সাদাসিধে কথা-বাংলাদেশ হবে পৃথিবীর আস্তাকুঁড়? by মুহম্মদ জাফর ইকবাল
জাহাজভাঙা ‘শিল্প’ নিয়ে আমরা সবাই ভাসা ভাসাভাবে নানা কথা শুনেছি। আমি মোটামুটিভাবে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, পত্রপত্রিকা হোক, রেডিও-টেলিভিশন হোক, কোথাও কেউ এই ‘শিল্প’টি নিয়ে একটা ভালো কথাও শোনেননি। অবস্থা কতটুকু খারাপ সেটা বুঝতে হলে জায়গাটি নিজের চোখে দেখতে হয় (এ বছরের জলাবদ্ধতার কথা আমি
জানতাম, আমার কাছে সেটা ছিল একটা তথ্য, কিন্তু যখন নিজের চোখে গিয়ে দেখেছি তখন সেটা হয়ে গিয়েছিল অন্য ব্যাপার)। আমি সীতাকুণ্ডে গিয়ে জাহাজভাঙার ‘শিল্প’টি দেখিনি। তাই আমার কাছেও সেটা ছিল শুধু তথ্য। কিন্তু গত সপ্তাহে টেলিভিশনে আয়রন-ইটার বা লোহাখোর নামে একটা ডকুমেন্টারি ছবি দেখিয়েছে। ছবিটি এত গভীর মমতা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে যে আমি প্রথমবার সীতাকুণ্ডের জাহাজভাঙা ‘শিল্প’ নামের নরকটিকে অনুভব করতে পেরেছি। আমার খুব ইচ্ছে, আমার দেশের সব মানুষ এ ছবিটি দেখুক, তাহলে তারা অনুভব করতে পারবে এ দেশের মাটিতে কী ঘটছে।
লোহাখোর ছবিটি কোনো প্রচারণা নয়, এ ছবিতে যেটুকু সময় শ্রমিকদের দেখানো হয়েছে তার সমান পরিমাণ সময় এ শিল্পের মালিক আর কন্ট্রাক্টরদের দেখানো হয়েছে। তাঁরা অকপটে নিজেদের কথা বলেছেন। শ্রমিকেরা তাঁদের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে অভিযোগ করেননি, তাঁদের দৈনন্দিন কাজ করে গেছেন, হাসি-তামাশা করেছেন। তার পরও আমরা দেখেছি, খালি পায়ে ধারালো ধাতব আবর্জনার ভেতর দিয়ে তাঁরা ভারী বোঝা টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। আমরা দেখেছি, বিস্ফোরণের মাঝে আটকা পড়ছেন, আহত শ্রমিককে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন, শ্রমিকদের সেই কষ্টের জীবনেও তাঁরা কিন্তু স্বপ্ন দেখেন। কেমন করে হাঁস পালন করে জীবনকে পাল্টে ফেলবেন, সেটা নিয়ে তাঁদের দীর্ঘ আলোচনা হয়। ভারী লোহার কেব্ল ঘাড়ে নিয়ে টানতে টানতে তাঁদের কেউ একজন সুরেলা গলায় গান গেয়ে ওঠেন। আমাদের চোখে পানি এসে যায় যখন দেখি দীর্ঘ সময় কাজ করেও তাঁরা মজুরি পান না এবং রিক্ত হাতে দেশে আপনজনের কাছে ফিরে এসে শিশুসন্তানটিকে বুকে চেপে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন।
লোহাখোর ছবিটি কিন্তু মানুষের ব্যর্থতার ছবি নয়, দুর্বৃত্তদের নিষ্ঠুরতার ছবিও নয়। এটি হচ্ছে মানুষের সংগ্রামের ছবি, স্বপ্ন দেখার ছবি। কেব্ল টেনে যায় ঘাড়ে দগদগে ঘা, মজুরি না পেয়ে যে শূন্য হাতে ফিরে এসেছে, খেতে কোদাল চালাতে চালাতেও সে কিন্তু ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে, এ দেশের মাটিতে মাথা তুলে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে।
আমার খুব ইচ্ছে, এ দেশের সব চ্যানেলে লোহাখোর ছবিটি দেখানো হোক, দেশের সব মানুষ এ ছবিটি দেখুক।
২.
জাহাজভাঙা ‘শিল্পে’ কী ঘটছে জানার জন্য চোখ-কান খোলা রাখার কিছুদিনের মধ্যে আমি অবিশ্বাস্য কিছু তথ্য পেয়ে যাই। পাঠকেরা হয়তো লক্ষ করে থাকবেন, আমি প্রত্যেকবার জাহাজভাঙা ‘শিল্প’ কথাটা লেখার সময় ‘শিল্প’ কথাটাকে কোটেশনের মাঝে রেখেছি, কারণ এটা আসলে শিল্প নয়। একটা শিল্প গড়ে উঠতে হলে তাকে পরিবেশগত ছাড়পত্র নিতে হয়, বাংলাদেশের জাহাজভাঙা ‘শিল্প’গুলোর কোনোটিরই সেই ছাড়পত্র নেই।
যেসব ক্ষমতাবান মানুষ এই জাহাজভাঙা ‘শিল্প’ নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁদের জন্য চাপ দিয়ে কিংবা টান দিয়ে একটা ছাড়পত্র বের করে আনা কোনো ব্যাপারই না, তার পরও তাঁরা পারছেন না। কারণ একটা ইয়ার্ডকে ছাড়পত্র দিতে হলে একটা ইয়ার্ড থাকতে হয়, কারও কোনো ইয়ার্ড নেই—খোলা সমুদ্রতীরে জাহাজ ভাঙা হয়। ছাড়পত্র দেবে কেমন করে? শ্রমিকেরা সেখানে কী ধরনের অমানবিক মধ্যযুগীয় অবস্থায় কাজ করেন, তার কথা আপাতত না হয় ছেড়েই দিলাম।
দেশের আইন, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কেউ যদি টাকা কামাই করতে শুরু করে দেয়, তাহলে সেটাকে কি শিল্প বলা যায়? তাহলে মলম পার্টি কেন শিল্প নয়? কালা জাহাঙ্গীর, ধলা জাহাঙ্গীরদের চাঁদাবাজি কেন শিল্প নয়? ফেনসিডিলের ব্যবসা কেন শিল্প নয়?
৩.
জাহাজভাঙা ‘শিল্প’-এর সঙ্গে সম্পর্ক আছে এ রকম কোনো মানুষ যদি এ লেখাটি পড়তেন, তাহলে তাঁদের এখন খুব গরম হয়ে ওঠার কথা, তাঁদের বলার কথা, ‘যত বড় মুখ নয়, তত বড় কথা! আমাদের সঙ্গে মলম পার্টির তুলনা? আমরা দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। একটা দেশকে উন্নত করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন লোহা, দেশের লোহার প্রয়োজনের শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ আসে ভাঙা জাহাজ থেকে। শুধু কি তাই? জাহাজ ভাঙার কাজে একজন নয়, দুজন নয়, দেড় লাখ শ্রমিক সরাসরি জড়িত! আমাদের কথা বিশ্বাস না করলে মার্চ মাসের ৮ তারিখে জাতীয় সংসদে দেওয়া নৌপরিবহনমন্ত্রীর বক্তব্যটা একবার পড়ে দেখেন!’
নৌপরিবহনমন্ত্রীর বক্তব্যটা চমকপ্রদ, আমি সেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছি। শ্রমিকদের জন্য কী চমত্কার বেতন এবং স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা আছে তার বর্ণনাটা রসিকতার মতো মনে হয়। প্রায় ৩০ বছরের পুরোনো জাহাজের পরিত্যক্ত জেনারেটর দেশের বিদ্যুত্ ঘাটতি পূরণ করে এ রকম হাস্যকর যুক্তিও আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, জাহাজভাঙার সঙ্গে নিয়োজিত শ্রমিকদের সংখ্যা, জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছেন, দেড় লাখ শ্রমিক সরাসরি সেখানে কাজ করে। মজার কথা হচ্ছে, এর মাত্র ১২ দিন পর শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটিতে জানানো হয়েছে, জাহাজ ভাঙার কাজে মোট শ্রমিকের সংখ্যা মাত্র ১৯ হাজারের মতো (সঠিক সংখ্যা ১৮ হাজার ৮৮৮)। শুধু তা-ই নয়, এই ১৯ হাজারের মাঝে মাত্র সাড়ে তিন হাজার (সঠিক সংখ্যা তিন হাজার ৫৪৩) হচ্ছে স্থায়ী শ্রমিক। অন্য সবাই অস্থায়ী এবং তাদের মাঝে শিশুশ্রমিকও আছে। শুধু তা-ই নয়, ওই কমিটি শ্রমিকদের চমত্কার জীবন কিংবা স্বাস্থ্যসেবার কথা বলেনি। তারা বলেছে, ‘এ শিল্পে শ্রমিকদের নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র নেই বললেই চলে। তা ছাড়া শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা খুবই নাজুক। প্রায়ই দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে শ্রমিক মারা যায়।’
তাহলে কে সত্য কথা বলছেন? নৌপরিবহনমন্ত্রী নাকি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি? সেটা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না। আমার কমন সেন্স দিয়েই বুঝতে পারি। আমাদের অভুক্ত, শীর্ণ-দুঃখী শ্রমিকেরা বিশাল বিশাল জাহাজ ভেঙে টুকরো টুকরো করেন দুই মাসের ভেতর। ভাঙার জন্য প্রতি মাসে গড়ে ১০ থেকে ২০টা করে জাহাজ আসে—সব যদি একই সঙ্গে ভাঙা শুরু হয়, স্ক্যাপগুলো পাঠানোর জন্য ট্রাকে বোঝাই করা হয়, তাহলেও প্রতি জাহাজে কয়েক শ মানুষের বেশি লাগার কথা নয়। কাজেই মোট শ্রমিকের সংখ্যা শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কথা অনুযায়ী কয়েক হাজার হওয়ার কথা, নৌপরিবহনমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী লক্ষাধিক হওয়ার কথা নয়। মনে হয় সংখ্যাটা লিখতে গিয়ে একটা শূন্য বেশি পড়ে গেছে।
আমি অনেক জায়গাতেই কথা বলে দেখেছি, তাদের ধারণা, আমাদের দেশের লোহার ৮০ থেকে ৯০ ভাগ আসে ভাঙা জাহাজ থেকে। তাঁরা এ ধারণাটা কোথা থেকে পেয়েছেন, আমি জানি না। একবার লোহার দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার কারণে পত্রপত্রিকায় ‘ব্যবসায়ীদের কারসাজি’ হিসেবে লেখালেখি শুরু হলে বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশন তখন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ‘প্রকৃত তথ্য’ ছাপিয়েছিল। ২০০৮ সালের ৩১ জানুয়ারি প্রথম আলোতে ছাপা হওয়া সেই বিজ্ঞাপনটি আমার কাছে আছে। সেখানে লেখা আছে, ‘বাংলাদেশে প্রতিবছর ২৫-৩০ লাখ টন লৌহার চাহিদা সচরাচর বিদ্যমান’ (লোহাকে তাঁরা কেন লৌহা বলেন আমি জানি না)। সেই একই বিজ্ঞাপনে অন্য জায়গায় লেখা আছে, ‘অন্যদিকে পুরাতন জাহাজ হতে প্রাপ্ত লৌহার জোগানের পরিমাণ সাত-আট লাখ টনের মতো। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যায়, শিপ ব্রেকিং খাত হতে দেশের চাহিদার মাত্র ২৫ হতে ৩০ শতাংশের জোগানদাতা।’
যাঁরা জাহাজ ভেঙে দেশে লোহার জোগান দেন তাঁরা নিজেরাই বলছেন, দেশের মোট লোহার মাত্র ২৫-৩০ শতাংশ তাঁরা দিচ্ছেন, তাহলে অন্যরা কেন এটাকে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ দাবি করছেন? বিজ্ঞাপনটি ২০০৮ সালের, এরপর দুই বছর পার হয়েছে, কিন্তু সে কারণে এ সংখ্যাটির আকাশ-পাতাল পরিবর্তন হওয়ার কথা নয়। যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, যেটা এই দেশের সবার জানা উচিত, জাহাজ ভেঙে এ দেশের প্রয়োজনের মাত্র চার ভাগের এক ভাগ লোহা আসে! তার থেকে বেশি নয়, দেশ এই প্রক্রিয়ার ওপর মোটেও নির্ভর করে নেই।
পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশ কিন্তু তাদের প্রয়োজনের এক গ্রাম লোহাও জাহাজ ভেঙে তৈরি করে না। ১৯৫টি দেশের মাত্র ১৪টি দেশের নিজের লোহা আছে, অন্য সবাইকে বাইরে থেকে লোহা আনতে হয়। মাত্র পাঁচটি দেশ লোহার জন্য জাহাজ ভাঙে—তারা হচ্ছে চীন, তুরস্ক, বাংলাদেশ, গুজরাট আর পাকিস্তান। (কেউ কি লক্ষ করেছেন, আমি ভারত না লিখে গুজরাট লিখেছি? কারণ ভারতের অন্য কোনো রাজ্যে এই ভয়ংকর অমানবিক কাজ করা সম্ভব নয়। গুজরাটে আইনশৃঙ্খলা বলে বিশেষ কিছু নেই। প্রয়োজনে তারা মানুষকে পুড়িয়ে ফেলে, কেউ উচ্চবাচ্য করে না। তাই জাহাজভাঙার এই ভয়ানক কাজটা শুধু গুজরাটেই করা সম্ভব।) চীনকেও হিসাবের বাইরে রাখা যায়, কারণ তারা ভারী যন্ত্রপাতি আর প্রযুক্তি ব্যবহার করে জাহাজ ভাঙে। তাদের প্রক্রিয়াটাকে সত্যিকার একটা শিল্পই বলা যায়। তুরস্ক তাদের জাহাজভাঙা খুব কমিয়ে এনেছে। কাজেই বাকি থাকল বাংলাদেশ, গুজরাট আর পাকিস্তান। বাংলাদেশের অবস্থা কি এতই খারাপ যে আমাকে গুজরাট আর পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করে গৌরব পেতে হবে?
শ্রীলঙ্কাকে জাহাজভাঙার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, তারা রাজি হয়নি। থাইল্যান্ড আইন করে জাহাজ ভাঙা বন্ধ করেছে। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ এই ভয়ংকর অমানবিক এবং মান-মর্যাদাহীন কাজ করতে রাজি নয়। তার মানে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ থেকে দুর্বল দেশ আছে, সবল দেশও আছে। পৃথিবীর সব দেশ যদি জাহাজ না ভেঙে নিজের দেশ উন্নয়ন করতে পারে, তাহলে আমরা কেন পারব না?
ইচ্ছে করলে ব্যাপারটাকে আরও খুঁটিয়ে দেখা যায়। কেউ যদি জাহাজ ভেঙে সেখান থেকে কাঁচামাল বের করে লোহা তৈরি করতে না চায়, তাহলে তাদের বাইরে থেকে লোহার ‘বিলেট’ আমদানি করে সেটাকে স্টিল মিলে ব্যবহার করে লোহার রড ইত্যাদি তৈরি করতে হয়, তাতে খরচ পড়ে প্রতি মেট্রিক টনে ৬০০ ডলারের মতো। বাংলাদেশের প্রয়োজনের তিন-চতুর্থাংশ লোহাই কিন্তু এভাবে তৈরি হয়, বাকি এক-চতুর্থাংশ লোহা তৈরি হয় জাহাজ ভেঙে এবং দাম প্রতি মেট্রিক টনে মাত্র ১০০ ডলার (সাত হাজার টাকা) কম।
কিন্তু বাজারে প্রতি মেট্রিক টনে সাত হাজার টাকা বাঁচানোর জন্য আমরা কত টাকা ক্ষতি করেছি তার হিসাব কে দেবে? সীতাকুণ্ডের সমুদ্রতটে পরিবেশের যে দূষণ হয়েছে, তার আর্থিক মূল্য কত? ২১ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এমন কোনো বিষাক্ত দ্রব্য নেই, যেটা সেই এলাকার পানিতে পাওয়া যায় না। জাহাজ ভাঙার জন্য সীতাকুণ্ডে রাতের আঁধারে যে হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে, তার হিসাব কে দেবে? সরকারি হিসাবেই দুই বছরে ৩৮ জন শ্রমিক মারা গেছেন, তাঁদের প্রাণের মূল্য কত? (প্রকৃত সংখ্যা নাকি আরও অনেক বেশি।) যে কিশোর এবং তরুণেরা সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছে, তাদের খরচ কে দেবে? গুজরাটে জাহাজ ভাঙার কাজে যে শ্রমিকেরা আছেন, তাঁদের ১৬ শতাংশ এসবেস্টসের কারণে ক্যানসারে ভুগছেন। আমাদের দেশের পরিসংখ্যান কার কাছে আছে? এই মুূহূর্তে আমি একটা ছবির দিকে তাকিয়ে আছি, যেখানে দেখা যাচ্ছে, একজন মহিলা চালুনি দিয়ে এসবেস্টসের গুঁড়ো আলাদা করছেন। তাঁকে কি কেউ বলেছে, তাঁকে নিশ্চিত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে বলা হয়েছে? শুধু কি এসবেস্টস? পুরোনো জাহাজে আরও কত রকম বিষাক্ত বর্জ্য আছে, সবাই কি সেটা জানে? সব রকম সুযোগ-সুবিধা, ভারী যন্ত্রপাতি থাকার পরও ইউরোপের বড় দেশগুলো তাদের পুরোনো জাহাজ নিজেরা না ভেঙে কেন আমাদের মতো দেশে পাঠিয়ে দেয়? তারা তাদের পরিবেশ নষ্ট করার মতো ঝুঁকি নিতে সাহস পায় না, তাই তার মূল্য দিতে হবে আমাদের?
প্রতি মেট্রিক টন লোহায় ১০০ ডলার বাঁচাতে গিয়ে আমরা কত বড় মূল্য দিচ্ছি কে এই হিসাব দেবে? এ দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য কি কেউ নেই?
৪.
সত্যি কথা বলতে কি, এ দেশে পরিবেশ আর আত্মমর্যাদা রক্ষা করার জন্য কিন্তু অনেকেই আছেন। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো জাহাজভাঙা ‘শিল্প’-এর ক্ষতিকর রূপটা সবার সামনে তুলে ধরার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে, খবর বের হচ্ছে, সম্পাদকীয় ছাপা হচ্ছে। আমার ধারণা, সবচেয়ে বড় প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্যটা এসেছে সুপ্রিম কোর্ট থেকে। একটা রিট মামলার রায়ে তাঁরা খুব পরিষ্কার করে পুনর্ব্যক্ত করেছেন, যে জাহাজ ভাঙার জন্য ঠিক করা হয় সেটা হচ্ছে বর্জ্য: (আন্তর্জাতিক আইনকানুনেও সেভাবে বলা আছে, ভেঙে ফেলার জন্য পরিত্যক্ত জাহাজ হচ্ছে বর্জ্য—সোজা কথায় আবর্জনা।) সুপ্রিম কোর্টের সম্মানিত বিচারপতিরা দেশের পরিবেশ আর শ্রমিকদের নিরাপত্তার কথা ভেবে খুব সুন্দর করে বলে দিয়েছেন, আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন মেনে ভেঙে ফেলার জাহাজগুলোকে সব রকম বিষাক্ত পদার্থ থেকে পরিষ্কার করে রীতিমতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার সার্টিফিকেটসহ বাংলাদেশের সীমানায় পাঠাতে হবে। সোজা কথায়, বাংলাদেশ কারও আস্তাকুঁড় নয়, কোনো বিদেশি তার আবর্জনা এ দেশে পাঠাতে পারবে না। (আমার ধারণা ছিল, কোর্টের রায়গুলো বুঝি হয় কটমটে আইনি ভাষায়, পড়ে কিছু বোঝা যায় না। কিন্তু এই রায় দেখে আমি চমত্কৃত হয়েছি, এর ভেতরে জাহাজের গলুইয়ের ছবি আছে, সেখানে কোথায় কোথায় বিষাক্ত জিনিস আছে সেটাও দেখানো আছে। প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা, পড়ে সবকিছু বোঝা যায়। আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকেরা দেশের মানুষকে, দেশকে বুক আগলে রক্ষা করার জন্য এত পরিশ্রম করে রায় লেখেন দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি।)
বলা যেতে পারে, এতটুকু ছিল ভূমিকা, এখন আমি আসল বক্তব্যে আসি। আমরা যখন দেখি সুপ্রিম কোর্ট দেশের পরিবেশ আর শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য সরকারকে কিছু সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেন, তখন আমরা আশা করি, সরকার সেটাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে বীরদর্পে এগিয়ে যাবে। অথচ আমরা দেখছি, ঠিক তার উল্টো ব্যাপার ঘটছে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় জাহাজভাঙা ‘শিল্প’পতিদের ভয়ে নতজানু হয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশগুলোকে একটি একটি করে অকার্যকর করে দিচ্ছে। ‘জাহাজ বিষাক্ত বর্জ্যমুক্ত’ হতে হবে সেই নির্দেশটিকে পাল্টে ফেলে। নতুন গেজেট পর্যন্ত প্রকাশিত হয়ে গেছে, এখন জাহাজ তার ‘ইনবিল্ট’ সব রকম বিষাক্তদ্রব্য নিয়ে আসতে পারবে। জাহাজভাঙা ‘শিল্প’ হচ্ছে পরিবেশের ওপর সবচেয়ে বড় ঝুঁকি, তাই সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হওয়ার কথা পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের, অথচ দেখা যাচ্ছে, আমাদের পরিবেশমন্ত্রী জাহাজভাঙা ‘শিল্প’পতিদের পক্ষ নিয়ে বলছেন, এই শিল্পে অস্থিরতা তৈরি করা যাবে না, তাহলে দেশে লোহার দাম লাখ টাকা থেকে বেশি হবে। শুধু তা-ই নয়, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে জাহাজভাঙা নজরদারি করার জন্য যে কমিটি করা হয়েছে, সেখানে সব নিয়মনীতি ভেঙে শিপ ব্রেকারস অ্যাসোসিয়েশনের দুজন মেম্বার ঢুকিয়ে রেখেছেন, যাঁদের ওপর চোখ রাখা হবে তাঁরাই হচ্ছেন সদস্য। এর চেয়ে উত্কট রসিকতা আর কী হতে পারে? সোজা কথায়, সুপ্রিম কোর্টের আদেশকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে সেটাকে টুকরো টুকরো করে ভাঙা হচ্ছে, ঠিক যেমনটি করে জাহাজ ভাঙা হয়।
জাহাজ আমদানির পুরো নীতিটাকে পাল্টে ফেলার একটা চেষ্টা করা হচ্ছে, যেখানে একটা জাহাজকে আবর্জনামুক্ত করার সার্টিফিকেট আর রাষ্ট্রকে দিতে হবে না, সেটি দেবে রপ্তানিকারক নিজেই। সে সত্যি কথা বলছে না মিথ্যে কথা বলছে সেটি দেখবে আমাদের নতজানু পরিবেশ অধিদপ্তর। ডাহা মিথ্যে কথা বললেও তাদের বিরুদ্ধে কী করা হবে সেটি কোথাও বলে দেওয়া নেই। সোজা বাংলায় পৃথিবীর যত আবর্জনা যেন কোনো রকম ঝামেলা ছাড়া বাংলাদেশে চলে আসতে পারে তার ব্যবস্থা পাকাপাকি করে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের প্রিয় দেশটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে পৃথিবীর কাছে ঘোষণা করা হচ্ছে একটা আস্তাকুঁড় হিসেবে, যত আবর্জনা আছে সব যেন এখানে এনে ফেলে দেওয়া হয়।
৫.
আমরা আমাদের দেশকে আস্তাকুঁড় বানাতে দেব না। আমার দেশের সন্তানেরা যখন বাইরে যাবে তখন পৃথিবীর মানুষ আঙুল তুলে তাদের দেখিয়ে বলবে, ওই দেখো, সারা পৃথিবীর আস্তাকুঁড়ে যে বাংলাদেশ, এই ছেলেমেয়েগুলো সেই দেশের সন্তান। আমরা কিছুতেই সেই অসম্মান সহ্য করব না। কিছু লোভী মানুষ আর কিছু মেরুদণ্ডহীন কর্মকর্তা মিলে সারা পৃথিবীর সামনে আমাদের অসম্মান করবে—সেটা কিছুতেই হতে দেব না।
আমাদের সবার ভোটে নির্বাচিত যে সরকার তাকে আমরা আমাদের দেশের সম্মানটুকু রক্ষা করতে দিয়েছি। সেই সরকারকে এই দেশের সম্মান রক্ষা করতে হবে। এটি আমাদের আবেদন নয়, এটি আমাদের দাবি। এ দেশ থেকে জাহাজভাঙা ‘শিল্প’ চিরদিনের জন্য তুলে দিতে হবে। পৃথিবীর আত্মসম্মানসম্পন্ন অন্য যেসব দেশ জাহাজ না ভেঙেই উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, আমরাও সেদিকে এগিয়ে যাব, দেশের অর্থনীতিবিদ-প্রযুক্তিবিদেরা আমাদের সেই পথ বাতলে দেবেন। দেশকে ভালোবাসলে সবকিছু সম্ভব, সেটা এ দেশের মানুষ থেকে ভালো করে আর কে জানে?
আমি যখন এটা লিখছি তখন খবর পেয়েছি, জাহাজ ভাঙতে গিয়ে আরও একজন শ্রমিক মারা গেছেন। স্বজন হারানো মানুষের দীর্ঘশ্বাস যে ভয়ংকর টর্নেডোর মতো সবকিছু ছারখার করে দিতে পারে, সেটা কি সবাই ‘জানে’?
২৮.০৪.২০১০
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক। অধ্যাপক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments