আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস-নৃত্যকলায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করুণ by লায়লা হাসান

মুক্তসুরের ছন্দে সব অন্ধকার, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা দূর করে আলোকিত হওয়া ও আলোকিত করার লক্ষ্যে ১৯৯২ সাল থেকে ২৯ এপ্রিল আমরা আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস পালন করে আসছি।২৯ এপ্রিল দিনটি উদ্যাপনের কারণ হিসেবে বলা যায় ফ্রান্সের একজন নৃত্য সংস্কারক জাঁ জর্জেস নভেরার জন্ম ১৭২৭ সালের এপ্রিল মাসের এ দিনটিতে।


নভেরা নৃত্যকে ক্ষুদ্র গণ্ডি ও সংকীর্ণতাকে মুক্ত করে অপেরায় উন্নীত করেন। তাঁর Letters of dancing নৃত্যে নবযুগ রচনা করেছে। এই অগ্রদূত নৃত্যশিল্পী ও তাঁর অবদানকে চিরভাস্বর করে রাখার প্রয়াসে ইউনেসকো এই বিশেষ দিনটি ধার্য করেছে। ১৯৮২ সালে আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস প্রথম পালিত হয় ফ্রান্সে।
১৯৯২ সালে আমরা যখন (ইন্টারন্যাশানাল ডান্স কাউন্সিল) এ দিনটি উদ্যাপন করা আরম্ভ করি, তখন এর গণ্ডি ছিল ক্ষুদ্র, ক্রমে এ দিনটি উদ্যাপনের কর্মকাণ্ড ব্যাপকতা লাভ করে। বর্তমানে দেশব্যাপী বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থা এ দিনটি সাড়ম্বরে উদ্যাপন করছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল, বিভাগ, জেলা শহরগুলো নিজ নিজ এলাকায় ওই একই ব্যানারে দিনটি পালন করে থাকে। শুধু নৃত্যানুষ্ঠান পরিবেশনই আমাদের মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নয়, আমাদের উদ্দেশ্য সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে নৃত্যশিল্পকে মূল্যায়ন করা ও মর্যাদা প্রদান। আমরা জানি, নৃত্য শুধু বিনোদন নয়, নৃত্যশিল্প জীবনের কথা বলে, জনগণের চাওয়া, না পাওয়া, হতাশা, বঞ্চনার কথা বলে, স্বাধিকার আদায়ের কথা বলে। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, নারীমুক্তি আন্দোলন, মানবাধিকার প্রতিটি বিষয়ই বিবৃত হয় আমাদের নৃত্যকলার মাধ্যমে। আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি, নৃত্য জীবনের প্রতিফলন, জীবনের প্রতিবিম্ব।
আগামী প্রজন্ম যারা সোনার বাংলার ভবিষ্যত্ তাদের মেধা ও মননের যথাযথ বিকাশের জন্য প্রাথমিক পাঠক্রম থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাঠক্রম পর্যন্ত নৃত্যকলাকে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্তি করা একান্ত প্রয়োজন। এর কোনো বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা একান্ত অপরিহার্য।

২.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগের মতো নাট্যকলা, সংগীতকলা বিভাগের পাশাপাশি আমরা একটি স্বতন্ত্র নৃত্যকলা বিভাগ প্রতিষ্ঠার আবেদন রেখেছি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে। সংস্থার পক্ষ থেকে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পৃথক পৃথক বৈঠক করে এ দাবি উত্থাপন করা হয় এবং কর্তৃপক্ষও এ ব্যাপারে মতৈক্য পোষণ করে। ৮ এপ্রিল বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থা একটি সেমিনারের আয়োজন করে। এখানে এ প্রসঙ্গে আলোচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, উপ-উপাচার্য হারুনুর রশীদ, কলা অনুষদের ডিন সদরুল আমীন এবং নাট্যকলা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ইস্রাফিল শাহীন। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন নৃত্যগুরু আমানুল হক।
সেমিনারে সম্মানিত অতিথিদের বক্তব্যের কিছু অংশ এ নিবন্ধে উদ্ধৃত করছি—মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি নৃত্যশিল্পী সংস্থার এই দাবি সমর্থন করছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ের প্রায় ৭০টি বিভাগ রয়েছে শুধু নেই নৃত্যকলা বিভাগ। কিন্তু সবকিছুরই প্রক্রিয়া আছে। প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এলে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই নৃত্যকলা বিভাগ প্রতিষ্ঠার।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘উপাচার্য হিসেবে নয়, একজন সাধারণ মানুষ, একজন শিক্ষক হিসেবে বুঝি সংস্কৃতি, বিজ্ঞান মানুষের মেধা-মননকে ঋদ্ধ করে, চিত্তশুদ্ধি ঘটায়। বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যময় সংস্কৃতির গৌরব সর্বজনবিদিত। তাই শিক্ষা ও সংস্কৃতির সমন্বয় প্রয়োজন। নৃত্যশিল্পের সৃজনশীল-প্রক্রিয়া বুদ্ধিবৃত্তি, সুকুমার বৃত্তির বিকাশের ক্ষেত্রে অপরিহার্য। স্বতন্ত্র নৃত্যকলা বিভাগের প্রবর্তন করার জন্য এ দাবি অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং সময়োচিত।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপচার্য হারুনুুর রশীদ এই বিভাগ প্রতিষ্ঠার সমর্থনে বলেন, ‘নৃত্যশিল্প প্রাচীনতম শিল্প। আশ্চর্যের ব্যাপার, এ বিষয়টিকে এখনো শিক্ষাব্যবস্থার তালিকাভুক্ত করা হয়নি। এ ঔদাসীন্য আমাদের পীড়া দেয়। আমার ধারণা, নৃত্যকলা বিভাগ একটি অত্যন্ত সফল বিভাগ হিসেবে সুনাম অর্জন করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিভাগ থাকা অপরিহার্য। আমার বিশ্বাস, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমশনের সহযোগিতায় এই বিভাগের প্রতিষ্ঠা হবে অচিরে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন সদরুল আমীন নৃত্যশিল্পের মনোমুগ্ধকর নৈপুণ্যের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘নৃত্যকলা বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হলে অনেক অজানা দিক উন্মোচিত হবে, অনেক ভ্রান্ত ধারণা ও অন্ধকার দূরীভূত হবে এবং শিক্ষার্থীরা হবেন আলোকিত ও সংস্কারমুক্ত।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের বক্তব্য আমাদের মনে আশার সঞ্চার করেছে। আশা করছি, আমরা আমাদের ঈপ্সিত লক্ষ্যে অচিরেই পৌঁছাতে পারব।
শুধু অনুষ্ঠানসর্বস্ব নৃত্যশিক্ষা বা পরিবেশন নয়, আমাদের মূল লক্ষ্য হবে নৃত্যশিল্প ও নৃত্যশিল্পীকে সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সম্মানীয় স্থানে অধিষ্ঠিত করা। নৃত্যই আমাদের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, তাই আমরা দৃঢ়প্রত্যয়ের সঙ্গে উচ্চারণ করি—
আজ নয় কাল নয় পরশু/বিভাবরী সূর্য উঠবেই/একদিন না একদিন।
লায়লা হাসান: নৃত্য পরিচালক।

No comments

Powered by Blogger.