অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের অপমান, বাংলাদেশের অপমান!
কিছু কিছু মানুষ আছেন যাঁদের শ্রদ্ধা করা যায় অন্তরের অন্তস্তল থেকে। কেননা এ শ্রদ্ধা কেবল কোনো ব্যক্তিমানুষের চৌহদ্দিতে সীমাবদ্ধ থাকে না, হয়ে উঠে দেশমাতৃকার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ। কিছু কিছু মানুষ আছেন যাঁদের ভালোবাসা যায় প্রাণভরে, কেননা তাঁদের প্রতি ভালোবাসা দেশের প্রতি ভালোবাসার সমার্থক হয়ে ওঠেন।
কিছু কিছু মানুষ আছেন যাঁদের অবনত মস্তকে প্রণাম করা যায়; যেভাবে প্রণাম করতে হয় জাতীয় পতাকাকে, কেননা এ মানুষগুলো নিজেদের কর্মগুণে জাতীয় পতাকার সমতুল্য জাতীয় প্রতীক হয়ে ওঠেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এ রকম একজন ব্যক্তি যাঁকে ভালোবাসা যায়, শ্রদ্ধা করা যায় এবং অবনত মস্তকে প্রণাম করা যায়। তাই অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে 'অপমান' করা, দেশকে, দেশাত্মবোধকে এবং জাতীয় পতাকাকে অবমাননা করার শামিল। এ তুলনা এখানে এ কারণেই অধিকতর যুক্তিযুক্ত যে, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সম্প্রতি অপমানিত হয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হিসেবে আদালতে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে। তাই অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তখন আর ব্যক্তি থাকেন না, তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ ও সম্ভ্রম হারানো দুই লাখ মা-বোনের প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন। তখন তাঁর অপমান এ দেশের ১৬ কোটি মানুষের অপমান হয়ে ওঠে। ১৪ মে আদালতের ভেতরে এবং বাইরে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সুষ্পষ্ট বক্তব্য রাখার কারণে, অধ্যাপক আনিসুজ্জামাকে 'মিথ্যুক' বলে অপমান করা হয়। এ ঘটনায় আমরা চরমভাবে অপমানিত বোধ করি। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা সেলের সদস্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস, বাংলা একাডেমীর বর্তমান সভাপতি, বরেণ্য শিক্ষাবিদ এবং সব প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামের সোচ্চার কণ্ঠস্বর অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তিনি ১৪ মে আদালতে ঘৃণিত যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর যুদ্ধাপরাধের ঘটনায় জবানবন্দি দিয়েছেন। স্বাধীনতার চেতনাধারী এ দেশের প্রতিটি মানুষের বহুল প্রতীক্ষিত এ বিচারকার্যে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়ে তিনি জাতীয় দায়িত্বই পালন করেছেন। আমরা এই সাহসী মানুষটির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও অভিবাদন জানাই। কেননা এ দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদ যখন দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করে ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারার হালুয়া-রুটি খাওয়ার মাতাল তালে বেঘোর, তখন অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে আমরা দেখতে পাই আদালতে গিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের একজন সাক্ষী হয়ে ১৯৭১ সালে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের সাক্ষ্য দিতে। আমরা মনে করি, তিনি জাতির বিবেকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি এ দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের বিদেহী আত্মার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এ দেশের ১৬ কোটি মানুষের, গুটিকয়েক রাজাকার এবং তাদের নব্য দোসর ব্যতীত, জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের এ মামলায় অভিযুক্ত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর তথাকথিত আইনজীবী স্বাধীনতাবিরোধীদের দোসর ফখরুল ইসলাম মহামান্য আদালতে এবং আদালতের বাইরে মিডিয়ার সামনে অত্যন্ত অশ্লীলভাবে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে 'মিথ্যুক' বলে আখ্যা দিয়েছেন। সংবাদপত্রের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি, ১৪ মে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সাক্ষ্য শেষে জেরা শুরুর একপর্যায়ে ওই ফখরুল বলেছেন, 'আনিসুজ্জামান কত বড় মিথ্যুক তা তিনি দেখিয়ে দেবেন।' সে সময় আদালত এতে আপত্তি জানালেও তা উপেক্ষা করে তিনি আদালতের বাইরে সাংবাদিকদের কাছে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সম্পর্কে অনুরূপ অশ্লীল ভাষার পুনরাবৃত্তি করেন।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান কেন আদালতে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে গেলেন? এখানে তাঁর ব্যক্তিগত লাভালাভের কোনো বিষয় নেই। তিনি জাতির বিবেক হিসেবে, চেতনার তাড়নায়, মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন সক্রিয় যোদ্ধা এবং সংগঠক হিসেবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সপক্ষে এ দেশের আপামর গণমানুষের অনুচ্চারিত অভিব্যক্তি ব্যক্ত করতেই তিনি আদালতে গিয়েছিলেন। তাই অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে 'মিথ্যুক' বলে কটূক্তি করাকে আমরা যুদ্ধাপরাধীদের ঘৃণিত, অবৈধ এবং নিন্দিত আস্ফালন বলে মনে করি। আমরা এ ন্যক্কারজনক ঘটনার তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করছি। আমরা মনে করি, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষাবলম্বনকারী ওই আইনজীবী ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত বর্বর, যা তাঁর বিকৃত রুচিরই পরিচায়ক। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মতো মানুষের প্রতি তাঁর এ আস্ফালন জাতির বিবেকের প্রতিই চরম অবমাননা হিসেবে অনুভব করছি। আমরা আইনজীবী ফখরুলের ধৃষ্টতার প্রতি ধিক্কার জানাই এবং আদালত অবমাননার জন্য তাঁকে অবিলম্বে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি। আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই। তাই যাঁরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে বিলম্বিত ও বাধাগ্রস্ত করতে চায় এবং সে প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মতো মনীষাকে 'মিথ্যুক' বলে অপমান করার দুঃসাহস দেখায়, তাঁদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এ দেশের প্রতিটি নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব বলে আমরা মনে করি। কেননা, আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের অপমান, বাংলাদেশের অপমান। আর বাংলাদেশের অপমানে আমরা আর নিশ্চুপ ঘরে বসে থাকতে পারি না।
লেখকবৃন্দ : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা সেলের সদস্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস, বাংলা একাডেমীর বর্তমান সভাপতি, বরেণ্য শিক্ষাবিদ এবং সব প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামের সোচ্চার কণ্ঠস্বর অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তিনি ১৪ মে আদালতে ঘৃণিত যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর যুদ্ধাপরাধের ঘটনায় জবানবন্দি দিয়েছেন। স্বাধীনতার চেতনাধারী এ দেশের প্রতিটি মানুষের বহুল প্রতীক্ষিত এ বিচারকার্যে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়ে তিনি জাতীয় দায়িত্বই পালন করেছেন। আমরা এই সাহসী মানুষটির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও অভিবাদন জানাই। কেননা এ দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদ যখন দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করে ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারার হালুয়া-রুটি খাওয়ার মাতাল তালে বেঘোর, তখন অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে আমরা দেখতে পাই আদালতে গিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের একজন সাক্ষী হয়ে ১৯৭১ সালে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের সাক্ষ্য দিতে। আমরা মনে করি, তিনি জাতির বিবেকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি এ দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের বিদেহী আত্মার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এ দেশের ১৬ কোটি মানুষের, গুটিকয়েক রাজাকার এবং তাদের নব্য দোসর ব্যতীত, জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের এ মামলায় অভিযুক্ত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর তথাকথিত আইনজীবী স্বাধীনতাবিরোধীদের দোসর ফখরুল ইসলাম মহামান্য আদালতে এবং আদালতের বাইরে মিডিয়ার সামনে অত্যন্ত অশ্লীলভাবে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে 'মিথ্যুক' বলে আখ্যা দিয়েছেন। সংবাদপত্রের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি, ১৪ মে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সাক্ষ্য শেষে জেরা শুরুর একপর্যায়ে ওই ফখরুল বলেছেন, 'আনিসুজ্জামান কত বড় মিথ্যুক তা তিনি দেখিয়ে দেবেন।' সে সময় আদালত এতে আপত্তি জানালেও তা উপেক্ষা করে তিনি আদালতের বাইরে সাংবাদিকদের কাছে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সম্পর্কে অনুরূপ অশ্লীল ভাষার পুনরাবৃত্তি করেন।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান কেন আদালতে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে গেলেন? এখানে তাঁর ব্যক্তিগত লাভালাভের কোনো বিষয় নেই। তিনি জাতির বিবেক হিসেবে, চেতনার তাড়নায়, মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন সক্রিয় যোদ্ধা এবং সংগঠক হিসেবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সপক্ষে এ দেশের আপামর গণমানুষের অনুচ্চারিত অভিব্যক্তি ব্যক্ত করতেই তিনি আদালতে গিয়েছিলেন। তাই অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে 'মিথ্যুক' বলে কটূক্তি করাকে আমরা যুদ্ধাপরাধীদের ঘৃণিত, অবৈধ এবং নিন্দিত আস্ফালন বলে মনে করি। আমরা এ ন্যক্কারজনক ঘটনার তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করছি। আমরা মনে করি, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষাবলম্বনকারী ওই আইনজীবী ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত বর্বর, যা তাঁর বিকৃত রুচিরই পরিচায়ক। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মতো মানুষের প্রতি তাঁর এ আস্ফালন জাতির বিবেকের প্রতিই চরম অবমাননা হিসেবে অনুভব করছি। আমরা আইনজীবী ফখরুলের ধৃষ্টতার প্রতি ধিক্কার জানাই এবং আদালত অবমাননার জন্য তাঁকে অবিলম্বে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি। আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই। তাই যাঁরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে বিলম্বিত ও বাধাগ্রস্ত করতে চায় এবং সে প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মতো মনীষাকে 'মিথ্যুক' বলে অপমান করার দুঃসাহস দেখায়, তাঁদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এ দেশের প্রতিটি নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব বলে আমরা মনে করি। কেননা, আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের অপমান, বাংলাদেশের অপমান। আর বাংলাদেশের অপমানে আমরা আর নিশ্চুপ ঘরে বসে থাকতে পারি না।
লেখকবৃন্দ : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক।
No comments