সপ্তাহের হালচাল-উপজেলার মালিক কে? by আব্দুল কাইয়ুম

পত্রিকার খবর যদি সত্য হয়, তাহলে দিনাজপুরের বিরল উপজেলায় এক অভিনব ঘটনা ঘটে গেছে। চেয়ারম্যান মো. মোকাররম হোসেন এক অপ্রীতিকর ঘটনায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ কে এম আজাদুর রহমানের মুখের ওপর প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন, ‘উপজেলার মালিক আমি, না তুই?’


চেয়ারম্যান সাহেব কি একটু সুন্দর ভাষায় কথাটা বলতে পারতেন না? একেবারে তুই-তোকারির পর্যায়ে নামতে হলো? নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের কাছে তো মানুষ মানবিক আচরণ আশা করে। কিন্তু বিরলের চেয়ারম্যানের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ সবাইকে হতাশ করেছে। চেয়ারম্যান সাহেব শুধু প্রশ্নই ছুড়ে মারেননি, সেই সঙ্গে ছুড়ে মেরেছেন পেপারওয়েট নামক ভারী বস্তুটিও, যার ফলে কাচের জিনিসপত্র ভাঙচুর হয়েছে। পুরো ব্যাপারটা সৌজন্যবোধের সীমা অতিক্রম করে গেছে।
পরের ঘটনাটি আরও দুঃখজনক। চেয়ারম্যান সাহেবের কোমরে রশি বেঁধে, হাতকড়া পরিয়ে আদালতে হাজির করা হয়েছে। এটা সত্যিই নিন্দনীয়। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাঁর তো যথাযথ সম্মান পাওয়ার কথা। তাঁকে বিনয়ের সঙ্গে আইন অনুযায়ী গ্রেপ্তারের কথা বলাই তো যথেষ্ট হতে পারত। থানা-পুলিশ সেই সম্মানটুকু কেন দেখাল না? কোমরে দড়ি দেওয়ার দরকার কেন হলো? উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান ঐক্য পরিষদের নেতারা কোনো ভাঙচুর বা ঝগড়া হয়নি বলে দাবি করে বলেছেন, দেশবাসী ও সরকারের কাছে হেয় করতে ‘সাজানো’ ঘটনায় বিরল উপজেলা চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
অথচ উপজেলার তথাকথিত মালিকানা নিয়ে এ রকম ঝগড়া বাধার তো কথা নয়। গত ১২ এপ্রিল উপজেলা চেয়ারম্যানদের এক প্রশিক্ষণ কর্মশালার উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইন ও বিধি মেনেই উপজেলা চেয়ারম্যানদের কাজ করার পরামর্শ দেন। তিনি এটাও বলেন, কাউকে অবহেলা করলে চলবে না। সবাইকে নিয়েই কাজ করতে হবে। বিরল উপজেলার চেয়ারম্যান সাহেব কি প্রধানমন্ত্রীর কথার মর্ম বুঝতে পারেননি? প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা যদি তিনি মেনে চলতেন, যদি প্রচলিত আইন ও বিধিবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতেন, তাহলে হয়তো এত বড় ঘটনা ঘটার সুযোগই সৃষ্টি হতো না। এ ধরনের চেয়ারম্যানদের কথা ভেবেই হয়তো প্রধানমন্ত্রী সেদিন আরেকটি কথা বলেছিলেন। ভবিষ্যদ্রষ্টার মতো তিনি বলেন, ‘আপনারা (উপজেলা চেয়ারম্যান) আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির প্রধান হতে চান, তা দেওয়া হবে। কিন্তু কমিটির প্রধান হয়ে গুন্ডা-পান্ডা নিয়ে গাড়িতে করে ঘুরবেন, তা হবে না। এ রকম অভিযোগ পেলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’ আমরা জানি না, অদূর ভবিষ্যতে আবার কোনো এক বিরল উপজেলায় কোনো চেয়ারম্যান গাড়ির অপব্যবহারে লিপ্ত হন কি না। আমরা চাই না ও রকম কিছু ঘটুক। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর অনেক কথাই তো ভবিষ্যদ্বাণীর মতো ফলে যায়।
বিরল উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেবের গাড়ি দরকার, উপজেলায় একটি গাড়ি পড়ে আছে, তিনি অবশ্যই সে গাড়িটি পেতে পারেন। কিন্তু প্রচলিত আইন অনুযায়ী সেটা লিখিতভাবে জানাতে তাঁর সমস্যা কোথায়? গাড়ি কার কাছে গেল, তার একটা লিখিত হিসাব তো ইউএনও সাহেবের কাছে থাকতে হবে। চেয়ারম্যান সাহেব যদি বলেন, তাঁর মুখের কথাই যথেষ্ট, তাহলে তো চলবে না। বিধি লঙ্ঘন করা তো তাঁর সাজে না।
অন্যদিকে ইউএনও সাহেবেরও বোঝা দরকার যে তিনি একজন নির্বাচিত চেয়ারম্যানের সঙ্গে কাজ করছেন। তাঁর প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। গাড়ি দেওয়ার ব্যাপারে ইউএনও সাহেবের বিরুদ্ধে টালবাহানার অভিযোগ উঠল কেন। সত্য যে ইউএনও সাহেবের কাছে একটা লিখিত চিঠি থাকা দরকার। এটাই নিয়ম বা বিধি। কিন্তু এই দরকারের কথা কি চেয়ারম্যান সাহেবকে চিঠি দিয়ে জানাতে হবে? চায়ের টেবিলে বসেও তো বিষয়টা পরিষ্কার করে নেওয়া যেত। সব মানুষ তো সমান নয়। কেউ একে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেন, আবার কেউ চিঠি দেওয়াকে অপমানজনকও ভাবতে পারেন। ইউএনও সাহেবেরই তো এ ব্যাপারে সবচেয়ে ভালো জানার কথা।
উপজেলার মালিকানার প্রশ্ন তোলাটা অবশ্য অবান্তর নয়। মালিক অবশ্যই আছেন, কিন্তু সেটা চেয়ারম্যানও না, ইউএনও তো নয়ই। দেশের অংশ হিসেবে উপজেলার মালিকও জনগণ। সাধারণভাবে মনে হয়, উপজেলা তো কোনো কলকারখানা বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নয় যে তার একজন মালিক থাকবে। এখানে মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের প্রশ্ন আসবে কেন। কিন্তু আমরা তো জানি যে সংবিধানের ৭(১) অনুচ্ছেদে লেখা আছে ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।’ এরপর ৯ অনুচ্ছেদে স্থানীয় শাসনসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের উন্নয়ন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্র এদের ‘উৎসাহ দিবে এবং এই সকল প্রতিষ্ঠানসমূহে কৃষক, শ্রমিক এবং মহিলাদিগকে যথাসম্ভব বিশেষ প্রতিনিধিত্ব দেওয়া হইবে।’ যদি তাই হয়, তাহলে রাষ্ট্রের তরফে, সরকারের প্রশাসন ক্যাডারের অন্যতম কর্মকর্তা হিসেবে ইউএনও সাহেবেরও উচিত ছিল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে চেয়ারম্যান সাহেবকে না চটিয়ে, আবার নিয়ম রক্ষা করে কাজ চালিয়ে যাওয়া। সেটা করা খুবই সম্ভব। শুধু মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। এবং সেটা উভয় তরফে। চেয়ারম্যান সাহেব হুকুম দেবেন আর সবাইকে তা মেনে চলতে হবে, এ রকম মনোভাব নিয়ে উপজেলায় চেয়ারম্যানগিরি করা চলে না। আবার একই অফিস চত্বরে চেয়ারম্যান ও ইউএনও সাহেব কাজ করবেন কিন্তু তাঁরা সব সময় চিঠি চালাচালি করে ভাব বিনিময় করবেন, অনানুষ্ঠানিকভাবে কিছুই করা যাবে না, এটাই বা কেমন কথা।
আমলা ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে এক ধরনের বাঁকা মনোভাব কাজ করে। একজন সাবেক সচিব ও পরবর্তীকালে একটি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতা সেদিন কথায় কথায় তাঁর এক তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বললেন। তাঁদের দলের একজন মন্ত্রীর সঙ্গে জেলা সফরে গিয়েছেন। সার্কিট হাউসে দলের নেতা-কর্মীরা এসেছেন। হঠাৎ মন্ত্রী সাহেব হাঁকডাক শুরু করলেন, কোথায় ডিসি সাহেব, এত লোকজন এসেছে, আসেন, চা দিয়ে যান। জেলা প্রশাসক সাহেব ঘরের মধ্যেই, দলীয় লোকজনের ভিড়ে ছিলেন। তাঁর সেখানে থাকার কথা নয়। কিন্তু মন্ত্রী মহোদয় থাকলে তাঁকেও যেতে হয়। তাই বলে তাঁকে চা সরবরাহ করতে হবে? ডিসি সাহেব এতই অপমানিত বোধ করেন যে তিনি ঘর ছেড়ে চলে যান। মন্ত্রীর হুকুম তামিলের কাজ তো তাঁর নয়। এই সামান্য সত্যটা মন্ত্রীরা বেমালুম ভুলে যান। পরে অবশ্য তিনি ভুল স্বীকার করে ডিসি মহোদয়কে ফিরিয়ে আনেন। এ রকম ঘটনা অহরহ ঘটছে। জেলায় জেলায় গিয়ে মন্ত্রীরা সার্কিট হাউসে ওঠেন। তারপর ডিসি সাহেবকে বলেন, তাঁদের দলীয় ৫০-৬০ জন লোকের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু খরচ দেবে কে? মন্ত্রীরা বলেন, টাকা-পয়সা আটকাবে না! এর অর্থ যে কী, তা সবাই জানেন। উপজেলা পর্যায়ে নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও ইউএনও সাহেবদের মধ্যে এই মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বটা আরও দৃষ্টিকটুরূপে ধরা পড়ে।
দ্বন্দ্ব শুধু আমলাদের সঙ্গেই নয়, সাংসদদের সঙ্গেও। সংবিধান অনুযায়ী স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করা সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সাংসদদের ভূমিকা কী হবে? শেষ পর্যন্ত উপজেলা পরিষদে সাংসদদের পরামর্শ মেনে চলা বাধ্যতামূলক করা হলো। এটা স্থানীয় শাসনকে বরং দুর্বল করবে। যুক্তি দেখানো হলো, যেহেতু নির্বাচনের সময় সাংসদেরা এলাকাবাসীকে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাই এলাকার উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে তাঁদের নির্ধারকের ভূমিকা থাকতে হবে। না হলে জনগণ আর তাঁদের ভোট দেবেন না। কথাটা অযৌক্তিক নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তাঁদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার জন্য কি সাংসদেরা নিজেরা গিয়ে এলাকায় রাস্তাঘাট, সেতু-কালভার্ট বানাবেন? এটা হয় না। তাঁরা সাংসদ। সংসদে তাঁরা তাঁদের এলাকার উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরবেন। এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে বরাদ্দ আদায় করবেন। সেই বরাদ্দ যেন সঠিকভাবে ব্যয় হয়, সেটা দেখবেন। কিন্তু উন্নয়নমূলক কাজগুলো, এলাকার স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা প্রভৃতি দায়িত্ব প্রত্যক্ষভাবে পালন করবে উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ প্রভৃতি। এটাই তো গণতন্ত্র। এতে সাংসদদের ক্ষমতা ক্ষুণ্ন হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।
ইল্যান্ডের নির্বাচনই দেখুন না। ইস্টলন্ডনের নির্বাচনী এলাকায় যে কয়জন নির্বাচন প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদের সবাই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। তাঁদের সবাই সিলেটের। বিবিসি বাংলায় তাঁদের সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়েছে। তাঁদের প্রায় সবাই বলেছেন শিক্ষা, আবাসন, এলাকার উন্নয়ন, চাকরির ব্যবস্থা প্রভৃতি তাঁদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। এখন তাঁদের যেকোনো একজন তো নির্বাচিত হবেন। তিনি তখন কীভাবে তাঁর প্রতিশ্রুতি পালন করবেন? বিলেতে তো স্থানীয় সরকার খুব শক্তিশালী। এই যে এলাকার উন্নয়ন, আবাসন ব্যবস্থা করা, শিক্ষার সুব্যবস্থা করা, এগুলো তো করবে এলাকার কাউন্সিলররা। নির্বাচিত সাংসদেরা হাউসে গিয়ে তাঁদের এলাকার জন্য বরাদ্দ যেন নিশ্চিত হয় সেটা দেখবেন, সেটাই হবে তাঁদের মূল কাজ। বাকি কাজ তো করবে স্থানীয় সরকার। সেখানে সাংসদদেরও ভূমিকা থাকবে। তাঁরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার ভালো-মন্দ অবশ্যই দেখবেন। হয়তো সে জন্য সাংসদদের এলাকায় উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য বিশেষ বরাদ্দ থাকতে পারে। ভারতেও সে ব্যবস্থা আছে। বাংলাদেশেও আছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে উপজেলা পরিষদের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে হবে।
উপজেলার মালিক বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তাহলে সেটা এলাকার জনগণ। তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে চেয়ারম্যানরা কাজ করবেন। সেখানে ইউএনওর ভূমিকাও সুনির্দিষ্ট থাকবে। সাংসদেরাও নির্ধারিত ভূমিকা পালন করবেন। সেটা হবে মূলত সংসদে। আর নির্বাচনী এলাকায় তাঁরা স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা দেবেন, বিভিন্ন কাজের সমন্বয় করবেন। স্থানীয় সরকারের ওপর কর্তৃত্বের প্রশ্ন সেখানে থাকবে না। যার যার অবস্থান থেকে সমন্বিতভাবে কাজ করলে সমস্যা অনেক কমে যাবে। তাঁদের মধ্যে যে দেয়াল উঠেছে সেটা মূলত মনস্তাত্ত্বিক। এই কৃত্রিম দেয়ালটা সরিয়ে ফেলতে হবে। মন-মানসিকতার পরিবর্তন সেখানে একটা বড় ব্যাপার।
গণতন্ত্র শক্তিশালী করতে হলে এই বাধা দূর করতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.