বাঘা তেঁতুল-পাখির কোষ্ঠবদ্ধতা ও মানুষের বাঁচামরা by সৈয়দ আবুল মকসুদ
ফরিদপুরে কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্যপ্রযুক্তি মেলায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে শ্রম ও কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘ছোট ঘর, জায়গা কম। ঘরে লোকজন ধরে না। সারা দিন বাড়ির উঠানে গাছের নিচে বসে ছিলাম। কিন্তু আমার মনে বড়ই আক্ষেপ, সারা দিন বসে থাকার পরও একটা পাখিরও বিষ্ঠা আমার মাথায় পড়ল না।’
(দৈনিক ডেসটিনি)
মাননীয় মন্ত্রী যদি বলতেন, সারা দিন তিনি গাছে কোনো পাখি দেখেননি, তা হতো এক কথা। কিন্তু তিনি পাখির চেয়ে পাখির পায়খানার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। এমনও হতে পারে যে গাছের ডালে পাখি ছিল, কিন্তু সে পাখি ওই দিন মলত্যাগ করেনি। নানা কারণে পাখি মলত্যাগ না করতে পারে। এক. কোনো মাননীয়ের মাথায় মলত্যাগ করা সমীচীন নয় ভেবে। দুই. সরকারি দলের লোকদের মাথায় বিষ্ঠা ফেলা বিপজ্জনক মনে করে এবং তিন. পাখির কোষ্ঠবদ্ধতা হতে পারে।
কলিকালের গণতন্ত্রে যে-গাছের নিচে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বৈঠক, সেখানে পাখি কেন সাধারণ মানুষও যেতে চাইবে না নিতান্ত দায়ে না পড়লে; বিশেষ করে সে জমায়েতে যদি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র ও যুব নেতা-কর্মী উপস্থিত থাকেন, তাহলে পাখি তো দূরের কথা, বনের বাঘও তার ত্রিসীমানায় যাবে না।
কৃষকের খেতখামার, ফসল, পোকামাকড়, কীটনাশক, পাখি প্রভৃতি নিয়ে ভাবার কথা কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর। এবং তিন তাঁর মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সম্পর্কে খুবই সচেতন। পাখ-পাখালি ও কীটনাশক নিয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থানমন্ত্রীর আক্ষেপকেও আমরা মূল্যহীন মনে করি না। তবে সাধারণ মানুষের ‘আক্ষেপ’ অন্যখানে। তারা পাখির মলমূত্র নিয়ে মাথা ঘামায় কম। তাদের চিন্তা ডলার, রিয়াল বা দিনার নিয়ে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে যদি ওই সব আসা বন্ধ হয়ে যায় বা কমে যায়, তাতে তাদের বিরাট ক্ষতি। দেশেরও ক্ষতি। বর্তমান সরকারের সময় তা দ্রুত কমছে বলে মানুষের বড়ই আক্ষেপ। যে হারে মধ্যপ্রাচ্য থেকে শ্রমিকেরা ফিরে আসছেন, তার বেগ যদি আরও বাড়ে, তখন আর তা আক্ষেপের পর্যায়ে থাকবে না, বড় রকম বিক্ষোভে পরিণত হবে।
খেতখামারের কীটনাশক পেটে যাওয়ায় বাংলাদেশের বহু প্রজাতির পাখি মারা গেছে। মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ হলে অথবা আরও কমে গেলে, কীটনাশক খেয়ে মরবে বাংলার নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ। তখন পাখির যদি উদরাময় হয় এবং ঘন ঘন পাতলা পায়খানা করতে থাকে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও উপসম্পাদকীয় লেখকদের মাথায়, তাহলেও কোনো লাভ হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে গেলে পাখির বিষ্ঠা দিয়ে সে ক্ষতির পূরণ হবে না।
পাখি আমাদের খেতের পাকা ধান প্রচুর সাবাড় করে। কিন্তু পাখি জানে না কত ধানে কত চাল। সেটা জানে বাংলার মানুষ। বাংলার অনেক রাজনৈতিক দলও জানে। এই সময় জানে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। কোন কাজের কী পরিণতি তা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কেউই ভেবে দেখার সময় পান না।
দেড়টি বছর দেশের মানুষ শুধু নীরবে পর্যবেক্ষণ করেছে। বেশি খতিয়ে দেখেনি। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনো আসেনি। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষ একেকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। তাদের লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস বা হার্ভার্ডের ডক্টরেট ডিগ্রি না থাকলেও, মাথার মধ্যে তারা বিচার-বিশ্লেষণের যে ক্ষমতা রাখে, তা বিশ্বব্যাংক ও বিদেশি অর্থে তৈরি কোনো গবেষণাপত্রের চেয়ে কম মূল্যবান নয়। সাধারণ মানুষের ভাষাজ্ঞান না থাকতে পারে, কিন্তু তাদের ভাবের জ্ঞান কম নয়।
জনগণের একটি অংশ আজ খেয়ে-পরে ভালো আছে তাদের মানুষ বিদেশ থেকে টাকা পাঠায় বলে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে গেলেও প্রবাসী শ্রমিকদের সুবিধা-অসুবিধা ও সমস্যা দেখাশোনার দায়িত্ব সরকারের। দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাও সরকারের কাজ। সরকারের বৈদেশিক সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানের পরিমাণ। বিদেশে গমনে ইচ্ছুক ব্যক্তিরা তো বটেই, বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যরাও আজ ভীষণ উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন। সরকারের নীতিনির্ধারকদের মনে রাখা দরকার, মুসলিম দেশগুলোতেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি দক্ষ-অদক্ষ হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান শ্রমিক কর্মরত। তাদের চাকরিচ্যুতি ও দেশে ফিরে আসা পাখির পেস্টিসাইড খেয়ে মরার চেয়ে বেশি শোকাবহ।
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার স্বার্থে পক্ষিকুল নিয়ে আমাদের ভাবতেই হবে। তবে পাখির কোষ্ঠবদ্ধতা ও বাঁচামরার বিষয়ের চেয়ে মানুষের বাঁচামরার প্রশ্নটির মীমাংসা বেশি জরুরি।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
কলিকালের গণতন্ত্রে যে-গাছের নিচে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বৈঠক, সেখানে পাখি কেন সাধারণ মানুষও যেতে চাইবে না নিতান্ত দায়ে না পড়লে; বিশেষ করে সে জমায়েতে যদি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র ও যুব নেতা-কর্মী উপস্থিত থাকেন, তাহলে পাখি তো দূরের কথা, বনের বাঘও তার ত্রিসীমানায় যাবে না।
কৃষকের খেতখামার, ফসল, পোকামাকড়, কীটনাশক, পাখি প্রভৃতি নিয়ে ভাবার কথা কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর। এবং তিন তাঁর মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সম্পর্কে খুবই সচেতন। পাখ-পাখালি ও কীটনাশক নিয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থানমন্ত্রীর আক্ষেপকেও আমরা মূল্যহীন মনে করি না। তবে সাধারণ মানুষের ‘আক্ষেপ’ অন্যখানে। তারা পাখির মলমূত্র নিয়ে মাথা ঘামায় কম। তাদের চিন্তা ডলার, রিয়াল বা দিনার নিয়ে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে যদি ওই সব আসা বন্ধ হয়ে যায় বা কমে যায়, তাতে তাদের বিরাট ক্ষতি। দেশেরও ক্ষতি। বর্তমান সরকারের সময় তা দ্রুত কমছে বলে মানুষের বড়ই আক্ষেপ। যে হারে মধ্যপ্রাচ্য থেকে শ্রমিকেরা ফিরে আসছেন, তার বেগ যদি আরও বাড়ে, তখন আর তা আক্ষেপের পর্যায়ে থাকবে না, বড় রকম বিক্ষোভে পরিণত হবে।
খেতখামারের কীটনাশক পেটে যাওয়ায় বাংলাদেশের বহু প্রজাতির পাখি মারা গেছে। মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ হলে অথবা আরও কমে গেলে, কীটনাশক খেয়ে মরবে বাংলার নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ। তখন পাখির যদি উদরাময় হয় এবং ঘন ঘন পাতলা পায়খানা করতে থাকে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও উপসম্পাদকীয় লেখকদের মাথায়, তাহলেও কোনো লাভ হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে গেলে পাখির বিষ্ঠা দিয়ে সে ক্ষতির পূরণ হবে না।
পাখি আমাদের খেতের পাকা ধান প্রচুর সাবাড় করে। কিন্তু পাখি জানে না কত ধানে কত চাল। সেটা জানে বাংলার মানুষ। বাংলার অনেক রাজনৈতিক দলও জানে। এই সময় জানে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। কোন কাজের কী পরিণতি তা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কেউই ভেবে দেখার সময় পান না।
দেড়টি বছর দেশের মানুষ শুধু নীরবে পর্যবেক্ষণ করেছে। বেশি খতিয়ে দেখেনি। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনো আসেনি। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষ একেকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। তাদের লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস বা হার্ভার্ডের ডক্টরেট ডিগ্রি না থাকলেও, মাথার মধ্যে তারা বিচার-বিশ্লেষণের যে ক্ষমতা রাখে, তা বিশ্বব্যাংক ও বিদেশি অর্থে তৈরি কোনো গবেষণাপত্রের চেয়ে কম মূল্যবান নয়। সাধারণ মানুষের ভাষাজ্ঞান না থাকতে পারে, কিন্তু তাদের ভাবের জ্ঞান কম নয়।
জনগণের একটি অংশ আজ খেয়ে-পরে ভালো আছে তাদের মানুষ বিদেশ থেকে টাকা পাঠায় বলে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে গেলেও প্রবাসী শ্রমিকদের সুবিধা-অসুবিধা ও সমস্যা দেখাশোনার দায়িত্ব সরকারের। দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাও সরকারের কাজ। সরকারের বৈদেশিক সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানের পরিমাণ। বিদেশে গমনে ইচ্ছুক ব্যক্তিরা তো বটেই, বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যরাও আজ ভীষণ উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন। সরকারের নীতিনির্ধারকদের মনে রাখা দরকার, মুসলিম দেশগুলোতেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি দক্ষ-অদক্ষ হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান শ্রমিক কর্মরত। তাদের চাকরিচ্যুতি ও দেশে ফিরে আসা পাখির পেস্টিসাইড খেয়ে মরার চেয়ে বেশি শোকাবহ।
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার স্বার্থে পক্ষিকুল নিয়ে আমাদের ভাবতেই হবে। তবে পাখির কোষ্ঠবদ্ধতা ও বাঁচামরার বিষয়ের চেয়ে মানুষের বাঁচামরার প্রশ্নটির মীমাংসা বেশি জরুরি।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments