চরাচর-হারিয়ে যাচ্ছে রায়েরবাজারের ঐতিহ্যবাহী পালপাড়া ও মৃৎশিল্প by শরাফত হোসেন
রায়েরবাজারের পাল সম্প্রদায়ের মৃৎশিপ্লীরা পৈতৃক পেশা ছেড়ে অন্য পেশার দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। উপর্যুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবের পাশাপাশি অ্যালুমিনিয়াম, মেলামাইন ও প্লাস্টিকের ভিড়ে হারিয়ে যেতে বসেছে মাটির তৈরির মৃৎশিল্পের প্রয়োজনীয় চাহিদা। ফলে অস্তিত্বের শঙ্কায় পড়েছে ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পটি।
প্রায় ২০০ বছর আগে ঢাকার রায়েরবাজারে মৃৎশিল্পের ব্যাপক প্রসার ছিল। ট্যানারি মোড় থেকে সাতমসজিদ এলাকাজুড়ে আনুমানিক ৭৫০টি কারিগর পরিবার বিভিন্ন ধরনের মৃৎশিল্প যেমন- হাঁড়ি-পাতিল, মূর্তি, পুতুল, টব, টালি, শোপিস, গহনাসহ নানা রকমের মাটির পাত্র ও জিনিস তৈরি করার কাজে নিয়োজিত ছিল। বর্তমানে সংখ্যাটি কমে ৩০টিরও নিচে নেমে এসেছে। আবহমানকাল থেকে সভ্যতার নিদর্শনস্বরূপ মৃৎশিল্প অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। আর মৃৎশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ এলাকা হিসেবে বিবেচিত ছিল ঢাকার প্রাচীন জনপদ রায়েরবাজারের পালপাড়া। পাল বা মৃৎশিল্পীদের বসবাসের কারণেই এলাকার এমন নাম। একসময় এ এলাকা অসংখ্য মৃৎশিল্পীর হাতে গড়া মৃৎপাত্রের কদর ছিল সারা দেশে। রায়েরবাজার পালপাড়ায় দুই শ্রেণীর পাল ছিল। রাজবংশী পাল ও রুদ্র পাল। নবাবী আমলে মুর্শিদাবাদের রাজবংশী পালরা এখানে এসে বসবাস শুরু করেন আর রুদ্র পালরা বসবাস করত আগে থেকেই। রাজবংশী পালরা তৈরি করতেন দেব-দেবীর প্রতিমা আর রুদ্র পালরা সাধারণত নিত্যপ্রয়োজনীয় মৃৎপাত্র তৈরি করতেন। এ দুই শ্রেণীর পালদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল মৃৎশিল্পের জমজমাট বাজার। রায়েরবাজারের পশ্চিম পাশ দিয়ে একসময় বয়ে যেত একটি প্রশস্ত খাল। এ খালের একটি মুখ বুড়িগঙ্গা নদী এবং অন্যটি সংযোগ রক্ষা করত তুরাগের সঙ্গে। পালদের তৈরি মৃৎপাত্র নৌকা বোঝাই হয়ে এ খাল দিয়েই ছড়িয়ে পড়ত দেশের বিভিন্ন স্থানে। সহজ যোগাযোগব্যবস্থা, উৎকৃষ্ট মাটির সহজলভ্যতা এবং দক্ষ কারিগরের উপস্থিতির কারণেই সারা দেশে মৃৎশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ লাভ করে এ জায়গাটি। রায়েরবাজারের মৃৎশিল্প অবকাঠামো গড়ে তোলা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের একটি বড় স্বপ্ন ছিল। সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি উদ্যোগও নিলেন। রায়েরবাজারের পাল সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই তিনি উদ্যোগটি নিয়েছিলেন, তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার জমিও অধিগ্রহণ করে। কিন্তু নানা অনিয়ম, অবহেলা আর ভূমি দখলদারদের চক্রান্তে মুখ থুবড়ে পড়ে সে উদ্যোগ। ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (ইসপিক) রায়েরবাজারে 'গ্রেসড পটারি' শিল্প ইউনিট গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। এ জন্য ১ দশমিক ৬৮ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। নগরী সারাই জাফরাবাদ মৌজার ছয় নম্বর নামজারি খতিয়ানের প্রায় ১০টি প্লটের মৃৎশিল্প কারখানা ও শেড নির্মাণ করা হয়। অথচ বর্তমানে জায়গাটিতে মৃৎশিল্পের কোনো অস্তিত্ব নেই।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকে সেখানকার পাল সম্প্রদায়ের লোকজন দেশ ত্যাগ করতে থাকেন। এর কয়েক বছর পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে দেশ ত্যাগের ঘটনা আরো বেড়ে যায়। ১৯৬৭ সালে পটারি শিল্প ইউনিটকে পুনর্গঠন না করে বিক্রির সিদ্ধান্ত নিলে প্রতিবাদ জানান শিল্পী জয়নুল আবেদিন, পটুয়া কামরুল হাসান, কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খানসহ অনেকে। রায়েরবাজারের মৃৎশিল্পই শুধু নয়, ধ্বংস হয়ে গেছে সেখানকার পাল সম্প্রদায়। মাত্র কয়েক ঘর কুমার সনাতন পদ্ধতিতে মাটির হাঁড়ি-পাতিল তৈরি করে কোনোমতে জীবিকা নির্বাহ করছেন। অথচ একসময় চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষকরা প্রায়ই শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শিক্ষা দিতে রায়েরবাজারের পালপাড়ায় নিয়ে আসতেন। এ সম্প্রদায় থেকে মরণচাঁদ পালের মতো বরেণ্য শিল্পীর জন্ম হয়। তিনি চারুকলার মৃৎশিল্প বিভাগে শিক্ষকতাও করেছেন। মৃৎশিল্প ব্যবসায়ী গোসাই দাস পাল জানান, 'মাটির দুষপ্রাপ্যতা, লাকড়ির উচ্চ দাম ইত্যাদি কারণে এ শিল্প ধ্বংসের মুখে।
শরাফত হোসেন
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকে সেখানকার পাল সম্প্রদায়ের লোকজন দেশ ত্যাগ করতে থাকেন। এর কয়েক বছর পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে দেশ ত্যাগের ঘটনা আরো বেড়ে যায়। ১৯৬৭ সালে পটারি শিল্প ইউনিটকে পুনর্গঠন না করে বিক্রির সিদ্ধান্ত নিলে প্রতিবাদ জানান শিল্পী জয়নুল আবেদিন, পটুয়া কামরুল হাসান, কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খানসহ অনেকে। রায়েরবাজারের মৃৎশিল্পই শুধু নয়, ধ্বংস হয়ে গেছে সেখানকার পাল সম্প্রদায়। মাত্র কয়েক ঘর কুমার সনাতন পদ্ধতিতে মাটির হাঁড়ি-পাতিল তৈরি করে কোনোমতে জীবিকা নির্বাহ করছেন। অথচ একসময় চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষকরা প্রায়ই শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শিক্ষা দিতে রায়েরবাজারের পালপাড়ায় নিয়ে আসতেন। এ সম্প্রদায় থেকে মরণচাঁদ পালের মতো বরেণ্য শিল্পীর জন্ম হয়। তিনি চারুকলার মৃৎশিল্প বিভাগে শিক্ষকতাও করেছেন। মৃৎশিল্প ব্যবসায়ী গোসাই দাস পাল জানান, 'মাটির দুষপ্রাপ্যতা, লাকড়ির উচ্চ দাম ইত্যাদি কারণে এ শিল্প ধ্বংসের মুখে।
শরাফত হোসেন
No comments