চারদিক-জ্ঞানের ফেরিওয়ালা আবুল কাশেম by সাইফ উদ্দিন
আবুল কাশেম তখন নবম শ্রেণীতে। ‘মানুষের মতো মানুষ’ হওয়ার স্বপ্ন্রেবিভোর। উচ্চশিক্ষা নিয়ে বড় কোনো পদে চাকরি করার আশায় পড়ালেখাও করতেন বেশ। কিন্তু আবুল কাশেমের সেই স্বপ্ন্রতাঁর কাছে অধরাই রয়ে গেল। দারিদ্র্যের কাছে হার মানতে হলো তাঁর পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার জেদটাকে। কাঁধে জুটল পরিবারের ভার।
একটা চাকরির খুব বেশি প্রয়োজন্র ছিল তখন। চাকরি নিলেন একটি প্রতিষ্ঠানের অফিস সহকারীর। কিন্তু সেই আয়ে কি আর সংসার চলে?
দেশের দক্ষিণে নিঃসঙ্গ একটি দ্বীপ—হাতিয়া। সেখানে পৌঁছাতে এখনো মাঝেমধ্যে সময় লাগে দুই দিন। সবচেয়ে বড় সমস্যা এই দ্বীপের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগব্যবস্থা। জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করে এখানকার নৌযানগুলো চলাচল করে। সময় তখন ১৯৮৪ সাল। পরিবারের বড় দায়িত্ব নিয়ে হিমশিম খাওয়া আবুল কাশেমের সেই সময়টায় এই দ্বীপে জাতীয় পত্রিকা পাওয়া যেত না। একে তো খারাপ যোগাযোগব্যবস্থা, তার ওপর উপকূলীয় এলাকা বলে যখন-তখন ঝড়-তুফানের হানা। সবকিছুর মধ্যে সে সময়ের সেকান্দারিয়া লাইব্রেরির সেকান্দার সাহেবের কাছে একটি পত্রিকা পৌঁছাত। সেই লাইব্রেরিতে নিয়মিত যাওয়া হতো আবুল কাশেমের। হুট করে আবুল কাশেম ভাবলেন, পত্রিকা বিক্রি করলে কেমন হয়? সেই ’৮৪ সালে শুরু করেন সোনার বাংলা পত্রিকার হাতেগোনা কয়েকটি সংখ্যা দিয়ে। তারপর সময় গড়ায় আর আবুল কাশেম হাতিয়ার পাঠকদের হাতে তুলে দিতে থাকেন নতুন নতুন কাগজ।
এই দ্বীপে অন্য রকম এক আলোর বার্তা বয়ে আনেন ছোটদের ‘কাশেম কাকা’ আর বড়দের ‘কাশেম ভাই’। অথচ কত কষ্ট আর ত্যাগ স্বীকার করতে হয় তাঁকে, সেই খবর অনেকেরই অজানা। সেই গানটার মতোই, ‘প্রতিদিন কত খবর আসে যে কাগজের পাতা ভরে/জীবনপাতার অনেক খবর রয়ে যায় অগোচরে’। জমাটবাঁধা খবরের একগাদা কাগজ নিয়ে ছুটে বেড়ান হাতিয়ার এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। মানুষের কাছে নিত্যনতুন দেশের খবর, বিশ্বের খবর পৌঁছে দিয়ে জ্ঞানে ঋদ্ধ করতেই তো তাঁর এই ছুটে চলা। কী রকম কষ্ট আর ত্যাগ তিনি স্বীকার করেছেন এবং এখনো করছেন তা এই আধুনিক সময়ে ভাবনার মধ্যেই আসে না। পত্রিকা যেত আগে নোয়াখালী থেকে চরজব্বার ঘাটে, আর এখন যায় চেয়ারম্যান ঘাটে। তারপর হাতিয়া পৌঁছানোর জন্য নদী পাড়ি দিতে হতো কখনো সি-ট্রাকে, কখনো বা ট্রলারে। তারপর হাতিয়ায় পৌঁছে আবার মূল শহরে যাওয়ার জন্য পাড়ি দিতে হয় ট্যাক্সিযোগে অনেকটা পথ। সেখানে পৌঁছে আবার পুরো হাতিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া। নদীর ওপার থেকে কখন পত্রিকা এপারে মানে হাতিয়ায় পৌঁছাবে তার ঠিক নেই। কাশেম কাকার সেই অভিজ্ঞতাটা এমন—‘নদীর ঘাটে যাই, বই থাই। রাইত নাই, দিন নাই। সময়ের কোনো ঠিক-ঠিকানা নাই। এমনও অইছে, বিষ্টির রাইত, ঝড় আইছে, দোয়ানটোয়ান বন্ধ অই গেছে। খালি আই একলা বই রইছি বাতাস আর বিষ্টির মইধ্যে। ভিজি গেছি এক্কারে। হেসুমও কিছু আইয়ে ন (সি-ট্রাক বা ট্রলার)। কোনো কোনো সময় বিয়ালের (বিকেল) তেন রাইত হার হই বেনও (ভোর) অই গেছে। কিন্তু আই পেপারের লাই বই রইছি।’ এমন কত ঝড়-বাদলের দীর্ঘ রাত জেগে পত্রিকার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে, সেই হিসাব তাঁর কাছেও নেই। কেবল পাঠকের হাতে দ্রুত পত্রিকাটা পৌঁছে দিতে হবে। তার মনে হয়, হয়তো কোনো পাঠক দেশ-বিদেশের খবর কিংবা বিনোদন কিংবা চাকরির খবরটা জানতে এই কাগজের অপেক্ষায় বসে আছেন।
আবুল কাশেমের সঙ্গে যখন ওসখালী শাহজাহান সুপার মার্কেটের রোকেয়া হোমিও ফার্মেসিত্রে কথা হয়, সময় তখন রাত ১২টা। নিয়মিত যে দোকানটিতে বসে তিনি পত্রিকাগুলো সাজাতেন, সেই দোকানটি তখন বন্ধ হয়ে গেছে। মাত্রই সেদিনের কাগজ হাতে এসে পৌঁছেছে। পাঁচ সন্তানের মধ্যে বড় ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে কাগজগুলো পাঠকের হাত পৌঁছানোর প্রক্রিয়া চলছে। ছেলেকে দিয়ে শুধু এই সাজানোর কাজটাই করান। কখনো বিক্রি করান না। ছেলে তাঁর ডিগ্রিতে পড়ে। তাই নিজে, যত রাতই হোক, পৌঁছে দেন পত্রিকা সবার হাতে। কাশেম কাকার নিজের বসার কোনো জায়গা নেই। বৃষ্টি-বাদলার দিনে তাই কাগজ নিয়ে পড়েন বিপাকে। নিজে দোকান ভাড়া করতে গেলে লাভের চেয়ে বিনিয়োগই বেশি হয়ে যাবে। কেউ যদি একটা দোকানে বসে তাঁর পত্রিকা বিক্রির সুযোগ করে দিত তবে? নিখাদ আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, ‘তাইলে আই হেতেরে কইলজা লুটি খাওয়ামু’। তাঁর প্রতি চিরকালই কৃতজ্ঞ থাকতেন বিনয়ী এই মানুষটি।
নিজের পাঁচ ছেলে ক্রেনিয়েই তাঁর স্বপ্ন। একদিন আর্থিক অনটনের কারণে নিজের পড়ালেখা বন্ধ করে দিয়ে যে জগতে পা দিয়েছেন, নিজের সন্তানদের তিনি সেই জগতে দেখতে চান না। নিজের যতই কষ্ট হোক, সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে পত্রিকা হাতে অনবরত কড়া নেড়ে যান মানুষের দ্বারে দ্বারে। আলো জ্বালিয়ে যান হাতিয়ার ঘরে ঘরে। ২৬ বছর ধরে এই ৫৫ বছর বয়সী লোকটি হাতিয়ার মানুষকে নিভৃতে কতখানি ঋণী করে রেখেছেন তা তিনি নিজেও জানেন না। সংবাদপত্র যদি জ্ঞানের ভান্ডার হয়ে থাকে, তবে আবুল কাশেম নিশ্চয়ই হবেন সেই জ্ঞানের ফেরিওয়ালা।
দেশের দক্ষিণে নিঃসঙ্গ একটি দ্বীপ—হাতিয়া। সেখানে পৌঁছাতে এখনো মাঝেমধ্যে সময় লাগে দুই দিন। সবচেয়ে বড় সমস্যা এই দ্বীপের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগব্যবস্থা। জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করে এখানকার নৌযানগুলো চলাচল করে। সময় তখন ১৯৮৪ সাল। পরিবারের বড় দায়িত্ব নিয়ে হিমশিম খাওয়া আবুল কাশেমের সেই সময়টায় এই দ্বীপে জাতীয় পত্রিকা পাওয়া যেত না। একে তো খারাপ যোগাযোগব্যবস্থা, তার ওপর উপকূলীয় এলাকা বলে যখন-তখন ঝড়-তুফানের হানা। সবকিছুর মধ্যে সে সময়ের সেকান্দারিয়া লাইব্রেরির সেকান্দার সাহেবের কাছে একটি পত্রিকা পৌঁছাত। সেই লাইব্রেরিতে নিয়মিত যাওয়া হতো আবুল কাশেমের। হুট করে আবুল কাশেম ভাবলেন, পত্রিকা বিক্রি করলে কেমন হয়? সেই ’৮৪ সালে শুরু করেন সোনার বাংলা পত্রিকার হাতেগোনা কয়েকটি সংখ্যা দিয়ে। তারপর সময় গড়ায় আর আবুল কাশেম হাতিয়ার পাঠকদের হাতে তুলে দিতে থাকেন নতুন নতুন কাগজ।
এই দ্বীপে অন্য রকম এক আলোর বার্তা বয়ে আনেন ছোটদের ‘কাশেম কাকা’ আর বড়দের ‘কাশেম ভাই’। অথচ কত কষ্ট আর ত্যাগ স্বীকার করতে হয় তাঁকে, সেই খবর অনেকেরই অজানা। সেই গানটার মতোই, ‘প্রতিদিন কত খবর আসে যে কাগজের পাতা ভরে/জীবনপাতার অনেক খবর রয়ে যায় অগোচরে’। জমাটবাঁধা খবরের একগাদা কাগজ নিয়ে ছুটে বেড়ান হাতিয়ার এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। মানুষের কাছে নিত্যনতুন দেশের খবর, বিশ্বের খবর পৌঁছে দিয়ে জ্ঞানে ঋদ্ধ করতেই তো তাঁর এই ছুটে চলা। কী রকম কষ্ট আর ত্যাগ তিনি স্বীকার করেছেন এবং এখনো করছেন তা এই আধুনিক সময়ে ভাবনার মধ্যেই আসে না। পত্রিকা যেত আগে নোয়াখালী থেকে চরজব্বার ঘাটে, আর এখন যায় চেয়ারম্যান ঘাটে। তারপর হাতিয়া পৌঁছানোর জন্য নদী পাড়ি দিতে হতো কখনো সি-ট্রাকে, কখনো বা ট্রলারে। তারপর হাতিয়ায় পৌঁছে আবার মূল শহরে যাওয়ার জন্য পাড়ি দিতে হয় ট্যাক্সিযোগে অনেকটা পথ। সেখানে পৌঁছে আবার পুরো হাতিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া। নদীর ওপার থেকে কখন পত্রিকা এপারে মানে হাতিয়ায় পৌঁছাবে তার ঠিক নেই। কাশেম কাকার সেই অভিজ্ঞতাটা এমন—‘নদীর ঘাটে যাই, বই থাই। রাইত নাই, দিন নাই। সময়ের কোনো ঠিক-ঠিকানা নাই। এমনও অইছে, বিষ্টির রাইত, ঝড় আইছে, দোয়ানটোয়ান বন্ধ অই গেছে। খালি আই একলা বই রইছি বাতাস আর বিষ্টির মইধ্যে। ভিজি গেছি এক্কারে। হেসুমও কিছু আইয়ে ন (সি-ট্রাক বা ট্রলার)। কোনো কোনো সময় বিয়ালের (বিকেল) তেন রাইত হার হই বেনও (ভোর) অই গেছে। কিন্তু আই পেপারের লাই বই রইছি।’ এমন কত ঝড়-বাদলের দীর্ঘ রাত জেগে পত্রিকার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে, সেই হিসাব তাঁর কাছেও নেই। কেবল পাঠকের হাতে দ্রুত পত্রিকাটা পৌঁছে দিতে হবে। তার মনে হয়, হয়তো কোনো পাঠক দেশ-বিদেশের খবর কিংবা বিনোদন কিংবা চাকরির খবরটা জানতে এই কাগজের অপেক্ষায় বসে আছেন।
আবুল কাশেমের সঙ্গে যখন ওসখালী শাহজাহান সুপার মার্কেটের রোকেয়া হোমিও ফার্মেসিত্রে কথা হয়, সময় তখন রাত ১২টা। নিয়মিত যে দোকানটিতে বসে তিনি পত্রিকাগুলো সাজাতেন, সেই দোকানটি তখন বন্ধ হয়ে গেছে। মাত্রই সেদিনের কাগজ হাতে এসে পৌঁছেছে। পাঁচ সন্তানের মধ্যে বড় ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে কাগজগুলো পাঠকের হাত পৌঁছানোর প্রক্রিয়া চলছে। ছেলেকে দিয়ে শুধু এই সাজানোর কাজটাই করান। কখনো বিক্রি করান না। ছেলে তাঁর ডিগ্রিতে পড়ে। তাই নিজে, যত রাতই হোক, পৌঁছে দেন পত্রিকা সবার হাতে। কাশেম কাকার নিজের বসার কোনো জায়গা নেই। বৃষ্টি-বাদলার দিনে তাই কাগজ নিয়ে পড়েন বিপাকে। নিজে দোকান ভাড়া করতে গেলে লাভের চেয়ে বিনিয়োগই বেশি হয়ে যাবে। কেউ যদি একটা দোকানে বসে তাঁর পত্রিকা বিক্রির সুযোগ করে দিত তবে? নিখাদ আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, ‘তাইলে আই হেতেরে কইলজা লুটি খাওয়ামু’। তাঁর প্রতি চিরকালই কৃতজ্ঞ থাকতেন বিনয়ী এই মানুষটি।
নিজের পাঁচ ছেলে ক্রেনিয়েই তাঁর স্বপ্ন। একদিন আর্থিক অনটনের কারণে নিজের পড়ালেখা বন্ধ করে দিয়ে যে জগতে পা দিয়েছেন, নিজের সন্তানদের তিনি সেই জগতে দেখতে চান না। নিজের যতই কষ্ট হোক, সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে পত্রিকা হাতে অনবরত কড়া নেড়ে যান মানুষের দ্বারে দ্বারে। আলো জ্বালিয়ে যান হাতিয়ার ঘরে ঘরে। ২৬ বছর ধরে এই ৫৫ বছর বয়সী লোকটি হাতিয়ার মানুষকে নিভৃতে কতখানি ঋণী করে রেখেছেন তা তিনি নিজেও জানেন না। সংবাদপত্র যদি জ্ঞানের ভান্ডার হয়ে থাকে, তবে আবুল কাশেম নিশ্চয়ই হবেন সেই জ্ঞানের ফেরিওয়ালা।
No comments