দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ-অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ থেকে সরকার সরে আসুক by ইফতেখারুজ্জামান

দুর্নীতি দমন আইন ২০০৪-এর সংশোধনকল্পে সরকারের মন্ত্রিপরিষদে ২৬ এপ্রিল ২০১০ যে প্রস্তাবগুলো অনুমোদিত হলো বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা যদি আইনে রূপান্তরিত হয় তাহলে দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালনের সম্ভাবনা ধূলিসাত্ হয়ে যাবে।


কমিশনের ওপর সরকারের, বিশেষ করে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হবে। যার অর্থ, সরকার জনগণের কাছে যে দুর্নীতিবিরোধী নির্বাচনী অঙ্গীকার করে অভূতপূর্ব গণরায় পেয়েছে, তা পূরণ অসম্ভব হবে।
দুদকের স্বাধীনতা ও কার্যকরতার বিষয়টি সাম্প্রতিক কয়েক বছর ধরেই সব শ্রেণীর মানুষের আলোচনা ও উত্কণ্ঠার অন্যতম বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে রয়েছে। এর গুরুত্ব বহু গুণে বৃদ্ধি পায় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে, যখন দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান এক প্রকার জাতীয় মতৈক্যে পরিগণিত হয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী অন্য সব দল বা জোটের তুলনায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকারে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতিবিরোধী প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনি পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে এক ডজনেরও বেশি সুস্পষ্ট পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল দুর্নীতি দমন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে এর ক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
নির্বাচন-পরবর্তী সময়েও সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অনুরূপ অঙ্গীকার নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘোষিত হয়ে আসছে। মন্ত্রিপরিষদের উল্লিখিত সিদ্ধান্ত আরও একবার প্রমাণ করল রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি এক বিষয়, এর বাস্তবায়ন সম্পূর্ণ অন্য বিষয়। এর ফলে আরও প্রমাণিত হলো, বাংলাদেশে দুদকের মতো প্রতিষ্ঠান ততটুকুই কার্যকর হবে যতটুকু সরকার চায়। ২০০৪ সালে দুদক প্রতিষ্ঠিত হলেও দীর্ঘদিন অকার্যকর থাকার পর ‘১/১১’ পরিচয়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে রূপান্তরিত কমিশন প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে দুর্নীতিকে একটি বাস্তবিকই শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস পেয়েছিল। সেই সময়কার হাই-প্রোফাইল ও হাই-স্পিড দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের ফলে মানুষের মধ্যে আশাবাদ জন্মেছিল যে, দুর্নীতিগ্রস্ত যে-ই হোক না কেন, অপরাধ প্রমাণিত হলে শাস্তি পেতে হবে। যার গুরুত্বের স্বীকৃতি দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে পার্লামেন্টে প্রদত্ত ভাষণে বলেছিলেন, এ ধরনের ঝাঁকুনির প্রয়োজন ছিল।
অন্যদিকে জাতীয় সংসদ ও এর বাইরে তত্কালীন দুদকের ভূমিকা ব্যাপকভাবে সমালোচিতও হয়েছে। বিশেষ করে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান অনেকাংশে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহূত হয়েছে বলে যে ধারণা জন্মেছে, তার পাশাপাশি মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণের ব্যর্থতা ও সর্বোপরি দুদকের দায়বদ্ধতার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে শুধু বিতর্ক ঘনীভূত হয়েছে তা নয়, দুদকের ভাবমূর্তি ও গ্রহণযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অবশ্য স্মরণ রাখা দরকার যে, সে সময়ে ক্ষমতার একাধিক কেন্দ্রস্থল থেকে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়। যে কারণে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নামে তখন যা ঘটেছিল, তার কতটা দুর্নীতি দমন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে ছিল তা নিরূপণ না করে সব দায়ভার দুদকের কাঁধে দেওয়া এবং তার ফলে মাথাব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেলার মতো অবস্থান গ্রহণ কতটুকু যুক্তিযুক্ত হবে, তা খতিয়ে দেখতে হবে।
সেই পথে না গিয়ে কতিপয় সরকারি কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠিত কমিটির সুপারিশ মতে এমন কিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো, যার ফলে কমিশন সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে সত্যিকার অর্থেই ‘নখ-দন্তহীন এক কাগুজে বাঘে’ পরিণত হতে পারে। কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ প্রস্তাবগুলো সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রতিবাদ জানিয়েছে। সবশেষে প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবার কাছে আবেদন করেছে নির্বাচনী অঙ্গীকারের নিরিখে বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে বিষয়গুলো বিবেচনা করার জন্য। গণমাধ্যমসহ অন্যান্য স্টেকহোল্ডারও উত্কণ্ঠা প্রকাশ করেছে। সবকিছু অবজ্ঞা করে প্রস্তাবগুলো যেভাবে গৃহীত হলো, তার নেতিবাচক পরিণতি প্রতিরোধ করার হাতিয়ার রইল শুধু জাতীয় সংসদ সদস্যদের ওপর।
অনুমোদিত সংশোধনীগুলোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির অভিযোগের ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমতি গ্রহণের বাধ্যবাধকতা যা বাস্তবিক পক্ষে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি দুদকের এখতিয়ারবহির্ভূত করার সমতুল্য। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এরূপ অনুমতি পাওয়ার প্রত্যাশা করা যেরূপ অবাস্তব, তেমনি অর্থহীন। এর পেছনে উত্থাপিত যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে, দুদক কর্তৃক মামলা করা হতে পারে—এই ভয়ে প্রশাসন গতিহীন হয়ে পড়েছে! বাস্তবে সরকার যদি যথার্থই দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে চায়, তাহলে তো এরূপ ভীতিপ্রদ প্রতিরোধকের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণই বাঞ্ছনীয়। যার পাশাপাশি থাকবে ইতিবাচক প্রণোদনার কার্যকর প্রয়োগ। তা না করে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি দুদকের কর্মপরিধির বাইরে নিয়ে যাওয়া মূলত প্রশাসন ও অন্য সব সরকারি খাতে লাগামহীন দুর্নীতির প্রসার ঘটাবে। অন্যদিকে এরূপ পদক্ষেপ হবে সংবিধানের মৌলিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। দুদক যদি অন্য সব শ্রেণী-পেশার নাগরিকের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের ক্ষমতা রাখে, অন্যদিকে পূর্বানুমতি ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির অভিযোগের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের ক্ষমতা হারায়, তবে তা হবে সব নাগরিকের সমান অধিকারের মূলনীতির লঙ্ঘনের সমতুল্য।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি দুদকের ক্ষমতা খর্ব করবে তা হলো, দুদকের সচিবের নিয়োগসংক্রান্ত প্রস্তাবিত সংশোধনী। বর্তমান আইন অনুযায়ী দুদকের সচিব নিয়োগকর্তা হচ্ছে কমিশন। সংশোধনী অনুযায়ী এ ক্ষমতা অর্পিত হবে সরকারের হাতে। যার অর্থ হবে দুদকের কর্মব্যবস্থাপনা তথা সব কার্যক্রমে সরকারের নিয়ন্ত্রণ, যা কখনোই দুদকের লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হবে না। বরং সরকারি প্রভাবে দুদককে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষসহ বিভিন্ন নির্ধারিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যবহার করার পথ উন্মুক্ত হবে।
প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, দুদক রাষ্ট্রপতির কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। কোনো প্রতিষ্ঠান একচ্ছত্রভাবে স্বাধীন থাকবে, কোনো প্রকার দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে থাকবে, এটি কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। দুদকের মতো প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা অনুযায়ী তখনই ফলপ্রসূ হয় যখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বা আইন পরিষদের কাছে দায়বদ্ধতার এখতিয়ার অর্পণ করা হয়। আইন পরিষদ তথা জাতীয় সংসদে এরূপ বিশেষ কমিটিতে সংসদের প্রতিনিধিত্বকারী সব রাজনৈতিক দলের এক বা একাধিক সমানসংখ্যক সংসদ সদস্য থাকতে পারেন, যাঁরা জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে দুদককে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ করবেন। এরূপ সম্ভাবনা গ্রহণ না করে রাষ্ট্রপতির কাছে দায়বদ্ধ করার ব্যবস্থা করার ফলে সরকার তথা দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবে প্রভাবান্বিত হবে দুদকের দায়বদ্ধতার বিষয়টি। কারণ সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রপতি শুধু প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করে থাকেন।
সংশোধনীতে আরও বলা হচ্ছে যে, মিথ্যা অভিযোগে দুর্নীতির মামলা করা হলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড প্রযোজ্য হবে। প্রস্তাবটি আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিযুক্ত মনে হলেও এর ফলে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা করার ক্ষেত্রে এটি একটি কঠিন প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করবে। দুদকের ক্ষেত্রে এরূপ বিশেষ বিধির প্রয়োজন নেই। প্রচলিত আইনেই উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রণীত মিথ্যা মামলাকারীর বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।
দুদককে উল্লিখিত সংশোধনীর মাধ্যমে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে দেওয়ার পরিবর্তে প্রয়োজন একে পরিপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দেওয়া, যার ফলে দুদক সরকারের দুর্নীতিবিরোধী নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সহায়ক ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারে। পাশাপাশি দুদকের বেশ কিছু প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার ক্ষেত্র রয়েছে, যার উত্তরণে দুদকের নিজের দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ সাবেক দুর্নীতি দমন ব্যুরোর সব কর্মীকে কমিশনে আত্তীকরণের ফলে এর মানবসম্পদের কর্মদক্ষতা, সততা ও গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। বলিষ্ঠ পদক্ষেপের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। দুদকের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়মিতভাবে জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে, যাতে দুদকের অভ্যন্তরেই দুর্নীতির অভিযোগের প্রতিকার করা সম্ভব হয়। দুদকের সব কর্মীর জন্য নৈতিক আচরণবিধি প্রণয়ন এবং কঠোরভাবে এর প্রয়োগ করতে হবে; যার মাধ্যমে দুদকের স্বাধীনতার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ দায়বদ্ধতার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ সম্ভব হয়। সর্বোপরি দুদকের সব কর্মীর জন্য কার্যকর ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রণোদনা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে, যার মাধ্যমে দুদকের প্রতি সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবার, বিশেষ করে সাধারণ জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা বৃদ্ধি পাবে।
দুদকের স্বাধীনতা ও কার্যকরতা সরকারের কাছে প্রাধান্য পাওয়ার কথা। মন্ত্রিপরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত সংশোধনী প্রস্তাব শুধু সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকই নয়, বাংলাদেশে কার্যকরভাবে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে অপ্রতিরোধ্য অন্তরায় হিসেবে প্রতীয়মান হবে। এই আত্মঘাতী পথ থেকে সরকার সরে আসুক, জাতীয় সংসদ একে প্রতিহত করুক—এ দাবি দেশের আপামর জনগণের।
ইফতেখারুজ্জামান: নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

No comments

Powered by Blogger.