জমজমকে উদ্ধারে এগিয়ে আসতে পারে।
মগ, পর্তুগিজ ও আরাকানি জলদস্যুদের হাত থেকে ঢাকা শহরকে রক্ষার জন্য সতেরো শতকের ত্রিশের দশকে পূর্ববঙ্গে যেসব কামান তৈরি করা হয়েছিল, তার মধ্যে দুটি কামান ছিল বিখ্যাত। বিশালত্বে, নির্মাণশৈলীতে ও সৌন্দর্যে এগুলো ছিল ভারতখ্যাত। কামান দুটির নামকরণ কে করেছিলেন, তা কোথাও লেখা নেই। তবে বহুকাল থেকে এ দেশে ঐতিহ্য আছে যে নতুন কোনো যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করা হলে এর নামকরণ করা হয় কোনো বীর বা শহীদের নামে। সম্ভবত সে রীতি অনুসরণ করে সবচেয়ে বড় কামানটির নামকরণ করা হয় কালে খাঁ জমজম নামের কোনো বীর কিংবা শহীদের নামে। আর ছোট কামানটির নামকরণ করা হয় বিবি মরিয়মের নামে। সম্ভবত বিবি মরিয়ম কালে খাঁর স্ত্রী কিংবা সঙ্গিনী ছিলেন।
ধারণা করা হয়, কামান দুটি ঢাকাতেই তৈরি করা হয়েছিল। সে সময় ঢাকায় কামান তৈরির খুবই দক্ষ কারিগর ছিল। তখন ঢাকায় উন্নতমানের কামান তৈরি হতো। তবে এ কামান দুটির নকশা তৈরি ও নির্মাণকাজ তদারকি করেন মোগল কামান নির্মাতারা। নির্মিত হওয়ার পর কামান দুটিকে স্থাপন করা হয় সোয়ারী ঘাটের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা নদীর মধ্যে মোগলাই চরে। সেখানে স্থাপনের পর শুধুু ঢাকা শহর রক্ষাই নয়, দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে কামান দুটি দর্শনীয় বস্তুতে পরিণত হয়। বিশেষ করে কালে খাঁ জমজমকে দেখে মানুষ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেত।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে ভারতবর্ষের সর্ববৃহত্ কামানের যে তালিকা তৈরি করা হয়, তার মধ্যে কালে খাঁর নামও ছিল। কিন্তু মোগলাই চর বিলীন হয়ে গেলে কামানটিও তলিয়ে যায় বুড়িগঙ্গা নদীতে।
বিখ্যাত ভূগোলবিদ রেনেল তাঁর স্মৃতিকথায় কালে খাঁ জমজম সম্পর্কে বিস্তারিত লিখে গেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘খুব স্পর্শকারতার সঙ্গে কামানটিকে পরীক্ষা করি। আলাদা আলাদাভাবে প্রতিটি অংশের মাপ নিই। মরচে ধরে না এমন পেটানো লোহা দিয়ে কামানটি তৈরি। মোট ১২ খণ্ডের লোহার টুকরা একটির সঙ্গে অপরটি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে জোড়া দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে কামানটি তৈরি করা হয়েছে। কামানটির দৈর্ঘ্য ২২ ফুট সাড়ে ১০ ইঞ্চি। পেছন দিকের দৈর্ঘ্য তিন ফুট তিন ইঞ্চি। মুখের আয়তন দুই ফুট ১০ ইঞ্চি, ছিদ্রের ব্যাস এক ফুট তিন ইঞ্চি। প্রতিটি গোলার ওজন ছিল ছয় মণ। কামানটির ওজন কয়েক শ মণ, দেখতে একটি বিশাল টিউবের মতো তবে বেশ সুন্দর। এ কামানটির তুলনায় বিবি মরিয়ম ছিল অনুল্লেখ্য। ঢাকা শহরের উল্টোদিকে বুড়িগঙ্গা নদীর একটি চরে কামানটি ছিল। চরটির দুই কূল ভাঙছে। আমার বন্ধু জন কোয়ির (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রকৌশলী) সঙ্গে একবার পরিকল্পনা করি। একটি নৌযান তৈরি করে একে উদ্ধার করে কলকাতা পাঠাব। কিন্তু আমাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হওয়ার আগেই আমাদের বদলি হয়ে যেতে হয়।’
রবার্ট লিন্ডসে নামের এক তরুণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরি নিয়ে ১৭৭৬ সালে ঢাকা আসেন। তিনি লিখেছেন, ‘ঢাকায় গর্ব করার মতো তেমন কিছু নেই, শুধু একটি কামান ছাড়া। পানির আঘাতে চরটির তীর ভাঙছিল এবং নদী আস্তে আস্তে চরটিকে গ্রাস করে নিচ্ছিল। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা কামানটিকে রক্ষার ব্যাপারে অমার্জনীয় উদাসীন ছিলেন। ঢাকার মানুষ কামানটিকে খুবই ভালোবাসত। কামানটি সম্পর্কে তাদের জিজ্ঞাসা করলে তারা বলত, স্বর্গ থেকে কামানটি এসেছিল, তা আবার স্বর্গে চলে গেছে। তাদের মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, কামানটিকে তারা কত ভালোবাসত।’
এককালের ঢাকার গর্ব কালে খাঁ জমজম আজও শুয়ে আছে বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশে। আমাদের শাসকদের ইতিহাস-চেতনা আর ঐতিহ্যপ্রীতির অভাবের কারণে আজ পর্যন্ত কেউ কালে খাঁকে উদ্ধারে এগিয়ে আসেননি। অথচ বিজ্ঞানের আশীর্বাদে সাগরের তলদেশ থেকে এক টুকরো লোহাও খুঁজে বের করে আনা এখন কোনো বিষয় নয়। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে রাশিয়ার সাবমেরিন কুরস্ক বেরেন্টস সাগরে তলিয়ে গেলে নরওয়ের ডুবুরিদের চেষ্টায় মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই সেটি তুলে আনা সম্ভব হয়েছিল। তাই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কালে খাঁ জমজমকে নদীর তলদেশ থেকে তুলে আনা সম্ভব। বর্তমান সরকার কি কালে খাঁ জমজমকে উদ্ধারে সচেষ্ট হবে? বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রপ্রকৌশল বিভাগও কালে খাঁ জমজমকে উদ্ধারে এগিয়ে আসতে পারে।
No comments