সমসাময়িক-রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বিতর্ক নয় by শেখ শাহবাজ রিয়াদ

রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে পারলে সর্বকালের একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালিকেই আমরা যথার্থ অর্থে শ্রদ্ধা জানাতে পারব। তবে প্রস্তাবিত রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় নিশ্চয় আমাদের দেশের গতানুগতিক ধারার বিশ্ববিদ্যালয় ও এর বিভিন্ন বিষয় থেকে ভিন্ন হবে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য,


সংস্কৃতি, সঙ্গীত, জাতীয়তাবাদ চর্চার ও অনুশীলনের নতুন
দিগন্ত উন্মোচিত হবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে


সারাদেশে মহাআনন্দ, উৎসাহ ও উদ্দীপনায় হাজার বছরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী পালিত হয়েছে। বাংলাদেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিবস ছাড়া আর কারও জন্মদিন এমন করে পালিত হয়নি কোনো দিন। উল্লেখ্য, ১০-১১ বছর আগে বিবিসির জরিপে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে ১ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, দ্বিতীয়তে রবীন্দ্রনাথ ও তৃতীয়তে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম মনোনীত হয়েছিলেন। এটি খুবই আনন্দের যে, বিশ্বের বুকে বাঙালিদের দ্বারা, বাঙালিদের জন্য প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের পুরো অস্তিত্বজুড়ে আজ এই তিন যুগস্রষ্টা বাঙালি। বাংলাদেশের সব মানুষের হৃদয় ও চেতনায় বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের আসন। ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক ইচ্ছা ও তৎপরতায় কাজী নজরুল ইসলামকে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে নিয়ে আসাটা স্বাধীনতা অর্জনের মতো আনন্দের ছিল। অসুস্থ কবি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করলে আজকে আমাদের আফসোসের শেষ থাকত না। দেশ স্বাধীন বলেই আজ রবীন্দ্রনাথ, নজরুল একান্তই আমাদের। একজনের গান আমাদের জাতীয় সঙ্গীত, অন্যজনের গান রণসঙ্গীত। আবার ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ সব ক্ষেত্রে রবীন্দ্র-নজরুলের গান-কবিতা ও বাণী ছিল অনুপ্রেরণার প্রধান উৎস। তবে পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রনাথের জন্ম বা মৃত্যবার্ষিকী পালন এত সহজ ছিল না। আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে হয় জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহসহ সেসব মহান ব্যক্তিকে যারা ১৯৬১ সালে বৈরী পরিবেশে কবিগুরুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করেছিলেন। নোবেলজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম জন্মবার্ষিকীর এবারের অনুষ্ঠান তিন দিনব্যাপী, যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারীকে নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে উদ্বোধন করেন। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে, নওগাঁ জেলার পতিসরে, খুলনার ফুলতলার দক্ষিণডিহির শ্বশুরবাড়িতে হাজারো মানুষের সমাবেশ ও উৎসাহ-উদ্দীপনায় চলেছে জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠান।
সার্ধশত জন্মবার্ষিকীতে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রসঙ্গটি উঠে এসেছে জোরালোভাবেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও একাডেমী প্রতিষ্ঠা করা হবে, যেখানে তার ওপর গবেষণা ও উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণায় সারাদেশের রবীন্দ্রপ্রেমীরা উল্লসিত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান নিয়ে ইতিমধ্যেই বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে, যা নিতান্তই অনাকাঙ্ক্ষিত। শাহজাদপুরে পূর্ণাঙ্গ রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে শাহজাদপুর ও সিরাজগঞ্জ জেলাব্যাপী মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন চলছে। অন্যদিকে শিলাইদহের দাবি তো সবার অগ্রগণ্য। পত্রিকান্তরে সে রকম ইঙ্গিতও সুস্পষ্ট। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান নিয়ে কোনো ধরনের বির্তক মোটেই কাম্য নয়।
রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে পারলে সর্বকালের একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালিকেই আমরা যথার্থ অর্থে শ্রদ্ধা জানাতে পারব। তবে প্রস্তাবিত রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় নিশ্চয় আমাদের দেশের গতানুগতিক ধারার বিশ্ববিদ্যালয় ও এর বিভিন্ন বিষয় থেকে ভিন্ন হবে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য, সংস্কৃতি, সঙ্গীত, জাতীয়তাবাদ চর্চার ও অনুশীলনের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে। সেখানে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শন চর্চার ক্ষেত্র ও সুযোগ থাকতে হবে। আমরা জানি, তিনি শুধু কবিগুরুই নন, বিশ্বের একজন শ্রেষ্ঠ শিক্ষা-দার্শনিকও। কবি আশরাফ সিদ্দিকীর শান্তিনিকেতনের পত্র এবং রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন পুস্তকে আমরা কবিগুরুর শিক্ষা-দর্শন সম্পর্কে ভালোভাবেই জানতে পারি। যদিও দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটি সত্য, আমাদের দেশে তার শিক্ষা-দর্শন নিয়ে কাজ করার এবং তা চর্চা ও প্রচারের কোনো ক্ষেত্র এখনও তৈরি হয়নি, যা আমরা অদূর ভবিষ্যতে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে শুরু করতে পারব। সবশেষে প্রস্তাবিত রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান বিতর্কের অবসানে একটি আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করতে চাই। প্রস্তাবিত রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ক্যাম্পাস হোক কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। সঙ্গে সঙ্গে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে, নওগাঁ জেলার পতিসরে, খুলনার ফুলতলার দক্ষিণডিহিতে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদ স্থাপন করা হোক। অনুষদগুলো স্থাপিত হবে কবিগুরুর বিভিন্ন ভাবনা ও উলি্লখিত স্থানগুলোর আর্থ-সামাজিক ও ভৌগোলিক অবস্থা বিবেচনায়। তার স্মৃতিবিজড়িত স্থানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদ ও বিভাগ গড়ে উঠলে তা শুধু শিক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র হিসেবেই গড়ে উঠবে না, দেশি-বিদেশি হাজার হাজার রবীন্দ্রভক্ত ও প্রেমিকদের মিলন এবং পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীসহ সব রবীন্দ্র-গবেষক, রবীন্দ্রপ্রেমিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

শেখ শাহবাজ রিয়াদ : সহকারী অধ্যাপক, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকা
riadisrat1971@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.