বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৪০১ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। হাজারীলাল তরফদার, বীর প্রতীক দুর্ধর্ষ ও সাহসী যোদ্ধা দোসতিনা। একটি গ্রাম। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী। যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার অন্তর্গত।
ঝিকরগাছা-দোসতিনা সড়কটি যশোর জেলার পশ্চিমাংশে যোগাযোগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই সড়কে নিয়োজিত ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর টহল দল। তারা এ অঞ্চলে নিয়মিত ঘুরেফিরে টহল দিত এবং মুক্তিযোদ্ধাদের গতিবিধি লক্ষ রাখত।
জুলাই মাস থেকে যশোর অঞ্চলের প্রশিক্ষণ পাওয়া মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে আসতে থাকলেন ৮ নম্বর সেক্টরে। কয়েকটি দল পাঠানো হলো বয়রা সাব-সেক্টরে। কিন্তু তাঁরা বাংলাদেশে ঢুকতে পারছেন না পাকিস্তান সেনাবাহিনীর টহল দলের কারণে। তাই সিদ্ধান্ত হলো, তাদের ওপর আক্রমণের।
সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমার্ধের একদিন। হাজারীলাল তরফদারসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা অ্যামবুশ করলেন দোসতিনায়। সুবিধাজনক এক স্থানে তাঁরা ফাঁদ পেতে অপেক্ষা করতে থাকলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর টহল দলের জন্য। একপর্যায়ে তাঁদের ফাঁদের মধ্যে উপস্থিত হলো টহল দল। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল হাজারীলালসহ সবার অস্ত্র।
মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে তাৎক্ষণিক হতাহত হলো কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা। তবে প্রাথমিক বিপর্যয় কাটিয়ে তারাও পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। তখন পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। হাজারীলাল তরফদার সেদিন যুদ্ধে যথেষ্ট সাহস ও বীরত্ব দেখান। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে বিচলিত না হয়ে সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যান। তাঁকে দেখে তাঁর সহযোদ্ধারাও অনুপ্রাণিত হন।
সেদিন যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর টহল দলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ছয়জন নিহত ও দুজন আহত হয়। বাকিরা পরে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
১৯৬৯ সালে অষ্টম শ্রেণীতে ওঠার পর আর পড়ালেখার সুযোগ হয়নি হাজারীলাল তরফদারের। এরপর বাড়িতে নানা সাংসারিক কাজে জড়িত ছিলেন। কৃষিকাজও করতেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারেননি। ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অংশ নেন। পরে ভারতের চাকুলিয়ায় প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেন ৮ নম্বর সেক্টরের বয়রা সাব-সেক্টরে।
হাজারীলাল তরফদার বয়রা সাব-সেক্টরে দুর্ধর্ষ ও সাহসী যোদ্ধা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। অনেক সম্মুখ ও গেরিলাযুদ্ধে তিনি অংশ নেন। এর মধ্যে চৌগাছা, নাভারন, ছুটিপুর, গোয়ালহাটি, গদখালী, কাগজপুকুর ও বেনাপোলের যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য হাজারীলাল তরফদারকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩৭৭।
হাজারীলাল তরফদারের পৈতৃক বাড়ি যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলার পাশাপোল ইউনিয়নের রানীয়ালী গ্রামে। পৈতৃক বাড়িতে তিনি থাকতে পারেন না। ২০০১ সালে একটি কুচক্রী মহল ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাঁর বসতবাড়ি দখলে নিয়ে তাঁকে উচ্ছেদ করে। তাঁকে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়। এ কারণে তিনি অনেক দিন আত্মগোপনে ছিলেন। বর্তমানে ঝিকরগাছা উপজেলার কৃষ্ণচন্দ্রপুর গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে অস্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। চৌগাছা-ঝিকরগাছা এলাকায় তিনি গোসাঁই (সৎ মানুষ) হিসেবে পরিচিত। জীবন বাঁচানোর জন্য তিনি বর্তমানে বিষধর সাপ ধরা ও কবিরাজি পেশার সঙ্গে যুক্ত।
হাজারীলাল তরফদারের বাবার নাম রসিকলাল তরফদার। মা শৈলবালা তরফদার। তাঁর দুই স্ত্রী শেফালী রানী তরফদার ও সুমিত্রা রানী তরফদার। তাঁদের দুই ছেলে, তিন মেয়ে।
সূত্র: জাহিদ রহমান, প্রধান নির্বাহী, মুক্তিযুদ্ধে মাগুরা গবেষণাকেন্দ্র এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৮।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
জুলাই মাস থেকে যশোর অঞ্চলের প্রশিক্ষণ পাওয়া মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে আসতে থাকলেন ৮ নম্বর সেক্টরে। কয়েকটি দল পাঠানো হলো বয়রা সাব-সেক্টরে। কিন্তু তাঁরা বাংলাদেশে ঢুকতে পারছেন না পাকিস্তান সেনাবাহিনীর টহল দলের কারণে। তাই সিদ্ধান্ত হলো, তাদের ওপর আক্রমণের।
সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমার্ধের একদিন। হাজারীলাল তরফদারসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা অ্যামবুশ করলেন দোসতিনায়। সুবিধাজনক এক স্থানে তাঁরা ফাঁদ পেতে অপেক্ষা করতে থাকলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর টহল দলের জন্য। একপর্যায়ে তাঁদের ফাঁদের মধ্যে উপস্থিত হলো টহল দল। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল হাজারীলালসহ সবার অস্ত্র।
মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে তাৎক্ষণিক হতাহত হলো কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা। তবে প্রাথমিক বিপর্যয় কাটিয়ে তারাও পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। তখন পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। হাজারীলাল তরফদার সেদিন যুদ্ধে যথেষ্ট সাহস ও বীরত্ব দেখান। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে বিচলিত না হয়ে সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যান। তাঁকে দেখে তাঁর সহযোদ্ধারাও অনুপ্রাণিত হন।
সেদিন যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর টহল দলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ছয়জন নিহত ও দুজন আহত হয়। বাকিরা পরে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
১৯৬৯ সালে অষ্টম শ্রেণীতে ওঠার পর আর পড়ালেখার সুযোগ হয়নি হাজারীলাল তরফদারের। এরপর বাড়িতে নানা সাংসারিক কাজে জড়িত ছিলেন। কৃষিকাজও করতেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারেননি। ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অংশ নেন। পরে ভারতের চাকুলিয়ায় প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেন ৮ নম্বর সেক্টরের বয়রা সাব-সেক্টরে।
হাজারীলাল তরফদার বয়রা সাব-সেক্টরে দুর্ধর্ষ ও সাহসী যোদ্ধা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। অনেক সম্মুখ ও গেরিলাযুদ্ধে তিনি অংশ নেন। এর মধ্যে চৌগাছা, নাভারন, ছুটিপুর, গোয়ালহাটি, গদখালী, কাগজপুকুর ও বেনাপোলের যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য হাজারীলাল তরফদারকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩৭৭।
হাজারীলাল তরফদারের পৈতৃক বাড়ি যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলার পাশাপোল ইউনিয়নের রানীয়ালী গ্রামে। পৈতৃক বাড়িতে তিনি থাকতে পারেন না। ২০০১ সালে একটি কুচক্রী মহল ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাঁর বসতবাড়ি দখলে নিয়ে তাঁকে উচ্ছেদ করে। তাঁকে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়। এ কারণে তিনি অনেক দিন আত্মগোপনে ছিলেন। বর্তমানে ঝিকরগাছা উপজেলার কৃষ্ণচন্দ্রপুর গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে অস্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। চৌগাছা-ঝিকরগাছা এলাকায় তিনি গোসাঁই (সৎ মানুষ) হিসেবে পরিচিত। জীবন বাঁচানোর জন্য তিনি বর্তমানে বিষধর সাপ ধরা ও কবিরাজি পেশার সঙ্গে যুক্ত।
হাজারীলাল তরফদারের বাবার নাম রসিকলাল তরফদার। মা শৈলবালা তরফদার। তাঁর দুই স্ত্রী শেফালী রানী তরফদার ও সুমিত্রা রানী তরফদার। তাঁদের দুই ছেলে, তিন মেয়ে।
সূত্র: জাহিদ রহমান, প্রধান নির্বাহী, মুক্তিযুদ্ধে মাগুরা গবেষণাকেন্দ্র এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৮।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments