রাজনীতি-দিনবদলের জন্য চাই বড় মন ও বড় মাপের নেতৃত্ব by সৈয়দ বদরুল আহ্সান
মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের এই বাংলাদেশে প্রয়াত পাকিস্তানি সামরিক শাসক আইউব খানের প্রভাব এখনো অনেকখানি রয়ে গেছে। আমরা বরাবরই তাঁকে গালমন্দ করে থাকি—এবং যথার্থ কারণেই—এবং এই দেশে এবং পাকিস্তানে যা কিছু মন্দ, যা কিছু কালো, এর প্রায় সবকিছুর পেছনে যে আইউব খানের অবদান রয়েছে, তা আমরা একটা বড় সত্যরূপে গণ্য করি।
হ্যাঁ, এও জানি আমরা যে এ ধরনের উক্তি করার ফলে অনেকেই কিছুটা বিস্মিত কিছুটা রাগাান্বিত হবেন। সে তা হোক গিয়ে। কিন্তু আমরা এ কথা কেন বলছি? এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যায়। সর্বত্রই একটা মানসিকতা কাজ করছে, যার মূলে হচ্ছে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করার, সবকিছু সীমিত করে দেওয়ার একটি প্রয়াস। এবং এই কাজটি করে যাচ্ছে সরকার নিজেই—যে সরকারের মূল নেতৃত্ব বিগত নির্বাচনের আগে জাতিকে পরিবর্তনের, দিনবদলের আশ্বাস দিয়েছিল। দিনবদল এখনো হয়নি। কবে হবে অথবা আদৌ হবে কি না, আমরা জানি না। যে দেশে সরকারি দলের পক্ষের ছাত্রগোষ্ঠী দিনের পর দিন বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং আইনশৃঙ্খলা ভেঙে ফেলে, সেখানে দিনবদলের আশা করাটা কি ঠিক হবে? এই গেল কিছুদিন আগে বাংলাদেশের মানুষের অতি প্রিয় ও গুণী পাঁচজন শিক্ষক সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যেন সরকারি দল সম্পূর্ণভাবে ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে ফেলে। এ ধরনের বক্তব্য তো অতীতে কোনো বড় মাপের মানুষ দেননি। তাহলে এখন কেন দিলেন? এর উত্তর একটাই—অতীতে ছাত্রলীগ টেন্ডার ব্যবসায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেনি; বরং দেশের গণতান্ত্রিক এবং মুক্তিসংগ্রামে অংশ নিতে গোটা জাতিকে উদু্বদ্ধ করেছে। বর্তমানের ছাত্রলীগ একটি ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা জনগণের মনে আতঙ্ক ও ভয় ছড়িয়ে দিচ্ছে।
ছাত্রলীগকে কি ভালো পথে আনা যায় না? দলের যেসব নেতা-কর্মী দেশে ত্রাসের সৃষ্টি করছে, তাদের কি গ্রেপ্তার করা যায় না? নাকি আমরা ধরে নেব যে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের কারণেই এসব টেন্ডারবাজকে ধরা যাবে না? আর যাঁরা এসব বেআইনি এবং অনৈতিক কাছে লিপ্ত, তাঁরা কি কখনো ভাবেন না যে ভবিষ্যতে আবারও পরিবর্তন হবে এবং তখন তাঁরাই নতুন এক সরকারের হাতে তাঁদের অপরাধের জন্য অনেক মাশুল দেবেন? আপনি হয়তো ভাবছেন সেই পুরোনো কথা—ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। খুব একটা ভুল হবে না যদি আপনি ওই মন্তব্যটি করেন। এই আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের কথাই ভাবুন। এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত উভয় দলই বিগত তত্ত্বাবধায়ক সকারের হাতে নাজেহাল হয়েছে। যেভাবে দুর্নীতির দায়ে এই দুটি দল তাদের নেতা-কর্মীদের করুণ পরিস্থিতির শিকার হতে দেখেছে, তাতে আমাদের মনে একটা ধারণা জন্মেছিল যে দুই দলই তাদের রাজনীতির ধারা এবং পন্থায় পরিবর্তন নিয়ে আসবে। কিন্তু নির্বাচনের পর ১৫ মাস যেতে না-যেতেই উভয় দলই সেই পুরোনো রাজনীতিতে ফিরে গেছে। জাতীয় সংসদ এবং সংসদের বাইরে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়, তাতে দেশের নাগরিক হিসেবে আপনার আমার সবারই লজ্জা হয়। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদদের সে ধরনের অনুভূতি বিন্দুমাত্র হয় না। তাঁরা আসলেই বিশ্বাস করেন যে, তাঁদের অতীতের দুরবস্থার জন্য দায়ী ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং দেশে জরুরি অবস্থা। হ্যাঁ, অনেক ক্ষেত্রে সেই সরকার বাড়াবাড়ি করেছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই সরকার আমাদের আশার আলো দেখিয়েছে।
সেই আলোয় ঘেরা জায়গাগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে—অথবা ছিল—দেশে দুর্নীতি দমন কমিশন। এবং আমরা সবাই আশা করেছিলাম যে নির্বাচনোত্তর অবস্থায় দুদক আরও কঠোর ও স্বাধীনভাবে কাজ করে যাবে, যেমনটি করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই ও ভারতের সিবিআই। কিন্তু সেটা আর হলো কই? পদে পদে দুদকের ক্ষমতা খর্ব করা হচ্ছে। কোনো সরকারি আমলার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে প্রথমে সরকারের অনুমতির প্রয়োজন হবে। অদ্ভুত একটি সিদ্ধান্ত। আর তা-ই যদি হয়, তবে দুর্নীতি দমন নিয়ে এত চিন্তাভাবনা কেন? দুদককে বাতিল করে দিলেই হয়। কিন্তু বাতিল করলে যে কী পরিমাণে সরকারকে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হবে, সেই সত্যটি সরকার নিজেই অনুধাবন করতে পারে। কিন্তু তাতেই বা আনন্দিত হতে হবে কেন আমাদের? সরকার তো দুর্নীতি দমন কমিশনকে ছোট করার নামে ক্ষমতাহীন করে ফেলার কাজে ব্যস্ত। যে দুদক শক্তিশালীভাবে পরিচালিত হয়েছে হাসান মশহুদ চৌধূরীর তত্ত্বাবধানে, সেই দুদক আর নেই, যদিও বা গোলাম রহমান সাহেব দুদকের মান-সম্মান রক্ষা করার কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন। কতটা সফল হবেন তিনি, সে বিষয়ে আমাদের কোনো ধারণা নেই। সরকার এবং বোধ করি বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনীতিবিদই বলেন যে দুদক যেন আর কোনো দিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। ওই যে আইউব খানের কথা বলছিলাম? ওই যে তাঁর মৌলিক গণতন্ত্র, Basic Democracy, ওটা আমাদের কাজকর্মে ও মানসিকতায় প্রকটভাবে রয়ে গেছে। এই যে কয়েক দিন আগে যোগাযোগমন্ত্রী সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে সরকারি কাগজপত্র হস্তান্তর করতে অস্বীকার করেছেন এই বলে যে, এর সঙ্গে গোপনীয়তার বিষয়টি জড়িত এতেই বোঝা যায় গণতন্ত্র কী রকমের কোণঠাসা পরিস্থিতিতে আটক রয়েছে। মন্ত্রীকে সংসদীয় কমিটি বাধ্য করল না কেন ওই দলিলপত্রগুলো তার হাতে তুলে দিতে? তিনি কোন সাহসে বলতে পারলেন যে, তিনি কমিটির আবেদন মেনে নেবেন না? যদি যুক্তরাজ্যে টনি ব্লেয়ার ইরাক অনুসন্ধান কমিটির সামনে উপস্থিত হতে পারেন কমিটির প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য, তাহলে আমাদের মন্ত্রীরা কেন সেই একই কাজ জাতীয় সংসদের কমিটির ব্যাপারে করবেন না?
গণতন্ত্র কী ধীরগতিতে এবং পরিষ্কারভাবে তার শক্তি হারিয়ে ফেলছে, সেটা লক্ষ করা যায় উপজেলাগুলোর দিকে তাকালে। দেশে যে শক্তিশালী স্থানীয় সরকারের একটি বড় ধরনের প্রয়োজনীয়তা আছে, সে বিষয়ে দেশবাসী মোটামুটি একমত। কিন্তু সরকারের মতামত মনে হচ্ছে অন্য রকম। নির্বাচিত উপজেলার ওপর মনে হয় সব শ্রেণীর মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়বে এখন। একবার শুনতে পাই, উপজেলা পরিষদের ওপর বসিয়ে দেওয়া হবে স্থানীয় সাংসদকে। আর তা-ই যদি হয়, তবে নির্বাচিত উপজেলা কেন? এখন আবার ভাবা হচ্ছে, আরও কী করে উপজেলা পরিষদের ক্ষমতা বেশি করে খর্ব করা যায়। এবং হবে যখন উপজেলা কর্মকর্তাকে উপজেলা পরিষদের চেয়েও বেশি ক্ষমতা দেওয়া হবে। অতএব যতই দিন যাচ্ছে, ততই আমরা মনে করছি যে বাংলাদেশে শক্তিশালী ও প্রাণবন্ত গণতান্ত্রিকব্যবস্থা আর গড়ে উঠবে না। আর সেটা না হলে যে রাষ্ট্র শক্তি হারাবে এবং সমাজ পরিবর্তনের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি সাধিত হবে না, সেই সত্যটি কত লোকেই বা বোঝে? ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে যে ব্যাপক সুফল আসে, সেই বাস্তব সত্যটি অনুধাবন করতে পারছে না সরকার। আমাদের কেন ধরে নিতে হবে যে সাংসদ এবং সরকারি আমলাই হচ্ছে দেশ পরিচালনার পেছনে মূল শক্তি? আর যদি উপজেলা তথা স্থানীয় সরকার পদ্ধতি এই স্থবির অবস্থায়ই থাকে, তাহলে দেশে যে একটি পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিকব্যবস্থা গড়ে উঠবে, সেই আশা করাটাই বোকামি হবে।
দিনবদলের রাজনীতি ওই সব ব্যক্তি দ্বারাই সম্পন্ন হতে পারে, যাঁরা উদার এবং ভবিষ্যত্ প্রজন্মের কথা ভাবেন। এবং যাঁরা উদার তাঁরা ভুল করেন ও সেই ভুল স্বীকার করেন এবং স্বীকার করে আবার সঠিক পথ ধরে হাঁটা শুরু করেন। এই যে হাইকোর্টের নবনিযুক্ত দুই বিচারকের শপথ নেওয়াকে কেন্দ্র করে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে, তার অবসান হওয়া দরকার। সরকারের উচিত হবে দুজনের নামই প্রত্যাহার করা। প্রধান বিচারপতি তাঁদের দুজনের নাম দেখেছেন বা গ্রহণ করেছিলেন কি না, সেটা মুখ্য বিষয় নয়। এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে এই দুজনের নিয়োগের ব্যাপারে জনমনে স্বাভাবিক কারণেই অনেক প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। সরকারের উচিত হবে না উচ্চ আদালত এবং প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কোনো সংঘাতে জড়িয়ে পড়া। আমাদের সবারই কাম্য একটি স্বাধীন বিচারব্যবস্থা এবং সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে সরকারকে হলে বর্তমান এই সংকটে নমনীয় হতে হবে। ওই দুই ব্যক্তির নাম প্রত্যাহার করলে সরকারের জনপ্রিয়তার কোনো কমতি হবে না। বরং তা নৈতিক সাহসের পরিচায়ক হয়ে থাকবে।
দিনবদলের রাজনীতি আমাদের সবার মনের কথা। কিন্তু দিনবদল যদি কেবল শাসক বদল বোঝায়, কোনো গুণগত পরিবর্তন বয়ে না আনে, তাহলে বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ নিয়ে আমরা দুশ্চিন্তায় পড়ে যাব। বিগত বিএনপি-জামায়াত সরকার দেশে দুঃশাসন চালিয়েছে। তাই বলে আওয়ামী লীগ ভালো সরকার পরিচালনা করবে না কেন? যুবদল ও ছাত্রদল আমাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। সেই একই কাজ ছাত্রলীগ করবে কেন? তখনকার সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা কথা বেশি বলেছেন, কাজ করেননি। ওই একই নিয়মে বর্তমান সরকার চলবে কেন? বেগম জিয়া তাঁর ছেলের কারণে অনেক দুর্নাম কুড়িয়েছেন। এরপর কেন শেখ হাসিনা তাঁর নিজের ছেলেকে রাজনীতিতে নিয়ে আসবেন?
হ্যাঁ, আমাদের দিন বদলে দিন—জনগণের ক্ষমতায়নের মধ্য দিয়ে। উপজেলা-ব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন ও অন্যান্য জাতীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা খর্ব করে দিন বদলানো যাবে না। যে রাজনৈতিকব্যবস্থায় দেশের প্রধানমন্ত্রী সব অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন এবং সব বিষয়ে সব মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেন, সেই রাজনৈতিকব্যবস্থায় কেবল দিন আসে আর দিন চলে যায়। দিন বদলায় না। পরিবর্তনের জন্য দরকার উদার চিন্তাশক্তি এবং বড় মাপের ও মনের নেতৃত্ব। তা নাহলে ওই আইউব খানের কথাই বারবার মনে পড়বে আমাদের।
সৈয়দ বদরুল আহ্সান: সাংবাদিক।
ছাত্রলীগকে কি ভালো পথে আনা যায় না? দলের যেসব নেতা-কর্মী দেশে ত্রাসের সৃষ্টি করছে, তাদের কি গ্রেপ্তার করা যায় না? নাকি আমরা ধরে নেব যে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের কারণেই এসব টেন্ডারবাজকে ধরা যাবে না? আর যাঁরা এসব বেআইনি এবং অনৈতিক কাছে লিপ্ত, তাঁরা কি কখনো ভাবেন না যে ভবিষ্যতে আবারও পরিবর্তন হবে এবং তখন তাঁরাই নতুন এক সরকারের হাতে তাঁদের অপরাধের জন্য অনেক মাশুল দেবেন? আপনি হয়তো ভাবছেন সেই পুরোনো কথা—ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। খুব একটা ভুল হবে না যদি আপনি ওই মন্তব্যটি করেন। এই আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের কথাই ভাবুন। এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত উভয় দলই বিগত তত্ত্বাবধায়ক সকারের হাতে নাজেহাল হয়েছে। যেভাবে দুর্নীতির দায়ে এই দুটি দল তাদের নেতা-কর্মীদের করুণ পরিস্থিতির শিকার হতে দেখেছে, তাতে আমাদের মনে একটা ধারণা জন্মেছিল যে দুই দলই তাদের রাজনীতির ধারা এবং পন্থায় পরিবর্তন নিয়ে আসবে। কিন্তু নির্বাচনের পর ১৫ মাস যেতে না-যেতেই উভয় দলই সেই পুরোনো রাজনীতিতে ফিরে গেছে। জাতীয় সংসদ এবং সংসদের বাইরে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়, তাতে দেশের নাগরিক হিসেবে আপনার আমার সবারই লজ্জা হয়। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদদের সে ধরনের অনুভূতি বিন্দুমাত্র হয় না। তাঁরা আসলেই বিশ্বাস করেন যে, তাঁদের অতীতের দুরবস্থার জন্য দায়ী ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং দেশে জরুরি অবস্থা। হ্যাঁ, অনেক ক্ষেত্রে সেই সরকার বাড়াবাড়ি করেছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই সরকার আমাদের আশার আলো দেখিয়েছে।
সেই আলোয় ঘেরা জায়গাগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে—অথবা ছিল—দেশে দুর্নীতি দমন কমিশন। এবং আমরা সবাই আশা করেছিলাম যে নির্বাচনোত্তর অবস্থায় দুদক আরও কঠোর ও স্বাধীনভাবে কাজ করে যাবে, যেমনটি করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই ও ভারতের সিবিআই। কিন্তু সেটা আর হলো কই? পদে পদে দুদকের ক্ষমতা খর্ব করা হচ্ছে। কোনো সরকারি আমলার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে প্রথমে সরকারের অনুমতির প্রয়োজন হবে। অদ্ভুত একটি সিদ্ধান্ত। আর তা-ই যদি হয়, তবে দুর্নীতি দমন নিয়ে এত চিন্তাভাবনা কেন? দুদককে বাতিল করে দিলেই হয়। কিন্তু বাতিল করলে যে কী পরিমাণে সরকারকে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হবে, সেই সত্যটি সরকার নিজেই অনুধাবন করতে পারে। কিন্তু তাতেই বা আনন্দিত হতে হবে কেন আমাদের? সরকার তো দুর্নীতি দমন কমিশনকে ছোট করার নামে ক্ষমতাহীন করে ফেলার কাজে ব্যস্ত। যে দুদক শক্তিশালীভাবে পরিচালিত হয়েছে হাসান মশহুদ চৌধূরীর তত্ত্বাবধানে, সেই দুদক আর নেই, যদিও বা গোলাম রহমান সাহেব দুদকের মান-সম্মান রক্ষা করার কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন। কতটা সফল হবেন তিনি, সে বিষয়ে আমাদের কোনো ধারণা নেই। সরকার এবং বোধ করি বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনীতিবিদই বলেন যে দুদক যেন আর কোনো দিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। ওই যে আইউব খানের কথা বলছিলাম? ওই যে তাঁর মৌলিক গণতন্ত্র, Basic Democracy, ওটা আমাদের কাজকর্মে ও মানসিকতায় প্রকটভাবে রয়ে গেছে। এই যে কয়েক দিন আগে যোগাযোগমন্ত্রী সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে সরকারি কাগজপত্র হস্তান্তর করতে অস্বীকার করেছেন এই বলে যে, এর সঙ্গে গোপনীয়তার বিষয়টি জড়িত এতেই বোঝা যায় গণতন্ত্র কী রকমের কোণঠাসা পরিস্থিতিতে আটক রয়েছে। মন্ত্রীকে সংসদীয় কমিটি বাধ্য করল না কেন ওই দলিলপত্রগুলো তার হাতে তুলে দিতে? তিনি কোন সাহসে বলতে পারলেন যে, তিনি কমিটির আবেদন মেনে নেবেন না? যদি যুক্তরাজ্যে টনি ব্লেয়ার ইরাক অনুসন্ধান কমিটির সামনে উপস্থিত হতে পারেন কমিটির প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য, তাহলে আমাদের মন্ত্রীরা কেন সেই একই কাজ জাতীয় সংসদের কমিটির ব্যাপারে করবেন না?
গণতন্ত্র কী ধীরগতিতে এবং পরিষ্কারভাবে তার শক্তি হারিয়ে ফেলছে, সেটা লক্ষ করা যায় উপজেলাগুলোর দিকে তাকালে। দেশে যে শক্তিশালী স্থানীয় সরকারের একটি বড় ধরনের প্রয়োজনীয়তা আছে, সে বিষয়ে দেশবাসী মোটামুটি একমত। কিন্তু সরকারের মতামত মনে হচ্ছে অন্য রকম। নির্বাচিত উপজেলার ওপর মনে হয় সব শ্রেণীর মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়বে এখন। একবার শুনতে পাই, উপজেলা পরিষদের ওপর বসিয়ে দেওয়া হবে স্থানীয় সাংসদকে। আর তা-ই যদি হয়, তবে নির্বাচিত উপজেলা কেন? এখন আবার ভাবা হচ্ছে, আরও কী করে উপজেলা পরিষদের ক্ষমতা বেশি করে খর্ব করা যায়। এবং হবে যখন উপজেলা কর্মকর্তাকে উপজেলা পরিষদের চেয়েও বেশি ক্ষমতা দেওয়া হবে। অতএব যতই দিন যাচ্ছে, ততই আমরা মনে করছি যে বাংলাদেশে শক্তিশালী ও প্রাণবন্ত গণতান্ত্রিকব্যবস্থা আর গড়ে উঠবে না। আর সেটা না হলে যে রাষ্ট্র শক্তি হারাবে এবং সমাজ পরিবর্তনের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি সাধিত হবে না, সেই সত্যটি কত লোকেই বা বোঝে? ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে যে ব্যাপক সুফল আসে, সেই বাস্তব সত্যটি অনুধাবন করতে পারছে না সরকার। আমাদের কেন ধরে নিতে হবে যে সাংসদ এবং সরকারি আমলাই হচ্ছে দেশ পরিচালনার পেছনে মূল শক্তি? আর যদি উপজেলা তথা স্থানীয় সরকার পদ্ধতি এই স্থবির অবস্থায়ই থাকে, তাহলে দেশে যে একটি পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিকব্যবস্থা গড়ে উঠবে, সেই আশা করাটাই বোকামি হবে।
দিনবদলের রাজনীতি ওই সব ব্যক্তি দ্বারাই সম্পন্ন হতে পারে, যাঁরা উদার এবং ভবিষ্যত্ প্রজন্মের কথা ভাবেন। এবং যাঁরা উদার তাঁরা ভুল করেন ও সেই ভুল স্বীকার করেন এবং স্বীকার করে আবার সঠিক পথ ধরে হাঁটা শুরু করেন। এই যে হাইকোর্টের নবনিযুক্ত দুই বিচারকের শপথ নেওয়াকে কেন্দ্র করে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে, তার অবসান হওয়া দরকার। সরকারের উচিত হবে দুজনের নামই প্রত্যাহার করা। প্রধান বিচারপতি তাঁদের দুজনের নাম দেখেছেন বা গ্রহণ করেছিলেন কি না, সেটা মুখ্য বিষয় নয়। এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে এই দুজনের নিয়োগের ব্যাপারে জনমনে স্বাভাবিক কারণেই অনেক প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। সরকারের উচিত হবে না উচ্চ আদালত এবং প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কোনো সংঘাতে জড়িয়ে পড়া। আমাদের সবারই কাম্য একটি স্বাধীন বিচারব্যবস্থা এবং সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে সরকারকে হলে বর্তমান এই সংকটে নমনীয় হতে হবে। ওই দুই ব্যক্তির নাম প্রত্যাহার করলে সরকারের জনপ্রিয়তার কোনো কমতি হবে না। বরং তা নৈতিক সাহসের পরিচায়ক হয়ে থাকবে।
দিনবদলের রাজনীতি আমাদের সবার মনের কথা। কিন্তু দিনবদল যদি কেবল শাসক বদল বোঝায়, কোনো গুণগত পরিবর্তন বয়ে না আনে, তাহলে বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ নিয়ে আমরা দুশ্চিন্তায় পড়ে যাব। বিগত বিএনপি-জামায়াত সরকার দেশে দুঃশাসন চালিয়েছে। তাই বলে আওয়ামী লীগ ভালো সরকার পরিচালনা করবে না কেন? যুবদল ও ছাত্রদল আমাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। সেই একই কাজ ছাত্রলীগ করবে কেন? তখনকার সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা কথা বেশি বলেছেন, কাজ করেননি। ওই একই নিয়মে বর্তমান সরকার চলবে কেন? বেগম জিয়া তাঁর ছেলের কারণে অনেক দুর্নাম কুড়িয়েছেন। এরপর কেন শেখ হাসিনা তাঁর নিজের ছেলেকে রাজনীতিতে নিয়ে আসবেন?
হ্যাঁ, আমাদের দিন বদলে দিন—জনগণের ক্ষমতায়নের মধ্য দিয়ে। উপজেলা-ব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন ও অন্যান্য জাতীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা খর্ব করে দিন বদলানো যাবে না। যে রাজনৈতিকব্যবস্থায় দেশের প্রধানমন্ত্রী সব অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন এবং সব বিষয়ে সব মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেন, সেই রাজনৈতিকব্যবস্থায় কেবল দিন আসে আর দিন চলে যায়। দিন বদলায় না। পরিবর্তনের জন্য দরকার উদার চিন্তাশক্তি এবং বড় মাপের ও মনের নেতৃত্ব। তা নাহলে ওই আইউব খানের কথাই বারবার মনে পড়বে আমাদের।
সৈয়দ বদরুল আহ্সান: সাংবাদিক।
No comments