ভোলা উপনির্বাচন-আমরা কি সত্যাশ্রয়ী হতে পারি না by মাহমুদুর রহমান মান্না

গত ২৪ এপ্রিল ভোলা-৩ আসনের উপনির্বাচন হয়ে গেল। অনেক সংশয়-আশঙ্কা ছিল এই নির্বাচন নিয়ে। এমনিতেই যেকোনো উপনির্বাচনই আমাদের দেশে যথেষ্ট আলোড়ন তোলে। জোয়ার-ভাটার এ দেশে জনপ্রিয়তাও কচুপাতায় পানির মতো। আজ যে আমির, কাল সে ফকির। আজ যে নেতা, কাল সে হতেও পারে খলনায়ক।


গত টার্মে যিনি দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন, এই টার্মে তিনি হয়তো ধরাশয়ী হয়ে গেলেন। এ জন্যই উপনির্বাচন এত আগ্রহের জন্ম দেয়, যাতে অন্তর্বর্তীকালে সরকারের জনপ্রিয়তায় কোনো হেরফের হলো কি না, তা ধরা যায়। ১৬ মাস আগে যে মহাজোট মহাবিজয় অর্জন করেছিল তার অবস্থা এখন কেমন, তা জানতে মানুষ আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। এই সময় সরকারের কিছু কিছু সাফল্য থাকলেও বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি নিয়ে এমন সমস্যা তৈরি হয়েছিল যে ঢাকা মহানগর নেতাদের কথার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার নির্বাচন কমিশনকে সিটি করপোরেশন নির্বাচন শীত পর্যন্ত পিছিয়ে দিতে অনুরোধ করেছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে ভোলার নির্বাচনের অবস্থা কী দাঁড়াবে, তা জানতে সবাই কৌতূহলী ছিলেন।
আরও একটা ব্যাপার ছিল। ভোলা-৩ আসনের নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগ যে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছিল, তা ভুল ছিল। এ রকম ভুল অবশ্য আরও কোনো কোনো আসনে ছিল। কিন্তু সে কথা অন্য কেউ সাহস করে বলার আগে প্রার্থী (পরে বিজয়ী সাংসদ) নিজেই তাঁর আচরণের মাধ্যমে তা প্রমাণ করেছিলেন। তাঁর অবিমৃষ্যকারিতার কারণে নির্বাচন কমিশন শেষ পর্যন্ত তাঁর সদস্যপদই বাতিল করে দিয়েছিল। মজার ব্যাপার, তার পরও দলের হাইকমান্ড তাঁকেই আবার উপনির্বাচনে মনোনয়ন দিয়েছিল, যা মানতে পারছিলেন না স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। এটা এ রকম একটা ব্যাপার ছিল, যাতে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের তাকিয়ে তাকিয়ে নৌকা ডুবে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে হতো। কিন্তু যেন হঠাৎ করে সংবিৎ ফিরে পায় হাইকমান্ড। নৌকার মাঝি বদলে যায়, নৌকাবাইচটা দেখার মতো হবে বলে মনে হয় দলীয় নেতা-কর্মীদের। এ কারণেই উত্তাপ তৈরি হয় নির্বাচনে।
এ রকম সব উপনির্বাচনেই হয়—একটা প্রেস্টিজের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়, জেতার জন্য উভয় পক্ষ মরিয়া হয়ে ওঠে। নির্বাচনের মাঠে উত্তাপ তৈরি হয়। একপক্ষ আরেক পক্ষকে দুষতে থাকে। ভোলার নির্বাচনেও তা-ই হয়েছিল। খোদ বিরোধী দলের নেতা ওয়ার্নিং দিয়েছিলেন, যদি কোনো গড়বড় হয় (তাঁরা তো জিতবেনই, যদি সে রায় বদলে দেওয়া হয়), তাহলে ঢাকার মহাসমাবেশ থেকে বৃহত্তর আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করবেন তিনি।
ভোলার নির্বাচনে কি কোনো গড়বড় হয়েছে? নির্বাচন কি সুষুম ও নিরপেক্ষ হয়েছে, নাকি বিএনপি যে রকম করে নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে সে রকম হয়েছে, সে বিতর্কে আমি যাব না। আমার আজকের লেখার প্রতিপাদ্যও তা নয়।
এই নির্বাচনে যে সহিংসতা হয়েছিল, সেটি প্রতিষ্ঠিত। নির্বাচনের আগে কয়েক দিন ধরেই আমরা সে খবর পত্রিকায় ছাপা হতে দেখেছি। এর মধ্যে একটি বিশেষ খবর হলো, এলাকার তজুমদ্দিন থানার চাচড়া ইউনিয়নের বিএনপির এক নেত্রী অভিযোগ করেন, তাঁকে ধর্ষণ করা হয়েছে। তিনি দাবি করেন, স্থানীয় যুবলীগের কয়েকজন কর্মী এর সঙ্গে জড়িত।
এ ঘটনার কয়েক দিন পর গত ২৯ এপ্রিল চাচড়া ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক গোলাম মাওলা ও মাহমুদুল্লা পাটোয়ারী (তাঁরা দুজনই কয়েক দিন আগে বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন) তজুমদ্দিন প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির নেত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা মিথ্যা ও সাজানো বলে দাবি করেন। গোলাম মাওলা বলেন, ‘১৮ বছর আগে এই নেত্রী আমার বিরুদ্ধেও ধর্ষণের একটি মিথ্যা মামলা করেছিল। এখনকার এ ঘটনাও পরিকল্পিত।’
আমি আগেই বলেছি, ভোলার নির্বাচন কতখানি সুষ্ঠু হয়েছে, সেটা নিয়ে এই লেখা লিখছি না। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিকে গত শনিবার এ ব্যাপারে পাঠকদের মতামত প্রকাশিত হয়েছে। বলাই বাহুল্য, সেখানে দুই রকম মতামতই আছে, যা সরাসরি বিএনপি অথবা আওয়ামী লীগের পক্ষে যায়। আমাদের দেশে প্রায় সবকিছুরই দলীয়করণ হয়েছে। মানুষের চিন্তাও এভাবে গঠিত ও পরিচালিত হচ্ছে। একজন রিপোর্টারও রিপোর্ট করার সময় তাঁর পেশার কথা ভাবার আগে সম্ভবত দলের কথা ভাবেন। বুদ্ধিজীবী এমনকি গবেষক, ডাক্তাররাও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যান। কিন্তু ওই মতামতে সবকিছুর মধ্যেও একটি আকাঙ্ক্ষা খুবই স্পষ্ট। আর তা হলো সবাই চান এই উগ্র, নগ্ন দলবাজি বন্ধ হোক। গণতন্ত্র বিকশিত হোক, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক, চামচামির বিপরীতে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হোক।
গণতন্ত্র তো মূলত একটি মূল্যবোধ। নির্বাচন তার মৃন্ময়ী রূপ। মৃন্ময়ী রূপের জন্য তো চিন্ময়ী সৌন্দর্যকে উপেক্ষা করছি না আমরা? নির্বাচনকেই সবচেয়ে মূল্য দিচ্ছি; ফলে গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিসর্জিত হচ্ছে। তজুমদ্দিন থানার চাচড়া ইউনিয়নের মহিলা যে অভিযোগ করেছেন, তা রীতিমতো ভীতিকর। নির্বাচনে জেতা-হারা আছে। কিন্তু এই হারা-জেতার পরিপ্রেক্ষিতে যদি প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়, তাহলে তো গোটা রাজনীতিকেই ধর্ষণ করা হয়। সেই ১/১১-এর সময় আমরা বললাম, ষড়যন্ত্র হচ্ছে রাজনীতির বিরাজনীতিকরণের। তার চেয়েও রাজনীতির ধর্ষণ কি গুরুতর অপরাধ নয়? মূল্যবোধ বলে কিছু থাকছে কি? একজন মহিলা (এবং তিনি একজন সাধারণ মহিলা নন, একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেত্রী) অভিযোগ করেছেন, তাঁকে প্রতিপক্ষরা ধর্ষণ করেছে। আর প্রতিপক্ষরা বলছেন, অভিযোগ মোটেই সত্যি নয়; এটি সাজানো, মিথ্যা।
পাঠকবৃন্দ, এই দুই পক্ষের একপক্ষ তো মিথ্যা। সেই মিথ্যা কত নিম্নমানের। সেই মিথ্যাকে একটি রাজনৈতিক দল তো সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে, যারা পালা বদলে সরকার গঠন করে, আমাদের দেশ চালায়। তার মানে সেই রাজনৈতিক দল তথা আমাদের সরকার কতখানি অধঃপতিত। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের মা-বোনের সম্ভ্রম লুট করেছিল। আমরা কী করছি?
কেউ কি সত্যের পক্ষে দাঁড়াবেন না? এই যে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ তার মধ্যে থেকে কি সত্যকে খুঁজে পাওয়া যাবে না? কেন যাবে না? বিএনপি থেকে সদ্য আওয়ামী লীগে যোগদানকারী গোলাম মাওলা যে বললেন, ১৮ বছর আগে এই নেত্রী তাঁর বিরুদ্ধেও ধর্ষণের একটি মিথ্যা মামলা করেছিলেন, এর সত্যাসত্য জানা কি অসম্ভব? কোথায় মামলা করেছিলেন সেই মহিলাটি? নিশ্চয়ই থানায় (কিংবা কোর্টে) তার প্রমাণাদি থাকবে। বোঝা তো যাবে কে সত্য—সেই মহিলা, নাকি গোলাম মাওলা।
কে করবেন সেই কাজ? এ ক্ষেত্রে অবশ্যই দুটি দল, তার নেতৃত্ব। আরও স্পষ্ট করে বললে, দুই নেত্রী। এ রকম একটা ব্যাপার দাঁড়িয়েছে যে দুই নেত্রী না বললে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি বৃক্ষ দুটির পাতাও নড়ে না। অতএব উদ্যোগটা নিতে হবে দুই নেত্রীকেই।
দুই নেত্রী সেই উদ্যোগ নেবেন কি? দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালনের? তাঁরা যদি না নেন, তাহলে এই অবলা ধর্ষিতা নারীরা অথবা মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত বা সাজাপ্রাপ্তরা বিচার পাবেন কোথায়? সমাজ ও রাজনীতি পরিচ্ছন্ন হবে কীভাবে? আমরা বিচার করে খুনিদের সাজা দিয়ে বলছি, জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। কিন্তু সেই যে তখন থেকে মহিমা, ফাহিমা, সীমারা সম্ভ্রম হারিয়ে অবশেষে জীবন থেকে অব্যাহতি নিতে বাধ্য হয়েছে, তা কি আমাদের জাতির ললাটে নতুন করে কলঙ্ক লেপন করেনি? ইডেন কলেজ, আনন্দ মোহন কলেজ আমাদের মাথা হেট করে দেয়নি?
এই নৈতিকতার অধঃপতনের দায় তো শেষ পর্যন্ত রাজনীতির ওপর বর্তায়। কারণ, রাজনীতি হলো সমাজের চালিকাশক্তি। অর্থনীতি, সংস্কৃতি এই রাজনীতি দ্বারাই চালিত হয়। রাজনীতিই অসুরকে প্রতিপালন কিংবা বিনাশ করে। সেই যে বিগত জোট সরকারের আমলে পুঠিয়ায় ধর্ষিতা হয়ে ফাহিমা আত্মহত্যা করল, তখন ওই সব ধর্ষকের পক্ষে গিয়েই তো দাঁড়িয়েছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। যে ভোলা-৩ নির্বাচনী এলাকা নিয়ে এত হইচই করার চেষ্টা করছে বিরোধী দল, ২০০১ সালের নির্বাচনের পর তারা কী করেছিল? লালমোহনের সেই জয়ন্তীর (না কী ছিল ওর নাম, প্রথম আলোতে যার ঘটনা ছাপা হয়েছিল) কথা মনে আছে অনেকের। অন্তঃসত্ত্বা ছিল জয়ন্তী। কিন্তু সুন্দরী ছিল। শকুনেরা হামলা করেছিল ওর ঘরে। বেড়ার ঘর ছিল ওদের। জয়ন্তীর এক খালা সেই বেড়া ভেঙে ভাগনিকে নিয়ে ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যান। তখন ছিল বর্ষাকাল। চতুর্দিকে থই থই পানি। আর মাঝখানে দ্বীপের মতো জেগে ছিল গ্রামের রাস্তা। সেই পথে দৌড়াতে দৌড়াতে পেটে ব্যথা শুরু হয়। রাস্তার ওপরেই খালার দাইগিরিতে বাচ্চা হয় জয়ন্তীর। সমগ্র প্রকৃতি স্তম্ভিত হয়ে থাকে। আর তাই দেখে তখনকার সরকারি দলের পান্ডারা ফিরে যায়। প্রথম আলোয় বিস্তারিত তার প্রতিবেদন বেরিয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের দৃষ্টিতে আসেনি তা।
এ রকম অজস্র ঘটনা আছে ২০০১-এর নির্বাচনের পর। পাঁচ বছর ক্ষমতাসীন বিএনপি সীমাহীন অত্যাচার করেছিল সংখ্যালঘুদের ওপর, যার কোনো প্রতিকার আজ পর্যন্ত হয়নি। ক্ষতিগ্রস্তরা থানায় গিয়ে মামলা করতে পারেনি।
কিন্তু এবার একটা ব্যতিক্রম লক্ষ করার মতো। গত ২৩ এপ্রিল গভীর রাতে সিরাজ মৃধার নেতৃত্বে ৮-১০ জন লালমোহনের পশ্চিম চরউমেদ ইউনিয়নের গোদাখালি গ্রামের এক জেলে পরিবারের মা-মেয়ের শ্লীলতাহানি করে। এরপর গত ২৫ এপ্রিল নবনির্বাচিত সাংসদ নূরনবী চৌধুরী ওই বাড়িতে গিয়ে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলেন এবং পুলিশকে মামলা নেওয়ার নির্দেশ দেন। তারপর ওই রাতে জেলে পরিবারটির পক্ষ থেকে স্থানীয় যুবলীগের কর্মী সিরাজ মৃধা, সোহাগ, সাইফুল ও আবদুল্লাহ এবং অজ্ঞাত আরও ছয়জনকে আসামি করে মামলা করা হয়।
১ মে প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী পুলিশ এই মামলার দুই আসামিকে বাউফল থেকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তার হওয়া সোহাগ ও সাইফুল যুবলীগের কর্মী। বলতেই হবে, নবনির্বাচিত সাংসদ নূরনবী চৌধুরী একটি উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন, যার কণাটুকুও পাঁচ বছরে বিএনপি করেনি। যদি করত, তাহলে আজ ভোলার ইতিহাস অন্য রকম হতেও পারত।
পাঠকবৃন্দ, আমি আমার দলের পক্ষে সাফাই গাইবার জন্য কলম ধরিনি। আমি অতীতকে নিয়ে অপ্রয়োজনে ঘাঁটাঘাঁটি করারও পক্ষে নই। আমি বরং বর্তমানে থাকতে চাই।
তজুমদ্দিনের ওই মহিলা নেত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগের একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কি হতে পারে না? বিএনপি নিশ্চয়ই ওই মহিলাকে চেনে। আওয়ামী লীগও গোলাম মাওলাকে চেনে। দল দুটির নেতৃত্ব যদি আন্তরিক হয়, তবে তো তদন্তেরও কোনো দরকার পড়ে না। যে দায়ী, তাকে উন্মোচিত করে তার শাস্তি বিধান করতে পারে তারা।
সত্য এই দুটি দলের কাছেই আছে। দল দুটি কি সত্যাশ্রিত হতে পারে না?
মাহমুদুর রহমান মান্না: রাজনীতিক।

No comments

Powered by Blogger.